Mahfujur Rahaman

Horror Thriller Others

4.7  

Mahfujur Rahaman

Horror Thriller Others

অদ্ভুতুড়ে

অদ্ভুতুড়ে

12 mins
434


 

রঘুনাথবাবু শান্তিপুরে যখন পৌছলেন তখন বেলা প্রায় বারোটা। মাথার উপর সুয্যিমামা রেগে আগুন। আর এদিকে তাড়াতাড়িতে ছাতা নিয়ে আসতেই ভুলেছেন তিনি। শান্তিপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখলেন যে পুরো ফাঁকা একটা বাসস্ট্যান্ড, চারিদিকে শুধু অলসতার ছাপ। ভাবলেন, নামের সঙ্গে জায়গাটা বেশ মানানসই।

রঘুনাথবাবুর বাড়ি বীরভূমের খন্ডগ্ৰামে। তিনি একজন স্কুলমাস্টার, অঙ্কের শিক্ষক। বিয়ে করেছিলেন কিন্তু স্ত্রীটি বছরখানেক আগে মারা গেছেন। বাড়িতে বুড়ো বাবা মা আর এক ভাই ছাড়া কেউ নেই। তিনি ডায়মনন্ডহারবারে একটা স্কুলে চাকরি করতেন, আর এখন তিনি শান্তিপুরে বদলি হয়ে এসেছেন। আর সেইজন্যই এখানে থাকার একটা জায়গা খুঁজছিলেন। তারপর ছোটোবেলার বন্ধু প্রিয়তোষের থেকে খবর পেলেন যে মদন হালদার বলে একটা লোক একটা পুরনো বাড়ি ভাড়া দেন তবে সেখানে নাকি ভুতেরা আস্তানা গেড়েছে। ভুতের কথা হলেও কি রঘুনাথ বাবু আর শোনার পাত্র। উল্টে উনি বেশ মজা পেলেন। উনি ভুতটুত মানেন না , তাই। ভুতের কথা শুনে ওই বাড়িতেই থাকবেন বলে ঠিক করলেন। তারপর মদনবাবুর সাথে যোগাযোগ করে রঘুনাথবাবুর বাড়িটাতে থাকার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলো। আগামী সপ্তাহ থেকে নতুন স্কুলে জয়েন করবেন তিনি, তাই আজই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এসেছেন শান্তিপুরে।

মদন হালদারের দোকান বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে মিনিট পাঁচেক, কিন্তু আজ এতো গরমে পথ যেন ফুরোতেই চায় না। রঘুনাথবাবু মদনবাবুর দোকানে যখন পৌছলেন তখন মদনবাবু তার দোকানে বসে‌ বর  পড়ছিলেন।পরনে লুঙ্গি আর একটা হাতকাটা সাদা রঙের গেঞ্জি। রঘুনাথবাবুকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। রঘুনাথবাবু নমস্কার ভঙ্গিতে নাম জানালেন, ''রঘুনাথ সরকার, তা আপনি কি...''

রঘুনাথ বাবুকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মদনবাবু বলে উঠলেন,'' হ্যাঁ আপনি তো সেই বাড়িটার ব্যাপারে..... আরে বাইরে কেন! ভিতরে আসুন, ভিতরে আসুন।''

মদনবাবু রঘুনাথবাবুকে সঙ্গে করে দোকানের ভেতরে নিয়ে গেলেন অবশ্য ভেতরে বসার জায়গা নেই, চারিদিকে জিনিসপত্র ভর্তি। মদনবাবু রঘুনাথবাবুকে গ্লাস জল দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, '' চা চলবে? ''

রঘুনাথবাবু উত্তরে বললেন,'' না, না ! যা গরম পড়েছে!''

''হ্যাঁ, আর বলবেন না। তা আপনি কি এখনি বাড়িতে যাবেন একটু বসলে হতো না!''

''না, না ! এসে যখন পড়েছি তখন আর দেরি কেন ? এখনই যাওয়া যাক।''

''ঠিক আছে তবে চলুন'' মদনবাবু বললেন,'' এক মিনিট! আমি দোকানটা বন্ধ করে নিই।''

এরপর দোকান বন্ধ করে মদনবাব রঘুনাথবাবুকে সঙ্গে করে বাড়িটার উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলেন।পথে যেতে যেতে মদনবাবু রঘুনাথবাবুকে বললেন,'' অনেক দিনের পুরনো বাড়ি তো! তাই সংস্কারও সেরকম করা হয়নি। তবে আপনার জন্য বাথরুম, বেডরুম আর রান্নাঘরটা ঠিক করে রেখেছি।''

রঘুনাথের বাবু মৃদু হেসে বললেন ,''বাহ্ ! বেশ ভালো। এটাই যথেষ্ট, একা মানুষ ।আর কি চাই!''

''তবে..'' এটুকু বলেই একটা সাসপেন্স রেখে মদনবাবু থেমে গেলেন।

''তবে কি? ''রঘুনাথ বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

''না ,সেরকম কিছু নয় তবে আপনি ভূতের ভয় পান না তো!''

''না না ভূত আবার হয় নাকি! তাই ভয় তো দূরের কথা। কেন ও বাড়িতে ভুত টুত আছে নাকি?'' জেনেও না জানার ভান করলেন রঘুনাথ বাবু।

''হ্যাঁ, মানে মাঝে মাঝে ভুতুড়ে কান্ড দেখা যায় আর কি, মানে আগের কয়েকটা ভাড়াটিয়া তো তাই বললাম আর কি।''

মদনবাবুর মাঝেমাঝেই ''আর কি'' বলার স্বভাব রয়েছে। যেমন কয়েকটা লোকেরা থাকে , যেমন ওই ''বটে'' বা ওই ধরনের কিছু। তেমনই মদনবাবুর ক্ষেত্রে ''আর কি''।

রঘুনাথ বাবু হেসে ফেললেন,'' ভূত টুত কিছু হয় না। সব মনের ভুল।''

আসলে রঘুনাথ বাবু সায়েন্সের স্টুডেন্ট, যুক্তিবাদী মানুষ। যুক্তি ছাড়া কোন কিছুই মানেন না, তাই যুক্তি ছাড়া ভগবানকেও মানতে নারাজ।

মদনবাবু বললেন, ''সে আপনি যাই বলুন ভূতের দেখা আপনি পাবেনই পাবেন''

''তাহলে তো বেশ ভালই হয়। একা বাড়িতে সঙ্গীর অভাব হবে না।''হেসে উঠলেন রঘুনাথ বাবু।

কথা বলতে বলতে ওনারা বাড়িটার কাছে চলে এলেন। হলুদ রঙের একটা দোতলা বাড়ি । দেখলেই মনে হয় কম করে হলেও 50 বছরে পুরনো বাড়ি। রঘুনাথ বাবু লক্ষ্য করলেন আশেপাশে সেরকম কোনো বাড়ি নেই। তাদের দেখে কয়েকটা কাক উড়ে চলে গেল। মদনবাবু চাবি দিয়ে দরজায় ঝুলানো তালাটা খুললেন আর ক্যাঁচ্ করে একটা শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল এরপর ভেতরে ঢুকলেন তারা দুজনে। রঘুনাথ বাবু দেখলেন বাড়িটা বেশ পরিস্কারই করে রেখেছে মদনবাবু।

'' আপনার জন্য দোতলায় ঘর ঠিক করেছি , কোন অসুবিধা নেই তো?'' জিজ্ঞাসা করলেন মদনবাবু।

রঘুনাথ বললেন,'' না ,না, অসুবিধা কি ?''

রঘুনাথ বাবু মুখে বললেন বটে কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না যে, একতলা থাকতে আবার দোতলায় কেন?

এরপর সিঁড়ি বেয়ে মদনবাবু রঘুনাথ বাবুকে দোতলায় নিয়ে গেলেন । রঘুনাথ বাবুকে ঘরটা দেখিয়ে দিলেন তিনি।

ঘরটা বেশ ছিমছাম একটা ড্রেসিং টেবিল রয়েছে আর একটা রাইটিং টেবিল আর কয়েকটা বইয়ের তাকও রয়েছে । ঘরটায় দুটো জানলা, আর তা থেকে একচিলতে রোদ এসে পড়েছে ঘরের ভিতরে। ঘরটা দেখে রঘুনাথ বাবুর বেশ পছন্দ হল। মদনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন ,''পছন্দ হয়েছে তো?''

উত্তরে তিনি বললেন ,'' বাহ্! বেশ ঘর ,আমার পক্ষে একদম আদর্শ ।খুব পছন্দ হয়েছে।''

রঘুনাথ বাবু লক্ষ্য করেছিলেন যে মদনবাবু কিছুক্ষণ থেকে একটা কিছু বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু বলছেন না। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, '' কিছু বলবেন কি?''

মদনবাবু আমতা আমতা করে বললেন, '' না ওই আর কি ,মানে ওই, আপনার মানে অ্যাডভান্স ভাড়াটা হলে আর কি, মানে ভালো হতো আর কি।''

''ও হ্যাঁ, একটু দাঁড়ান ।''এই বলে ব্যাগ থেকে একটা চেক বার করে মদন বাবুর হাতে দিয়ে রঘুনাথ বাবু বললেন,'' এই নিন,আমার তিন মাসের আগাম অ্যাডভান্স।''

মুখে একটা অর্থহীন হাসি ফুটে উঠল মদনবাবুর। ধন্যবাদ দিয়ে টাকাটা নিয়ে মদনবাবু চলে গেলেন।

মদন বাবু চলে গেলে রঘুনাথবাবু একটু ফ্রেশ হয়ে নিলেন। এরপর রঘুনাথবাবু বাড়িটা একটু ঘুরে দেখতে চাইলেন। রঘুনাথ বাবু রয়েছেন দোতলায় একদম ধারের ঘরে । আর বাকি সব ঘরগুলো ধুলো-ময়লা ভর্তি। এছাড়া একটা ঘরে ঢুকে দেখলেন একটা বড়সড় পিয়ানো রাখা আছে তাছাড়া আছে একটা বেহালা এছাড়া আরো অনেক সঙ্গীতের সরঞ্জাম রয়েছে । এসব রঘুনাথ বাবু বেশি বোঝেন না উনি কাট্টাখোট্টা মানুষ, অংক নিয়ে ওনার কারবার। এছাড়া আরও সব ঘরে ঘুরে দেখলেন এ বাড়ির গৃহকর্তা বেশ ধনী ছিলেন প্রতিটা ঘরে বেশ দামী আসবাব পত্র রয়েছে। এরপর একতলার ঘরে গিয়ে দেখলেন যে, একতলার অবস্থাটা দোতলারই মতো।মদন বাবুর দোকান এর কাছে একটা রেস্টুরেন্ট দেখেছিলেন রঘুনাথ বাবু। কিছুক্ষণ পরে ওখান থেকে সবজী, ডাল-ভাত খেয়ে চলে এলেন তিনি। আজ আর রান্নাবান্নার ঝামেলায় গেলেন না। তিনি নাকি বেশ ভালই রান্না পারেন। দুপুরে খেয়ে দেয়ে রঘুনাথ বাবু ছাদে যাবেন বলে ঠিক করলেন। ছাদে ওঠার সময় রঘুনাথ বাবুর পায়ের আওয়াজ শুনে একটা কাক উড়ে চলে গেল। ছাদে গিয়ে দেখলেন চারদিক ঘেরা একটা ছাদ। ছাদটা দেখেই রঘুনাথ বাবুর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল ‌। তিনি ঘুড়ি ও রাতে খুব ভালোবাসতেন। আর এই ছাদটা ঘুড়ি ওড়ানোর পক্ষে এক্কেবারে আদর্শ। এরপর তিনি লক্ষ্য করলেন এই বাড়িটার আশেপাশে সেরকম কোনো বাড়ি নেই ‌।

এরপর নিচের ঘরে এসে একটা বই পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়ালই নেই।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন পাঁচটা বেজে গেছে। চোখেমুখে জল ছিটিয়ে বাইরে একটু ঘুরতে বেরোলেন তিনি। গিয়েছিলেন জায়গাটা সত্যিই শান্তি রয়েছে। প্রিয়তোষ বাবু বলেছিলেন কাছাকাছি নাকি একটা বিরাট দিঘী আছে, নাম শান্তদিঘী। তারপর হাঁটতে লাগলেন। একটু পর দিঘীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন দিঘির পাড়ে বেশ কয়েকটা বেঞ্চও রয়েছে। অনেকে সেখানে বসে আছে। বেশিরভাগই বুড়ো অথবা বাচ্চাদের ভিড়। দিঘীটা সত্যিই সুন্দর, বলতে গেলে ছবির মত সুন্দর। আর নামে সঙ্গে বেশ অদ্ভুতভাবে একটা মিল রয়েছে, দিঘীর জল সত্যিই শান্ত।  এরপর তিনি দিঘীর পাড় বরাব হাঁটতে লাগলেন। তিনি আপন মনে হাঁটছিলেন।হঠাৎই একটা লোক ওনাকে পেছন থেকে ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করলেন ,''এখানে নতুন বুঝি?''

রঘুনাথ বাবু দেখলেন একটা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে রঘুনাথ বাবুর মতই পায়জামা-পাঞ্জাবি। উত্তরে রঘুনাথবাবু বললেন,'' হ্যাঁ, আমি এখানে স্কুলে বদলি হয়ে এসেছি ।''

''ও, নমস্কার , আমি হলধর মাইতি । এখানেই থাকি।''

প্রতি নমস্কার করে রঘুনাথ বাবু বললেন,'' আমি রঘুনাথ সরকার।''

''তা কোথায় থাকা হচ্ছে আপনার?''

''ওই যে‌ একটা পুরনো বাড়ি আছে না! হলুদ রঙের.....''

কথা শেষ হতে না হতেই হলধর বাবু বলে উঠলেন,''ওই ভূতের বাড়িতে??''

রঘুনাথবাবু মৃদু হেসে বললেন,''মদনবাবু তো তাই বললেন, তবে আমি এখনও পর্যন্ত পর্যন্ত পর্যন্ত ভুতের টিকিটুকুও খুঁজে পায়নি, অবিশ্যি আজকেই এসেছি ।''

''পাবেন, পাবেন,ও বাড়িতে ভূত আছে এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।''

''তবে ভূত থাকলে তো ভূতের দেখা পাবো। ভুত হয় নাকি! আমি ওসব মানি না। এই ভূতের ব্যাপারে সবাই বানিয়ে গল্প ছাড়া কিছুই বলেনি।''

''উঁহু , ভূত আছেই। পরে টের পাবেন, আগে রাতটা হোক । আসলে অন্ধকারেই ভূতরা বেশি আসে। আচ্ছা চলি, পরে দেখা হবে।'' বলেই হনহন করে যেমন হঠাৎই এসেছিলেন, তেমন হঠাৎই চলে গেলেন।

এরপর রঘুনাথবাবুও শান্তদিঘী থেকে চলে এলেন। হাঁটা দিলেন মদনবাবুর দোকানের উদ্দেশ্য।

দোকানের কাছে এসে দেখলেন সকালের মতোই ফাঁকা। ওনাকে দেখে মদনবাবু হেঁ হেঁ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ,'' ঘুরতে বেরিয়েছিলেন বুঝি?''

''হ্যাঁ , ওই শান্তদিঘীর দিকে একটু গিয়েছিলাম। তা আপনার দোকানে খদ্দের টদ্দের তেমন হয়না নাকি?''বললেন রঘুনাথবাবু।

''হুঁ'', একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মদনবাবু বললেন, ''এখন সব এমনই হাল কি আর বলবো। তা কেমন দেখলেন আমাদের শান্তদিঘীকে?''

''বেশ ভালো।''

''তা আজ দুপুরে ভূতের দেখা টেখা কিছু পেলেন নাকি মশাই?''

মদনবাবুর কথা শুনে জোরে হেসে উঠলেন রঘুনাথ বাবু। বললেন ,''দেখা এখনো পায়নি তবে আপনারা যা করছেন তাতে দেখা শীঘ্রই পাব । আজ হলধর মাইতি নামের এক জনের সাথে দেখা হলো, তিনিও ভুতের কথা বললেন।''

''উনি ভুল কিছু বলেননি। ওই যে পিয়ানো টা দেখেছেন, মাঝরাতে ওই পিয়ানো থেকে আওয়াজ শোনা যায়। কে যেন পিয়ানোটা বাজায়। আগে যে গৃহকর্তা ছিলেন, উনি নাকি পিয়ানো বাজাতে খুব ভালোবাসতেন। সবাই বলে মরে গিয়েও উনি ওনার প্রিয় পিয়ানো কে ভুলতে পারেননি। আজ আবার অমাবস্যা, ভুতের দেখা পেতেই পারেন। ''

''তা দেখা যাবে।''

''চা খাবেন ! তাহলে চা বলি?''

''না থাক্। লাগবে না। আজ তাহলে আসি। কাল দেখা হবে। দেখবো আপনার ভূত দেখা দেয় নাকি ভয়ে লুকিয়ে থাকে।''

মদন বাবুর দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন রঘুনাথ বাবু। বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

এখানে বেশি ঝুপ করেই সন্ধে নামে, কলকাতায় থাকলে মনে হয় এত তাড়াতাড়ি সন্ধ্যেটা নামতো না। খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যার অন্ধকার গ্রাস করে ফেলতে চায় জায়গাটাকে।

বাড়ি পৌঁছে রঘুনাথ বাবু প্রথমে বাড়িতে একটা ফোন করলেন তারপর একটা গল্প বই নিয়ে বসলেন কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারলেন না। একটা চিন্তা ওনাকে ভাবিয়ে তুলল। '' ভূত বলে কি সত্যিই কিছু আছে বা থাকলেও এখানে কি সত্যি ভূত আছে?''নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি। ডায়মন্ড হারবারে যখন থাকতেন, তিনি বাড়িতে একাই থাকতেন। কোন অসুবিধা হতো না। এখানে যে অসুবিধা হচ্ছে সেটা বলা ভুল কিন্তু কিরকম যেন একটা বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি ছাড়াও ঘরে আরো একজন আছে। কিন্তু তা তো হবার নয়। বাড়িটাতে তো তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। পরক্ষনেই ভাবলেন এসব তার মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয় । সারাক্ষণ ভূত আছে ভূত আছে শুনেই মনে হয় এরকমটা হচ্ছে।

রাত দশটা নাগাদ দুপুরের মতোই তিনি আবার সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে চলে এলেন। তারপর বাড়ি এসে আর দেরি না করে শোবার প্রস্তুতি নিলেন। সবাই প্রস্তুতি নিলেন ঠিকই , কিন্তু উনি ঘুমাবেন না বলে ঠিক করলেন। সত্যি ভূত আছে কিনা সেটা পরখ করে একবার দেখতে হবে। এমন সময় মদনবাবু এসে একবার দেখা করে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,'' কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো! হলে বলবেন।''

''ঠিক আছে '' ,বললেন রঘুনাথ বাবু,''তবে ভুতের দেখা পেলে জানাবো নিশ্চয়ই।'' বলে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি।

মদনবাবু চলে যাবার পর দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লে কিন্তু দরজায় ছিটকিনি দিলেন না। কারণ ছোটবেলায় রঘুনাথ বাবু দেখেছিলেন তার দাদু রাতে নিজের ঘরে মারা গেলে দরজা ভেঙে বার করতে হয় ওনাকে, তাই সেই থেকে ওনাদের বাড়িতে কেউ ছিটকিনি দিয়ে ঘুমান না।

এরপর লাইট অফ করতে যাবেন কি, এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং । কিন্তু কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন যে, বাইরে দু্রে তো আলো জ্বলছে। হতে পারে বাড়ির ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশানে কোনো গন্ডগোল হয়েছে। নিজেকে চিন্তা মুক্ত করে শুতে গেলেন তিনি। এই অমাবস্যাতেও যেন ঘরের থেকে বাইরে বেশি আলো রয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ চোখের পাতা বন্ধ করে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎই জানালাটা খোলার একটা মৃদু শব্দ শুনতে পেলেন। রঘুনাথবাবুর মনে হল শব্দটা অনেকটা ভূতের সিনেমা গুলোতে দেখানো শব্দের মতো। কিন্তু তিনি তো জানালা এঁটে ছিলেন, জানালা বন্ধ করেই শোয়ার অভ্যাস তার। কিন্তু জানালা খুলল কি করে? বাইরে জোরে হাওয়া তো বইছে না। তাহলে কি ......

একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছেন তিনি নিজেকে। তারপর হঠাৎই জানালাটার দিকে চোখ গেল রঘুনাথ বাবুর। দেখলেন হাতের ছাপ। কিন্তু এটা তো ছিল না। তবে কি হলধর বাবু আর মদনবাবুর কথা মত ভুতুড়ে খেল শুরু হয়ে গেল নাকি! ভাবতে চেষ্টা করলেন তিনি, হয়তো ছাপটা আগে থেকেই ছিল, তার চোখে পড়েনি কিন্তু ছাপটা তো চোখে পড়ার মতো। কিছু মাথায় ঢুকছে না তার । এভাবে মিনিট খানেক বসে রইলেন তারপর আবার শুয়ে পড়লেন তিনি। যেই বালিশে মাথা রাখলেন, ঠিক সেই সময়েই দরজাটা হ্যাট করে সশব্দে খুলে গেল। কিন্তু দরজাটা খোলার তো কথা নয় । তিনি ভালোভাবেই দরজা দিয়েছিলেন আর বাইরে তো জোরে হাওয়া বইছে না যে, দরজা খুলে যাবে। আর বইলেও বা কি! কেও জোরে না ঠেললে দরজা তো খোলার নয়। তাহলে কি এগুলো সব ভূতের কান্ড! আর কিছু ভাবতে পারছেন না তিনি। একদিকে প্রচণ্ড গরমে ঘামছেন আর অপরদিকে ভয়ে ঘাড় থেকে একটা হিমেল স্রোত নিচের দিকে নেমে গেল। কোন মতে ঢোক গিলে একবার যেন চিৎকার করলেন,'' কে ? কে ওখানে?'' কিন্তু গলার স্বর যেন বেরোতেই চায় না রঘুনাথ বাবুর গলাএকেবারে শুকিয়ে কাঠ। হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিতে গেলেন কিন্তু পেলেন না।এরপর জলের বোতল নিতে টেবিলের দিকে এগোলে দরজাটার দিকে চোখ পড়তেই রঘুনাথ বাবুর হৃদস্পন্দনের মাত্রা বেড়ে গেল। তিনি দেখতে পেলেন একটি ছায়ামূর্তি হঠাৎই দরজা থেকে সরে গেল । তিনি চেঁচিয়ে বললেন,''কে ওখানে? কিন্তু কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও বোধহয় তা শুনতে পেত না।রগুনাথ বাবু সাহস করে দরজার বাইরে বেরিয়ে আসতে যাবেন কি এমন সময় একটা কালো বেড়াল লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। রঘুনাথ বাবু তো পুরো স্থির। তিনি কোত্থেকে যেন শুনেছিলেন ভূতেরা নাকি রাতের বেলা মাঝে মাঝে কালোবেড়ালের রূপ নিয়ে থাকে। ভয় তো পা থর থর করে কাঁপছে ওনার। তারপর হঠাৎই আলো জ্বলে উঠলো , দেখলেন কেউ নেই কাছাকাছি। আবার হঠাৎ আলো বন্ধ হয়ে গেল , কিছুক্ষণ পর আবার আলো জ্বলে উঠলো, তারপর আবার বন্ধ হয়ে গেল। এরকম কান্ড দেখে রঘুনাথ বাবু কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো ওনার। এই বিস্ময় আর ভয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তিনি পিয়ানোর আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাহলে কি মদনবাবু সত্যি কথাই বলেছেন! একটু এগিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু পিয়ানোর ঘরটায় গিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। এরপর রঘুনাথবাবু যেন টলতে শুরু করলেন। তারপর কি হল ওনার আর কিছুই মনে নেই।

পরদিন সকালে জলের স্পর্শে ঞ্জান হল রঘুনাথ বাবুর। চোখ খুলতেই প্রথম মদনবাবুকে দেখতে পেলেন তিনি। ওনাকে চোখ খুলতে দেখে মদনবাবু হাসি মুখে বলে উঠলেন,'' উঃ , যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন না আপনি! ''

হঠাৎ গতরাতের কথা মনে পড়ায় রঘুনাথ বাবুর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠলো। তা দেখে মদনবাবু বললেন, '' তা বলেছিলাম না ! ভূত আছে, মিললো তো! ''

রঘুনাথবাবুর কাছে এর উত্তর দেবার আর কোনো ভাষা নেই।

এর প্রায় দু'ঘণ্টা পারে রঘুনাথ বাবু অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করে নিলেন। আর দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন।

গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

রঘুনাথ বাবুর চলে যেতেই মদনবাবু একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,‌ যাক্, প্ল্যানটা কাজ করেছে তাহলে। মাঝে মাঝে কয়েকটি ভুলচুক হলেও প্ল্যানটা কাজ করেছে। পিয়ানোর আওয়াজ যান্ত্রিক মনে হলেও কাজ হয়েছে, ভাগ্যিস রঘুনাথ বাবু বুঝতে পারেননি যে ওটা টেপ রেকর্ডারের আওয়াজ। আগে থেকেই জানালাতে সুতো বেঁধে রেখে দিয়েছিলেন পরে সুযোগ বুঝে টান দিতেই খুলে যায় , এতে ভৌতিক ব্যাপার মোটেই নেই। রাত্রিবেলা রঘুনাথ বাবুর সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে গিয়ে হাতের ছাপ এঁকে এসেছিলেন। আর তারপর ঠিক সময়ে মেইন সুইচটা অফ করে দেন তিনি। কিছুক্ষণ পরে ওপরে উঠে দরজা জোরে ঠেলে দেওয়া খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। এরপর হলধর বাবুর কাছ থেকে ধার করা বেড়াল

ছেড়ে দেন আর তারপর আবার সুইচ অন আর অফ করতে থাকেন তিনি। তারপর টেপ রেকর্ডারে পিয়ানো চালিয়ে দেন। আর তাছাড়া সকাল থেকে উনি আর হলধর বাবু মিলে রঘুনাথ বাবুর মনে যা ভুতের ভয় দেখিয়েছেন , তাতে ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করাটা সহজই হয়ে যায়।

আসলে মদনবাবু ওই বাড়িতেই নীচের তলায় থাকেন, ওই বাড়ির সবাই অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলে এ বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে তাকেই বাড়ির দায়িত্ব দেয়া হয়। তাই রঘুনাথ বাবুকে দোতলায় থাকতে দেন। আর রঘুনাথ বাবুকে ভয় দেখানোর কাজটা মদনবাবুকে দেন প্রিয়তোষবাবু। কারণ, প্রিয়তোষবাবু ভূত বিশেষজ্ঞ, ভূত নিয়েই ওনার কারবার। কিন্তু এর জন্যে রঘুনাথ বাবু ওনাকে মাঝেমাঝেই ঠাট্টা করেন। বেশ রাগ হতো তবে কিছু বলতেন না। এবার শান্তিপুরে রঘুনাথ বাবুর বদলির কথা শুনে এই কুবুদ্ধি মাথায় চাপলো তার। মদনবাবুকে আগে থেকেই চিনতেন তিনি। তাই তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বশ করেন। আর তারপরেই এই ব্যাপার।

তবে রঘুনাথ বাবু আর যেখানেই যাক না কেন সপ্তসাগর পার, ভুতের ভয় তিনি পাবেনই পাবেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror