Mahfujur Rahaman

Classics Others Children

4.7  

Mahfujur Rahaman

Classics Others Children

পান্তাবুড়ির আখ্যান

পান্তাবুড়ির আখ্যান

7 mins
287



     পান্তাবুড়ির নাম তো সবাই শুনেছো ! কিন্তু, আমি যে পান্তাবুড়ির কথা বলতে চলেছি , এ সেই পান্তাবুড়ি মোটেই নয়। এ হল এক্কেবারে সত্যিকারের পান্তাবুড়ি, গল্পে পড়া পান্তাবুড়ির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।


    আমি পান্তাবুড়িদের পাড়াতেই থাকি। ছোটবেলায় ওনার সাথে আমরা প্রচুর মজা করেছি। আসলে পান্তাবুড়ির আসল নাম ক্ষান্তা দেবী, আর আমরা বাঙালিরা তো কোনো নামকে বিকৃত করতে না পারলে মনে শান্তি থাকে না ! তাই ছোট থেকেই ছোট্ট ক্ষান্তার নাম বিকৃত রূপ নিয়ে পান্তাবুড়িতে পরিণত হয়। অবশ্য আমরা যখন পান্তাবুড়িকে দেখি তখন উনি বুড়িই বটে! লোকে ক্ষান্তাকে পান্তাবুড়ি বলে ডাকলে কি হবে! পান্তাবুড়ির কিন্তু পান্তাভাত মোটেই পছন্দ না।


    পান্তাবুড়ি হল আমাদের পাড়ার সৌম্যর পিসিঠাকুমা। কিন্তু, পান্তাবুড়ির এই কাহিনি পান্তাবুড়ির ভাইপো সাহস বাবু অর্থাৎ সৌম্যের বাবাকে ঘিরে। সাহসবাবুর নাম সাহস হলে কি হবে! উনি মোটেই সাহসী নন্‌। সবসময় পিসির ভয়ে সিঁটকে থাকেন। তাই, পাড়ার লোকে আদর করে ওনার নাম রেখেছে ঢ্যাঁড়স, কেউ কেউ আবার সরাসরি ওনাকে ঢ্যাঁড়সবাবু বলেই ডাকেন। উনি অবশ্য কিছুই বলেন না। ওই যে বললাম না! সাহসবাবু মোটেই সাহসী নন্‌। সাহসবাবুর ঢ্যাঁড়স নামের সাথে মিলিয়ে ওনার ছেলেমেয়েদের নামও রেখেছে পাড়ার নামবিশারদরা। সৌম্যর নাম রেখেছে পটল আর সৌম্যর বোনের নাম ঝিঙে। ওরাও এই নামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।


    যাইহোক, এবার আসি পান্তাবুড়ির কথায়। পান্তাবুড়ি খুব অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যান। তখন ওনার ২৬ বা ২৭ বছর বয়স হবে বোধহয়। তারপরেই উনি বাবার বাড়ি চলে আসেন , অবশ্য ততদিনে ওনার বাবা ঊর্ধ্বগমন করে ফেলেছেন। মেয়ের বৈধব্যপ্রাপ্তির খবর শুনে হার্টফেল করে জামাইয়ের কাছে পৌঁছে গেছেন। আমরা শুনেছিলাম পান্তাবুড়ি বিয়ের আগে যেমন ছিলেন, বিধবা হবার পরেও তেমনি রয়ে গিয়েছিলেন। সাদা শাড়ি পরে থাকলেও মনে হত ওনার জীবনে কখনও দুঃখ বলে জিনিসের আগমন ঘটেনি।                          


    পান্তাবুড়ি পাড়ায় আলোচিত ওনার অদ্ভুত সব আবদার, সাধ, ইচ্ছের জন্য। যখন তখন উল্টোপাল্টা সব আবদার করে বসেন সাহস বাবুকে। অবশ্য সবই temporary। তবে একধরনের আবদার কিন্তু permanent। পান্তাবুড়ির শখ স্পোর্টসম্যান হবার। তবে, পান্তাবুড়ির ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতিটা চিরদিনের। আমরা গোপাল খুড়োর কাছ থেকে শুনেছি যে ছোট্ট থেকেই পান্তাবুড়ির শখ ক্রিকেট খেলবে। এখনকার মতো তখনকার দিনে অতো দোকানে দোকানে ব্যাট বল পাওয়া যেত না। তাই, সেলাই করার সুতো, ঊলের বল , বেল দিয়ে বল বানিয়ে আর গাছের ডাল, কাঠের তক্তা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে নিয়ে ‘মিতালি রাজ’ আর ‘ঝুলন গোস্বামী’ হবার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নেমে পড়ত পান্তাবুড়ি। শুনেছি নাকি সজনেডাঁটা দিয়েও IPL খেলা হয়ে গেছে পান্তাবুড়ির। ন্যাড়া মাথায় বেল মানে বল পড়ে মাথাও যেমন ভেঙেছে, তেমনি এর-ওর বাড়ির-গাড়ির কাঁচও তেমন ভেঙেছে। বাড়ির এমন কোনো কাঁচ ছিল না, যেটা পান্তাবুড়ির ক্রিকেটের শিকার হয়নি। তাই এখন বাধ্য হয়ে বাড়িতে কাঠের জানালা লাগিয়েছেন সাহসবাবু।  


    এই তো সেদিন সৌম্যর ক্রিকেট বল নিয়ে লোফালুফি খেলতে গিয়ে বাড়ির বহুদিনের পুরনো অস্টিন ( যেটি কোনরকমে পান্তাবুড়ির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল ) এর কাঁচ ভেঙে চুরমার। আবার সেইদিন সাহসবাবু যখন ছোট মেয়ের স্কুলে ভর্তির ফর্ম ফিল আপ করছিলেন, তখন হঠাৎ পান্তাবুড়ি হাঁক দিলেন , “ ওরে সাহস! সেই কবে থেকে বলছি ক্রিকেটের কিটব্যাগটা কিনে দে। প্র্যাকটিস করবো। সামনের বিশ্বকাপে নামতে হবে তো!’’


    ব্যাস্‌! যেই পিসির গলা শুনতে পেলেন, ওমনি সব কেমন যেন গুলিয়ে গেলো। স্কুলের ফর্মে মেয়ের নাম ‘নির্ঝরিণী রায়’এর বদলে লিখে বসলেন ‘ঝিঙে’, এক নিমেষে মেয়েকে female থেকে male বানিয়ে দিলেন। Student signature এর জায়গায় নিজে সই করে মেয়েকে Guardian signature এর জায়গায় সই করতে দিলেন। তারপরেও সবকিছু ঠিকঠাকই দেখে জমাও দিয়ে দিলেন। তারপরে কি হল তা আর বলার প্রয়োজন হবে না নিশ্চয়!


    অবশ্য পান্তাবুড়ির এই অতিরিক্ত ক্রিকেতপ্রীতি পটল থুড়ি সৌম্যদের একটা সুবিধা করে দিয়েছে! খেলার সময় খেলাটা অন্তত দেখতে পাওয়া যায়। কেননা, টিভির সামনে পান্তাবুড়ি বসলে সিরিয়ালের চ্যানেল খেলার চ্যানেলে চেঞ্জ হয়ে যায়। অবশ্য খেলা দেখার সময় খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে পান্তাবুড়ির সাবধানবানী শুনতে হয় সৌম্যদের, “এখন তোরা খেলছিস আর আমি দেখছি। এরপর আমি খেলব আর তোরা দেখবি আর হিংসেই লুচির মতো ফুলবি। তাই না রে সাহস!”


সাহসবাবুও ভয়ে ভয়ে সায় দেন, “হ্যাঁ পিসিমা, একদম ঠিক বলেছো। তোমার খেলা দেখলে বিরাট কোহলিও হার্টফেল করবে!”


   আবার, এই কদিন আগে পিসিমা নির্ঝরের ( ঝিঙে ) বইতে ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ পড়ে রাজার পিসির মতো কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলার শখ জাগে। যেমন করে হোক ওনাকে কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সাহসবাবু তো বেকায়দায় পড়ে গেলেন। পিসির কথার অমান্য করা যাবে না। কারণ পিসির কথার অমান্য করলেই পিসি কাশীবাসি হবার পণ করবেন। একদিন পান্তাবুড়ি আবদার করলেন ওনাকে গিটার, বেহালা, সিন্থেসাইজার কিনে দিতে হবে, উনি singer হবেন। সাহসবাবু আপত্তি করলেন, “তোমার কাছে তো হারমোনিয়াম আছে! ওটাই বাজাও।” 


    ব্যাস্‌! পান্তাবুড়ি তো রেগে আগুন। এটা তো একেবারে মুখের ওপরে অপমান করা হল! তাও আবার পান্তাবুড়ির অপমান! পান্তাবুড়ি তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করলেন, “ওই কে আছিস! আমাকে কেও কাশী যাবার বন্দোবস্ত করে দে। আমি আর এ বাড়িতে মুখ দেখাতে চায় না।”


   সবাই ভেবেছিল এমনি রাগে চ্যাঁচাচ্ছে। কদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ফল হল উল্টো। তারপর সাহসবাবু ভাবলেন, কদিনের জন্য কাশী যেতে চাইছে তো যাক! এরপর পিসির কাশী যাবার ব্যাবস্থা করে ওনাকে বলতেই উনি আবার খেঁকিয়ে উঠলেন, “ ও! তোরা এই চাস! আমি কাশী চলে যাই! তাই তো!”


   সাহসবাবু তো বেশ বেকায়দায় পড়লেন ! তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পিসিকে বেনারস পাঠানো হলো। বুড়িকে কাশী তো পাঠানো হলো! কিন্তু, এদিকে পিসির আসার নাম নেই। পিসির সাথে সাহসবাবু ওনার গিন্নিকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু পান্তাবুড়ি ওনাকে পাঠিয়ে দিয়ে ওখানেই থেকে গেছেন। সাহসবাবুর তো মাথায় হাত! পিসি কি এখনও রেগে আছে নাকি! এরপর সাহসবাবু নিজে বেনারস গিয়ে পিসিকে গিটার, বেহালা কিনে দেবার কথা দিয়ে নিয়ে এলেন। তাই সেই থেকেই ঢ্যাঁড়সবাবু পান্তাবুড়ির কথার অমান্য করতে ভয় পান।


   এই যে ২০১৭ তে ভারতে U-17 ফুটবল বিশ্বকাপ হোলো না! ওই বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ আমাদের যুবভারতী স্টেডিয়ামে হবে শুনে আমাদের পাড়ার বেশিরভাগই টিকিট কেটেছিল। পান্তাবুড়িও গিয়েছিল। কিন্তু খেলা দেখে আসার পর দিনই সাহসবাবুকে পান্তাবুড়ি অর্ডার দিলেন, “ ওরে সাহস! আজকে আমার জন্য ফুটবল খেলার সরঞ্জামগুলো কিনে আন্‌ তো! প্র্যাকটিশটা শুরু করে দিই।”  


    সাহসবাবুর মাথায় যেন বাজ পড়লো! ক্রিকেটেই যা অবস্থা সবার! ফুটবলে কি হবে! সাহসবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “ঠিক আছে পিসি কিন্তু এই বয়সে ফুটবল খেললে...”


    কথা শেষ করতে না দিয়ে পিসি চিৎকার করে বলে উঠলেন, “কি বললি? আমাকে বুড়ি ভাবিস? তোকে দেখিয়ে দেব আমি এই বুড়ি কী করতে পারে! আগে তোকে যা করতে বলেছি তা কর !”


   এরপর শুরু হল প্র্যাকটিস। কিন্তু কদিনের মধ্যেই হাত পা ভেঙে পান্তাবুড়ি শয্যাশায়ী। পান্তাবুড়ি একবার বলেছিল, “যাদের সত্যিকারের ট্যালেন্ট আছে তারা কখনও সুযোগ পায় না জানিস! এই দেখ্‌ আমার অবস্থা।”


   এরপর পান্তাবুড়ির মাথা থেকে ফুটবলের ভুত নামল বটে! কিন্তু, পান্তাবুড়ির স্পোর্টসম্যান হবার শখ নামল না। আমাদের এখানে শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। তাই প্রতি বছর শীতকাল এলেই পান্তাবুড়ির পি ভি সিন্ধু হবার ইচ্ছেটা চাগার দিয়ে ওঠে। কিন্তু, পান্তাবুড়ি খেলতে নামলেই ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেটগুলোকে আর চেনা যায় না! খেলতে খেলতেই র‍্যাকেটগুলোর প্লাস্টিক সার্জারি করে দেন তিনি। অবশ্য বুড়ির কথায়, “ এসব বাচ্চাদের জিনিস নিয়ে খেলতে গেলে ভাঙবে না তো কী হবে! বড়ো বড়ো প্লেয়াররা দামি দামি জিনিস নিয়ে খেলে। তারা যদি তোদের মতো ব্যাট নিয়ে খেলে তাহলে তো ভাঙবেই!”   


    আমাদের আর তখন আর কিছু বলার থাকে না। আবার কিছু না বললে বুড়ি বলে ওঠে, “কি রে! আমার কথার উত্তর দিলি না যে বড়!”


    তখন ভয়ে ভয়ে উত্তর দিতেই হয়, “ হ্যাঁ ঠাকুমা! ঠিকই বলেছ।”


    আবার মাঝে মাঝে উত্তর দিলেও বুড়ি বলে, “ খুব তো বেড়েছিস দেখছি! বড়দের মুখে মুখে কথা!”


   এসব তো হল। কিন্তু একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি। পান্তাবুড়ির খুব ইচ্ছে ওনাকে কেন্দ্র করে কোন অনুষ্ঠান হোক। তাই প্রতিবছর বুড়ির জন্মদিন পালন করাটা মাস্ট। কিন্তু এবছরের ব্যাপার একটু আলাদা। বুড়ির জন্মদিন তো পালন করা হলই কিন্তু, বুড়ির এবার শখ হয়েছে নতুন মানে unique কিছু করার। পান্তাবুড়ি এবার ঝোঁক ধরেছে যে এবছর ওনার ৫০ বছরের ‘বিধবাবার্ষিকী’ পালন করতেই হবে। ৫০ বছর হল বুড়ি বিধবা হয়েছেন। তাই উনি চান এবছর ওনার বৈধব্যপ্রাপ্তির 50th anniversary পালন করা হোক। তাই আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিতে চান পান্তাবুড়ি।


   পান্তাবুড়ির ৫০ বছরের ‘বিধবাবার্ষিকীর’ আয়োজন প্রায় শেষ। এমন সময় পান্তাবুড়ির সাহসবাবুকে বললেন, “বুঝলি সাহস! আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলোতে তো আমার ছোটবেলার বন্ধুদের নেমন্তন্ন করা হয় না! তাই, এবারে ঠিক করেছি সবাইকে নেমন্তন্ন করব! আমি একটা লিস্টি করেছি। সবাইকে নেমন্তন্ন করবি।”


   এই বলে সাহসবাবুকে লিস্টটা ধরিয়ে দিলেন পান্তাবুড়ি। আর বললেন, “আমার বন্ধুদের সবাইকে আনতে হবে কিন্তু! একজনও যেন বাদ না যায়! ৫১ জন আছে। ৫১ জনের ১ জনও যেন বাদ না যায়! যদি বাদ যায় তো শুনে রাখ! আমি কাশীবাসি হবো। এই আমি বলে রাখলুম।”


   সাহসবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “পিসি! যদি কেও মারা যায় তো!”


   “ তো আমি কি করব! আমি সবাইকে চায়। ব্যাস! আমি ঠিক করেছি সবাই মিলে একসাথে ক্রিকেট খেলব। যদি না আনতে পারিস তো তাহলে আমার কাশীবাসি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”


  ব্যাস! সাহসবাবু তো মহা ফাঁপড়ে পড়লেন! সেই থেকে ৫১ জনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু চিন্তা আরও বাড়লো যখন দেখলেন ৫১ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন বেঁচে। তাই এখন তিনি শুধু ভাবছেন আর ভাবছেন, কি করা যায়! তোমরাও ভাবো। আর সমাধান খুঁজে পেলে জানাতে ভুলোনা কিন্তু!


 




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics