"অচিনবাবুর দুঃস্বপ্ন"
"অচিনবাবুর দুঃস্বপ্ন"


হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল অচিনবাবুর। ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ যেন তাকে ডাকছে। নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে, দেখলেন ২টো ১০ বাজে। এতরাতে কে আবার ডাকবে, স্বপ্ন দেখছিলেন হয়ত। ভাবলেন সকাল ৭টায় ট্রেন যখন, এখন ঘুমিয়ে পড়াই ভাল। যাবেন গুয়াহাটি, খুব ভাল একটা বিজনেস ডিল পেয়েছেন। শৈশবে বাবা-মা কে হারিয়ে মামাবাড়িতে মানুষ। বিপত্নীক ও নিঃসন্তান মামা, ভাগ্নেকে নিজের ছেলের মত কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন। মামার কাছেই ব্যবসার হাতেখড়ি। মামার ইলেক্ট্রিক্যাল গুডসের ছোট দোকান ছিল। মামার মৃত্যুর পরে দোকানের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নিরলস পরিশ্রমে সেই ব্যবসা বাড়ানো এবং ইলেক্ট্রিক্যাল সাপ্লায়ার্স হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, সবই করেছেন একাহাতে। এই করতে গিয়েই প্রৌঢ়ত্বে এসে পড়েছেন, বিয়ে আর করা হয়নি। একা থাকাটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। বিছানাতে উঠে বসে সাইড্ টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা নিতে যাবেন, চোখ চলে গেল সামনের দেওয়ালের আয়নাটায়। যা দেখলেন বুকটা ছ্যাঁত্ করে উঠল। সাহসী বলে নিজেকে দাবি করেননি কোনোদিন, তাই বলে ভীতুও নন তিনি। দেখলেন আয়নাতে কার যেন একটা প্রতিচ্ছায়া। ঘুমচোখ কচলে ভাল করে দেখার পর সমস্ত শরীরে শিহরণ খেলে গেল। আয়নার ভেতরে প্রতিচ্ছবি আর কারো নয়,স্বয়ং তাঁরই। কিন্তু তা কি করে সম্ভব, তিনি তো খাটের ওপর বসে রয়েছেন,আর আয়নার অচিনবাবু আয়নার ওপারে একদম সম্মুখে। অচিনবাবু যদি আয়নার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন তখন যে প্রতিবিম্ব হত ওনার, আয়নার অচিনবাবু সেরকমভাবেই আছেন। ওপারের অচিনবাবুই তাঁর নাম ধরে ডাকছেন,"অচিনবাবু, ও মশাই শুনতে পাচ্ছেন..বড়ই বিপদ..অচিনবাবু"
বুঝলেন হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, সংজ্ঞা হারাবেন যেকোন মুহূর্তে। জ্ঞান হারাবার আগে আবার শুনলেন ওপার থেকে, "কাল যাবেন না..খুব বিপদ..যে করেই হোক কাল একদম গুয়াহাটি যাবেন না"
..............
রাত ৯টা বাজে। ডিনার সেরে শোয়ার তোড়জোড় করছেন। উত্তরবঙ্গের ওপর দিয়ে চলেছে ট্রেন এখন। কালরাতের দুঃস্বপ্নটা ভাবলেও বুকের ভেতরে ভয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর থেকে না ভাবাই ভাল হবে। ভোরে গুয়াহাটি পৌঁছবে ট্রেন, এখন না শুয়ে পড়লে রাত থাকতে থাকতে উঠতে পারবেন না। খামোখা এক দুঃস্বপ্নের ভয়ে এত ভাল অফারটা হাতছাড়া করা নির্বুদ্ধিতা হত। যাকগে এবার শুয়ে পড়াই ভাল। ভাগ্য ভাল তাই নিজের পছন্দের আপার সাইড বার্থ পেয়েছেন। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
...............
বেয়াড়া ঝাঁকুনি আর যন্ত্রণাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। সারা শরীর অবশকরা যন্ত্রণার মধ্যে দেখলেন কামরার দেওয়ালটা দুমড়ে মুচড়ে তাঁর শরীরের ওপর চেপে বসে আছে যেন এবং তাঁর ডান হাতটা কনুই থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। ঘটনার বীভৎসতায় সংজ্ঞা হারালেন সঙ্গে সঙ্গেই।
চোখ খুলেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। নিজের ঘরেই অক্ষত অবস্থাতে নিজেকে দেখে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল অচিনবাবুর। দুঃস্বপ্ন ছিল, কিন্তু এত নিখুঁত, যেন সবটুকু বিশ্বাস করতে হয়। জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে খেয়াল করলেন সাইড টেবিলটা নেই। ভাল করে দেখতে গিয়ে দেখলেন ঘরের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ঘর তাঁরই কিন্তু আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, সাইড টেবিল সব কিছুরই জায়গা বদল। এমনকী জানলা-দরজাটাও উলটো দিকে। ক্যালেন্ডারএর দিকে চোখ পড়তে একটু সময় লাগলেও সবকিছু জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল অচিনবাবুর। গোটা ঘর আর ঘরের মধ্যে সবকিছু মিরর ইমেজ হয়ে গেছে কোনো জাদুমন্ত্রবলে। হয়ত এও এক দুঃস্বপ্ন। নিজেকে চিমটি কেটে বুঝলেন স্বপ্ন তিনি দেখছেন না মোটেই। কিন্তু এসমস্ত কিছুর ব্যাখ্যা কি? তাঁর সাথেই বা এরকম কেন হচ্ছে?ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর আরেকটা সুনাম হল তিনি খুবই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ বিদ্যুৎ এর ঝিলিকের মত একটা কথা মাথায় এল। আয়না!!
এগিয়ে গেলেন দেওয়ালে রাখা আয়নার দিকে। আয়নাতে তাঁর প্রতিবিম্ব পড়লনা। অবশ্য এতে অবাক হলেননা বিন্দুমাত্র, এরকমই হবে সেই সম্ভাবনাই তাঁর মাথায় এসেছিল। আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখলেন তাঁর ঘর আর সব কিছু সহাবস্থানেই আছে, যেমনটি এতকাল ধরে ছিল। খাটের পাশেই রাখা ট্রাভেল ব্যাগ আর ব্রিফকেস, গতরাতে যেখানে রেখেছিলেন। আর বিছানাতে স্বয়ং তিনি অথবা তাঁর আরেক সত্ত্বা। এই মুহূর্তে অনেক কিছু বোধগম্য হল তাঁর। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে গতরাতের থেকে এখন অবধি ঘটা কোনোকিছুই যে দুঃস্বপ্ন নয়, সবটাই যে কঠিন বাস্তব তা বুঝলেন। যদিও কোনোকিছুরই যুৎসই ব্যাখ্যা পেলেন না। তবুও ঠিক করে নিলেন এই মুহূর্তের কর্তব্য। যদি ঠিকঠাক বুঝে থাকেন আয়নার ওপারে গতকালের অচিনবাবু ঘুমিয়ে আছেন এবং তাঁর সামনে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। নিজেকে অর্থাৎ ওপারের অচিনবাবুকে সাবধান করতেই হবে যেকরেই হোক। আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে নিজের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন, "অচিনবাবু! ও মশাই শুনতে পাচ্ছেন!''