শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy Others

4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Tragedy Others

অব‍্যাক্ত বেদনা

অব‍্যাক্ত বেদনা

5 mins
298


বহুবছর পর ঋষি আজ দেশে ফিরছে। তাই অনেকদিন পর মল্লিক বাড়িতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আসলে ঋষি সবকিছু ছেড়ে একেবারে দূর দেশে চলে যাওয়ায়, সেই আঘাতটা ঋত্বিক বাবু মেনে নিতে পারেননি, তাই বছর ঘুরতে না... ঘুরতেই তিনি এই জগতের মায়া ত‍্যাগ করে অন্য জগতে পাড়ি দেন। আর বৈশাখী দেবী একা এই মল্লিক বাড়ি আগলে পড়ে রইলেন, আর নিজের একটা ভুলের জন্য সবকিছু হারালেন। এইভাবে তিলে তিলে সবার চোখের আড়ালে জ্বলে পুড়ে শেষ হতে থাকলেন। তবে আজ বৈশাখী দেবী খুব খুশি, কারন.... ছেলে আজ ফিরে আসছে মায়ের কাছে বহু বছর পর। তাই নিজের হাতে ছেলের পছন্দ মত সমস্ত রান্না করেছেন। এই দিনটার জন‍্য তিনি কবে থেকে অপেক্ষা করে বসে আছেন। একটা মানুষের জন‍্য ঋষি যে.... সব কিছু ছেড়ে এত দূরে চলে যেতে পারে, সেটা বৈশাখী দেবী কখনও কল্পনাও করতে পারেননি!!! আসলে তিনি কোনদিন ছেলের মনটাকেই বুঝতে চান নি...। সবসময় নিজেদের চারিপাশে একটা আভিজাত্যের আর অহংকারের বেড়াজাল তৈরী করে রেখেছিলেন।


কিছুক্ষনের মধ্যে একটা মস্ত বড় গাড়ি এসে দাঁড়াল মল্লিক বাড়ির গেটের সামনে। গাড়ির দরজা খুলে লম্বা, ফর্সা, সুঠাম চেহারা এবং উজ্জ্বল ব‍্যক্তিত্ব নিয়ে একজন যুবক দাঁড়াল। বৈশাখী দেবী অবাক হয়ে চেয়ে আছেন, আসলে দশ বছরে ঋষির চেহারা এতোটা পাল্টে যাবে তিনি মনে করেন নি...। আসলে মায়ের মনতো সবসময় মনে করে তার ছেলে সেই ছোটটিই আছে। দশ বছর পর ছেলেকে চোখের সামনে দেখে তিনি আবেগ প্রবন হয়ে পড়েন। চোখের জল বাঁধ মানেনা গাল বেয়ে আপন ধারায় পড়তে থাকে।


ঋষি মায়ের কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। সত‍্যি এই মূহুর্তে মা আর ছেলের মনের মধ‍্যে একটা আনন্দের বন‍্যা বয়ে যায়। যা... হয়তো মুখের ভাষা দিয়ে ব‍্যাক্ত করা সম্ভব নয়!!!!বৈশাখী দেবী হাত ধরে ছেলেকে বাড়ির ভীতরে নিয়ে যান। ঋষি নিজের ঘরে যায়, গিয়ে দেখে যেমন ভাবে দশ বছর আগে ছেড়ে গেছিল আজও ঠিক তেমনি আছে। ঋষি তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে এল। অনেকদিন পর একসাথে মা... আর ছেলে মিলে খাবার খেল তৃপ্তি করে। 


বিকেল বেলায় ঋষি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ল তার ছোট বেলার সেই গ্রামটাকে ঘুরে দেখার জন‍্য। সত‍্যি সবার জীবনে ছোট বেলাটাই সবথেকে ভালো। ঋষি আপন মনে হাটতে লাগল গ্রামের রাস্তা ধরে। সত‍্যি সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে সময়ের সাথে সাথে তবে কিছু কিছু জায়গা যেমন ঋষির স্কুল, দেবকুন্ডু পুকুর যেখানে রোজ গ্রামের সব বন্ধুদের সাথে ঋষি জলে নেমে দাপাদাপি করত, সেই বুড়ো শিব মন্দির এই জায়গা গুলো আজও আগের মতো একই আছে তাদের পুরনো সব স্মৃতি আগলে নিয়ে।


হঠাৎ ঋষির পা... আটকে গেল। মনে মনে ঋষি বলে উঠল এটা খুশিদের বাড়ি না...!!! ঋষি... যে.. হাটতে হাটতে আর পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে কখন খুশিদের বাড়ির পথে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি। ঋষির বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠল, খুশির কথা মনে করে। ঋষি বহু বছর ধরে এই কষ্ট বুকের মাঝে জমিয়ে রেখেছে, আর সহ‍্য করতে পারছেনা। শতবার ভোলার চেষ্টা করলেও ভুলতে পারেনা। খুশির মায়া ভরা হাসি মুখটা যেন ঋষির চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে। খুশি কেন যে এই রকম করল তা ঋষির আজও অজানা!!! ঋষি আর এক মুহুর্ত ওখানে না..... দাঁড়িয়ে সোজা বাড়ি চলে আসে।


বৈশাখী দেবী মনে মনে ঠিক করেছেন আজকে ঋষিকে সব সত‍্যি কথা বলে ক্ষমা চেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবেন ওনার ভুলের জন‍্য। এবং ভিতরে ভিতরে তিল তিল করে কষ্ট পেয়ে দ্বগ্ধে মরার যন্ত্রণা যদি একটু কমে এতে। যদিও তিনি আগের মতো সবকিছু ফিরিয়ে দিতে পারবেননা! তবুও নিজের অপরাধ বোধ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবেন। বৈশাখী দেবী ধীরে... ধীরে... ঋষির ঘরে ঢুকলেন।


ঋষি তখন জানলার দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠা তাদের বাড়ির বাগানের দিকে একমনে তাকিয়ে অতীতের কথা ভেবে চলেছে, কি সুন্দর ছিল সেই সব দিন!!!! ঋষি, খুশি, অর্ঘ্য, রাজ, মিষ্টি ওরা একটা বন্ধুদের গ্রুপ ছিল। সবার বাড়ির অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল তবে খুশিদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলনা কারন খুশির বাবা দিনমজুর। দিন আনে দিন খায় অবস্হা। কিন্তু ঋষি আর খুশির এই বন্ধুত্ব বৈশাখী দেবীর একদম পছন্দ ছিলনা। কিন্তু ঋষি খুশির বন্ধুত্বকে কোনদিনও হারাতে চাইনি নিজের জীবন থেকে, কারন ঋষি খুশির প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করতো, সেই টানকে ভালোবাসা বলে কিনা তা সঠিক ভাবে জানা নেই ঋষির, তবে খুশি ওর পাশে থাকলে কাছে থাকলে সবকিছু যেন ভালো লাগত মনে হত এইভাবেই যেন জীবন একে অপরের পাশে থেকে কাটিয়ে দেওয়া যাবে যতই বাঁধা, বিপত্তি আসুক।  


একদিন খুশি বিকেল বেলায় ঋষিদের বাড়ি যায় অথচ ঋষির সাথে দেখা না... করেই কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। ঋষি পিছন থেকে খুশিকে অনেক ডাকে কিন্তু খুশি আর সারা দেয়না। তারপর কিছুদিনের মধ‍্যে খুশির বিয়ে হয়ে যায়, খুশি গ্রাম ছেড়ে চলে যায় স্বামীর হাত ধরে। অবশ‍্য খুশির বিয়ের কথা জানতে পেরে ঋষি বিয়ে আটকানোর অনেক চেষ্টা করে ছিল কিন্তু মায়ের কথা রাখতে গিয়ে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। খুশির ওর জীবন থেকে চলে যাওয়ার কষ্ট সহ‍্য করতে না... পেরে ঋষি সবকিছু ছেড়ে পড়াশোনার নামে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল।


-----------বৈশাখী দেবী পিছন থেকে ঋষির কাঁধে একটা হাত রাখেন। অতীতের কথা ভেবে ঋষির চোখে তখন জল ভরে এসেছে। কোন রকমে নিজেকে সামলে ঋষি বলে কিছু বলবে মা....???


----------বৈশাখী দেবী বললেন হ‍্যাঁ....। আজ আমার করা সমস্ত অপরাধ আর অন‍্যায়, তোর কাছে স্বীকার করব। বৈশাখী দেবীর গলা কান্নায় ভারি হয়ে আসে।


------------ঋষি ব‍্যাকুল কন্ঠে বলে কি...... অপরাধ করেছ মা....?????


-----------বৈশাখী দেবী বলেন আজ আমার জন‍্য সবকিছু হয়েছে। তোর এই জীবনের জন‍্য আমি দায়ি আমার অহংকার দায়ি!!! খুশি সেদিন এসেছিল তোকে বিয়েটা আটকানোর জন‍্য বলতে। কিন্তু আমি সেদিন ওকে অপমান করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলাম, আর বলে ছিলাম, তোর থেকে যেন দূরে থাকে!!! তারপর একদিন মিষ্টি একটা চিঠি নিয়ে এসেছিল তোকে দেওয়ার জন‍্য আমি সেটাও লুকিয়ে রেখে ছিলাম তোর কাছ থেকে।


-----------ঋষি জোড়ে বলে ওঠে, মা......তুমি এটা কি... করে করতে পেরেছিলে.......???? তুমি যে...... আমাকে বলেছিলে চিঠিটা হারিয়ে গেছে!


--------বৈশাখি দেবী কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠলেন, আসলে চিঠিটা হারিয়ে যায় নি.....!!!!আমি ওটা তোর থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়ে ছিলাম। জানি আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি, আর তার জন‍্য এত কষ্ট পাচ্ছি নিজে, সাথে তোকেও কষ্ট দিয়ে ফেলেছি নিজের অজান্তেই, তখন বুঝতে পারিনি তুই খুশিকে এতটা ভালোবাসিস, আর যখন বুঝতে পারলাম তখন আমার আর কিছুই করার ছিলনা!!!! পারলে তোর মাকে ক্ষমা করে দিস। এই বলে চিঠিটা ঋষির হাতে দিয়ে বৈশাখী দেবী চোখের জল মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।


ঋষি চিঠিটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন চোখের জল ফেলল। তারপর চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল.........


"প্রিয় ঋষি


          তুই আমার সব থেকে ভালো বন্ধু, আর তোকে আমি আমার জীবনের সাথে সবসময় জড়িয়ে রাখতে চাই...., কারন তুই আমার মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছিস। তুই পারিসনা বন্ধু আমার বিয়েটাকে আটকাতে। তাহলে জীবনের বাকি পথটা আমরা একে অপরের পাশে থেকে কাটিয়ে দেব। বহু কষ্ট করে এই চিঠিটা মিষ্টির হাত দিয়ে তোকে পাঠালাম। তাড়াতাড়ি এর উত্তর দিস বন্ধু। আমি উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।


ইতি খুশি।"


ঋষি চিঠিটা পড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আর বাইরে বজ্র বিদ‍্যুৎ সহ ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। আসলে প্রকৃতিও ঋষির কষ্টটা বুঝতে পেরে অঝোর ধারায় ঝড়ে পড়ছে। ঋষি কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। বৃষ্টির জলের সাথে ঋষির চোখের জল মিশে যেতে লাগল। এইভাবে হয়তো ঋষি নিজের মনের মধ‍্যে জমে থাকা কষ্টটা বৃষ্টির সাথে ভাগ করে নিল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance