নন্দা মুখার্জী

Drama Classics

2.5  

নন্দা মুখার্জী

Drama Classics

আত্মসম্মান

আত্মসম্মান

2 mins
1.5K


  


  অনেক চেষ্টা করে অতীশ যাতে সংসারটা ভেঙ্গে না যায় | আলাদা থাকলে কি হবে ? এক বাড়িতেই তো মায়ের সাথে আছে | যখন ইচ্ছা হয় তখনই তো মায়ের সাথে দেখা করতে পারে | কিন্তু রোজ  অফিস থেকে ঘরে ফিরলেই বৌয়ের ঘ্যানঘ্যানানি আর ভালো লাগছেনা | অদ্ভুতভাবে মায়ের কাছ থেকে কোনদিনও কোন অভিযোগ সে পায়নি | ইতিকার সেই এক গো "আমি এখানে থাকবোনা , তোমার মায়ের স্বভাব ভালোনা --- তুমি অফিসে বেরিয়ে গেলেই তোমার মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান | তুমি ফেরার একটু আগেই ঘরে ফেরেন | আমি জানতে চাইলে রোজ সেই একই উত্তর ,'আমার কাজ আছে '| উনার স্বভাব চরিত্র ঠিক না |" এ কথা শুনে সেদিন অতীশ বৌয়ের গায়ে হাত তুলেছিল | কিন্তু নিজেকেও খুব ভাবাচ্ছে বিষয়টা | সত্যিই তো মা তাহলে রোজ কোথায় যান | 

 পরদিন ঘুম থেকে উঠে মায়ের ঘরে যায় অতীশ | অতীশের বিয়ে দিয়েই অষ্টমঙ্গলার পরেরদিন থেকে তিনি ছেলে আর বৌকে নীচের সমস্ত অংশ ছেড়ে দিয়ে উপরে একখানা ঘর , একচিলতে রান্নার জায়গা , ঘরের সাথে টয়লেট  আর তার সাধের ঠাকুরঘর -- নিয়ে নিজের মতোই থাকেন | তিনি তার অতুর বিয়ের আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন আর পাকা কথা বলার দিনে সে বাড়িতেও জানিয়ে এসেছিলেন যেন তারা মেয়েটিকে একটু রান্নাবান্না শিখিয়ে পাঠান |

 চৌদ্দ বছর বয়সে বৌ হয়ে এ বাড়িতে ঢুকে সেই যে হেঁসেল ধরেছিলেন তারপর একদিনের তরেও সেই হেঁসেল থেকে তিনি পরিত্রান পাননি | তাই তিনি ঠিক করেই রেখেছিলেন ছেলের বিয়ের পরে তিনি একটু নিজের মত করে বাঁচবেন | ছেলেবেলা থেকেই গল্পের বই পড়ার নেশা ছিল মারাত্মক | বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক | তিনি মাঝে মাঝে স্কুলের লাইব্রেরি থেকে মনীষীদের জীবনী ভির্ত্তিক বই এনে দিতেন তার বড় মেয়ে অচলাকে | আর বছরে পূজার সময় নুতন জামা জুতোর সাথে একটা করে গল্পের বই | জন্মদিনেও বাবার কাছে আবদার থাকতো একটি গল্প বই এর | সেই মেয়ের স্কুলের গন্ডি পার হবার আগেই তার মায়ের জোরাজুরিতে দশ বছরের বড় ছেলের সাথে বিয়ে দিতে দেন | স্বামী শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী শুধু নামেই নন স্বভাবেও তিনি শিবেরই মত | তিনি যখন শুনলেন অচলার এই গল্পের বইয়ের প্রতি নেশার কথা তিনিও বাড়িতে লুকিয়ে মাঝে মাঝেই তাকে গল্পের বই কিনে দিতেন | কিন্তু ভোর থেকে রাত অবধি সেই বই পড়ার সুযোগ তার হত না | রাতে খেয়েদেয়ে দরজা বন্ধ করে তবে তিনি বই নিয়ে বসতেন | আবার অধিক রাত পর্যন্ত জাগতে পারতেননা | সেই ভোর পাঁচটাতে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকতে হবে | বাড়িতে শ্বশুর , শ্বাশুড়ি , বিধবা বড় ননদ , দেওর-- আর তার উপর অতিথি তো লেগেই আছে |  

  স্বামী করতেন সরকারি চাকরি | সুদূর বর্ধমান থেকে তিনি ধর্মতলা নিত্য যাতায়াত করতেন | তাই তিনি সকাল সাতটাতেই বেরোতেন | শ্বশুরমশাই আটটায় টিফিন করতেন , দেওরের কলেজের ভাত দশটাতে দিতে হত , শ্বাশুড়িমা পূজার্চনা করে সাড়ে দশটা থেকে এগারোটাই টিফিন করতে আসতেন | ওই সময় তিনি টিফিনের সাথে চা ও খেতেন | পুজো না করে তিনি কিছু খেতেননা | আর বিধবা ননদ মুড়ি , চিড়ে কিছু একটা খেয়ে নিতেন আর দুপুরে নিরামিষ তরকারির সাথে ভাত | এমনিতে তার কোন চাহিদা ছিলোনা | শ্বাশুড়ি ছাড়া অন্য সকলে তাদের সময় মত খাবার পেয়ে গেলে কেউ তেমন মুখ ঝামটাও কখনো দেয়নি অচলাকে | কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে শ্বাশুড়ি বসে থেকেই তার কাজের খুদ ধরে গালমন্দ করতেন | কেউ তার মুখের উপর কোন কথা বলতো না | এমনকি তার শ্বশুরমশাইও না | 

 ছেলের বয়স তখন দশ বছর | একদিন রাতে শিবপ্রসাদ ঘুম থেকে জেগে দেখেন অচলা গল্পের বই পড়তে পড়তে টেবিল লাইট জ্বালিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে | তিনি তাকে ডেকে এনে খাটে শুতে বলেন | আর সেদিনই মনেমনে প্রতিজ্ঞা করেন একটা বাড়ি তিনি কলকাতা শহরে কিনবেই যেভাবে হোক | আর সেখানে তিনি তার ছেলে বৌকে নিয়ে থাকবেন | তাই ছাড়া এই সংসারে অচলা কোনদিনও একটু বিশ্রাম পাবেনা | ছেলের মাধ্যমিকের আগেই তিনি এ ব্যবস্থা করেন | তবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে শুনে তাকে ত্যাজ্য পুত্র করা হয়েছিল |

 অতীশ মায়ের ঘরে ঢুকে দেখে মা গ্যাসে ভাত চাপিয়ে ঠাকুরঘরে চোখ বন্ধ করে বসা | মাকে তার খুব প্রবিত্র মনে হচ্ছিলো | সে কোন শব্দ না করে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে | ইতিকা রাতের চড়ের কথা ভুলে গিয়ে দৌড়ে তার কাছে এসে জানতে চাইলো ,

--- কিছু স্বীকার করলেন উনি ?

 অতীশ সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে স্নান করতে বাথরুমে ঢুকে গেলো | খাবার টেবিলে স্বামীকে খেতে দিয়ে বললো ,

--- তুমি যদি এর ব্যবস্থা না করো আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো |

--- তাই যাও | তোমার এই নিত্য অশান্তি আমার ভালো লাগছেনা | আমিও দেখবো ভায়ের সংসারে তুমি কতদিন থাকতে পারো | তোমার মা ই তো আছেন সেই পরগাছার মত ---

 কথা শেষ হয়না অতীশের | হঠাৎ ইতিকা বলে ওঠে ,

--- আমার মা অন্তত তোমার মায়ের মত দুশ্চরিত্রা মহিলা নন |

 অতীশ রেগে গিয়ে খাবারের থালা ছুড়ে ফেলে দিয়ে না খেয়েই জামাকাপড় পরে বাড়ি থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে |


 অফিস যাবে বলে বাসস্ট্যান্ডে এসেও কি মনে করে সে একটি থামের আড়ালে লুকিয়ে থাকে | একটু পরেই সে দেখতে পায় মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে চলেছেন | সেও একটি রিক্সা নিয়ে মাকে অনুসরণ করতে থাকে | অনেকটা পথ এসে রিক্সা থামে 'অরফান চাইল্ড হোম'- নামে একটি সংস্থার সামনে | ভাড়া মিটিয়ে মা এগিয়ে চলেন | আর অতীশ মায়ের পিছন পিছন | মা একটি বড় হল রুমে ঢুকে যান | অতীশ দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখে প্রায় জনা পঞ্চাশেক বাচ্চা মাকে দেখতে পেয়েই বড়মা বড়মা করে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরেছে | যারা মায়ের কাছে এগোতে পারছেনা মা তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে | আর প্রতিটা বাচ্চাকে পরম মমতাই আদর করে চলেছেন | কেউ কেউ কোলে উঠার বাইনাও করছে | মা তাদের কোলে তুলে অনর্গল তাদের সাথে বকবক করে চলেছেন | সে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে আসে | চোখটা একটু ঝাপসা হয়ে এসেছিলো | রুমাল বের করে চোখদুটো মুছে একটা রিক্সা ধরে বাড়িতে এসে ইতিকাকে তাড়া দেয় রেডি হয়ে নেওয়ার জন্য | মা রোজ কোথায় যায় সেটা তাকে সে দেখাতে চায় | ইতিকাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি | আর সেখানে পৌঁছে সব দেখে তো 'থ' | তার মুখে কোন কথা নেই | কিন্তু অচলাদেবী তাদের দুজনের কাউকেই দেখতে পাননা | কারণ তিনি বাচ্চাগুলিকেই নিয়ে ব্যস্ত | ওরা এসে অফিস রুমে ঢোকে | আর সেখানে এসে যা শোনে তাতে তারা দুজনেই আরও 'থ'- হয়ে যায় | এই সংস্থাটি নাকি অতীশের বাবার নিজহাতে তৈরী | প্রতিমাসে তিনি এখানে মোটা অঙ্কের টাকা দিতেন | পরবর্তীতে বাচ্চাদের সংখ্যা বেরে যাওয়ায় সেই টাকাই যখন সংকুলান হচ্ছিলোনা তখন কিছু মানুষের কাছ থেকে মাসিক অর্থ সাহায্য নেওয়া হত | মোটামুটি চলে যাচ্ছিলো | কিন্তু হঠাৎ শিবপ্রসাদবাবুর মৃত্যুতে আবার অথৈ সমুদ্রে পরে সংস্থাটি | এদিকে বাচ্চার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ | তখন অচলাদেবী তার সমস্ত গয়না এনে সংস্থাটির হাতে তুলে দেন | আর নিজে এসেও যোগদান করেন কারণ নুতন লোক রাখলে  আবার তাদের মাইনে দেওয়ার ব্যাপার আছে | 

 সব শুনে স্বামীর সাথে মাথা নিচু করে ইতিকা বেরিয়ে আসে | বেশ কয়েকবার অতীশের কাছে সে ক্ষমা চেয়েছে | কিন্তু অতীশ কোন উত্তর দেয়নি | মাইনে পেয়ে সংসার চালানোর খরচ ইতিকার হাতে দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে সে মায়ের ঘরে ঢোকে | পিছন পিছন ইতিকাও ওঠে | মা ছেলেকে দেখতে পেয়ে কাছে ডেকে নেন | অচলাদেবী তখন একটি গল্পের বই পড়ছিলেন | তিনি সেটিকে পাশে সরিয়ে রেখে বলেন ,

--- আমায় কিছু বলতে এসেছিস বাবা? নাকি রোজ আমি কোথায় যাই সেটা জানতে এসেছিস ?

 অতীশ একটা টাকার বান্ডিল বের করে মায়ের সামনে ধরে বলে ,

--- এটা রাখো মা |

--- কিন্তু আমি তো বহুবার বলেছি তোর বাবার পেনশনেই আমার ভালোভাবে চলে যায় | এ টাকার আমার কোন দরকার নেই তো |

--- আমি জানি মা তোমার এ টাকার কোন দরকার নেই কিন্তু ওই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর তো দরকার আছে | এখন থেকে প্রতি মাসেই কিছু টাকা আমি তোমায় দেবো আর তুমি ওই বাচ্চাগুলোর জন্য সেই টাকা খরচ করবে |

--- কিন্তু তুই এসব জানলি কি করে ?

--- সেসব থাক | কিন্তু তুমি আমায় বলতো এটা তো ভালো কাজ তবে আমায় কেন লুকিয়ে গেলে ?

--- তোর বাবা কিছু মানুষের সহায়তায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে প্রথমে এটা চালু করেন | তখন আমিও জানতামনা | তারপরে অবশ্য তিনি আমায় সব খুলে বলেছিলেন | মৃত্যুর আগে আমায় প্রায়ই বলতেন উনার কিছু হয়ে গেলে আমি যেন সংস্থাটি দেখাশুনা করি | তিনি চলে যাওয়ার পর সংস্থাটি  মুখ থুবড়ে পড়েছিল | কিন্তু এখন অনেক মানুষ এগিয়ে এসেছে | অর্থ সাহায্যও করছে অনেকে | সরকারি কিছু অনুদান পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে | ওখানে গেলে আমি খুব ভালো থাকি | তাই তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই আমিও ওখানে চলে যাই | বাচ্চাগুলোর সাথে সময় কাটালে মন আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায় | আমি জানি বৌমার এই নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে আমি কোথায় ---

 কথা শেষ হয়না | এতক্ষণ ইতিকা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল এবার সে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে মায়ের সামনে হাত জোর করে বললো ,

--- আমার অন্যায় হয়ে গেছে মা , ক্ষমা করে দিন | আমিও কাল থেকে আপনার সাথে ওখানে যাবো | ওদের সাথে সময় কাটাবো | আমি তো একা একাই সারাদিন বাড়িতে থাকি | আমায় নিয়ে যাবেন তো মা ?

--- সে তোমার ইচ্ছা হলে তুমি যেতেই পারো | তবে একটা কথা তোমায় আজ না বলে পারছিনা --- মানুষের বাইরেটা দেখে তাকে কখনো বিচার করতে যেওনা | তুমি যেসব কথা অতুকে বলতে বা আমি  বাড়ি থাকাকালীন সময়ে ফোনে আত্মীয়দের আমার সম্পর্কে বলতে সবই আমার কানে আসতো | খুব একটা আস্তে কথা তো তুমি বলোনা ---- ইচ্ছা করলে আমি সব কথার উত্তর দিতে পারতাম | কিন্তু আমার রুচিতে বেঁধেছে | 

 ইতিকা শ্বাশুড়ীর পায়ের উপর পরে বলে ,

--- অন্যায় করেছি মা , ক্ষমা করে দিন |

--- ও অতু তাহলে কি কাল থেকে বৌমাকে সাথে নিয়ে যাবো ?

--- হ্যাঁ মা , আমিও তাহলে কিছুটা রেহাই পাবো |

 কথাটা বলেই বৌয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে | আর ইতিকা তখন চোখের জল মুছে চলেছে | 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama