Sharmistha Mukherjee

Drama Romance Tragedy

3  

Sharmistha Mukherjee

Drama Romance Tragedy

আত্মার আত্মীয়

আত্মার আত্মীয়

6 mins
167



 

বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে অঝোরে কাঁদছে রিমা । সামনে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হচ্ছে অসুস্থ নীলাম্বরকে । হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিলে রিমা ও ছুটতে শুরু করে । কিছুটা গিয়ে রাস্তায় পড়ে মূর্ছা যায় । রাস্তার লোকেরা ধরাধরি করে রিমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় । প্রায় ৩ ঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে । জ্ঞানস্থ হতেই আবার চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । 


রিমার পুরো নাম মধুরিমা । বেশ মিষ্টি চেহারা, হরিণের মতো চঞ্চলা - চপলা , মিষ্ট

ভাষী । বয়স মাত্র ২৬ । অন্যদিকে নীলাম্বরের তখন ৫০ বছর বয়স । একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করতো । নীলাম্বরের পরিবার বলতে স্ত্রী এবং ১৫ বছরের এক ছেলে । স্ত্রী যুথিকা ছিলো খুব মুখরা ও দাপুটে । আর ছেলে সৌম্য মায়ের বাধ্য সন্তান । এদের দুজনেরই নীলাম্বরের সাথে শুধুই টাকার সম্পর্ক, মনের সম্পর্ক নেই বললেই চলে । তাই স্ত্রী - পুত্রের কাছ থেকে অবহেলিত হতে হতে তিনি খুব একাকী, মনমরা হয়ে গিয়েছিলো । অফিসে কারো সাথে বিশেষ বার্তালাপ ছিল না । নিজেকে যেন কেমন শামুকের মতো খোলসের আড়ালে লুকিয়ে রাখতো , যার বাইরেটা ছিল কঠিন কিন্তু ভিতরটা নরম তুলতুলে । 


একদিন lunch time - এ ক্যান্টিনে একটি মেয়ে হঠাৎ করে এসে পাশে দাঁড়ায়, " একটু বসতে পারি ? " আচমকা প্রশ্নে কেমন যেন হকচকিয়ে যায় নীলাম্বর । " হ্যাঁ হ্যাঁ Please " । মেয়েটি বলে, " Hello Sir, I'm Madhumita Sanyal " । নীলাম্বর বলে, " হুমমম ! নমস্কার " । খানিক চুপ থেকে মেয়েটি বলে, " আপনি আমাকে " রিমা " বলে ডাকতে পারেন " । এককথায় দুকথায় মেয়েটির সাথে পরিচয় জমে ওঠে । বোধহয় একটু বিরক্ত হচ্ছিলো নীলাম্বর, " মেয়েটি বড্ড বেশি কথা বলে, উফ্! " বলে উঠে চলে যায় । খুব অবাক হয়ে যায় রিমা । পরে আর কথা বলতে সাহস পায়নি । পরের দিন lunch time- এ একই ঘটনা । এভাবে বেশ কয়েক দিন চলতে চলতে, রিমার ননস্টপ বকবক শুনতে শুনতে নীলাম্বর ও অনেকটা সাবলীল হয়ে ওঠেন । নীলাম্বর একদিন বলে, " Please don't call me Sir, say Nilamber " । রিমা বলে, " But Sir, আপনি তো আমার থেকে অনেক বড়ো, তাহলে আমি কি করে আপনাকে নাম ধরে ডাকবো ? " তখন নীলাম্বর জানায় " বন্ধুত্বের মধ্যে বয়সের ফারাক কোনো matter না, বন্ধুত্বই আসল । So u can call me Nilamber " । 


রিমা আর নীলাম্বর এর বন্ধুত্ব যতো দিন যেতে থাকে ততোই নিবিড় হয়ে ওঠে । এক সুন্দর, সাবলীল মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ধীরে ধীরে পরিণত হয় সুগভীর ভালোবাসায় । রিমা কখন যেন নীলাম্বরের শুণ্য - একাকী মনটাতে রাঙা আবীর ছড়িয়ে রাঙিয়ে তুলেছে । স্ত্রী - পুত্রের অবহেলায় পর্যবসিত হয়ে যে হৃদয় রঙ হীন হয়ে গিয়েছিল , রিমার হঠাৎ আগমনে আবার তা হয়ে উঠেছে সাতরঙা রামধনু । রিমার কথা , প্রাণোচ্ছল হাসি, মর্মস্পর্শী হৃদয়, শিশুর মতো নিষ্পাপ মন নীলাম্বরের মনে প্রবলভাবে সাড়া ফেলে দেয় । 


রিমা ও নীলাম্বরের সম্পর্ক ধীরে ধীরে পদার্পণ করলো এক বছরে । এই এক বছরে ওদের আত্মা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে । যেখানে শুধুই মানসিক পরিতৃপ্তি , আর্থিক বা দৈহিক কোনো চাহিদার সৃষ্টিই হয় নি । তাই শুধুই আত্মার সাথে আত্মার কঠিন বন্ধনে ওরা হয়ে ওঠে " আত্মার আত্মীয় " । দুজনে দুজনকে অদ্ভুত ভাবে বুঝতে পারতো । কার কখন কী দরকার ? কি সমস্যা ? মন খারাপ না ভালো ? চিন্তায় আছে না চিন্তামুক্ত ? একে অপরকে দেখেই বুঝতে পারতো । দুজনেই প্রাণে - মনে সকালের অপেক্ষায় থাকতো কারণ রাত্রিটুকুই ওদের মধ্যে ব্যবধান আর সকাল হলেই আবার অফিস , আবার দেখা । এক কথায় বলা চলে, বয়সের ফারাক প্রায় ২৪ বছরের হলেও দুজনের আত্মা কিন্তু সমবয়সী । একে অপরের পরিপূরক । একটা অবিচ্ছেদ্য আত্মিক বন্ধন ছিল তাদের । দুজনেই ছিল একে অপরের মন খারাপের ওষুধ , হাসি - মজা - গল্পে মন খারাপ just vanish । 


কিন্তু হঠাৎ একটা গোটা দিন নীলের কোনো খবর নেই । ও : ! অবাক হচ্ছেন , এই নীলটা আবার কে ? নীল আর কেউ নয়, রিমা নীলাম্বরকে ভালোবেসে " নীল " নামে ডাকতো । রিমা সোজা গিয়ে উপস্থিত হয় নীলের বাড়ির সামনে, কিন্তু নীলের মুখরা স্ত্রীর ভয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে সাহস পায় না । অস্থির রিমা আচমকাই দ্যাখে বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামলো । মিনিট কয়েকপর স্ট্রেচারে করে বাড়ির ভিতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে মূর্ছিত নীলকে । আশেপাশের লোকজনের মুখে শোনে, গতকাল ভোর রাতে হার্ট অ্যাটাক করেছে নীলাম্বর । বাঁচবে কিনা ঠিক নেই। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল রিমার । রাস্তায় বসেই হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো , তারপর ছুটতে শুরু করলো অ্যাম্বুলেন্সের পিছন পিছন । কিছুটা গিয়েই পড়ে গিয়ে মূর্ছা যায় । প্রায় ৩ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলে কাঁদতে কাঁদতে আবার সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে । দুদিন পরে জানতে পারে নীলাম্বর পরলোকগত হয়েছে । শোকে কেমন যেন পাথর হয়ে যায় । রিমার বাবা - মা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না ,তাদের একমাত্র সন্তানের কি হোলো ? ওনাদের সম্বিৎ ফিরলো যখন রিমা সাদা থানে বিধবার বেশে সামনে এসে দাঁড়ায় । সে আর রঙিন কাপড় পরে না , আর সাজগোজ করে না , কারো সাথে কথা বলে না , হাসে না এমনকি কাঁদেও না । জীবনটা যেন সাদা - কালোর ক্যানভাস । 


কিন্তু কি আশ্চর্য জানেন ! রিমা নাকি নীলকে দেখতে পেতো, ওর স্পর্শ অনুভব করতে পারতো, দীর্ঘক্ষণ একা একা একদিকে তাকিয়ে খুব কথা বলতো- হাসতো যেন সব ঠিক হয়ে গেছে । কেউ কিছু বললেই বলতো , " নীল এসেছিল, আমিতো নীলের সাথেই গল্প করছিলাম। " খুবই হতাশ হয়ে পড়ে রিমার বাবা - মা । ওনারা রিমাকে একজন ভালো Psychiatrist ( মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ) দেখান । মনের চিকিৎসা শুরু হলো কিন্তু নীলের মৃত্যুর পর দুমাস কিছু গেল রিমার অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটলো না । সারাদিন একা একা হাসতো, কথা বলতো আর একটা ডায়েরিতে যেন কী সব লিখতো । হঠাৎ করে একদিন রাতে সজোরে কিছু পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রিমার বাবা - মায়ের । রিমার মা বলে, " শুনছো শব্দটা

মামণির ঘর থেকে এলোনা ? চলতো দেখি ? " দুজনেই ছুটে এসে রিমার ঘরের দরজা খুলেই আৎকে ওঠে । রিমার মা চীৎকার করে ওঠে, " মামণি, মামণি তুই এটা কি করলি মা ? কেন করলি ? একবারও আমাদের কথা ভাবলি না ? এখন আমি আর তোর বাপি কি নিয়ে বাঁচবো ? তুই ফিরে আয়,মারে ফিরে আয় । "


রিমার বাবা লক্ষ্য করে কি অদ্ভুত!! ঝুলন্ত মেয়ের ঠোঁটের কোণায় কি সুন্দর সাবলীল হাসি, যেন তৃপ্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে । নিজের পরণের কাপড় খুলে সিলিং ফ্যানের সাথে বেঁধে আত্মহত্যা করেছে রিমা । পরণে শুধু লাল ব্লাউজ ও লাল সায়া , সিঁথি ভর্তি রাঙা সিঁদুর , হাতে শাঁখা- পলা , গলায় রজনীগন্ধার মালা পরিহিতা নববধূ । 


ডায়েরিতে নীলাম্বর সম্বন্ধে অনেক কথা লেখা ছিল । রোজ কাল্পনিক নীলের আত্মার সাথে যা কথা হোতো সব লিখে রাখতো রিমা । মৃত্যুর আগেও লিখে রেখে গেছে, " মা - বাপি আমি আর নীল বিয়েটা করেই ফেললাম । বিয়ের পর তো সব মেয়েকেই শ্বশুর বাড়ি যেতে হয় বলো ? কিন্তু আমার নীল যে ইহলোকে থাকে না তাই আমি ওর হাত ধরে পরলোকে চললাম । আমি যে নীল ছাড়া অসম্পূর্ণ , আমার আত্মা যে নীলের কাছেই রয়েছে সেই কবে থেকে । আর আমাকে যে তোমরা দেখেছো ওটা আমার পার্থিব দেহের খোলস মাত্র । আমি শ্বশুর বাড়িতে চললাম , তোমরা সাবধানে থেকো, ভালো থেকো কিন্তু । "


আজ ও রিমার ঘরের দেওয়ালে রিমা আর নীলের ছবি আছে মালা পরিহিত । অন্যদিকে নীলাম্বরের স্ত্রী - পুত্র বহাল তবিয়তে আছে । টাকা-পয়সার তো কোনো অভাব ছিল না , অভাব ছিল শুধু আত্মিক যোগের । 


স্বল্পদিনের পরিচয়ে মধুরিমা ও নীলাম্বরের আত্মিক মেলবন্ধন দৃষ্টান্ত রেখে গেছে । সত্যিই ওদের আত্মা অবিচ্ছেদ্য , বন্ধনহীন বন্ধনে আবদ্ধ । হয়তো পরলোকে দুজনের আত্মা আজ পরিতৃপ্ত । 

    

    



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama