আশ্রয়
আশ্রয়
১
বাজারের ব্যাগটা রেখে হাঁফিয়ে যান সুমন, পাখাটা চালিয়ে দিয়েছে করবী, বসেন কিছুক্ষণ, করবীর হাত থেকে জলের গেলাস নিয়ে খেয়ে একটু সুস্থির লা“তিনতলায় ফ্ল্যাট নেওয়াটা বোধহয় ভুল হয়েছে গো কবি, বয়স হচ্ছে এখন বুঝতে পারি, তখন ঝোঁকের মাথায় কিনে ফেলেছিলাকরবী ভ্রুকুটি করেন,
“আজকাল প্রতিটি কথায় তুমি বয়স বয়স করো কেন, সেই রিটায়ার করার দিন থেকে এই দুমাস তোমার মুখে একই কথা। সবে তো ষাট, আমি পঞ্চান্ন খুব কি বুড়োবুড়ি আমরা? দেখে তো সবাই বলে তোমাদের কি ইয়ং লাগে, বোঝাই যায় না দাদা রিটায়ার করেছে, করবীদি এই বয়সেও কি ফিগার, তোমরা দারুণ গ্ল্যামারাস, মেড ফর ইচ আদার“ "সেতো বাইরে কবি, আর ভিতরে?”
অবাক হন করবী, “কি ভিতরে?”
“এই যে তিনতলা উঠতে হাঁফিয়ে যাই আজকাল, প্রোস্টেট সমস্যা কি বেড়েছে, বাথরুম যেতে কান্না পায় দুটোর বেশি তিনটে সিগারেট খেলে কাশির চোটে রাতে ঘুম ভেঙে যায় সেসব তো বাইরে থেকে জানে না কেউ। আর তুমি কবি, রোজ সকালে ব্যাথায় বলো শরীর নাড়াতে পারো না, অত চুল ছিল তোমার এখন মাথা ফাঁকা, যতই কায়দা করে কাটো রঙ করো আর ফাঁপিয়ে রাখো। যতই আমরা জিন্স পরি, চুল রঙ করি, হেসে প্রমাণ করি আমরা একদম ফিট, কিন্তু মনে তো জানি ভিতরে তো জানি আমরা আগের মত“
"এই তোমার দোষ সুমন, আরে বয়স বেড়েছে কিছু সমস্যা তো আসবেই সেটা কি আর করা যাবে, কিন্তু তুমি এমন ভাবে বলো না মনটাই খারাপ হয়ে যায়, দূর। নাও খেয়ে নাও আজ ওটস করেছি চিকেন দিয়ে, আমি বরং গান শুনি একটু। তুমি খালি একই কথা বলে যাও গলাটা কেমন ধরে আসে সুমনের,
“বড্ড চিন্তা হয় কবি আজকাল, দুজনে তো একসাথে যাবো না, কেউ আগে কেউ পরে, তখন আরেকজনের কি হবে!”
“কেন ভাবো এত, যা কপালে আছে তাই হবে গো, কেউ তো নেই আমাদের যে দেখবে, এত তো চেষ্টা করেছিলাম আমরা ডাক্তার ওষুধ সবই তো হোল। তোমার মায়ের কথায় জলপড়া তেলপড়াও করেছি, মাদুলি শিকড় ব্রত কিছুই বাদ রাখিনি। কি লাভ হোল! নতুন নতুন ডাক্তারের কাছে গেছি আশায় বুক বেঁধেছি, তারপর প্রতি মাসে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েছি, কারুর নাকি কোন দোষ নেই আমাদের তবুও সন্তান যা ফুটপাথের ভিখারিরও কোল জুড়ে আসে, আমার কোলে এলনা, আমার কপালের দোষ আর কি বলবো। কেন মনে করাও এসব? কেন“যাকগে কি কথায় কি এল, আমি কখন এই সব বললাম। যাও তুমি গান শোনো। জলখাবার খেয়ে বেরোব বুঝলে, আর দু রবিবার পরেই পুজো, বাপিদা কাজল সব বসে আছে। আমি গেলেই একসাথে বেরোবে, আজ চাঁদা তোলা শেষ করতেই হবে। পুজো তাড়াতাড়ি এবার, সব কাজই বাকিএবার হেসে ফেলেন করবী,
“হুম তুমি তো পাড়ার পুজো নিয়ে ইদানীং যা মাতামাতি করো।”“কিছু নিয়ে তো মেতে থাকতে হবে গো, সময়টা কাটবে কি করে আর তুমি যে পুজোর কটাদিন সারাদিন প্যান্ডেলে কাটাবে, সকাল দুপুর সন্ধ্যে শাড়ি পাল্টাবে! হাহাহা তোমরা মেয়েরা পারো বটে।”
“সত্যি কটাদিন বড্ড ভালো কাটে, নতুন নতুন শাড়ি পরে আড্ডা গল্প,ছবি তোলা তারপর বরণ করেই মন খারাপ। আর কি। বিকেলে দর্জির দোকান থেকে ব্লাউস গুলো আনতে যাবো। জানো একটা কথা জানলাম, মানি মাসীমাকে মনে আছে? মানসী গাঙ্গুলি ওই সুহৃদ সেনের বাড়িতে অনেকদিন ভাড়া থাকতো ওরা, বছর চার পাঁচ আগে নিজেরা বাড়ি করে চলে যায়, কি গো সব ভুলে যাও কে“কে মানি মাসীমা মনে নেই, তা হঠাৎ তার কথা কেন বলো তো?”
“তুমি সেদিন বললে না, কনকতলার মোড়ে মুখোমুখি দুটো বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে শান্তি নিবাস আর শেষের তরী বলে মনে আছে?”“শান্তি নিবাস আর শেষের খেয়া, হ্যাঁ হয়েছে তো, তাই কি?”
“বিকেলে যখন আমরা হাঁটতে বেরোই,কাল ভাবলাম কনকতলার দিকে যাওয়া যাক, বৃদ্ধাশ্রমদুটো একটু দেখার ইচ্ছে ছিল,তা গিয়ে দেখি, ওই শেষের কথা না কি যেন, তার বাইরের বারান্দায় মানি মাসীমা বসে।“শেষের কথা কেন হতে যাবে! দূর কি যে বলো, শেষের খেয়া। মানি মাসীমা ওখানে কেন, ওনার ছেলে মেয়ে কজন?”“তিন ছেলে তো, মন্ত্র, ওংকার আর ভক্তি বলে, ওই ভক্তি তো কবিতা লিখতো আর ওংকার তোমাদের সাথে রাতে ব্যাডমিন্টন খেলতো, পুজোয় খুব ধুনুচি নাচতো, মনে নেই?”
“ও, মনে পড়েছে বুঝেছি এবার, কিন্তু ওরা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়েছে কেন, ওদের অবস্থা তো বেশ ভালই ছিল বাড়ি করেছিল কদমতলার দিকে।“মানি মাসীমার চেহারা একদম ভেঙে গেছে, কথা বললাম, বললেন তো ভাল আছেন কিন্তু বিশ্বাস হয় না, খুব কষ্ট হোল।”
“হুম। চলো বেরোই এবার, ওরা বসে আছে, ফিরতে বেলা হবে তুমি খেয়ে নিও।”
“আচ্ছা।”
২
পুজোর আর সাত দিন বাকি, ক্লাবের মিটিং এ বসে আনমনা হয়ে গেছিলেন সুমন, প্রেসিডেন্ট নিমাই রায় বুড়ো হয়েছেন প্রায় আশি, বলার সুযোগ পেলে থামতেই চান না, আজও বকবক করে যাচ্ছেন বিষয় বস্তু পুজোর ঐতিহ্য। এমন সময় তার ফোনটা বাজল। করবীর ফোন। বাইরে এসে ফোন ধরতে করবীর উত্তেজিত গলা কানতুমি সবাইকে নিয়ে এখনই শেষের সেদিনে চলে এসো, এখানে যা তা চলছে আমি প্রতিবাদ শুরু করেছি, কিছুতেই ছাড়বো না। সুমনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে গেলো। ফিরে ফোন করলেন, করবী তুললো না। মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলেন না সুমন। শেষের সেদিন মানে, বোধহয় ওই বৃদ্ধাশ্রম শেষের খেয়া, বেরোনোর সময়ে বলেছিলো বটে আজ একবার মানি মাসিমার সাথে দেখা করতে যাবে সেখানে আবার কিসের প্রতিবাদ, করবী কি করতে পারে, তিনিই বা কাদের নিয়ে সেখানে যাবেন। মিটিং এ ফিরে এসে অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলেন, নিমাই রায় এখোনো বকে চলেছেন। বেশিরভাগ সদস্য মোবাইলে ব্যস্ত। এমন সময়ে রাজা দুমদাম করে ক্লাব ঘরে ঢুকে এলো।
আরে আপনারা কি মিটিং করছেন শিগগির টিভি খুলুন, কনকতলার বৃদ্ধাশ্রমে পুলিশ এসেছে, রাস্তা অবরোধ হয়েছে, খবর রাতদিন এ দেখাচ্ছে।
ক্লাবের টিভিটা নতুন, চালাতেই ব্রেকিং নিউজ। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের রাস্তা অবরোধ, ওই রাস্তায় বাস অটো কিছুই চলছে না। সার দিয়ে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা রাস্তায় বসে আছেন। মহিলা সাংবাদিক কার মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরেছেন। হতবাক সুমন দেখলেন সেটা করবী। করবীর মুখ লাল জোরের সাথে কথা বলছেআপনারা ভাবতে পারেন, এই বৃদ্ধাশ্রমে প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি দিয়ে এই মানুষগুলো থাকতে এসেছিলেন, মাসে মাসেও এরা তিন হাজার টাকা করে দেন অথচ এরা ঠিকমত খেতে পান না। ভর্তির সময়ে যেমন বলা হয়েছিল সেরকম কোন খাবারই এরা পান না। অসুস্থ মানুষগুলোকে ঠিকমত ডাক্তার দেখানো হয় না। প্রতিবাদ করলে জোটে মারধর, অবাক হবেন না, এখানকার আবাসিক পঁচাশি বছরের এক মহিলা পেচ্ছাপ বাহ্যি করে ফেলেছিলেন কাপড়ে সেই অপরাধে এখানকার আয়া তার হাত মুচড়ে দেন, শুধু তাই নয় রাতে তার খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না তাহলে তাদেরও মার খেতে হয়। মানসী গাঙ্গুলি প্রতিবাদ করেছিলেন বলে চুলের মুঠি ধরে তাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করা হয়েছে। এদের ছেলে মেয়েরা টাকা পাঠিয়ে খালাস, কেউ কোন খোঁজ নেয় না, এরা বলতে গেলে শোনে মানিয়ে নেবার কথা, চুপ করে থাকার কথা। আজ তাই এরা রাস্তা অবরোধ করেছেন, সবাই শুনুক এদের কথা, এরা আমার বাবা মাকরবী আরো কত কথা বলছে, শুনতে শুনতে ক্লাবের সবারই রক্ত গরম হয়ে উঠলো। তখনই রওনা হলেন সবাই কনকতলার দিকে। পৌঁছে দেখা গেলো ভিড়ে ভিড়। আরো অসংখ্য নিউজ চ্যানেল চলে এসেছে,প্রচুর পুলিস। একজন সিনিয়র অফিসার করবী আর মানসী গাঙ্গুলির সাথে কথা বলছে। সুমনও এগিয়ে গেলেন। হাতজোড় করে অফিসারটি বলছেন, আমি বুঝতে পারছি আপনাদের কথা, এই বৃদ্ধ মানুষগুলোকে ভিতরে নিয়ে যান, অবরোধ তুলে নিন আপনারা থানায় আসুন, আমরা এফআইআর লিখে নেবো, সব আবাসিকদের এজাহার নেবো, মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, দয়া করে অবরোধ তুলে নিন, সবার অসুবিধেসবাইকে ভিতরে নিয়ে যাবার পরে সুমন, করবী, নিমাই রায়, রাজা, মানসী গাঙ্গুলি এবং আরো দু এক জন পুলিসের গাড়িতেই থানায় গেলেন। এফআইআর লেখা হোল। উত্তেজিত করবী ডিউটি অফিসার সুকোমল রায় কে বলল শেষের কবিতার মত জায়গা সেখানে কোথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান শোনানো হবে তা নয়, মারছে, গালাগালি দিচ্ছে, ওদের কড়া চার্জ দিন তো। সুমন তাড়াতাড়ি বলেন না না অফিসার ও শেষের খেয়ার কথা বলছে, নামটা ভুল করছে, কিন্তু অপরাধ গুরুতর, দেখ বৃদ্ধাশ্রমের মালিক তিলক সেন থাকেন চেন্নাইতে তাকে ফোন করে ডাকলো পুলিস, তিন দিনের মধ্যে তিনি আসবেন জানালেন, কিছুই নাকি জানতেন না এখানে কি হচ্ছে।সব মিটিয়ে বাড়ি ফিরলেন দুজনে বেলা তিনটের পরে। রান্না হয়নি, করবী খুব ক্লান্ত। সুমন প্রেসার কুকারে একটু সেদ্ধ ভাত বসিয়ে দিলেন। চারটের পরে খেয়ে উঠে করবীকে বললেন "এসিটা চালাই, একটু বিশ্রাম নাও...
হ্যাঁগো তুমি রাগ করেছো আমার ওপরে? এই যে হঠাৎ কি সব করলাম।"
"রাগ করবো? কি যে বলো, তোমাকে যে নতুন করে চিনছি কবি।"
জানো মানসী মাসিমা কে কিভাবে মেরেছে ওরা, মাসিমা ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে পাস করা, কত সুন্দর গান করতেন, তিন ছেলেকে মানুষ করার পরে আজ তার এই অবস্থা! নতুন বাড়িতে জায়গা হয় নি। আর সহ্য হোল না ভাবতে অবাক লাগে কবি।
তুমি সেদিন বললে ভবিষ্যতে হয়তো তুমি বা আমি এরকমই কোন আশ্রয়ে থাকবো তখন কে বলবে আমাদের হয়ে? কারোর তো প্রতিবাদ করা উচিৎ তাই নাদেখো কবি সারাজীবন তুমি দুঃখ করেছো আমাদের সন্তান নেই বলে, আজ এদের দেখে বুঝতে পারলে তো সন্তান থাকলেই সব হয় না।
ঠিক বলেছো, আজ ওরা সবাই যখন আমাকে মা বলে সম্বোধন করলো আমার খুব ভালো লাগলো জানো।
হুম জানি, একটু ঘুমোও এবার আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।সুমনের কোলে মাথা রেখে কবি ঘুমিয়ে পড়ে।
চেয়ে চেয়ে খুব গর্ব হয় সুমনের, চিরকালের গৃহবধূ কবি এমন একটা কাজ করলো আজ, চোখের কোণটা মুছে নেন তিনি। তাকিয়ে দেখেন ঘুমন্ত কবির মুখটা মাতৃত্বের আভায় উজ্জ্বল।
