আমাদের দেওঘর যাত্রার অভিজ্ঞতা
আমাদের দেওঘর যাত্রার অভিজ্ঞতা
(3)
দেওঘরে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম রয়েছে ।পরদিন আমরা সেখানেই গেলাম। খুব সুন্দর জায়গা। ছোটবেলায় বাবা মায়ের সাথে এখানে এসে একটা চিড়িয়াখানা দেখেছিলাম। সেটা আর খুঁজে পেলাম না।তবে পোষ্য দু একটা খরগোশ, কিছু পাখি, ছাগল, গরু এসব রয়েছে। মন্দিরটা ভারি সুন্দর। আশ্রম দেখতে যারা আসেন এখানে, দুপুর বেলায় তাদের সকলকে ভোগ খাওয়ানো হয়। দেখি বিশাল লাইন পড়েছে। আমরা আর ভোগের লাইনে দাঁড়ালাম না। কারণ মেয়েটাকে তখনও বাইরের খাবার দেওয়া হত না।আমরা খাবো, আর ও বেচারা খেতে পারবে না। তাই সরে গেলাম ওখান থেকে। এইখানে একটা কান্ড ঘটল। আশ্রমের গাছে একটা লাল টুকটুকে মস্ত গোলাপ ফুল দেখে বায়না জুড়ল রুমন (আমার মেয়ের নাম রুমন। এবার থেকে ওর নামটাই উল্লেখ করবো। নাহলে খুব অসুবিধা চ্ছে) । ওটা ওর চাই। কি করে দিই ।গাছে হাত দেওয়া মানা লেখা রয়েছে। কিন্তু ওর তো চাই ওই ফুল। পাওয়া গেল না বলে বাবার কোল থেকে নেমে পড়ে হাঁটতে শুরু করল। আশ্রমের ভেতরে মোরাম বিছানো চওড়া রাস্তা রয়েছে। সেই রাস্তা ধরে গুটগুট করে হেঁটে চলল। পড়ে গেলে তো দারুণ লাগবে। সেই ভেবে তাড়াতাড়ি আমি ধরতে গেলাম। চিৎকার করে আমার হাত ছাড়িয়ে আবার চলল। ধরতে গেলেই চেঁচাচ্ছে। ওদিকে চারদিকে লেখা রয়েছে" নীরবতা বজায় রাখুন"। কি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছিলাম ।শেষে কর্তামশাই বললেন, "ও চলুক অমনই। ওকে শুধু ফলো করতে হবে" । আমাদের পেছনে আসতে দেখে আরো জোরে হাঁটতে শুরু করল। বেশ অনেকটাই দূর থেকে ওকে অণুসরন করছি আমরা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে ওর ওপর। ওর হাতের নীল রঙের চুড়িগুলো রোদ লেগে চিকচিক করছে। শেষ দুপুরের উতল হাওয়ায় উড়ছে ওর নীল সাদা ফ্রকের প্রান্ত, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে একমাথা কোঁকড়ানো চুল। উল্টো দিক থেকে সাদা পোষাক পরা আশ্রমের দুজন সন্ন্যাসী আসছিলেন। ওনারা হঠাৎ ওর সামনে এসে পড়ায় ও ভয় পেয়ে ধুপ করে বসে পড়ল। আমরাও ছুটেছি। একজন সন্ন্যাসী ওকে কোলে তুলে নিলেন। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো ওনার মুখের দিকে। আমাদের দেখে উনি বললেন, "খুব দুষ্টু হয়েছে মনে হচ্ছে!" আমরা হাসলাম। এইবার কি মনে হতে, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হয়তো তখন রাগটা পড়ে গিয়েছিল।
আমাদের দেওঘর পর্ব এখানেই শেষ। পরদিন মধুপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আবার যশিডি স্টেশন ।ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। একটা বেলুন ওয়ালা দেখে ঝুলে পড়ল রুমন। দিলাম কিনে। বেলুন নিয়ে খুব খুশি।
ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্ট। যথেষ্ট ভীড় রয়েছে। বসার জায়গা পাইনি। রুমন কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোথাও একটা সিট খালি নেই। এমনকি, ট্রেনের মেঝেতেও গামছা, কাপড় বিছিয়ে বসে রয়েছে। আমার পেছনেই রয়েছে একটা পরিবার। একটা বৌ, তার কোলে একটা বাচ্চা, আর দুটো বছর দশ বারো হবে। ওদের দেখে অবশ্য বয়স তেমন বোঝা যায় না। দেখে ভিখারী শ্রেণীর মনে হচ্ছে। ট্রেনের মাটিতে গামছা বিছিয়ে বসে আছে। রুমন চুপচাপই ছিল।আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ দেখি কেঁদে একেবারে ককিয়ে গেল মেয়ে। কি হল! দেখি ওর হাতের বেলুনটা নিয়ে ওই ভিখারীর বাচ্চাটা খেলছে। অবাক হয়ে গেলাম। বেলুন কেড়ে নিয়েছে বলে এত কাঁদছে! সেটা তো হবে না। কারণ ও তো ঘুমোচ্ছিল। তখন ওর হাত থেকে টেনে নিলে ওর বোঝার কথা নয়। তাহলে! ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি, ওর হাতে রূপোর বালা জোড়া নেই। একটা হাত ওর লাল হয়ে গেছে। মানে জোর করে খুলে নেওয়া হয়েছে। এই ভিড়ের মধ্যেও ওই ছেলেমেয়ে দুটো বারবার যাওয়া আসা করছে। স্থির হয়ে বসছে না ওরা। তাহলে কি ওরাই করল একাজ! কাকে বলব!
বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ মধুপুর স্টেশনে নামলাম ।নরককুন্ড থেকে মুক্তি পেলাম যেন। বেশ ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম। ঝিরঝির করে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ভারি মনোরম পরিবেশ ।
মধুপুরে আমাদের একটা বাড়ি বুক করা ছিল। আমাদের নৈহাটীতে দয়াল চন্দ্র মান্নার দোকান, দীর্ঘ দিনের পুরোনো। ওদেরই একটা বাড়ি ছিল মধুপুরে। সেই বাড়ির দুটো ঘর বুক করা ছিল আমাদের। বাবা আর ভাই গেল বাড়ির অবস্থান টা দেখতে। আমি আর কর্তামশাই রয়ে গেলাম স্টেশনে। রুমন আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কর্তামশাই বললেন, প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে ওকে শুইয়ে দিতে। এতক্ষণ ধরে কোলে রয়েছে ও। আর পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিল । সাধারণত রাস্তায় ওর বাবার কোলেই থাকে ও। কিন্তু ওরা লাগেজ ক্যারি করছে। তাই আমাকে নিতে হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে কাঁথা পেতে ওকে শুইয়ে দিলাম। কর্তামশাই পায়চারি করছে। আর আমি মেয়ের কাছে বসে আছি। ওর হাতটা তখনও দেখি লাল হয়ে আছে। ঘুমন্ত মেয়েটার হাত থেকে প্রথম বালাটা সহজেই খুলতে পেরেছে। আর দ্বিতীয়টা খোলার সময়ে হয়তো জেগে উঠেছে, তখন হাতটা মুচড়ে খুলে নিয়েছে। কি আশ্চর্য! সামান্য দুটো রূপোর বালা, অন্নপ্রাশনে পাওয়া। ওই বালাগুলো তখন চল্লিশ কি পঞ্চাশ টাকায় পাওয়া যেত। ওইটুকুর জন্যে এমন শিশু নির্যাতন! তাহলে সোনা হলে কি হত! খুনই করে ফেলত হয়তো। এবার বসে থেকেও কষ্ট হচ্ছে। কোমর ব্যাথা করছে খুব। উঠে দাঁড়িয়ে আবার পায়চারি করতে লাগলাম। যাঃ। আমার বসার জায়গা এবার দখল হয়ে গেল। দেখি, এক প্ল্যাটফর্মবাসিনী নিজের বাচ্চাকে এনে ওই বেঞ্চিতেই শুইয়ে দিল। আমাদের থেকে একটু দূরে বসে ও নিজের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল। খাওয়া হতে এখানে এনে শুইয়ে দিল। এবার তো আর বসতেও পারব না, আবার মেয়েটার কাছ থেকে সরতেও পারব না। কি করি। দূরের দিকে তাকিয়ে দেখি বাবারা ফিরছে। যাক, তাহলে আর অপেক্ষা করতে হবে না। সেই মুহূর্তেই একটা মালগাড়ি ঝমঝম শব্দ করতে করতে এসে হাজির হলো। শব্দের চোটে ভয় পেয়ে রুমন জেগে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই কোলে তুলে নিলাম ওকে। আগে মালগাড়ি ও অনেকবার দেখেছে, তবে এত কাছ থেকে নয়। তাই আর কাঁদেনি ।কিন্তু থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওর ছোট্ট শরীরটা। ওদিকে অন্য বাচ্চা টা দেখি অবলীলায় ঘুমিয়ে চলেছে।
স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বাবা একটা টাঙ্গা দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল।
সেদিকেই এগোলাম আমরা। বেশ বুঝতে পারছিলাম, এবার একটা ঝামেলা পাকাবে। ঠিক তাই। ঘোড়া দেখে ভয় পেয়েছে। আর উঠবে না। কি চিৎকার। ভাই বলল, "আমার কাছে দে।" দিলাম। দেখি, কেমন করে সামলায়।
"চল। ঘোড়ার গাড়িতে আমরা উঠব না। অন্য গাড়িতে যাব", বলে ওকে নিয়ে টাঙ্গার পেছনে উঠে বসল ভাই । টাঙ্গা চলতে শুরু করলো। একটু পরে পেছন ফিরতেই ঘোড়া দেখে ফেলেছে। ব্যা স। তারস্বরে চিৎকার। আবার সামনে ফিরিয়ে দেওয়া হল ওকে। তখন চুপ। খানিক পরে আবার পেছন ফিরে দেখেই আবার চিৎকার। আবার সামনে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হল। এবার বেশ রাগ হচ্ছে আমার। জোকার নাকি! বেশ লম্বা, এবড়ো খেবড়ো রাস্তা ।লাফাতে লাফাতে চলেছে টাঙ্গা। জান বেরিয়ে যাচ্ছে। ভাবছি কতক্ষণে পৌঁছতে পারব ।এদিকে তিনি তো সার্কাস দেখিয়েই চলেছেন। এবার নজর পড়েছে নিজের হাতের দিকে। ব্যাস। শুরু হল চিৎকার। গয়না নেই হাতে। কোথায় গেল? ভীষণ বিরক্তিতে চড় তুলে তেড়ে গেলাম। এ্যাই ।থামবি! মেরেই দিয়েছিলাম ।ভাই সঙ্গে সঙ্গে ঢেকে নিয়েছে ওকে। চড়টা ফসকে গিয়ে পড়ল ভাইয়ের হাতে। বাবাও রেগে গেলেন আমার ওপর। "ওকে কেউ মারে"! কর্তামশাইও দেখলাম অসন্তুষ্ট। মেয়ের গায়ে টুসকি লাগলে ওনার প্রাণ কেঁদে ওঠে। আমিই বা কি করব। ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছি তখন।
বিশাল একটা মাঠ পেরোচ্ছি তখন। সে যেন তেপান্তরের মাঠ ।টাঙ্গাওয়ালা বলল, "এটা রাবণ পোড়ার মাঠ"। দশেরার দিন এই মাঠে রাবণ পোড়ানো হয়। মাঠে তখনও তার চিহ্ন রয়েছে দেখলাম। আরো কিছুক্ষণ পর এসে দাঁড়ালাম শান্তিকুঞ্জ র সামনে। বাড়িটার আসল নামটা ঠিক মনে নেই আমার। এই নামটাই থাক নাহয়।
চারদিকে বন জঙ্গল আর ফাঁকা মাঠ। তার মধ্যে দু তিনটে বাড়ি পাশাপাশি। মালিকরা সবাই কলকাতা বা অন্য কোনো বড় শহরে থাকে। বাড়ির দেখাশোনার জন্য আছে কেয়ার টেকার। শহরাঞ্চল থেকে কেউ বেড়াতে এলে, থেকে যায় দুচারদিন ।বাকি সময় বাড়িগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে। শান্তিকুঞ্জের পাশের বাড়িটা পরিত্যক্ত। দেখে Haunted House বলেই মনে হচ্ছে।
শান্তিকুঞ্জের সামনে টাঙ্গা থেকে যখন নামলাম, তখনও বিকেলের আলো রয়েছে। বিশাল গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির নাগাল পেলাম। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠে সামনেই একটা বড় ঘর। বাড়ির সামনে পেছনে দুই পাশে অনেকটা জায়গা রয়েছে। একটু পরে কেয়ারটেকার এল ।বাড়ির মালিকের চিঠি ছিল আমাদের সঙ্গে। চিঠিটা দেখে সে বলল, "আসুন, ঘর দেখে নিন"। বড় ঘরটার বাঁ পাশে আরও একটা ঘর রয়েছে। ঘরটা খুলে দিল কেয়ারটেকার। কালো রঙের, পিলপিলে চেহারা, নাম বৃন্দাবন। ভেতরের ঘরটাও বেশ বড় । দুটো ঘরেই বড় বড় অনেকগুলো জানলা আর দুটো করে দরজা। বৃন্দাবন বলে, "কোন ঘরটা নেবেন বলুন"। আমরা অবাক। কর্তামশাই বললেন,"কোন ঘরটা মানে! আমাদের তো দুখানা ঘরের বুকিং রয়েছে। এই ঘর দুখানার কথাই বলা হয়েছে আমাদের। এই ঘর দুটোই নেব আমরা"। বৃন্দাবন বলে, একটা ঘরে তো আপনাদের হয়ে যাবে। শুধু শুধু দুটো ঘর নিয়ে কি করবেন! আরো যদি লোক আসে, তাদের তো দিতে পারব ঘরটা।"
কর্তামশাই বললেন,"মানে কি! আমরা বিনাপয়সায় থাকতে চাইছি! ফুল পেমেন্ট করে এসেছি ভাই। এসব ঝামেলার মানে কি!আর অন্যদের ঘর দেওয়ার কথা বলছ, এবাড়িতে আর কি ঘর নেই! "
"তা আছে। আসলে লোক আরো লোক এলে তাদের তো ঘর দিতে হবে। তখন আমি কোথায় থাকব!তাই বলছিলাম, আপনারা এই ভেতর ঘরে থাকুন। আমি বাইরের ঘরটায় থাকব না হয় "।
বাবা বলে," এই একটা খাটে আমরা কি করে শোবো বলো তো ভাই "।
তখন সে লোক বলে," কেন! আপনারা তিন জন খাটে শুয়ে যাবেন, আর দিদিমনি বাচ্চা নিয়ে নীচে শুলেই তো হয়ে যায়।"
এত কথা আর ভালো লাগছিল না। আমি বললাম," আপনি তো আউট হাউসে থাকেন। তাহলে এখানে থাকতে চাইছেন কেন?" চমকে উঠল লোকটা। সেটা দেখেই আমি বললাম," এভাবে ঝামেলা করে লাভ হবে না। আমরা সব জেনেই এসেছি। এই, তোমরা লাগেজ তোলো ।এখানে আমি এক মূহুর্তও থাকব না। বাজারে অনেক ভালো ভালো হোটেল আছে। ঘর পেতে অসুবিধা হবে না।আর আগে আমি মালিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে আজকের ঘটনা জানাবো। " ততক্ষণে দেখে নিয়েছিলাম, আমাদের টাঙ্গাওয়ালাটা দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছিল। এবার তাকে ডাক দিলাম," ও কাকু, চলে যাবেন না। আমরা ফিরব "।
টাঙ্গাওয়ালাটা এবার এগিয়ে এল," কি হয়েছে"! সব শুনে টাঙ্গাওয়ালাও দিল ওকে দুটো কথা শুনিয়ে। তখন বৃন্দাবন বাবাজী বললেন, " না। না। থাকুন আপনারা। যেমন ইচ্ছে আপনাদের থাকুন। দুটো কেন, দশটা ঘর নিয়ে থাকুন।
কর্তামশাই হাসতে হাসতে বললেন, "পথে এসো বাবা। দশটার দরকার নেই। দুটো হলেই চলবে আমাদের।"
তবে আমার মন বলছিল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। না হলে এরকম অযৌক্তিক আচরণ কেন?