আমাদের দেওঘর যাত্রার অভিজ্ঞতা
আমাদের দেওঘর যাত্রার অভিজ্ঞতা
আজ অনেকদিন আগেকার একটা ঘটনার কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। প্রতিবার আমরা পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাই ।সেবার দেওঘর যাওয়া ঠিক হলো। সালটা বোধহয় 2001. মেয়ের বয়স আঠারো মাস। এতটুকু মেয়েকে নিয়ে বেশি দূরে যেতে চাইনি। যদিও ওই বয়সে ট্রাভেল করার অভ্যাস আছে ওর। আমরা অন্ততঃ সেরকমই মনে করেছিলাম। কারণ ন মাস বয়স থেকেই আমাদের সঙ্গে ঘুরছে ও। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে প্রথম পা ফেলে হাঁটতে শিখেছে আমার মেয়ে। তারপর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় আমার মামাবাড়ি। অনেকটা ট্রেন জার্ণি করে সেখানেও গেছে ও। অসুবিধা হয়নি ।
সেবারে আমাদের সঙ্গী ছিল আমার বাবা ও ভাই। ঠিক হল দূর্গা পূজার নবমীর দিন বেরোনো হবে। কর্তামশাই ট্রেনের সিট রিজার্ভেশনের উদ্যোগ নিলে বাবা বললেন ," রিজার্ভেশনের কোনো দরকার নেই। ভোরের সমস্তিপুর ধরে যশিডি পর্যন্ত চলে যাব।" আমরা চেঁচামেচি করে উঠলাম, "ওসব চলবে না। ওই গাড়িতে সাংঘাতিক ভিড় হয়। এতটুকু বাচ্চা নিয়ে ওভাবে যাওয়া সম্ভব নয়" । বাবা বললেন, "কোনো অসুবিধা যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা আমি করব। আমার একটা লোক আছে। সে ট্রেনের ড্রাইভার। ওকে বললে সব ব্যবস্থা করে দেবে"। আমরা বাবার মুখের ওপর আর কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু মনে অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছিল। যাইহোক, বাবার ডাকে সে লোক বাড়িতে এল। এবং আশ্বাস দিল আমাদের, "কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোমাদের আরামে যাবার ব্যবস্থা করে দেব। সমস্তিপুরে চারটে সিট রিজার্ভ করে রেখে দেব তোমাদের জন্য" । ঠিক আছে। তাই দিক। তবে ট্রাভেল করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। সেই অভিজ্ঞতা বলছে, বাতেলা মারছে ওই লোক। কারণ সমস্তিপুর দূরপাল্লার প্যাসেঞ্জার ট্রেন। ওখানে সিট রিজার্ভ হয়! বাবা কিছুতেই বুঝবেন না।" ও বলেছে যখন, তখন নিশ্চয়ই কিছু করবে"।
দেখতে দেখতে পুজো চলে এল। ওই লোক আর যোগাযোগ করে না। আমরা তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। এবারে বেড়াতে যাওয়াটা বোধহয় আর হলো না। শেষে সেই লোকের বাড়িতে গিয়ে বাবা ডেকে আনল তাকে। তিনি এলেন। শুরু হল তার বচন , "শোনো, সমস্তিপুরে সিট রিজার্ভ হয় না। তবে তোমাদের বলেছি যখন, ব্যবস্থা তখন আমি করবোই" । বাবা বললেন, "কি ভাবে" ?
"অষ্টমীর দিন নাইট ডিউটি আছে আমার। নবমীর সকালে ওই সমস্তিপুর ধরেই ফিরব আমি। ট্রেনে উঠেই নীচের একটা বার্থে শুয়ে পড়ব আমি। কাঁকিনাড়া স্টেশন থেকে উঠে পড়বে তোমরা। আমি তোমাদের সিট ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়ব।" আমি বললাম," কোন কম্পার্টমেন্টে আছো তুমি, আমরা বুঝবো কি করে "? সেই বাতেলাবাজ তখন বললে," আমি একটা সাদা রুমাল নাড়ব জানলা দিয়ে। সেটা দেখে তোমরা উঠে এসো "। বাবা খুব খুশি ।বললেন," দেখলে তো! কেমন সুন্দর ব্যবস্থা করে দিলাম। তোমরা শুধু শুধুই সন্দেহ প্রকাশ করছিলে"।
মনে মনে তখন প্রমাদ গুনছি।গন্ডগোল একটা হবেই। ওই ভিড় ট্রেনে ওই বাতেলাবাজ টা নাকি পুরো একটা বার্থে শুয়ে আসবে। আর লোকজন তাকে ছেড়ে দেবে! আমাদের সন্দেহ শুনে বাবা বললেন, "এই তো বাজে স্বভাব তোমাদের। মানুষ কে বিশ্বাস করতে চাও না। ও যদি বলে, সারারাত আমি ট্রেন চালিয়ে এলাম। এটুকু জায়গা তোমরা আমাকে দেবে না! লোকে তখন নিশ্চয়ই জায়গা ছেড়ে দেবে ওকে" ।
নবমীর দিন ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়লাম। আমার মেয়েটাকে বাবাই কোলে নিয়ে নিলেন ।দিব্য দাদুর কোলে ঘুমোতে ঘুমোতে চলল। স্টেশনে এসে চারিদিকের নানা কলরবে ঘুমটা ভেঙে গেল ওর ।মনে মনে ভাবছিলাম, যাওয়াটা আদৌ হবে তো!
নির্দিষ্ট সময়ে দেখলাম, ট্রেন ঢুকছে। আমরা রেডি হয়ে দাঁড়ালাম বাবা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন । একটা একটা করে কামরা আমাদের ক্রশ করে যাচ্ছে, আর বাবা আঁতিপাতি করে খুঁজছেন সেই বাতেলাবাজ কে।ট্রেন থামল, ভিড়ে ঠাসা একেবারে।বাবা এদিক সেদিক দৌড়চ্ছেন আর সেই বাতেলাবাজের নাম ধরে ডাকছেন। কারো সাড়া নেই, সাদা রুমালও ওড়াচ্ছেনা কেউ। হায় রে নির্দয় বাতেলাবাজ। এ কি ছল ছলিলি তুই! শেষে বাবা বললেন, "ঠিক আছে আগে তো উঠে পড়ো ট্রেনে" । আমরা কেউ নড়ছি না। কারণ ওইরকম ভিড়ের মধ্যে বাচ্চা নিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। আক্ষেপের সুরে বাবা বললেন, "যাঃ। ছেড়ে দিল। তোমরা কেউ ওঠার চেষ্টাই করলে না! " আমি বললাম, "এই ভিড়ের মধ্যে কি করে উঠবো"! সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। মন খুব খারাপ। বেড়াতে যাব বলে বেরিয়েও যাওয়া হল না। এবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে। বাবা আর ভাই ফিরে যাবার উপক্রম করতে, এবার মুখ খুললেন কর্তামশাই, " দাঁড়ান, বেরিয়েছি যখন, তখন যাবই"।
বাবা হাসলেন। শ্লেষের হাসি , "কিভাবে? ট্রেন তো ছেড়ে দিল"!
কর্তামশাই বললেন, "ট্রেন তো আরো আছে। ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। শুধু আমার মেয়েটা বড় কষ্ট পাবে। আমার কথা যদি শুনতেন, তাহলে আর এটা হতো না।"
এর পরের নৈহাটী লোকাল ধরে নৈহাটী এলাম আমরা। নৈহাটী থেকে ব্যান্ডেল।
মেয়েটাকে সকালে খাওয়াতে চেষ্টা করেছিলাম। খায়নি। বোতলে দুধ করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু খাওয়াতে পারছি না। বোতল মুখেই নিচ্ছে না। ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে একটা চায়ের দোকানে বললাম দুধটা গরম করে দিতে। দোকানী একটা পাত্রে দুধটা ঢেলে বলল, "মামণির দুধটা তো কেটে গেছে। আমি এটা ফেলে দিয়ে একটু গোরুর দুধ দিয়ে দিচ্ছি।" সত্যিই তো, চার ঘন্টার বেশি রাখা যায় না এই দুধ। আর চার ঘন্টা তো হয়েই গিয়েছে। তখন গোরুর দুধ সবে ধরানো হয়েছে মেয়েটাকে । দিনে একবার করে দেওয়া হতো। বাকিটা ল্যাক্টোজেনই খেত। ওটা ছিল ওর নেশা। আর সেরেল্যাক ।এদুটো যে কতদিন ও খেয়েছে! ডাক্তার বারণ করেছে। তাও খাবে।
যাইহোক, লোকটি বোতল গরম জলে পরিস্কার করে তাতে দুধ ভরে দিল। কিন্তু কিছুতেই পয়সা নিল না, "মামণিকে আমি একটু দুধ খেতে দিয়েছি। এর জন্য পয়সা কি নেব"?
ব্যান্ডেল থেকে বর্ধমানগামী ট্রেনে উঠলাম। এইবার শুরু হল ঝামেলা। কি চিৎকার মেয়ের। ভিড় ছিল গাড়িতে। তবে বসার জায়গা পেয়েছিলাম। কিন্তু ও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। খাওয়াতেও পারছি না। কিছুই খাবে না। ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বার করে একটু ভেঙে মুখে দিলাম ওর । পুরো আধখানা চকোলেট খেয়ে নিল। পাশের এক ভদ্রমহিলা বললেন, "দেখে তো মনে হচ্ছে চকোলেট খোর। অত চকোলেট খাওয়াবেন না ওকে"। চকোলেট খাওয়া শেষ হতে আবার কান্না। জল খাবে না, দুধ খাবে না। কি জ্বালা! একজন ভদ্রলোক বললেন, "ওর বোধহয় গরম হচ্ছে খুব। জামাটা খুলে দিন ওর।" তাই দিলাম। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খানিকটা দুধও খাওয়া হল।
নামার আগে জামাটা পরাতে গেলাম। আবার চিল চিৎকার। দাদুনভাই এবার এগিয়ে এলেন, "থাক তুই এমন ভুতনী হয়েই। ওই ভাবেই চল আমার সাথে।
বর্ধমান থেকে আসানসোল। এই রাস্তায় অতটা ঝামেলা করেনি। চুপচাপ ছিল। আসানসোল থেকে যশিডি। এই রাস্তায় ও খুব কষ্ট পেয়েছে। এই ট্রেনে বেশ ভিড় ছিল।একজন ভদ্রলোক আমাকে জায়গা ছেড়ে দিলেন। মেয়ে নিয়ে আমি বসলাম। চুপচাপই ছিল। আমার সামনে এবং পাশের সহযাত্রীরা বুঝতে পারছিলাম একই পরিবারের লোকজন। তবে অবাঙালী। ওদের সাথে দুটি তিন চার বছর বয়সী ছেলেমেয়ে রয়েছে। ছেলেটা আমার হাঁটু ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দেখি আমার মেয়ে কেঁদে উঠল। কি হলো আবার! পরমুহূর্তেই দেখি আমার মেয়ে ওই ছেলেটাকে চড় মেরে চুল টেনে ছিঁড়ে দেবার যোগাড়। আমি তো অবাক। ওরা ছেলেটাকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে উপদেশ দিল, মেয়েটাকে সামলে রাখো বাপু। একটু পরে হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার মেয়ের পায়ে পরিস্কার চিমটি কাটার দাগ। কর্তামশাই বারণ করলেন কিছু বলতে। কারণ আমরা পশ্চিম বাংলা অনেক আগেই ছাড়িয়ে এসেছি। আর তখন প্রায়শই শোনা যেত, বিহারের ওপর দিয়ে গাড়ি গেলে বাঙালিদের ওপর নানা উৎপাৎ হতো। যাইহোক, ওই বাচ্চা দুটো আমার মেয়ের ওপর যথেষ্ট উৎপাৎ করছিল। শেষে আমি প্রতিবাদ করতে বাধ্য হলাম। কিছুক্ষণ চুপ। খানিক পরে আবার শুরু করেছে ছেলেটা। ওর বাবা মা কিছুই বলছে না। এবার আমি অন্য পলিসি নিলাম। ছেলেটাকে আদর করে চকোলেট খেতে দিলাম। দুভাই বোনে ভাগ করে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নিল। মেয়েকে খাওয়াচ্ছি তখন, আবার আমার হাঁটু ধরে এসে দাঁড়াল, যদি আর একটু পাওয়া যায়। এবার আমি ওর কানের কাছে মুখ এনে খুব আস্তে করে বললাম, "আর শয়তানি করলে না, ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব। চিমটি কাটা কাকে বলে বুঝবে। যাও, চুপচাপ বসো নিজের জায়গায়"। মন্ত্রের মতো কাজ হলো। আর কিছু করেনি। তবে নিজের একটু খারাপ লাগছিল।
মেয়েটা আবার অশান্ত হয়ে উঠছে। আসলে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর, বুঝতে পারছি। ওর বাবা, দাদু, মামা সবাই দরজার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। অত কাঁদছে দেখে ওর বাবা আমার কোল থেকে ওকে নিয়ে নিল। একটু হাওয়া পেলে যদি ভালো লাগে মেয়েটার।
বেশ দ্রুত গতিতেই ট্রেন টা চলছে। প্রথমে চুপ করেই ছিল। তারপরই হঠাৎ কি হল, বাবার কোল থেকে একটা লাফ। ওই বিচ্ছু দুটোর বাবাও ওখানেই ছিল। কি হল বুঝতে পারলাম না, শুধু দেখলাম ওই লোকটির ছড়ানো দুটি হাতের আশ্রয়ে আমার স্বামী ও মেয়ে। রুক্ষ স্বরে কর্তামশাই কে উনি বললেন, "যান, ওর মায়ের কাছে ওকে দিয়ে দিন। সেদিন উনি না থাকলে যে কি হতে পারতো, আর ভাবতে চাই না।
শুধু যাত্রা পথের বর্ননা এখানেই শেষ। এর পরের অংশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।