আলোময়ী
আলোময়ী


---এই শুনছো,এ মাসে মুদিখানায় কত হয়েছে জান?
---কত?
---আড়াই হাজার।
মানস মনে মনে একবার হিসেব কষে নিল।আড়াই আর পুজোতে জামা,কাপড়,মিষ্টি,পাতি আনুসঙ্গিক মিলে তা প্রায় হাজার পাঁচেকের ধাক্কা।
ওদিকে ছেলে,মেয়েদুটোর মাস দুয়েকের টিউশানির ফি বাকি আছে।ওদের মাষ্টারও তো পুজোয় আনন্দ করবে।
এদিকে বাড়ির দেনাগুলোও সম্পূর্ণ মেটেনি।পাওনাদাররা তাগাদা দিচ্ছে ।
..এই সামান্য মাইনের কাজ!বোনাস আসে হাতে গোনা কয়েকটা টাকা!..কি দিয়ে যে কি করবে মানস বুঝে উঠতে পারে না।
ইদানিং কারখানার প্রোডাকশন আর সে রকম হচ্ছে না। মালিক মাইনে দিতে দেরী করছেন। ম্যানেজার,স্টাফ সবাই মালিকের তাড়া খেয়ে কর্মচারীদের গালাগাল দিতে শুরু করেছে।মানসের ভাগ্যে এখনো জোটেনি।তবে সেদিন আর দেরী নেই।
মানস ভাবছে।তার আগেই সে অন্য রাস্তা দেখে নেবে।সেটাও এত সহজ নয়।এখন চারিদিকে কাজের মন্দা।জুটমিলের অপারেটর হলে কি হবে?কারখানাগুলো তো সব বন্ধ হয়ে আসছে।কাজ শিখে সে যাবেটাই বা কোথায়?
তারসাথে আবার নতুন একটা সমস্যা জুড়েছে।একমাস ধরে তার শরীরটা একদম ভাল যাচ্ছে না। কপালের দুদিকটা রপ্ রপ্ করে।রাতে,দিনে কখনোই ঘুম আসতে চায় না। মাথার মধ্যে ধমধম আওয়াজ করে।তারসাথে দুর্বলতা।জ্বর,জ্বর ভাব।অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে।
ব্যথা আর জ্বরের ওষুধ খেয়ে দেখেছে।সে রকম কাজ হয় না। জ্বরটা আবার খুব বেশিও আসে না। ঠিক বিকেলটাই এসে রাতের দিকে ছেড়ে যায়।কিন্তু সারা রাত ঘুম আসে না কিছুতেই। তখনি হাজারো চিন্তার শুল এসে তাকে বিঁধতে থাকে।
ললিতাকে কিছুই বুঝতে দেয় না।
মানস তবু ভয় পায়।ললিতা এত অবুঝ নয়।সবদিকেই তার সমান খেয়াল।এখন সে বিড়ি খাওয়া একদম কমিয়ে দিয়েছে।ললিতা কি করে সেটা পর্যন্ত টের পেয়ে গেছে। মানস একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল,
--কি করে বুঝলে আমি বিড়ি খাওয়া কমিয়েছি?
---ডিউটির ড্রেসটাই নতুন কোন ফুটো নেয়।
সেই ললিতা কি কিছুই জানতে পারবে না?..অসম্ভব ।
তাই আজ মানস নিজের মুখেই বলে উঠল,
---ভাবছিলাম একবার ড. সামন্তর কাছে যাব।শুনেছি তিনশো টাকা ভিজিট।সরকারি হাসপাতালে তো আসা-যাওয়া করে মুখের লালা শুকিয়ে যাবে।তাছাড়া এত ছুটিও করা যাবে না।.. তাই ভাবছিলাম,একবার ঘুরেই আসি।
ললিতা জামা,কাপড়গুলো আবার ঠিকমত ভাঁজ করে বড় ট্যাঙ্কটাই ভরে রাখছে।বর্ষার জামা,কাপড় রোদ না খেলে পোকা ধরে যায়। তাই আজ একসাথে সবার পোশাকগুলো বের করে রোদে মেলেছিল।এখন তাই ললিতার মুখ ঘোরানোর সময় নেয়।
মানসের কথা শুনে বলল,
---টানের সংসার তো আর ঘোচার না। তুমি বরং কালকেই একবার ঘুরে এসো।
মানস,ললিতার কথায় খুব সাহস পায়।ও যেখানে বাধা দেবে।মানস সেখানে কিছুতেই যায় না। আর যেটাতে সায় দেয়,সেখানে মানস চোখ বুঁজে চলে যায়।
মানস উল্টোটা করলেও ললিতা রাগ করবে না।আবার সে যে ললিতাকে ভয় পায়।তা কিন্তু না। মানস মাঝে, মাঝে ভাবে,এটা তাহলে কি?
সে যায় হোক মানসের মনে এখন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বীধা,দ্বন্দ্ব থাকল না। এমন কি টাকার ব্যাপারেও সে আর চিন্তা করল না। যদিও কাজ সে করে।মাইনে সে তোলে।
সেই চিন্তা টা বোধ হয় এবার ললিতাকে ধরে বসল।তাই কাপড়ের ভাঁজগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে না। তবু ট্যাঙ্কের মধ্যে সাজান হয়ে যাচ্ছে।
----- ----- ----
ড. সামন্ত চেক করে সবশেষে বললেন
---কয়েকটা টেষ্ট লিখে দিলাম।এখুনি করে এনে দেখাও।সবগুলো আজকে না হলে কালকে এসে দেখিয়ে নেবে।সেইমত মেডিশিন দেব।.. তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে ভেতরে ডেঞ্জারেস কিছু হতে চলেছে।এখন দুটো ট্যাব লিখে দিলাম।আজ থেকেই নিতে শুরু করে দাও।
ডাক্তারের কথাগুলো মনের মধ্যে বার,বার চলাফেরা করছে।মানস তাই স্থির থাকতে পারছে না। ভয় পাচ্ছে।এই সময় ললিতাকে তার খুব মনে পড়ল।বেচারি,জানত।সেইজন্য আসতেও চেয়েছিল।তার মানা শুনে,আসেনি।সে কি তখন জানত,ডাক্তার এত ভারি,ভারি কথা শোনাবে?
রিশেপসনের লোকটাকে কাগজটা দেখিয়ে বলল
---টেস্টগুলো করতে কত লাগবে?
লোকটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হিসেব কষে বলে দিল,
--মোট পঁচিশশো টাকা।আর ইউ.এস.জি-টা আজ হবে না। কাল খালি পেটে আসতে হবে।
মানস জানে তার পকেটে এক হাজারো পুরো নেই।তবু একবার হাত ঢুকিয়ে দেখে নিল।থাকগে।তারপর আবার ওষুধ কিনতে আছে।
ধীরে, ধীরে উল্টো পায়ে চলা শুরু করল।
ওষুধের দোকানে ট্যাবলেটগুলো কেনার জন্য কাগজটা বাড়িয়ে বলল,
---কত লাগবে ভাই?
এ ভাইটি হিসেবে আরো তুখোড়।
--চারশো পাঁচ টাকা।
মানস বলল ,
---কতদিনের ভাই?
---সাতদিনের।
--- এক পাতা ওষুধের দাম চারশ টাকা!!
--দামি এ্যান্টিবায়োটিক।এক,একটা চল্লিশ টাকার।
--আচ্ছ তিন দিনের দাও।
--পুরো পাতা ছাড়া এসব দামি ওষুধ দেওয়া হয় না। সরি অ্যাঙ্কেল।
মানস বিড়বিড় করে বেরিয়ে গেল।ডাক্তারের কথাগুলো বড্ড বিচলিত করছে। কী হয়েছে,কী জানি!..ক্যান্সার নয় তো?..আবার টিউমার তো হতে পারে?..তার কাছে এত টাকাও নেই। শেষে সবকিছু হারিয়ে যদি সর্বশান্ত হয়ে যায়!তখন সবাইকে নিয়ে সে কি শহরের রাস্তায়, রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে?..
ডাক্তার বলছিলেন,প্রেসারটা খুব বেড়ে গেছে। মানস ভাবল,মিথ্যে বলেননি।মাথাটা তার ঘুরছে।বুকটাও ধড়ফড় করছে। সে হয়তো এখুনি মারা পড়বে।এল.আই.সির প্রিমিয়ামগুলো ঠিকঠাক ভরা আছে। কিন্তু এভাবে মরলে কি ললিতা টাকাগুলো পাবে?...শুনেছি, আত্মহত্যা করলে পায় না।..না..না।মানস মাথা ঘুরিয়ে একটা চলন্ত বাসের আগে পড়তে গিয়ে শেষ মূহুর্তে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল।
------ ----- ------
ললিতা অনেকদিন পর আজ নিজের বিছানায় মেয়েটাকে ঠিকঠাক শুইয়ে দিয়ে,মানসের পাশে এসে শুলো।ছেলেটাকে একটু সরিয়ে মানস ললিতার জায়গাটা করে দিল। আকাশে এক টুকরো চাঁদ উঠেছে। মধ্যবিত্তের অন্ধকার তাতেই অনেকটা ঘুচে যায়।
মানস ললিতার জোৎস্নাভেজা মুখটা তুলে বলল,
---কি হবে তাহলে?..আমার যদি কিছু হয়ে যায়!!
ললিতা উত্তরে মানসকে দু হাতের উষ্ণ আলিঙ্গনে ভরে বলল,
----ভয় কর না তো।আমি তোমার কিচ্ছুটি হতে দেব না।তুমি এক কাজ করো।
--কি?
---তোমাকে আর কাজে যেতে হয় না।
--তা কি আর হয়?..সংসার টা চলবে কী করে?
--ওটা আমি ভাবব?
--মানে?
---সমিতি থেকে দশ হাজার টাকা লোন নিয়ে আমরা সবাই মিলে বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধব।আমি ট্রেনিংটা শিখে এসেছি।
--ওই আয় দিয়ে সবকিছু পূরণ হবে?
--খুব হবে। না হয় রাতে একটু কম ঘুমবো।তোমার বিশ্রামটাও খুব দরকার। রাত জেগে ডিউটি করে তোমার শরীরের এই হাল হয়েছে।.. আর হতে দেব না।
ললিতা সযত্নে মানসের চোখদুটো মুছিয়ে শক্ত গোফের নিচে ঠোঁটটা ঘষে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
তখনি ছেলেটা বলে উঠল,
--বাবা হিসি পেয়েছে।
ললিতা বলে উঠল,
---চল আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে আসছি।বাবা ঘুমোচ্ছে।
ছেলেটা চোখ কঁচলে বলে উঠল,
--তুমি তো একটা ভিতু।ভূত এলে, তখন কী করবে?
ললিতা ছেলের একটা হাত শক্ত করে ধরে, যেতে যেতে বলল,
---আমাদের যে বাবা ভূত,ভবিষ্যত,বর্তমান কোন কিছুকে ভয় পেলে চলবে না।
ছেলেটা অবাকভাবে তার মায়ের চোখের দিকে চাইলো। ঠিক যেন দুটো সূর্য। একসাথে জ্বলছে। রাত বলে তার মনেই হল না।