আগমনী
আগমনী
"কিরে, আর কত ঘুমাবি? ওঠ এবার।" - মায়ের কন্ঠস্বরটা কেমন আবছামতো শুনতে পায় সৌম্য। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না কোথা থেকে ভেসে আসছে আওয়াজটা। সে দেখতে পাচ্ছে একটা কালোর উপর সাদা ডোরাকাটা অন্ধকার গুহা, সামনেটা ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কেমন ম্লান হয়ে গেছে। অন্যপ্রান্ত থেকে গলার আওয়াজটা এখনো ভেসেই আসছে -" চারটে বাজতে চললো তো রে ......এবার রেডিও ছাড়..... মহালয়ার দিন এতও ঘুম.....জাগো দুর্গা....জাগো দশপ্রহরণ........."
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে সৌম্য। আজ তো সত্যিই মহালয়া - এলার্ম দিয়েছিল ঠিক ৩ যে ৫০ এ। কিন্তু ভোররাতের ঘুমটাও বড্ড জাঁকিয়ে বসে। বিশেষতঃ বেঙ্গালুরুর এই অক্টোবরের ভোরের দিকে চারপাশটা এতটা ঠান্ডা হয়ে যায় যে চাদর গায়ে দিতে হয় - বুকটা ধক করে কেঁপে উঠলো সৌম্যর। হ্যাঁ, সত্যি তো, এটা তো কোলকাতা নয়, এটা তো তার শ্যামবাজার-ফরিয়াপুকুরের দোতলা বাড়ির বিছানা নয়।মনটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে । আধা ঘুম ভাঙা চোখে মোবাইলে সেভ করা 'মহিষাসুরমর্দিনী' -র রেকর্ডিং চালিয়ে দেয়। কারণ, আকাশবাণী ছেড়েই দেওয়া যাক, big fm, red fm এও এখানে বসে সেসব শোনার উপায় নেই। মাথার পাশে মোবাইলটা রেখে শুয়ে পড়ে সে। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে কতগুলো দৃশ্য সিনেমার মতো আসতে থাকে। কলকাতায় থাকতে মহালয়ার দিনের রুটিনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম থাকতো সৌম্য এন্ড কোম্পানির। হ্যাঁ, কোম্পানি বলতে ওর পাড়ার বন্ধুরা - অনুভব, শ্রীজাত, রোহনরা। ঠিক ৬ টায় মহালয়া শেষ হতে না হতেই দু'তিনটে বাইক নিয়ে হাজির হতো সবাই।তারপর বাইকে চেপে সোজা বাবুঘাট। হিন্দুশাস্ত্রমতে মহালয়া হলো পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা। পিতৃহারা সন্তানরা তাদের স্বর্গীয় পিতা ও পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে গঙ্গাবক্ষে তিলদান করে তর্পণ করেন সূর্যকে সাক্ষী রেখে। প্রচলিত জনমত যাদের পিতা জীবিত, তাদের তর্পণ দেখাটা বাঞ্চনীয় নয়। কিন্তু এই অমোঘ না দেখা রহস্যের প্রতি বাঙালি যুবকদের বরাবরই এক নিবিড় টান। বাবুঘাটের ইন্ডোর স্টেডিয়াম এর ঠিক উল্টোদিকে বাপ্পাদার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে তর্পণ দেখা - সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য - অকল্পনীয় সুখ - বর্ণনাহীন।
সৌম্য বুঝতো না মহালয়ার সকালটা কিভাবে কেমন করে এতটা সুন্দর হয়ে যায় আকস্মিকভাবে। দীর্ঘ প্রায় ৮৭ বছর আগে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নামক জনৈক বৃদ্ধ সাত সকালে উঠে দেবীর আরাধনায় স্তোত্রপাঠ করে বাঙালিকে ' মহিষাসুরমর্দিনী' নামক যে এক ভয়ংকর সুন্দর নেশায় নেশাছন্ন করেছিলেন, সেই নেশায় ডুবেছে সমগ্র বাঙালি জাতি - একের পর এক প্রজন্ম, যুগের পর যুগ - যে নেশা অমর, যে নেশার মৃত্যু নেই। আর তাৎপর্যপূর্ণভাবে সৌম্য উপলব্ধি করে মহালয়ার সকালের সূর্যটা ততটা প্রখর নয় - বরং মিষ্টভাষী, রাস্তার মানুষগুলোর মুখে দিনশুরুর চিন্তার বদলে হাসিতে ভরপুর। সৌম্য কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায়না, কারণ সে নিজেও তো সেই টানেই এখানে হাজির এই ভোরবেলায়। এ ব্যাখ্যার একটাই নাম - আবেগ, এ ব্যাখ্যার একটাই উপসংহার - অনুভূতি।
'রূপং দেহি...জয়ং দেহি...যশো দেহি..' - ওমা, এইতো শুরু হলো সবে, আর এই শেষ! সৌম্য বুঝলো তার স্মৃতির বইয়ের পাতাগুলো এই কয়েক ঘন্টায় শেষ হবার মত নয়। মোবাইলে দেখল - ৬ টা বাজতে ১০। নাহ, আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না সৌম্যর। না হোক এটা কলকাতা, না থাক বাবুঘাট, না থাক গঙ্গার তর্পণ, নিজের বাঙালীসত্ত্বা তো তাকে বারবার খোঁচা মারছে আর বলছে - ওরে আজ মহালয়া, ওঠ। আবার সেই এক বছরের অপেক্ষা। 'আসছে বছর আবার হবে' এর প্রতীক্ষা।
উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিল সৌম্য। হঠাৎ মনে পড়লো, মায়ের তো ফোন করার কথা ছিল ৪ টে নাগাদ। কাল রাতেও পইপই করে সে বলে রেখেছিল
মাকে, ফোন করলো না তো। শেষে মা - বাবা ঘুমিয়ে পড়লো না তো। একটা ফোন করা দরকার। রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের দুধটা গরম করতে বসিয়ে মা কে ফোন করতে যাবে, এমন সময়ে ফোন বেজে উঠলো। মা ফোন করেছে এতক্ষনে..
- " কিরে ঘুম ভাঙলো?"
- " তোমাকে এতবার বললাম ডেকে দিতে, ফোন করলে না কেন?"
- " আরে, অত রাত করে কাল বাড়ি ফিরেছিস অফিস থেকে। আজও তো অফিস আছে।তাই ভাবলাম..ঘুমটাও তো দরকার।"
- " মানে অদ্ভুত যুক্তি দাও মা। যাই হোক, মহালয়ার দিন সকালে আর মাথা গরম করিও না। আমি এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ৪ টে ভাগ্গিস। পুরোটাই শুনেছি -" মা কে বলা হলো না যে তোমার স্বপ্নের ডাকেই ঘুম ভেঙেছে আজ।
- " জানিস বাবু, মনটা কেমন করছে। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর বাবাও বলছিল। মহালয়ার দিনটা কেমন যেন টানে জানিয়ে তোকে আমার কাছে"- গলা ভারী হয়ে এলো মায়ের।
মায়ের এই ভারী স্বরটা সৌম্য একদমই নিতে পারেনা।কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে, চারদিকটা অন্ধকার লাগে - মনে হয় সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে। পেশার খাতিরে এই চাকরি, এই জীবনযুদ্ধ - আর দরকার নেই। কিন্তু তারপরেই বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে পা ঠেকে যায়। খুব ইচ্ছে করে সৌম্যর - মায়ের এই আবেগ, কষ্ট, অনুভূতি গুলোকে প্রশ্রয় দিতে, চায় মায়ের সুরে সুরে মিলিয়ে বলতে, চিৎকার করে বলতে - তোমাদের ছাড়া আমিও ভালো নেই মা। মহালয়া, দুর্গাপুজো এগুলোতে আমি ছুট্টে পালিয়ে যেতে চাই তোমাদের কাছে, শহর কোলকাতার কাছে। কিন্তু না, আবেগের বাঁধ ভাঙার আগেই সংযত হয় সৌম্য।
- " বুঝছি মা, কিন্তু কাজের চাপ তো জানোই।অফিসের চাপে মহালয়া, পুজোর দিনক্ষণও মনে নেই। বলছি, বাবা তর্পণ করতে বেরিয়ে গেছে?" - আবেগকে মিথ্যের পর্দায় ধামাচাপা দিয়ে কোনোরকমে হাঁফ ছাড়ে সে।
- " হ্যাঁ রে, গেছে একটু আগেই।"
- " আচ্ছা মা, আমি অফিস পৌঁছে জানাবো, এখন রাখি।"
- " সাবধানে থাকিস, খেয়ে যাস কিন্তু....."
ফোনটা কেটে দিয়ে রান্নাঘরে আসে সৌম্য। চা - টা কাপে ঢালতে ঢালতে তার মায়ের গলার স্বরটা মনে প্রাণে বিঁধতে থাকে। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় সে। বেঙ্গালুরুর সকালটাও মন্দ নয়। ঠান্ডা হাওয়া, তেরো তলা ফ্ল্যাটের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে গাছ-গাছালির সবুজ সমারোহ। অদ্ভুতভাবেই আজকে বেঙ্গালুরুর নীল আকাশেও পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে কি তিলোত্তমা শহর এক টুকরো শরতের মেঘ উপহার পাঠালো বহু মাইল দূরে তার এক অবাঞ্চিত সন্তানের জন্য? কে জানে......
মা , বাবা, পাড়ার বন্ধুগুলোকে খুব মিস করতে লাগলো সৌম্য। আর তার সাথে আরও একজনকে - ভীষণভাবে। গত দুটো মহালয়াতে তার করা ফোনেই ঘুম ভেঙেছে সৌম্যর। আর এবার - নাহ.....সৌম্য মনে মনে ঠিক করে আজ একবার সে ফোন করবেই রাহীকে। রাহী - সৌম্যর 'প্রেমিকা', অথবা হয়তো 'সদ্য প্রাক্তণ', অথবা হয়তো 'ভাবি প্রাক্তণ' , যার সাথে তিনটে বসন্ত সৌম্য কাটিয়েছে মসৃণভাবে। সেই সৌম্যও আজ জানে না তাদের সম্পর্কের নাম টা আসলে কি? গত এক সপ্তাহ ধরে সে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি রাহীকে। কি জানি, হঠাৎ কি হলো? ঠিকানার দূরত্বের সাথে সাথে সম্পর্কের দুরত্বটাও যে সমানুপাতিক - বোঝেনি সৌম্য। তবু চেষ্টা আজ সে একবার করবেই।
রাস্তায় লোকের আনাগোনা বাড়ছে, মানুষের ব্যস্ততাও। সৌম্যর কাপের চাও প্রায় শেষ, সূর্যের তাপটাও প্রখর হচ্ছে, সাদা মেঘগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ, আকাশের ওই কোণটায় কেমন একটু কালো করে মেঘ করে আসছে - তবে কি বৃষ্টি হবে আজ? নাকি দমবন্ধ করা গুমোট গরম? বৃষ্টি হলে আজ সে ভিজতে পারবে? কোলকাতাতেও কি হবে সে বৃষ্টি আজ? রাহীও কি ভিজবে সে বৃষ্টিতে?