Debdutta Banerjee

Inspirational

3  

Debdutta Banerjee

Inspirational

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে

3 mins
17.7K


মিলু বৌদির সাথে আমার পরিচয় সেই কলেজের দিন গুলোয়। আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া এসেছিল বৌদি তার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে। প্রবালদা ছিল মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। মাত্র তেত্রিশেই স্ট্রোক হয়ে বিছানা নিয়েছিল। বৌদি একটা ডাক্তারের পলিক্লিনিকে কাজ নিয়েছিল। দুপুর দুটো থেকে রাত নটা বৌদি থাকত না। প্রবালদার একটা সাইড প‍্যারালাইসিস। হাতের নাগালে জল,বিস্কুট,মুড়ি রেখে যেত বৌদি। দরজা ভেজানো থাকত।আমাদের সবাইকে বৌদি বলত একটু খেয়াল রাখতে। এছাড়া অনেক রাত অবধি বৌদি সেলাই করত। নিস্তব্ধ রাতে বৌদির সেলাই মেশিনের আওয়াজ পেতাম ঘরঘর করে। 

বৌদি দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। আর চোখ দুটো ছিল বড্ড মায়াময়। শুনেছিলাম বৌদি খ্রিস্টান ছিল বলে প্রবালদার বাবা ঘরে তোলেনি। ওরা বেরিয়ে এসে সংসার পেতেছিল। কিন্তু অসুখের পর প্রবালদা বিছানায় থাকতে থাকতে অসহায় হয়ে পড়েছিল। সবসময় বৌদির উপর চোটপাট করত। বৌদি মুখ বুজে নিজের কাজ করত। পাড়ার অনেকেই বৌদির এই লড়াইকে ট‍্যারা চোখে দেখত আর নোংরা কথা বলত। বৌদিকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি।

এক জল ঝড়ের রাতে মিলু বৌদির ডাকে ছুটে গিয়ে দেখেছিলাম প্রবালদা আর নেই। শুয়ে শুয়ে বিস্কুট খেতে গিয়ে গলায় লেগেছিল। জলটা হাতের ধাক্কায় উল্টে পড়ে গেছিল। বৌদি রাতে ফিরে দেখে শক্ত হয়ে গেছে শরীর। 

এরপর বৌদিকে অনেকেই অপয়া বলত, অপছন্দ ক‍রত। বৌদি চেষ্টা করছিল অন‍্য কোথাও চলে যাওয়ার। কিন্তু অল্প-বয়স্ক বিধবাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইতো না। বৌদি ভোরে বেরিয়ে রাতে ফিরত। 

এমনি এক জল ঝড়ের রাতে ট্রেনের গন্ডগোলে আমার বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছিল। বারাসত স্টেশনে নেমে একটা রিক্সাও চোখে পড়ল না। অন্ধকার পথ দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ বিপদের গন্ধ পেলাম। তিনটে ছেলে ঘিরে ফেলেছে আমায়। ওদের মুখে মদের গন্ধ, লোলুপ দৃষ্টি আর হিংস্র চোখমুখ দেখে আমি থরথর করে কাঁপছি। ফাঁকা অন্ধকার রাস্তায় আমার চিৎকার মিলিয়ে যেতেই পাশের ঝোপ জঙ্গলে আমায় টেনে নামিয়েছিল হায়নার দল। আর তক্ষুনি দেখতে পেয়েছিলাম মিলু বৌদিকে। একাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার জন‍্য। বৌদির হাতে উঠে এসেছিল চকচকে চাকু, অন‍্য হাতে সাইকেলের চেন। যা ওদের গায়ে আছড়ে পড়ছিল মুহুর্মুহু। বৌদির জন‍্যই সেদিন অক্ষত অবস্থায় ফিরেছিলাম, পরে জেনেছিলাম আত্মরক্ষার জন‍্য এসব থাকে বৌদির কাছে। এরপর বৌদির সাথে আমার সখ‍্যতা গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে। বৌদি প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে রাত করে ফিরত। এই নিয়ে পাড়ায় আলোচনা হত। বহুবার বৌদিকে উঠে যেতেও বলেছিল পাড়া ছেড়ে। আমার মন মানত না বৌদি কোনো খারাপ কিছু করে। কিন্তু ঐ বয়সে প্রতিবাদ করতে পারিনি। এরপর বৌদি কে অপমান করে পাড়া ছাড়া করা হয়েছিল। বহুদিন যোগাযোগ ছিলনা। 

বহুদিন পর একদিন বিরাটি স্টেশনে মিলু বৌদিকে দেখেছিলাম। কথা বলতে যেতেই হারিয়ে গেলো ভিড়ের মাঝে। আবার একদিন দেখলাম দমদম স্টেশনে। সেদিন জানতে পেরেছিলাম বৌদি ফুটপাথের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে। নিজের স্বল্প রোজগারের প্রায় সবটাই বৌদি খরচ করে পথশিশুদের জন‍্য। একটা ছোট নার্সিংহোমে কাজ করে এসব করত বৌদি। শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠেছিল। 

বিয়ের পর আমি গড়িয়া চলে গেছিলাম, বহুদিন আর মিলু বৌদির সাথে যোগাযোগ ছিলনা। ভুলেই গেছিলাম ওর কথা। আমার মেয়েকে ভর্তি করেছিলাম একটা মিশনারী স্কুলে। ওদের স্কুলের একটা প্রোগ্ৰামে গিয়ে হঠাৎ দেখা মিলু বৌদির সাথে। বৌদি ওখানে অনাথ শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। স্কুল থেকে বিশেষ সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বৌদিকে। ততদিনে বৌদি সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নিয়েছে। 

আমায় দেখে চিনতে পেরেছিল। খুব খুশি হয়েছিল আমায় দেখে। আমার বার বার মনে পড়ছিল বহুবছর আগের সেই রাতের ঘটনা। বৌদি আমায় রক্ষা না করলে কি যে হত আমার!! যেই নারীকে সবাই নোংরা চোখে দেখত, অপমান করত,একদিনও সে কোনো প্রতিবাদ না করেই নিজের পথে অবিচল থেকে নিজের কাজ করে গেছিল নিঃশব্দে। বৌদি কখনো ঝগড়া করেনি কারো সাথে, সুযোগ নিতে দেয়নি কাউকে। সেবাই ছিল বৌদির ধর্ম। নীরবে সেবা করে গেছিল সারাজীবন। তাই আমার মনের মাঝে বৌদির স্মৃতি আজো টাটকা। বৌদি আমার দেখা এক অসাধারণ নারী ।বৌদিকে দেখেই জীবনে লড়াই করতে শিখেছিলাম। বৌদিই আমার অনুপ্রেরণা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational