অচিনপুরের রূপকথা
অচিনপুরের রূপকথা
তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অনেক অনেক দূর —
চলতে গিয়ে পথের শেষে পাবে অচিনপুর।
নদীর পারে, বনের ধারে, ছায়ায় ঘেরা দেশ,
রাজা প্রজা সবাই মিলে সুখেই থাকে বেশ।
একটা ছিল রাজার কুমার, সবার চোখের মণি,
দুষ্টু ভীষণ, তাকে নিয়েই হিমসিম খান রাণী।
যত বড় হচ্ছে কুমার, বাড়ছে যে শয়তানি,
শাসন বারণ মানে না সে, কাঁদেন রাজা রাণী।
দিনের পরে দিন যে কাটে রাতের পরে রাত।
বাড়ছে বয়স,বাড়ছে কুমার,বাড়ছে লোভের হাত।
এমনি করেই কেটে গেল আরও অনেক দিন,
কুমার এখন দেশের রাজা, এক্কেবারে স্বাধীন।
রাজা হয়ে কুমার হলেন বেজায় রকম খুশি,
বুড়ো হয়ে রাজা রাণী হলেন বনবাসী।
নতুন রাজা ভীষণ লোভী, লোভের যে নেই শেষ,
লোভের মাশুল দিতে গিয়ে উজার হল দেশ।
পুরোনো সব নিয়ম যত বদলে সবই গেল,
তার বদলে নতুন নতুন আইন যে পাস হল।
করের ওপর করের বোঝা, তার ওপরে কর,
না যদি দাও তখন জেনো জ্বলবে তোমার ঘর।
অত্যাচারী রাজার হাত যে প্রজার ধন লুটে,
ভরাচ্ছে পেট, প্রজার রক্ত খাচ্ছে চেটেপুটে।
চকমিলানো রাজবাড়িটি স্ফটিক দিয়ে গড়া,
হাতিশালে হাতি আছে ঘোড়াশালে ঘোড়া।
রাজকোষটি ভর্তি রাজার মণি মানিক দিয়ে,
সোনার খাটে ঘুমোন রাজা নাসিকা গর্জিয়ে।
অত্যাচারী রাজার রাজ্যে চলছে জুলুম- রাজ,
তারপরে কি হয়েছিল বলছি শোনো আজ।
একটা ছিল গরীব চাষী, করত মাঠে চাষ,
বৌ ও একটা ছেলে নিয়ে কুঁড়েয় করত বাস।
হঠাৎ সেদিন রাজ পেয়াদা জানান দিল এসে,
কর পড়েছে বাকি তোদের বলল হেসে হেসে।
ছুটল চাষী রাজার কাছে মনে নিয়ে ভয়,
রাজকর তার আছে বাকি! এ তো সত্যি নয়।
করজোড়ে রাজাকে সে বলল মনের কথা,
রাগের চোটে বলল রাজা, নেবো রে তোর মাথা।
তুই যদি রে সত্যি বলিস, মিথ্যেবাদী আমি!
কাঁদতে কাঁদতে বলল চাষী, ক্ষমা করুন স্বামী।
রাজা বলেন, শোন রে চাষী, মুখ্যু কোথাকার!
আমার বাবা তোর বাবাকে দিয়েছিলেন ধার,
সে ধার এখন সুদেমুলে হয়েছে চতুর্গুণ,
শোধ যদি না করিস তবে করব তোকে খুন।
বলল চাষী, হে মহারাজ, আর কি আছে আমার!
ওইটুকুনি জমি, আর ওই কুঁড়ে টুকুই সার।
ফলিয়ে ফসল যে টুকু পাই, কর যুগিয়ে যাই,
দিই না ফাঁকি, সারা বছর একটি বেলা খাই।
বাবার ধার ছেলেই শোধে, এটাই তো হক্ কথা।
জমিটা তোর দে আমাকে, নইলে পাব ব্যথা।
বলেন রাজা হেসে হেসে গোঁফে দিয়ে চাড়া,
সভাসদগণ ঠিক ঠিক বলে মাথা নেড়ে দিল সাড়া।
নারাজ চাষী চলল ফিরে মুখটি করে ভার,
সেই দিনেতেই রাতের বেলি জ্বলল চাষীর ঘর ।
ধু ধু আগুন উঠল জ্বলে কুটিরটিকে ঘিরে,
চাষীর বৌ ও চাষী মিলে মরল জ্বলে পুড়ে।
চাষীর ছেলে ছোট্ট বিশু বাঁচল কোনোক্রমে,
বুঝল না সে কোন পাপে যে তাদের ছুঁলো যমে।
হায় রে কপাল চাষীর ছেলে —
কি যে হল ভাগ্যদোষে।
বাপ মা কে তার হারিয়ে ফেলে,
চোখের জলে বুক যে ভাসে।
পালিয়ে গেল বনের ভেতর —
চাষী বৌ এর কোলের ছেলে,
বনদেবীর আঁচল ভেজে
ছোট্ট বিশুর চোখের জ্বলে।
বনের ভেতর দিন কাটে ওর,
বনের ভেতর রাত যে কাটে,
গাছের ফল আর নদীর জলেই
ক্ষিদে এবং তেষ্টা মেটে।
দুপুরবেলায় সেদিন বিশু
বসেছিল গাছের তলে
হঠাৎ সে এক ছোট্ট পাখি—
পড়ল এসে বিশুর কোলে
নিষ্ঠুর এক ব্যাধের ছেলের
বিষ মাখানো মারণ তীরে,
নীল বর্ণের সেই পাখিটার
ছোট্ট সে প্রাণ কাঁপছে ধীরে।
দেখে বিশু অবাক হল,
ভাবল, এ কী নিষ্ঠুরতা!
তীরটি টেনে নিল খুলে,
যদি কমে পাখির ব্যথা।
বুনো ঘাস আর লতাপাতা
থেঁতো করে ক্ষেতের ওপর,
লাগিয়ে দিয়ে দিল বেঁধে
ছিঁড়ে নিজের পরার কাপড়।
দুদিন বাদে সুস্থ হয়ে
উড়ল পাখি নীল আকাশে,
খানিক উড়ে এল ফিরে,
বসল এসে বিশুর পাশে।
অবাক হয়ে দেখল বিশু,
পাখি তো আর পাখি টি নেই,
পাখি হয়ে গেছে পরী,
তাকিয়ে আছে বিশুর দিকেই।
বলল হেসে, ছোট্ট বিশু,
তোমার সেবায় সুস্থ হলাম,
তাই তো দ্যাখো তোমার কাছেই
আবার আমি ফিরে এলাম।
বলো এবার কি বর চাও,
যা চাও আমি দেবো তোমায়,
শুনে বিশু অবাক ভীষণ,
কি চাইবে যে ভেবে না পায়।
একটু হেসে বলল পরী,
ছোট্ট বিশু, দুঃখী তুমি,
বনে বনে কেঁদে ফেরো—
হারিয়ে নিজের বাস্তুভূমি।
বাপ মা হারা ছোট্ট ছেলে
এমনভাবে থাকতে পারে!
তোমায় আমি দেবো বিশু
এই দেশেরই রাজা করে।
যে রাজা তোর সব নিয়েছে,
সেই রাজারই মুকুটখানি—
যাদু করে তোর কাছেতে
উড়িয়ে নিয়ে আসব আমি।
যে গাছটির তলায় এসে
ছোট্ট বিশু বসেছিল,
পরীর হাতের যাদুর ছোঁয়ায়
সেখানে এক প্রাসাদ হল।
হাতি ঘোড়া লোক লস্কর —
কিছুই বাকি রইল না আর,
সেই প্রাসাদের রাজা বিশু,
খুশির ছোঁয়া মনে সবার।
এমনি করে বনের মাঝে
ছোট্ট নগর উঠল গড়ে।
বিশুর মুখের হাসি দিয়ে,
আকাশ পরী চলল ফিরে।
যাবার সময় বলল পরী—
বিশু সোনা মানিক আমার,
আজকে আমি যাচ্ছি চলে,
ডাকলে তুমি আসব আবার।
এই নাও এই সোনার বাঁশি,
রেখো এটা যত্ন করে,
বাজাও যদি এটা তুমি,
সুরের যাদু পড়বে ঝরে।
বিপদ যদি হঠাৎ আসে,
আমায় তখন স্মরণ কোরো।
তিনটি বারে বাজিয়ে একে
আমায় তুমি ডাকতে পারো।
বাঁশির সুরে দুলবে ভুবন,
সে ডাক শুনে আসব ফিরে,
এই না বলে আকাশ পরী
আকাশ পানে চলল উড়ে।
দুদিন বাদে সকাল বেলায়
বনেরই এক গাছতলাতে,
বসেছিল বিশুরাজা
সোনার বাঁশি নিয়ে হাতে।
বাঁশিতে তার ঠোঁট ছোঁয়াতেই —
যাদু বাঁশি উঠল বেজে,
সুরের মায়া ছড়িয়ে গেল
গাছে গাছে, বনের মাঝে।
বন ছাড়িয়ে সে সুর এবার
চলে সে কোন শহর পানে,
অত্যাচারী রাজার সভায়
আছড়ে পড়ে আঘাত হানে।
উঠল টলে রাজার আসন,
পড়ল রাজা ভুঁয়ের পরে,
মাথার মুকুটখানি রাজার
উড়িয়ে নিল ঘূর্ণীঝড়ে।
সোনার মুকুট হাওয়ায় ওড়ে!
একথা নেই কারো শোনা,
রাজার আদেশ মাথায় নিয়ে
চলল ছুটে রাজার সেনা।
বনের মধ্যে কে বসে ও!
ছোট্ট খাট্ট কালো কেলো!
রাজার মুকুট ওরই মাথায়!
এটা কেমন ব্যাপার হলো!
অবাক রাজার সেনা সকল,
সেনাপতি আদেশ দিল—
আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ওকে
রাজার কাছে নিয়ে চলো।
রাজসভাতে এলো বিশু, মনেতে নেই ভয়।
আপন বলে করবে ও যে বিশ্বভুবন জয়।
শুধান রাজা, কার ছেলে তুই!
কি পরিচয় তোর?
যাদুর খেলা দেখাস নাকি?
তুই কি যাদুকর?
বলল বিশু লোভের বশে
যে চাষিটির ঘরে—
আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন,
মনে কি আজ পড়ে?
আমি যে সেই চাষির ছেলে,
হারিয়ে আপন ঘর,
যাদু শিখে হয়েছি আজ
মস্ত যাদুকর।
আমার সেরা যাদুর খেলা দেখুন মহারাজ,
কী করে এই দেশের রাজা হচ্ছি আমি আজ।
এই না বলে বিশু তখন বাঁশিটি বের করে —
এক ফুঁ দিতেই বৃষ্টি এল আকাশ কালো করে,
দুই ফুঁ দিতেই রাজসভাতে নিভল সকল বাতি,
বাজ পড়ল কড়কড়িয়ে, ঝড়ের মাতামাতি —
দেখে সবাই উঠল কেঁপে, সবার মনে ভয়,
যাদুকরের যাদুর ঠেলায় কি জানি কি হয়।
তিন ফুঁ দিতেই ঝড় থামল, বৃষ্টি গেল থেমে।
রাজসভাতে জ্বলল আলো, স্বস্তি এল নেমে।
আলোর ধারায় উঠল নেয়ে সকল সভাতল,
দেখল সবাই অবাক হয়ে যাদুকরের ছল।
রাজার মুকুট ধুলোয় পড়ে
সিংহাসনের পাশে,
মুকুট হারা রাজামশাই
চোখের জলে ভাসে।
পরীরাণী এলেন এবার আকাশ আলো করে,
সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন বিশুকে হাত ধরে।
সবাই দিল জয়ধ্বনি, বিশুরাজার জয় ।
পরী বলল — বিশুরাজা অত্যাচারী নয়।
প্রজাপালন করবে সুখে, আজকে তবে আসি,
বিপদ এলে ডেকো আমায় বাজিয়ে সোনার বাঁশি।
দরকার না হলে আমায় কখনও ডেকো না,
সুখে থেকো বিশুরাজা, অন্যায় কোরো না।