যাবজ্জীবন
যাবজ্জীবন
হাতে ধরা মোবাইলটা আবার বেজে উঠলো রুমনার। নিলয়ের নাম্বার। অপেক্ষা করে করে অস্থির হয়ে উঠেছে নিলয়। স্বাভাবিক, রুমনা পৌঁছয়নি ষ্টেশনে, ধরছেও না ফোনটা। আসলে, রুমনার মাথাটা জট পাকিয়ে আছে। বাড়ী থেকে বের হবার সময় যে দৃঢ়তা নিয়ে বের হয়েছিল, যত হাঁটছে ততই যেন ওর দুটো পা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। দুটো স্বত্বার অনবরত লড়াই চলছে। দ্বিধা দ্বন্দ, বিবেক দংশন জট পাকিয়ে একটা ময়াল সাপ হয়ে ক্রমশ ওর দুটো পাকে জড়িয়ে ধরে চলার গতিকে মন্থর করছে।
মনের একটা স্বত্বা অনবরত একঘেয়ে ভাবে বলে চলেছে, “রুমনা, কিসের দ্বিধা? কিসের দ্বন্দ?। মুক্তি পাওয়ার এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? নিলয় তোকে ভালবাসে, বিয়ে করবে, সুখে রাখবে। এখনো জীবনের অনেক বসন্ত বাকি। একদম ঠিক করেছিস। অল দ্য বেস্ট”। আবার আর একটা কেউ যেন মনের ভেতর থেকে খুব নরম কিন্তু বড্ড দাগ কেটে বলছে, “রুমনা, কোথায় চলেছিস? ১২ বছরের দাম্পত্য পায়ে ঠেলে, পঙ্গু স্বামীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে সুখের খোঁজে? যদি তোদের সন্তান থাকত? পারতিস? নিলয় রাজী হত সন্তান সহ তোকে মেনে নিতে?”।
ভেতর থেকে আর একটা রুমনা ফুঁসে ওঠে, “নিলয় মোটেই অমন ছেলে নয়। নিশ্চয় আমাকে আমার সন্তান সহ মেনে নিত”। নাছোড়বান্দা ওই স্বত্বা আবার বলে ওঠে, “ যদি আজ তোর এই অবস্থা হতো যেমন দুর্ঘটনা নির্ঝরের হয়েছে? তোদের সন্তান হয়নি, সে তো প্রথমবার তুই চাকুরী করবি বলে গর্ভপাত করিয়ে নিলি, নির্ঝর কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল। তোর ইচ্ছেতেই সায় দিয়েছিল। পরের বার তোর মিস ক্যারেজ হোল- তারপরে তো ওর এই দুর্ঘটনা”। রুমনা বিপরীত স্বত্বাটার খোঁজ পেল না। ইঞ্জিনিয়ার নির্ঝর একটা কন্সট্রাকশন সাইটে ক্রেন থেকে পড়ে যায় অনেকটা নীচে, বাঁচার কথা ছিলনা।
মাথায় সেফটি হেলমেট পড়া ছিল বলে প্রাণে বেঁচে যায় কিন্তু কোমরের নীচ থেকে অসাড় হয়ে যায়। হুইল চেয়ারে যাবজ্জীবন বন্দী হয়ে পড়ে নির্ঝর। নির্ঝর যে নারসিং হোমে ভর্তি হয়েছিল, সেখানেই নিলয়ের সাথে দেখা এত বছর পরে। স্কুলে রুমনার সিনিয়র ছিল। ভাল ছাত্র হিসেবে সারা স্কুলে ওর খ্যাতি ছিল।
পরে নিলয় ডাক্তারি পড়তে চলে যায় মেডিক্যাল কলেজে। যোগাযোগটা আর থাকেনি। অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। নির্ঝরের নিউরলজির ব্যাপারটা নিলয়ই দেখে। প্রথম দিকে নিয়মিত না পারলেও, ওর ব্যাস্ততার মাঝে দিনে একবার ঠিক সময় বের করে নির্ঝরকে দেখে যায়। ওর পেশাগত দক্ষতা এবং আন্তরিকতায় প্রথম দিকে নির্ঝরের বেশ উন্নতি হচ্ছিল।
তারপরে যখন নিলয়ের প্রায় প্রতিদিন আসা শুরু হল, ওদের বাড়ীতে ওর থাকার সময় বেড়ে গেল নির্ঝরের মনের আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু হল। শুরু হল নিলয়ের পরামর্শ মত চলার ক্ষেত্রে অসহযোগিতা। ওর শরীরের ভাষা, চোখের দৃষ্টি পাল্টে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে নিলয়ের সাথে স্বাভাবিক সৌজন্য বোধেরও অভাব দেখা যেতে লাগল। অবশ্য নিলয় সেটা গায়ে মাখত না। রুমনা স্বামীর অজ্ঞাতে কাচুমুচু হয়ে ওকে বলেছে, “ওর ব্যবহারে তুমি কিছু মনে করো না, প্লীজ”। নিলয় অভয় দিয়ে হেসে বলেছে, “নট অ্যাট অল। এই ধরনের পেশেন্ট ওই রকম রিঅ্যাকট করবে, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া………” অর্থপূর্ণ হাসি হেসে নিলয় ওর চোখে চোখ রেখেছে। রুমনার গালে গোধূলির লালিমা।
বছর ছয়েক ঘর করার পরে নিলয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যায়। ওর স্ত্রী ঝিনুক বড় লোক বাপের একমাত্র প্যাম্পারড চাইল্ড। বাপের বাড়ীতেই পার্টি কালচারে বড় হয়েছে। নিলয়ও পেশাগত কারণে সেভাবে সময় দিতে পারত না। যখন সময় বের করে ঝিনুককে কাছে চেয়েছে, সে তখন পার্টিতে যাবার জন্য আয়নার সামনে। সন্তান চাওয়া নিয়েও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মতানৈক্য ছিল। আর এদিকে নির্ঝরের পঙ্গু হয়ে যাবার পরে রুমনার জীবনে যেন সীতার অগ্নি পরীক্ষা শুরু হল। স্কুলের চাকুরীটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়ে সব ভুলে নিজেকে নির্ঝরের সেবায় সঁপে দিল। পায়খানা পেচ্ছাপ থেকে
শুরু করে সবই করিয়ে দিতে হয়।
প্রথম দিকে সবই ঠিক ছিল, কিন্তু যত দিন যেতে লাগল নির্ঝর যেন কেমন পালটে যেতে লাগল। খিটখিট করে, কথায় কথায় খুঁত ধরে, সব সময় রুমনাকে ব্যতিব্যাস্ত করে রাখার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টা। নিলয়ের সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে ঘনিস্থতার পর্যায়ে যাবার আগে থেকেই নির্ঝরের মনে সন্দেহের আনাগোনা শুরু হল। বিশেষ করে যখন শুনল যে ওরা একই স্কুলে পড়েছে এবং নিলয় ডিভোর্সি। তারপরে তো যতো দিন গেছে ওর অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে। আজকাল নির্ঝর গায়েও হাত তুলছিল।
কাছে গেলে হাত মুচকে দিত, খিমচে দিত। একটা হিংস্র নেকড়ের চাউনি নিয়ে হিস হিস করে উঠত, “নিলয়, নিলয়ের কথা মতো চলতে হবে। হুম, আমার অসহায়তার সুযোগে রাসলীলা চলছে। ডারটি ওম্যান”।
আরও নোংরা নোংরা কথা বলে। রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারেনা রুমনা,জেগে জেগে ওঠে আতঙ্কে, এই বুঝি নির্ঝরের বেড প্যান দরকার পড়ল, এই বুঝি ও জল খেতে চাইল। দুপুরে আর রাতে ও ঘুমোলে, কিছুটা সময় রুমনা একা নিজের মত করে পায়। এখনকার নির্ঝরের সাথে সেসময়ের নির্ঝরকে মিলিয়ে দেখে। আদর, সোহাগে ভরা সোনা ঝরা দিন ছিল সেসব। কি প্রাণবন্ত আর রোম্যান্টিক ছিল নির্ঝর ! কিছু ভালবাসতে জানত ও। সেসব পাগলামোর কথা মনে পড়লে চোখে জল নিয়েও হেসে ফেলে রুমনা। বড় মেদুর, মেরুন রঙ্গা দিন ছিল সেসব।
আর এখন? ওর সন্দেহ আর অত্যাচার যতো বেড়েছে ততোই ও অজান্তে নিলয়ের কাছাকাছি চলে গেছে। ক্রমশ হ্যাম্লিনের বাঁশীওয়ালার মতো নিলয় ওকে আবার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছে। দিনের পর দিন অসীম ধৈর্য ধরে কখনো ফোনে, কখনো সামনা সামনি। রুমনা কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না।
ওর হাতে নখের দাগ দেখেছে, জানতে চেয়েছে। রুমনা বলেনি কিন্তু ও আঁচ করেছে। একদিন প্রস্তাব দিয়েছে, “ আমি চেন্নাইতে চলে যাব। একটা ভাল অফার পেয়েছি। আমি চাই তুমিও চলো। আমরা ঘর বাঁধব, সংসার করব আবার”। শুনে এক সুখের শিহরণে ওর অন্তর কেঁপে উঠেছে কিন্তু পর মুহূর্তে ওর অজান্তে মুখ থেকে বের হয়েছে, “নির্ঝর? ও যে অসহায়। ওকে কে দেখবে? কি হবে ওর? মরে যাবে যে ও”। নিলয় অভয় দিয়েছে,“ আমি সব ব্যাবস্থা করে যাব। ভাল নার্স দিয়ে যাব। সংস্থাকে পেমেন্ট করব আমি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। ভরসা করো" মাঝে মাঝে নিলয় সুযোগ বুঝে শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। রুমনাও কি চায় নি? ওর দীর্ঘদিনের অভুক্ত শরীরেও প্রবল তাগিদ বোধ করেছে। দীর্ঘশ্বাসে আর প্রবলতর মনের জোরে সেই ইচ্ছেকে দফন দিয়েছে। ভেতরের এক সংস্কার এবং দ্বিধা থেকে নিলয়কে আলিঙ্গন আর লুকনো চুম্বনের লক্ষণরেখা অতিক্রম করতে দেয়নি।
আবার ফোনটা বাজছে। স্ক্রিনে দৃষ্টি যেতে ওর বুকের ভেতরে কে যেন একটা হাতুড়ির ঘা দিল। নির্ঝরের নাম্বার। ও কি ভুল দেখছে? না, এতো সত্যিই নির্ঝরের নাম্বার। রুমনা যখন দুপুরে বের হয়, তখন তো ও ঘুমোচ্ছিল। তাড়াহুড়ো আর টেনশনে ফোনটা পাশে রেখে আসা হয় নি। তানাহলে চার্জ দিয়ে ওটা সব সময় বিছানায় ওর পাশেই থাকে। ইস! ফোনের নাগাল পেতে গিয়ে পড়ে গেল না তো? নিলয়ের ঠিক করা নার্সের তো এখনও আসার সময় হয়নি। তাহলে?
ফোনটা রেস্পন্স করে কানে দিতেই নির্ঝরের ধরা ধরা গলা শোনা গেল, “ আমি সব আঁচ করেছিলাম, রুমি। তুমি ঠিক করেছ। কোন অন্যায় করো নি। ভাল থেকো তোমরা। বিশ্বাস করো আমি খুব খুশী হয়েছি। I’ll take care of myself. চিন্তা করো ……..করো না”। ফোনটা কেটে দিল নির্ঝর। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল রুমনা। রিং ব্যাক করল কিন্তু রিং হয়ে গেল. না কোন উত্তর। তাহলে ? তাহলে কি ?
ট্যাক্সি ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, “ক্যায়া হুয়া ম্যাডাম? কোই প্রবলেম? “এক্ষুনি গাড়ী ঘোরান। যতো তাড়াতাড়ি। আমায় ফিরতে হবে।” – বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল রুমনা. আবার ফোন, ঝাপসা চোখে দেখল নিলয়ের ফোন। আরও ঝাপসা হয়ে যাবার আগেই রুমনা ফোনটা কেটে দিল।