তুমি কি কেবল ছবি(প্রথম পর্ব)
তুমি কি কেবল ছবি(প্রথম পর্ব)
ছবির প্রদর্শনীতে যেতে আমার খুব ভাল লাগে। কলকাতার বাইরেও কোনো চিত্র প্রদর্শনী থাকলে আমি যাই। এক বিখ্যাত শিল্পীর ছবির প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম সেদিন। ছবি দেখতে দেখতে শেষ ঘরটায় প্রবেশ করে চমকে উঠেছিলাম। ছবি গুলো কি জীবন্ত! নারীদের উপর অত্যাচারের বিভিন্ন রূপ,শিল্পীর তুলির টানে ভীষণ ভাবে প্রাণ পেয়েছে। ছবি গুলো দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম কোথায় যেন। আসলে ছবি গুলোর সাথে মিল ছিল আমার চেনা একজন চিত্রশিল্পীর। এই সব আঁচড়, রঙের কোলাজ্ যেন আমার বহুদিন-কার চেনা। খুব অবাক লাগছিল। এতো মিল .....
হঠাৎ একটা ছবির সামনে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছিলাম। একটা মাত্র এগারো বারো বছরের মেয়ের ভীত অবয়ব, তার দু চোখে জল ছাড়াও ফুটে উঠেছে এক আকুতি, তার চোখের তারায় ফুটে উঠেছে তীব্র ঘৃণা!! এ কার ছবি? কে এঁকেছে? আমি যেন নিজের অতীতকে আয়নার সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। স্মৃতির মণিকোঠা হাতড়ে যে নাম উঠে আসছিল এখানে তো সে নাম নেই!!
ব্যস্ত হয়ে ব্যবস্থাপকদের কাছে ছুটে গেলাম, জানালাম এই ১৭১ নম্বর ছবিটা আমি কিনতে চাই, আর একবার দেখা করতে চাই এ ছবির শিল্পীর সাথে। ওনারা জানালেন ঐ ছবিটা বিক্রি হবে না। আর শিল্পী সেই মুহূর্তে প্রেস কনফারেন্সে ব্যস্ত। সেদিন দেখা হবে না। আমি আবার পায়ে পায়ে ছবির কাছে ফিরে এলাম। প্রতিটা ছবি আবার মন দিয়ে দেখতে শুরু করলাম। নারীর জীবনের অপমান, অত্যাচার, যন্ত্রণার প্রতিফলন প্রতিটা ছবিতে। কিন্তু পরিচিত আঁচড়ের মধ্যে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সেই চেনা নামটা কোথাও দেখতে পেলাম না। এ সব এই প্রথিতযশা শিল্পীর আঁকা, এই প্রদর্শনী বিশিষ্ট শিল্পীর।
দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই ছোট্ট মেয়ের ছবিটার সামনে। কতক্ষণ খেয়াল নেই, হঠাৎ এক স্বেচ্ছা সেবক এসে বললেন সময় শেষ। এবার বন্ধ হবে প্রদর্শনী। আমি জেনে নিয়েছিলাম আরো দু দিন রয়েছে এই প্রদর্শনী।
পরদিন আবার গেছিলাম। ঐ ১৭১নং এর সামনে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ভাল করে লক্ষ্য করলাম, কোনের দিকে সেই লাল রঙের ছোপটা এখনো জ্বলজ্বল করছে। ফ্রেমে ঢাকা পড়েছে কিছুটা। এ ছবি কে এঁকেছে? আজ আমায় জানতেই হবে। আবার চেষ্টা করলাম আয়োজকদের বলে যদি একবার শিল্পীর মুখোমুখি হতে পারি। শুনলাম উনি বড় ব্যস্ত। দিল্লি উড়ে গেছেন কোনো কাজে।
পরদিন আবার গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই ছবিটার সামনে। জানি আশা নেই, তবুও......
খুব জানতে ইচ্ছা করছিল অনেক কিছু। হঠাৎ এক আয়োজক এসে জানালেন শিল্পী নেই কিন্তু ওনার এক সহকারী আছেন, আমি চাইলে ওনার সাথে কথা বলতে পারি। আমি তাতেই রাজি। আমায় ওরা দোতলায় একটা ঘরে গিয়ে বসতে বলল। একটু পরে এক ভদ্রলোক সেই ঘরে ঢুকল, মাঝবয়সী ভদ্রলোকের মাথার সামনে টাক, চোখে ভারি কাচের চশমা, লম্বা রোগা শরীরটা বয়সের ভারে সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। আমার সামনে এসে নমস্কার করে বলল,-"কি জানতে চান বলুন?"
আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, আমার পরিচিত সেই তরুণের সাথে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম। সেই স্বপ্ন মাখা মায়াময় চোখ দুটো খুঁজে ফিরছিলাম। হাত জোড় করে প্রতি নমস্কার করে কাঁপা গলায় বললাম-" আমি একজনের খোঁজ করছি, স্বপ্নিল আইচ।"
আমার মনে হলো চোখ দুটো একবার যেন জ্বলে উঠলো, ঐ বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া লোকটার মধ্যে একবার সেই তরুণের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম যেন।
-"এই নামে তো কেউ নেই।" মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। বলল-"ছবির ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছেন কি?"
-"এই পাঁচ নম্বর ঘরের ছবি গুলো কার আঁকা?"
-"এ প্রদর্শনী স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীর, এ কথা সবাই জানে ম্যাডাম।"
-" কিন্তু ঐ ১৭১ ছবিটা কিছুতেই ওনার আঁকা নয়। শুধু ঐ ১৭১ কেনো, ঐ পাঁচ নম্বর ঘরের কোনো ছবি ঐ শিল্পীর আঁকা হতেই পারে না। এ সব ছবির সাথে জড়িয়ে আছেন যিনি, আজ বছরের পর বছর আমি তাকেই খুঁজে চলেছি। " আমি চিৎকার করে উঠলাম।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমায় দেখছিল। ঠিক তক্ষুনি আমার চোখে পড়েছিল কানের পাশে সেই কাটা দাগটা। ঘাড়ের কাছের কাঁচা- পাকা লম্বা জুলফি দিয়ে যেটা আড়াল করা ছিল। ভদ্রলোক পাঞ্জাবি পাজামা পরে রয়েছে বলে কনুইটা দেখা যাচ্ছে না, ওখানেও একটা দাগ আছে আমি জানি। সজল চোখে বললাম -" আমায় তুমি চিনতে পারছো না নীলদা। আমি.... আমি...." কান্নায় আমার গলা বুজে এলো।
-"বৃষ্টি!!" অস্ফুটে শব্দটা বেরিয়ে এলো ওনার মুখ দিয়ে।
আমার দুচোখে প্লাবন নেমেছে। আবেগে জড়িয়ে এসেছে গলা। থরথর করে কাঁপছিলাম। দুহাতে আমায় ধরে ঐ পাজর সর্বস্ব বুকে টেনে নিলেন উনি। বললাম -" কোথায় লুকিয়ে ছিলে এতদিন? কত খুঁজেছি তোমায় ? কেন আমায় ওভাবে ছেড়ে চলে এসেছিলে তুমি? " আরো প্রশ্ন এসে জড়ো হচ্ছিল।
সে বলল -" এখানে নয়। চল আমার সাথে, আজ যখন দেখা হয়েই গেলো ভালোই হলো। "
ট্যাক্সি থেকে নেমে নীলদার হাত ধরে এগিয়ে গেলাম গঙ্গার ঘাটে। ইতিউতি জোড়ায় জোড়ায় নানান বয়সী কপোত কপোতির ভিড়। আমরা দুই অসম বয়সী ঘাটের শেষ সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। পশ্চিমাকাশে দিবাকর তার শেষ অস্তরাগের রেশ টুকু ছড়িয়ে বিদায় নিতে ব্যস্ত। ছোট ছোট ঢেউ এর মাথায় সে রঙের ছোঁওয়া, এ যেন কোনো চিত্রশিল্পীর হাতের জাদুকাঠির ছোঁওয়ায় জীবন্ত ক্যানভাসে আঁকা এক দিগন্ত বিস্তৃত ছবি।(চলবে)