Saswati Roy

Romance

2.0  

Saswati Roy

Romance

তুমি আসবে বলে

তুমি আসবে বলে

6 mins
1.1K


আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রবল বেগে ঝড় আসছে। যদিও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা উড়িষ্যাতেই বেশি কিন্তু বাংলাও ঝড়ের কবল থেকে রেহাই পাবে না।


টিভিতে ঝড়ের খবর নিতে নিতে ঝড়ের গতিতেই ব্রেকফাস্ট সারছিল রাই। সামনে যথারীতি পাহারায় মা। রাইয়ের ক্ষিদে থাকুক বা না থাকুক, মল্লিকা সকালবেলা বিশাল এক প্লেট খাবার সাজিয়ে মেয়ের সামনে ধরবেই।

-ধীরে ধীরে খা, গলায় আটকে যাবে তো।

-ধীরেই তো খাচ্ছি। তিন কামড়ে এগ-স্যান্ডউইচ শেষ করে, দুধের গ্লাসে চুমুক দিলো রাই। 

-এই মেয়েকে নিয়ে আর পারি না। একটা কথা যদি শোনে। কত করে বলছি আজ ছুটি নিতে, দেখছিস তো কিরকম অন্ধকার করে রয়েছে। এক্ষুনি হয়তো ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে। এর মধ্যে কিসের অফিস তোদের?

-অফিসই তো, নাকি অন্য কোথাও?

মল্লিকার কথার মাঝে সুবীরও ফোড়ন কাটে।

-বাবা, শেষে তুমিও? 

চটপট দুধের গ্লাস খালি করে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে এলো রাই। 

বাবাকে থামালেও, কথাটা যে সত্যি, রাইয়ের চেয়ে ভালো আর কে জানে। সত্যিই তো রাই আজ অফিসে যাচ্ছে না। 


নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে একটু দম নিয়ে নিল রাই। আলমারি খুলে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আকাশের রঙে রং মিলিয়ে বেছে নিল ধূসর রঙের সালওয়ার কামিজ। ঠোঁটে লাগাল হাল্কা গোলাপী লিপস্টিক, অল্প করে কাজল ছোঁয়ালো চোখে। কাঁধে নীল ওড়না বিছিয়ে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে। পথচলতি মানুষের নজরে বুঝতে পারছিল মন্দ হয়নি সাজটা। 


কিন্তু শুভ আসবে তো? যা বিশ্রী ওয়েদার। না এলে তো সব বৃথা যাবে।

রাই আর শুভর সম্পর্কটা প্রায় পাঁচ বছরের। বি.টেকের প্রথম বছর থেকেই ওদের প্রেম। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে রাই চাকরি পেয়ে গেল। কিন্তু শুভ বারবার চেষ্টাতেও সাফল্য পাচ্ছে না। প্রায় এক বছর হতে চলল শুভ চেষ্টা করছে। রাই চেয়েছিল নিজের কোম্পানিতেই চেষ্টা করবে শুভর জন্য। কিন্তু বাদ সাধল শুভ নিজে। কিছুতেই সে রাইয়ের সাহায্য নেবে না। প্রথমটা জোরাজুরি করলেও এখন রাইও মেনে নিয়েছে। থাক, এতে ওদের সম্পর্কটা যদি সুস্থ থাকে। 


টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করলো রাই। একটাও খালি অটোর দেখা নেই। কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে। সময়ে না পৌঁছালে শুভ আজকাল খুব রাগ করে। মুখে না বললেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয় যে শুভ বেকার বলেই রাইয়ের কাছে ওর সময়ের দাম নেই।

রাই বুঝতে পারে এসব শুধুই শুভর ফ্রাস্ট্রেশন। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ছোট্ট করে স্যরি বলে দেয়।


অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো অটো পেল না রাই। হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে এসেছে। আজ অবশ্য সরকারি বাসের সংখ্যা মন্দ নয়। পলক ফেলতেই এসেও গেল একটা। বাসে একটু বুঝি মন খারাপ করেই বসেছিল রাই। কাল অনেক রাতে শুভ ফোন করেছিল। রাইকে অফিসের জন্য খুব ভোরে উঠতে হয় বলে, অন্যদিন রাত বারোটার মধ্যেই ওরা যাবতীয় কথা সেরে নেয়।

কালও তাই হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও শুভ প্রায় একটার সময় রাইকে আবার ফোন করে। সত্যি বলতে কি রাই একটু বিরক্তই হয়েছিল কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায়।

- ঘুমিয়ে পড়েছিলি?

-না, এখনও ঘুমোনোর সময় তো হয়নি, কি বলিস। 

-তুই রাগ করছিস। শুভ একটু অপ্রস্তুত হয়েছিল।

-না বল। কি বলতে আবার ফোন করলি।

-আসলে আমার তোকে একটা কথা মনে করানোর ছিল। যাক গে। সে কাল বললেও চলবে।

-ওহ, প্লিজ শুভ। ন্যাকামো ছেড়ে পয়েন্টে আয়।

-তুই কর্পোরেটে কাজ করে করে কেমন যেন রোবট হয়ে যাচ্ছিস রাই। আজকাল তোকে আর সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ছুঁতে পারে না।

-আমার ওপর যে কতটা প্রেসার তুই বুঝবি না শুভ। অ্যাটলিস্ট এই মুহুর্তে তো নয়ই।

কথাটা বলে ফেলেই রাই বুঝেছিল, যে মারাত্মক আঘাত করে ফেলেছে শুভকে। 

শুভ আর কিচ্ছু না বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল। তারপর থেকেই ফোন সুইচ অফ।

কাল সারাটা রাত যে রাইয়ের কিভাবে কেটেছে তা একমাত্র রাই-ই জানে। স্যরি লিখে বারবার মেসেজ করেছে শুভকে।

কিন্তু সে দেখলে তো... ভীষণ অভিমানী ছেলে শুভ। আর এখন তো সামান্য কথাতেও বেশী আহত হয়। 


রাই জানে কেন শুভ দ্বিতীয়বার কল করেছিল। আজকের দিনটা কি সে ভুলতে পারে! আজকের দিনটাতেই তো শুভ রাইকে নিজের মনের কথাটা বলেছিল।


বাস থেকে নেমে দ্রুতপায়ে রাই পৌঁছে গেল নেচার পার্কে,ওদের প্রিয় বেঞ্চটার কাছে। খারাপ ওয়েদারের জন্য জায়গাটা আজ খালিই বলা যায়। ছাতাটা খুলে বেঞ্চে বসলো রাই।

শুভকে অনেকগুলো মেসেজ করেছে এখানে আসতে বলে। কে জানে ফোনটা অন করবে কিনা। মেসেজগুলো না দেখলে তো আসবেও না। 

না আসুক, রাই আজ সারাদিন সারারাত এখানেই বসে থাকবে। ঝড়-বৃষ্টিতে তোলপাড় হয়ে যাক পৃথিবী। রাইকে আজ এখান থেকে কেউ নড়াতে পারবে না।


ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। পার্কে বাকি দু চারজন যারা ছিল তারাও কখন যেন চলে গেছে। এই দিনের বেলাতেও সন্ধ্যার মত অন্ধকার নেমে এসেছে। কেমন যেন গা ছমছম করছিল রাইয়ের। এমন করতে পারল শুভ। এতবার স্যরি বলার পরেও। ইগোটা কি তাহলে এসেই গেল ওদের মাঝে!


ব্যাগের মধ্যে মুঠোফোনের সুরেলা ধ্বনি। 

কে জানে কেন, একটু চমকেই উঠলো রাই।

খুব আশা নিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো মা।

-কিরে অফিসে পৌঁছে গেছিস? কিসে গেলি? পৌঁছে একটা ফোন তো করবি।

শতাব্দী এক্সপ্রেসের গতিতে মা বলে চলেছে।

রাইয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করেই।

- উফ্ মা, থামবে তুমি? একাই বলে চলেছ।

আমার অফিসে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অনেক কাজ আছে। পরে কথা বলছি।

মল্লিকাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয় রাই। মনে মনে গজগজ করতে থাকে। মায়ের এই চিন্তা একেক সময় বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। কোথায় যে থামতে হয় মা জানেই না।


ফোনটা হাতব্যাগে রেখে পাশের খালি জায়গাটা দেখল রাই। পাঁচ বছরে কত স্মৃতি যে জমেছে এই বেঞ্চটাতে। এখানে বসেই শুভ প্রথমবার রাইয়ের হাত চেপে ধরে বলেছিল "তোকে ছাড়া থাকতে পারব না রে"। রাই সব বুঝেও অবাক হবার ভান করেছিল। বড়ো বড়ো চোখ মেলে জিজ্ঞেস করেছিল "হঠাৎ কি হয়েছে তোর?" 

তুতলে তুতলে "আই লাভ ইউ" বলেছিল শুভ। সেদিনের পরে এটা নিয়ে অনেকবার শুভর লেগপুল করেছে রাই। আজও কথাটা মনে পরতে একা মনে হেসে ফেলল সে।

আরও আরও আছে। পাঁচ বছরে কি একটা দুটো স্মৃতি!! এখানে বসেই তো তারা প্রথমবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। শুভর ঠোঁটে মিশে যেতে যেতেও রাইয়ের মনে হয়েছিল এই মুহুর্তটা অনন্ত নয় কেন। সেদিন

বাড়ি ফেরার পরেও তার সারা মুখে কেমন যেন আবিষ্ট করা এক গন্ধ লেগেছিল। সে গন্ধ কি শুধুই শুভর আফটারশেভের! উহুঁ, ভালোবাসারও বোধহয় নিজস্ব কোনো গন্ধ আছে। নাহলে চোখ বুজেও শুভর উপস্থিতি কিভাবে বুঝতে পারে রাই! 


মন খারাপটা আবার ফিরে আসছে। শুভ কি সত্যিই আসবে না? রাইয়ের সামান্য একটা ভুলে তাদের এতদিনের সম্পর্কটা ভেঙেই যাবে তাহলে। কি অপরাধ তার? সে আগে চাকরি পেয়ে গেছে, এটাই তো। দরকার হয় ছেড়ে দেবে চাকরি।


ঝড় উঠেছে। উত্তর দিক থেকে গোঁ গোঁ শব্দে ঝোড়ো হাওয়া ধেয়ে আসছে। পথচারিরা যে যেদিকে পারছে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। রাইয়ের খুব অসহায় লাগছিল। কিন্তু মনে মনে সংকল্পও করছিলো, যা খুশী হয়ে যাক এখান থেকে সে নড়বে না।

ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রাইয়ের। ছাতাটাও হাওয়ার এক ঝটকায় রাইয়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে উড়তে উড়তে পার্কের এক কোণে চলে গেল। এক হাতে ব্যাগটা বুকে চেপে আর এক হাত দিয়ে শক্ত করে বেঞ্চের হাতল চেপে ধরে বসে আছে রাই। ধুলোর জন্য ভালো করে চোখ খুলতেও পারছে না। 

দামাল হাওয়া ওড়নাটাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো রাইয়ের। ওড়নাটা সামলানোর জন্য উঠে দাঁড়াতেই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে রাইকে ওড়না সুদ্ধু জড়িয়ে ধরলো।


-পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এই ঝড়ের মধ্যে বসে আছিস?

হতভম্ব রাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, তার হাতটা চেপে ধরে ছুটতে শুরু করেছে শুভ। 

পার্কের বাইরে একটা গ্যারেজে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে। রাইকে নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়ল শুভ। হাঁপাচ্ছে দুজনেই।

-এদিকে আয়। রাইকে নিয়ে একপাশে সরে এলো শুভ। এই ওয়েদারে বেরিয়েছিলি কেন? আর ঝড় ওঠার পরেও ওভাবে বসেছিলি! পাগল হয়ে গেছিস? তোর কিছু হলে কি করতাম আমি? 

-আমি জানতাম তুই আসবি। 

চুপ করে যায় শুভ। এই কটা শব্দ শোনার জন্যই তো সেও আজ সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তার ভালোবাসার কাছে এসেছে।

-এতো ভালোবাসিস আমায়? গলা বুজে আসে শুভর।

-আমায় ক্ষমা করে দে শুভ। কাল ঘুমের ঘোরে কি বলতে, কি বলে ফেলেছি। বিশ্বাস কর, আমার লাইফে তোর খুশির থেকে বেশি ইম্পরট্যান্ট আর কিচ্ছু নেই। আমায় ভুল বুঝিস না প্লিজ। অঝোরে কাঁদছে রাই।

-ধুর পাগলি। ভুল বোঝাবুঝির জায়গা আছে বুঝি আমাদের মধ্যে?

রাইয়ের মুখটা দুহাতে তুলে ধরে শুভ। হাওয়ায় এলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো একটা একটা করে সরাতে সরাতে বলে

-তোদের কোম্পানির একটা অ্যাড বেরিয়েছে বলেছিলি না? লিঙ্কটা দিস তো আমায়। রেফারেন্সে তোর নামটাই দেব কিন্তু। রাইয়ের চোখে চোখ রাখে শুভ।

ঝোড়ো বাতাসে চেপে মান-অভিমান, অবিশ্বাস এখন পারি দিয়েছে দূর দেশে।রেখে গেছে শুধু ভালোবাসা।

সকলের চোখ এড়িয়ে শুভর বুকে মাথা রাখল রাই।

কখন যেন ঝড় থেমে গিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। স্বস্তির বৃষ্টি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance