তু চলে গেলি কেনে
তু চলে গেলি কেনে
ফরেস্ট ডির্পাটমেন্টে চাকরি পেয়েছে দিগন্ত আর তারপর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে পোস্টিং , ওই পুজোর ছুটি ছাড়া তার আর কোলকাতার বাড়ি থাকা হয় না এদিকে তার মা একাই থাকে, তাই ভীষণ চিন্তা হয় তার ৷
এবার আবার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে পুরুলিয়ার এক গ্রামে যেতে হবে ৷ মা'র সঙ্গে দেখা করে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো ৷ পৌঁছালো তখন বেশ বেলা গড়িয়েছে ৷ দিগন্ত ওখানে ওর অফিসে দেখা করে তারপর উঠল অফিসের কোয়ার্টার এ ৷
কোয়ার্টারটা যেখানে তার আসে পাশে পুরো ধূ ধূ মাঠ ৷দূরে শাল পিয়ালের জঙ্গল , প্রচুর পাখির আনাগোনা ৷ পরিবেশটা দিগন্তর বেশ ভালোই লাগলো ৷ কিছুক্ষন পর কেয়ার টেকার দিনু এসে বললো , "স্যার আমি দিনু ,যা কিছু লাগবে আমাকে বলবেন ৷"
দিগন্ত বললো , "রান্নার কোনো লোক পাওয়া যাবে ?"
দিনু জানালো আগের যে স্যার ছিলেন তার জন্য যে কাজের মেয়েটি ছিল সে বিয়ে করার পর আর কাজ করছে না তাই নতুন কাউকে খুঁজতে হবে ৷ দিনু বললো , "দু দিন একটু হোটেলের খাবার কষ্ট করে খেয়ে নিন স্যার তারপর আমি দেখছি ৷"
বিকেলের হাল্কা আমেজ ,বেশ চমৎকার আবহাওয়া ৷ দিগন্ত গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়লো, লাল কাঁকরের পথ আর মাটির বাড়ি সব সারি সারি সাজানো যেন জলছবি আঁকা ৷ কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলো গোলমাল হচ্ছে, একটা বাড়ি ঘিরে ,কাছে গিয়ে জানতে পারলো একটা লোক মদ খেয়ে তার স্ত্রীকে পেটাচ্ছে ।
দিগন্ত বললো , "আপনারা এ ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ ?"
গ্রামের লোকেরা বলে উঠলো , "আমরা কি কইরবোক , উ মাহাতো এমোনই গুঁয়ার বটে , রোজ মদ খাবেক আর ই সব ঝামেলা টো লাগাবেক ৷ আমরা কিছু বোইলতে গেলে আমাদের দিকে উ বোঁটি লিয়ে তেড়ে আসবেক ৷"
দিগন্ত ভিতরে গিয়ে ঝগড়া থামানো চেষ্টা করলো , মাহাতো নেশার ঘোরে বলে উঠলো , "ই টা কে বটে, কুথা থিইকে উদয় হলেক , ই তু কে ?"
মাহাতোকে দিগন্ত বাইরে নিয়ে এলো আর পুলিশের ভয় দেখালো , বললো, "এভাবে যদি তুমি রোজ বৌয়ের ওপর অত্যাচার করো , তাহলে পুলিশে দেবো ৷"
গ্রামের লোক মাহাতোকে কল পাড়ে নিয়ে গেল মাথায় জল ঢালবে বলে ৷ মাহাতোর বউ দিগন্তর কাছে নমস্কার করে বললো , "তু র জন্য মু বাঁচলোম আজ, মু র মরোদ্ কাউকে ডর তো পায় লা ৷"
দিগন্ত, গ্রামের সবার প্রিয় হয়ে উঠলো এই ঘটনার পর ৷ পরের দিন ও গেল, গ্রামে সবার সাথে আলাপ করলো ৷
দুদিন পর দিনু একটি মেয়েকে নিয়ে এলো কোয়ার্টার এর সব কাজ এবং দিগন্তর রান্না করে দেবার জন্যে ৷
দিগন্ত বললো ,"তোমার নাম কি ?"
সে উত্তরে জানালো , "মু র নাম ঝুমুর ৷ দিনু বললো আপনি স্যার , কি খাবেন আজ ? বাজার টা তো করতে হবে ।"
দিগন্ত বললো, "কিছু সবজি আর মাছ নিয়ে এসো ৷"
দিনু বাজারে গেলো ৷ ঝুমুর ঘর ঝাঁট দিয়ে ঘর মুছতে মুছতে দিগন্তকে বললো , "তু গ্রামে উ মাহাতোকে শাসন টো করার পর থিকে সবাই তুকে খুব পছন্দ টো করে ৷"
দিগন্ত বললো , "তোমাকে সেদিন কই দেখলাম না তো ৷"
ঝুমুর বললো , "মু ছিলোম, উ খান টো তেই ছিলোম ৷"
দিগন্ত তৈরি হয়ে অফিস চলে গেলো ৷
একদিন দিগন্ত টেবিলে দরকারী লেখালেখি করছে আর ঝুমুর হাঁ
হয়ে দেখছিল ৷ দিগন্ত বললো , "কি হলো কি দেখছো ?
ঝুমুর গালে হাত দিয়ে বললো, "বাপরে তু কোত্ত লিখা পড়া জানিস্ ,তড় তড় করে লিখছিস বটে ৷"
দিগন্ত হেসে উঠলো বললো ,"তুমি লিখতে পড়তে পারো না ?"
ঝুমুর মুখ নীচু করে বললো, "না জানিক নাই ৷ বুড়ি দিদার কাছে থাকি , মা বাপ কেউ নাই ৷ মু রা খুব গরীব , দিদা এতোকাল মু কে মানুষ করেছে এখোন দিদা আর কাম কোইরতে লারে ৷"
দিগন্ত বললো , "তুমি লেখা পড়া শিখবে ?"
ঝুমুর হেসে বললো ,"ইত ধাড়ি বয়োসে শিখলে লোকে হাসবেক্ ৷"
দিগন্ত বললো , "শোনো ঝুমুর লেখা পড়া শেখার কোনো বয়স হয় না তুমি চাইলে আমি তোমাকে শেখাবো ৷"
ঝুমুর খুশি হয়ে বলে উঠলো, "তু শিখাবি মু ..কে..."
রোজ নিয়ম করে দিগন্ত ঝুমুরকে লেখা পড়া শেখাতে শুরু করলো ৷ ঝুমুর কিছু ভুল করলে দিগন্ত বলে ওঠে, "দূর .. তোমার দ্বারা হবে না ৷"
ঝুমুর তখন বলে, "মু ঠিক পারবোক তু শিখা কেনে ৷"
এরকম খুনসুটি চলতে থাকে আর ঝুমুরের পড়াশোনা এগোতে থাকে ৷ একদিন দিগন্তর খুব জ্বর এলো ৷ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো ৷ ঝুমুর এসে কপালে হাত দিয়ে বললো, "ই বাবা এ তো জ্বর ৷" ঝুমুর জল পট্টি দিতে শুরু করলো, দিনুকে দিয়ে ডাক্তার আনালো ৷ দিগন্তর সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তুললো ৷
সেদিন ঝক্ঝকে আকাশ ৷ ঝুমুর বললো , "তু র অসুখ টোর সময় মু শশ্মান কালী মন্দির টো তে মানত টো করেছিলোম ৷আজ পুজা দিবো তু যাবি মু র সাথে ৷"
দিগন্ত ঝুমুরের সাথে গেলো , মন্দিরে পুজোর পর তারা অনেকটা সময় গল্প করে কাটলো ৷ এই অল্প দিনের মধ্যে দিগন্তর প্রতি ঝুমুর , যে টান অনুভব করলো সেই একই টান দিগন্তও অনুভব করল ৷ বন্ধুত্ব ও ভালবাসার মিশেলে এক নাম না জানা টান ৷
কিছু দিন চলার পর দিগন্তর আবার ট্রান্সফারের চিঠি এলো ৷ সে এখানে আর থাকবে না ঝুমুরকে জানালো ৷ ঝুমুর বললো ,"তু চলে যাবিক ,আর কু নো দিন আসবিক নাই ?" ঝুমুর কাঁদতে কাঁদতে বললো , "তু সোত্যি চোলে যাবি ? আর কু নো দিন দেএ -খা হবেক নাই তুর সাথে .. ৷"
দিগন্ত ব্যাগ গোছাতে গোছাতে জানায় তার ট্রান্সফারের চাকরি তাকে চলে যেতেই হবে, আরও বলে, "তুমি তো এখন লেখা পড়া শিখে গেছো , আমি আমার ঠিকানা ,ফোন নাম্বার সব দিয়ে যাচ্ছি কোনো প্রয়োজন হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো ৷"
ঝুমুর মুখ নীচু করে বেরিয়ে যায় ৷
দিগন্তকে ট্রেনে তুলতে দিনু এলো, বললো , "সাবধানে যাবেন স্যার ।"
দিগন্ত বললো, "তুমিও ভালো থেকো ৷"
দিগন্ত ট্রেনে উঠল, ওদিন শশ্মান কালী মন্দিরের পাশের জঙ্গলে বসে বসে ঝুমুর কাঁদতে থাকলো আর নিজের মনে বলতে থাকলো , "তু মু কে ছেড়ে চলে গেলি কেনে ?...আর কু নো দিন তু র সাথে দে- এখা হবেক নাই ৷"
ঝুমুর ভেবেছিল দিগন্ত হয়তো তাকে সাথে নিয়ে যাবে ৷ কিন্তু সব ভাবনা মেলেনা , ভালোবাসার টান দুজনেই অনুভব করেছিল একই ভাবে ৷ তবু ভাবনায় তা রূপ পেলো না ৷ ট্রেনে বসে দিগন্ত ঝুমুরকে খুঁজলো স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ৷ ভাবলো হয়তো ঝুমুর একবার তার সাথে দেখা করতে আসবে ৷
ট্রেন চলতে শুরু করলো ....