টুকুনের উপলব্ধি
টুকুনের উপলব্ধি
টুকুন ভোর রাত্রে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে আজ। এক আকাশ মিটিমিটি তারা তখনও জানান দিচ্ছে তাদের প্রগাঢ় উপস্থিতি, কিন্তু টুকুনের চোখে যে আর ঘুমের লেশমাত্র নেই! গ্যাংটক বেড়াতে এসে থেকে ও খুব উত্তেজিত। আজ ওদের নাথুলা পাস বেড়াতে যাবার কথা। কিন্তু বাধ সেধেছে ওর মায়ের শরীরটা। কি যে হবে শেষমেশ, ভারী চিন্তায় পড়ে গেছে আট বছরের ছেলেটা।
টুকুনেরা পুজোর ছুটিতে এবারে সপ্তাহব্যাপী গ্যাংটক ভ্রমণ সফরে এসেছে। টুকুন, ওর বাবা কল্লোলবাবু, মা মিতশ্রীদেবী তো আছেনই, সাথে আছেন কল্লোলবাবুর অফিসের আরও দুই সহকর্মী এবং তাঁদের পরিবার। মোট বারোজনের জমজমাটি দল।
এবছর নাকি ইতিমধ্যেই ওপরের অঞ্চলে ভারী তুষারপাত হয়ে গেছে। আজকের দিনটা নিয়ে টুকুনের তাই অনেক স্বপ্ন। এই প্রথম ওর বরফ দেখা হবে। উঃ, কি যে আনন্দ! ভাবতেই শিহরণ জাগছে ওর ছোট্ট মনে। ওর সাথে ওদের দলের আরও তিনজন পুঁচকে মিলে রীতিমত পরিকল্পনা করে রেখেছে। বরফে স্লিপ কাটা, হাতে হাত ধরে গোল রিং বানিয়ে বনবন করে ঘোরা, বরফ ছোড়াছুড়ি খেলা, আরও কত কি! স্নো-ম্যান তো একটা বানাতেই হচ্ছে।
আজ সবেমাত্র সফরের তৃতীয় দিন, কিন্তু গতকাল রাত থেকেই টুকুনের মা, মিতশ্রীদেবীর হঠাৎ ধুম জ্বর। টুকুন ভারী আশায় আশায় আছে, ভোরের দিকটায় যদি মায়ের জ্বরটা নেমে যায় আর মা সুস্থবোধ করে, তাহলে বোধহয় বিপদ কেটে যাবে। মানে টুকুন আর ওর বাবা-মা আজ যেতে পারবে নাথুলা পাস, দলের অন্যান্যদের সঙ্গে। কিন্তু ভোর ধীরে ধীরে সকাল হতে, মনে হচ্ছে সে আশা বৃথা।
জ্বর বারেবারে ঘুরেফিরে আসছে।
মিতশ্রীদেবী নিজের অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে কল্লোলবাবুকে একবার বললেন
'তুমি টুকুনকে নিয়ে সাবধানে ঘুরে এসো। সদলবলে যাচ্ছ, তবুও কিন্তু ছেলেটাকে চোখে চোখে রেখো, যা দুরন্ত হয়েছে'
কিন্তু কে শোনে কার কথা? ওমনি কল্লোলবাবু ধমকে উঠলেন
'এই ভিনদেশে তোমাকে এই দুই-জ্বরে রেখে আমরা যাবো ঘুরতে? একদম এসব ভাববেই না'
'আহা, আমি তো জ্বরের ওষুধ খেয়েছি। আজকের দিনটা বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে'
মৃদু আপত্তি জানানোর চেষ্টা করেন মিতশ্রীদেবী, 'ছেলেটাও তো এসে থেকে বরফ দেখবে বলে ছটফট করছে'
কিন্তু ওনার প্রতিবাদ ধোপে টেকেনা।
অবশেষে, সকল ৭টায় অন্যান্যরা যখন বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে, টুকুন তখন ওদের পান্থনিবাসের বাগানের সামনে অসহায়ের মতন ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু।
আজ বড্ড রাগ হচ্ছে ওর মনে মনে। কাল মা যে কোন আক্কেলে ঝপাং করে ওই কাদা জলে পড়ে গেল... তারপর ওই অবস্থায় ঠায় তিনঘন্টা ভিজে কাপড়ে থাকতে হল বলেই তো এসব বিপত্তি ঘটল! ধুর, ডাকুক খেতে, একদম সাড়া দেবে না ও এখন!
মায়ের অসুস্থ শরীরেও টুকুনকে বারংবার ডাকা, গরম মোমো আর স্যুপ দিয়ে প্রাতরাশের অমায়িক হাতছানি, এইসব কিছু অগ্রাহ্য করে টুকুন চুপটি করে বাগানের এক কোনে লুকিয়ে বসে থাকলো। চুপচাপ দেখতে লাগল সামনের দুর্ধর্ষ, অত্যাশ্চর্য, প্রকাণ্ড, মনোমুগ্ধকর পাহাড়টাকে। কতক্ষন যে ওভাবে একনাগাড়ে বসে পাহাড়ে মেঘের আলো-ছায়ার ছলনায় মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল, টুকুন নিজেও জানে না।
হঠাৎ কাঁধের ওপর মায়ের উষ্ণ হাতের স্পর্শনে সম্বিৎ ফেরে ওর। মা ওর জন্য এই জ্বর গায়েও প্রাতরাশ নিয়ে এসেছেন বাগানে। কিন্তু টুকুনের অভিমান যে তখনও বিগলিত হয়নি। ও মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে।
'এবারে একটু খেয়ে নাও সোনা। আগামীকাল শরীর ঠিক হয়ে গেলে, আমরা ঠিক যাবো আবার বেড়াতে' জোর করে মা খাইয়ে দেন দুটো মোমো আর কিছুটা স্যুপ। তারপর টুকুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওই রুগ্ন শরীরেই কোনোমতে টলতে টলতে ঢুকে যান ভেতরে।
কল্লোলবাবু তখন পান্থনিবাসের অফিসঘরে, মালিকের সাথে কথা বলছিলেন। কাছেপিঠে ডাক্তারের খোঁজখবর নিয়ে রাখাটা এই অবস্থায় জরুরি। তাই মা-ছেলের এই পর্বটি ওনার চোখ এড়িয়ে যায়।
মিতশ্রীদেবী ঘরে চলে যেতেই, সামনের রাস্তাটায় মনোনিবেশ করে টুকুন। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর। পান্থনিবাসের বাগানের সামনের দিয়ে বেরিয়ে, রাস্তাটা অনেকটা নীচে ঢাল বেয়ে নেমে গেছে। আর সেই রাস্তারই একটা দৃশ্য ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। নীচের রাস্তা দিয়ে উঠে আসছে সাদা শার্ট, নীল প্যান্ট স্কুল-ইউনিফর্ম পড়া একটা ছেলে। কত আর হবে, ওরই বয়সী হয়তো। বুকের সামনে স্কুল-ব্যাগ। পিঠে বইছে ওর থেকে বয়সে খানিক ছোট আরেকটা ছেলেকে। ব্যাগ আর ছোট ছেলেটার ভারে খানিক নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে। ছোট ছেলেটার পরনেও একই স্কুল-ইউনিফর্ম। তবে ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তার একটা পা পঙ্গু। নিজে হাঁটতে না পারায় কাঁধে চড়েছে ওপর ছেলেটির।
পাহাড়ী ছেলে দুটো পান্থনিবাসের গেটের কাছাকাছি আসতেই, টুকুন দেখল বেশ হাসিহাসি মুখ ওদের। এতটুকু ক্লান্তি অথবা বিষন্নতার রেশ নেই ওদের অভিব্যক্তিতে। বরং, মনে হলো ওরা বেশ গল্প করতে করতে, গুনগুন সুর বেঁধে এগিয়ে চলেছে। টুকুন আর নিজের কৌতুহল নিবৃত্ত করতে না পেরে ছুটে গেল বাইরের গেটের দিকে, ওদের সাথে আলাপ জমাতে।
'তোমরা স্কুলে যাচ্ছ?’
ওর কথায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে ওরা। স্পষ্টতই, ওর ভাষা ওরা বোঝেনি। একটু আগেই, পান্থনিবাসের মালিকের মেয়ে, বছর ষোলোর দ্যুতি বাগানে কাজে বেরিয়েছিল। টুকুনের সাথে দ্যুতির প্রথমদিনেই ভালো আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে। মেয়েটি এতো কম বয়সে কমপক্ষে পাঁচটি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। তাছাড়া এখানকার আঞ্চলিক পাহাড়ি ভাষা তো আছেই। তাই টুকুনের কান্ড দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে এলো ওর দিকে। সব শুনে, ওদের মধ্যে ভাষা অনুবাদ করে দিতে একটুও অসুবিধে হলো না দ্যুতির।
টুকুনকে স্পষ্ট বাংলায় বোঝালো
'ওরা নীচের দিকের গ্রামে থাকে। এই সময়ে রোজ পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। এই রাস্তায় তো আর স্কুল-বাস চলে না, অগত্যা পায়ে হাঁটা ছাড়া গতি নেই।
‘এই হলো অরিক' বড় ছেলেটার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল দ্যুতি, 'আর এই হলো ওর ছোট ভাই মিরিক' কাঁধে চড়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটাকে দেখাল এবার।
'ওরে বাবারে, পায়ে হেঁটে স্কুলে যাও? কতদূর তোমাদের স্কুল?' বড় বড় চোখ করে তাকায় টুকুন। গতকাল বেড়াতে বেরিয়ে, একটুখানি ঢাল বেয়ে উঠে আসতেই তো ও হাঁফিয়ে পড়ছিল! আর এরা কি না রোজ স্কুলে যায় হেঁটে, অবাক হয়ে যায় ও।
টুকুনের প্রশ্নকে এবার দ্যূতি অনুবাদ করে দিতেই ওরা জানালো যে রোজই পায়ে হেঁটে প্রায় ২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে স্কুলে যায় ওরা দুই ভাই। আরও কিছু ছাত্র আসে ওদের গ্রাম থেকে, কিন্তু ওদের দুজনকে একটু বেশী সময় হাতে নিয়ে আগেই বেরিয়ে পড়তে হয়। ছোট ভাই মিরিক সেই জন্ম থেকেই পঙ্গু। তাকে কাঁধে চড়িয়ে স্কুলে পৌঁছতে অনেকটা সময় লাগে। সঠিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল, অনেক খরচাপাতির প্রয়োজন। সেটার জোগান দেওয়া এইমুহুর্তে ওদের মায়ের পক্ষে দুঃসাধ্যকর। কিন্তু এর জন্য পড়াশোনা থেমে থাকেনি মিরিকের। অরিক বড়ভাই হয়ে, ওর মধ্যে প্রচুর উদ্যম আর দায়িত্ববোধ, মিরিকের প্রতি ওর প্রান-অন্ত স্নেহ। তাই রোজ ওরা দুই ভাই মিলে স্কুলে যায় এভাবে, ফেরেও এভাবে। আর স্কুল ছুটির পর মায়ের হেঁশেলে মাকে গরম গরম মোমো বানাতে সাহায্য করে। কত ক্লান্ত পথিক যে ওদের মায়ের মোমো খেয়ে প্রশংসা করে, তার আর শেষ নেই! সেই সবের বিবরণে ওরা মুখর হয়ে ওঠে।
কিছুক্ষন পর, ওরা চলে যায় নিজেদের রাস্তায়। টুকুনের হাতে দিয়ে যায় কিছু সুগন্ধি বুনোফুল, বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে। টুকুনের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়নের সৃষ্টি হয়। ওদের নিজেদের এতো সমস্যার মধ্যেও, কি প্রানবন্ত, কি হাসিখুশি অরিক আর মিরিক! নিজেদের সমস্যাকে হেলায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা। পথ যে ওদের আহ্বান করছে দূরে, আরও কত দূরে...
আর টুকুন কি না এতো ছবির মতন সুন্দর জায়গায় বেড়াতে এসে, ওর মায়ের অসুস্থতার কারণে কি মুষড়েই না পড়েছিল! শুধু কি তাই? নিজের ইচ্ছেটুকু জাহির করতে মায়ের অসুস্থতাকে যে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ করেনি! খুব লজ্জাবোধ হয় ওর নিজের এই ছোট মনোবৃত্তি আর দুর্ব্যবহারের কারণে।
কিন্তু আর নয়। খুব অন্যায় হয়ে গেছে। দুর্গাপুজোর দিনে নিজের মায়ের সাথেই কি না এতো বড়ো অবমাননা করলো ও? চোখদুটো অনুভূতিতে ছলছল করে ওঠে ওর। ছুটতে ছুটতে ওদের হোটেলঘরের দিকে দৌড়ে যায় টুকুন।
'মা, ও মা...'
ছোট্ট টুকুন ওর মায়ের কোলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আজ উপলব্ধি করে, ওই পাহাড়ের থেকেও বৃহৎ, এতো স্নিগ্ধ সুন্দর গ্যাংটকের থেকেও অপরিহার্য্য ওর মায়ের এই নৈস্বর্গিক কোল!
সমাপ্ত ।।