তমশা
তমশা
সকাল থেকে সান্যাল বাড়িতে গান বাজছে। বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে বলে কথা। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি গমগম করছে। সান্যাল গিন্নি (মঞ্জু দেবী) আর তমশার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নেই। তমশা সান্যাল বাড়ির বড় ছেলে অাশিষের বৌ।
সান্যাল গিন্নি কাঁসার বাটিতে করে হলুদ নিয়ে বাঁধানো উঠোনের ছাদনাতলায় এসে ডাক দিলেন........
---------তমা.... এই তমা... তোর ভাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ছাদনা তলায় আয়। আর দেরি করিস না...!!!! এরপর গায়েহলুদ নিয়ে মেয়ের বাড়ি যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে!!!!
----------আশিষ পিছন থেকে বলল, দাঁড়াও.... আসছে, বৌদি এখন দেওর কে... সাজাতে ব্যাস্ত, আর তোমার আদরের ছোট ছেলে চুপ করে বসে আছে, সত্যি ও.... সাজতে এত ভালোবাসে। আমার মনে হয় ও.... আমার ভাই না.... হয়ে বোন হলে ভালো হত...।
----------মঞ্জু দেবী একটু হেসে উঠে বললেন, তা.... যা.... বলেছিস বাবু। আর তমাটাও... পারে কোন সময় মুখে না.... নেই, ভাই যা..... বলবে তাতেই হ্যাঁ.....!!!
----------পিছন থেকে আশিষের পিসিমনি অনিতা দেবী বলে উঠলেন, কি.... কথা নিয়ে মা... ছেলের এত হাসাহাসি হচ্ছে শুনি????
---------মঞ্জু দেবী বলে উঠলেন, আর বলনা.... ছোড়দি, তমা আর তোমার ছোট ভাইপোকে নিয়ে কথা হচ্ছে। তা.... তোমরা এখানে এসে ভালোই করেছ, এখুনি গায়ে হলুদের কাজটা শুরু করতে হবে।
-----------অনিতা দেবী বলে উঠলেন, একটা কথা বলি.... বৌদি কিছু মনে করোনা, তোমরা তমাকে নিয়ে একটু বেশিই আদিখ্যেতা কর। আমার ছেলের বৌ... এই রকম হলে কবেই তাড়িয়ে দিয়ে ছেলের অাবার বিয়ে দিতাম।
-------------মঞ্জু দেবী বলে উঠলেন, এইসব কি... বলছ তুমি ছোড়দি!!! তমা আমার বৌমা নয়.... মেয়ে, আর ওর মত ভালো মেয়ে লাখে একটা হয়, আমাদের সবাই কে.... কত ভালোবেসে যত্ন করে আগলে রেখেছে।
------------অনিতা দেবী মুখটা বেকিয়ে বললেন, যতই ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা কর বৌদি.... সত্যি কখনও চাপা থাকেনা!!!! সেটা ঠিক বেড়িয়ে আসে।
------------মঞ্জু দেবী বলে উঠলেন, কোন সত্যির কথা বলছ তুমি ছোড়দি?
-----------অনিতা দেবী বাঁকা হেসে বললেন কেন জানোনা বুঝি!!!! সবই জানো, শুধু স্বীকার করনা।
----------মঞ্জু দেবী বললেন, কি..... স্বীকার করব বলতো!!!! আমরা কোন মিথ্যা কথা বলেছি বলে মনে তো.... হয়না!!!!
-------------অনিতা দেবী এবার বেশ কঠিন গলায় বললেন, কেন বৌদি তোমার বড় বৌ.... যে বাঁজা সেটা তো... সত্যি নাকি!!!! না..... হলে এত বছর বিয়ে হয়ে গেল, তবুও সন্তান হলোনা!!!! আর কত চাপা দেবে এই সত্যিটা!!!!! এরপর তোমার ছোট ছেলে বাবা হবে, কোলে সন্তান নিয়ে ঘুরবে, তখন বুঝি আশিষের খুব ভালো লাগবে দেখতে, আমার তো.... মনে হয় ঐ.... বাঁজা মেয়ের সাথে আশিষের ডির্ভোস দিয়ে তোমাদের উচিত আশিষের আবার একটা বিয়ে দেওয়া। আশে পাশের সমস্ত আত্মীয় স্বজন অনিতা দেবীর তালে তাল মেলালেন, সবার মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
----------মঞ্জুদেবী আর আশিষ প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যবে, তার আগেই ওদের চোখ মুখের পরিবর্তন হয়ে গেল; আশিষ অস্ফুট স্বরে বলে উঠল তমা.... ঠিক ওদের পিছনে তমশা দাঁড়িয়ে আছে জল ভরা চোখে। সেই ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসিটা হারিয়ে গেছে।
---------মঞ্জু দেবী কথা ঘোরানোর জন্য হাসি হাসি মুখে বলে উঠলেন, আরে তমা অনিকে নিয়ে এসেছিস, আয় তাড়াতাড়ি সবকিছু শুরু করতে হবে কত দেরি হয়ে গেল বলতো!!!!
---------তমশার চোখের কোন বেয়ে জলটা গড়িয়ে পড়ল আশিষ তমশার পাশে দাঁড়িয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে বলে উঠল তমা.....
তমশা আর না দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে চলে গেল আর পিছন থেকে অশিষ, অনি, আর মঞ্জু দেবী তমাকে ডাকতে লাগলেন।
-----------অনি গম্ভীর গলায় বলে উঠল, পিসিমনি একটা কথা বলছি কিছু মনে করোনা!!!!!দুদিনের জন্য আনন্দ করতে এসেছ আমার বিয়েতে সেটাই করনা, আর অন্য কাউকে কষ্ট দিয়ে কাঁদিয়ে কি....সুখ পাও বলতে পারো তুমি ????? আর দাদা তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি আমি, কোথায় প্রতিবাদ করবি তা.....না সব শুনছিস মুখ বুজে।
-----------অনিতা দেবী রাগে গর্জে উঠে বললেন, বাহ্..... বৌদি তোমার ছোট ছেলেকে ঐ.... মেয়ে তো.... ভালোই বশ করেছে, নাহলে পিসির সাথে এইভাবে কথা বলে, সমস্ত শিক্ষা, সহবত সব ভুলে গেছে দেখছি, কে... জানে কি ব্যাপার!!!!আমার তো.....অন্যকিছু মনে হচ্ছে।
----------অনি রাগে চিৎকার করে বলে উঠল, তা..... তো মনে হবেই, কারন নিজেতো কাওকে কোনদিন ভালোবাসতে পারলেনা, তাই কারোর ভালোবাসা, ভালো থাকা, দেখলে তোমার সহ্য হয়না!!!!! তোমার এই স্বভাবের জন্য তোমার একমাত্র ছেলে, ছেলের বৌ তোমার সাথে থাকতে পারলনা, আর বৌদি আমার দিদি আর আমার দিদিকে কেউ খারাপ কথা বললে, আমি সহ্য করবনা!!!!
----------অনিতা দেবী এইবার কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, আমি এক্ষুনি চলে যাব,আমাকে এইভাবে অপমান করলে তোমরা ডেকে এনে, এর থেকে না ডাকলেই পারতে!!!!
-----------মঞ্জু দেবী আর আশিষ দুদিক থেকে অনিতা দেবীকে ধরে বোঝাতে লাগলেন। মঞ্জু দেবী বলে উঠলেন, অনি তুই চুপ করবি,পিসিমনি তোর গুরুজন আর গুরুজনদের সাথে এইভাবে কথা বলতে নেই তুই জানিসনা!!!আমরা তোকে কি.... এই শিক্ষা দিয়েছি????
----------অনি দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল, আমাকে ক্ষমা করো মা....., কিন্তু পিসিমনি যখন বৌদিকে কষ্ট দিল তখন কিছুনা তাইতো.....!!!!!
-----------অনিতা দেবী কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, আমিকি ভুল বলেছি, যেটা সত্যি সেটাই তো বলেছি!!!!
-----------এইবার আশিষ বলে উঠল, না.... পিসিমনি সত্যি বলনি!!!! আমাদের সন্তান শুধুমাত্র তমার জন্য হচ্ছেনা তা... কিন্তু নয়!!!!সমস্যা আমাদের দুজনেরই আছে, কিন্তু সমস্ত কথা, কষ্ট তমাকে সহ্য করতে হয়, কেন বলতো???? আচ্ছা পিসিমনি একটা কথা বলবে মন থেকে, তুমি তো.... একজন মেয়ে তাহলে তুমি নিশ্চয়ই বোঝো একটা মেয়ে যখন মা.... হতে পারেনা তখন তার কতটা কষ্ট হয়! সে তো সব থেকে বেশি চায় মা হতে, তাহলে তাকে কথার তীরে বিদ্ধ করে অতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে কি লাভ বলতে পারো?
---------অনিতা দেবী চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন, এবং তার সাথে আশেপাশের সবাই।
--------মঞ্জু দেবী বলে উঠলেন আশিষ যা তমাকে ডেকে নিয়ে আয় না.... হলে গায়ে হলুদ শুরু হবেনা, ঐ তো..... আগে হলুদ দেবে।
--------আশিষ ডাকতে যাওয়ার আগেই পিছন থেকে একটা গম্ভীর গলা ভেসে আসল, কাউকে ডাকতে যেতে হবেনা....!!! আমার মেয়েকে আমি ডেকে নিয়ে এসেছি!!!
-সবাই সামনে তাকিয়ে দেখল বিকাশ বাবু তমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
-----------বিকাশ বাবু গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, আমার মেয়েকে এই অনুষ্ঠান বাড়িতে আর যেন কাঁদতে না হয়!!!! সবাই কান খুলে শুনে রাখো কথাটা!!! আর হ্যাঁ.... যার যা প্রশ্ন করার সাজেশন দেওয়ার আছে সব আমাকে বলো, তার সঠিক উত্তর আশা করি আমি দিতে পারব।
---------মঞ্জু দেবী এগিয়ে গিয়ে তমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, চল তোর ভাইএর গায়ে হলুদটা শুরু করি, আর পাগলি মেয়ে মন খারাপ করিস না...., আমরা সব সময় তোর সাথে আছি, পাশে আছি।
অনিতা দেবী আর বাকিরা সকলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শুরু হল গায়ে হলুদ। উলু ধ্বনি আর শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল। তমা অনিকে হলুদ মাখিয়ে দিল ভালো করে। আশিষ হাত ভর্তি হলুদ নিয়ে তমার মুখে লাগিয়ে সবার চোখের আড়ালে তমার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলল............
-----------আমার প্রত্যেক জন্মের সাথী হিসেবে এই তমাকেই চাই।
তমা নিজের মাথাটা আশিষের বুকে রাখল। আশিষ আলতো ভাবে তমাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল।

