তাতাইয়ের বড়দিন(তাতাইয়ের গল্প১)
তাতাইয়ের বড়দিন(তাতাইয়ের গল্প১)


---- আচ্ছা বাচ্চারা, তোমরা কেউ বলতে পারবে স্যান্টা ক্লজ কে?
---- আমি জানি আমি জানি।
---- আচ্ছা দিঠি তুমিই বলো।
---- মিস স্যান্টা ক্লজ একজন বুড়ো দাদু। তিনি ছোটো বাচ্চাদের গিফট দেন এক্স-মাসে।
---- একদম ঠিক দিঠি। আচ্ছা কে বলতে পারবে স্যান্টা কি রঙের ড্রেস পরেন?
---- লাল।
---- রাইট মিমো। এবার কেউ বলতো স্যান্টা ক্লজ কিসে চেপে পৃথিবীতে আসেন?
---- স্লেজ গাড়ি।
---- ভেরি গুড। আর স্লেজ গাড়িটা কারা চালায়?
---- সাতটা রেন ডিয়ার মিস।
---- এক্সসিলেন্ট অর্ক। তোমরা তো দেখছি অনেক কিছু জানো। আচ্ছা কেউ কি বলতে পারবে স্যান্টা দাদুর আসল নাম কি?
কেউ জানোনা? আচ্ছা ঠিক আছে। আমিই বলছি। স্যান্টা দাদুর আসল নাম সেন্ট নিকোলাস। উনি একজন ডাচ সন্ত ছিলেন। তিনি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন।
---- ওওও… (সমস্বরে)
---- হুমম। এবার বাচ্চারা আমরা একটা ছোট্ট সিনেমা দেখবো স্যান্টা ক্লজকে নিয়ে। তার থেকে তোমরা আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।
---- ইয়ে (সমস্বরে)
সিনেমার নাম শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তাতাই। এতক্ষণ তার বন্ধুরা স্যান্টা না কি যেন তাকে নিয়ে কত কিছু বলে যাচ্ছিল, এদিকে যে তাতাই কিনা ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল সে স্যান্টাকে নিয়ে একটাও উত্তর দিতে পারল না!!! ভেরি ব্যাড। তবে দেখা যাক মিস তো বললেন সিনেমাটা দেখলে অনেক কিছু জানা যাবে।
★★★★★
---- তাহলে বাচ্চারা আজ থেকে তোমাদের বড়দিনের ছুটি শুরু হল। তোমরা আনন্দ করে কাটাও এই ক'টা দিন। বাড়ির সবার সাথে বেড়াতে যেও, পিকনিক করো। আর স্যান্টা কোনো উপহার দিলে ফিরে এসে জানাতে ভুলো না যেন।
মিসের কথায় সম্বিৎ ফেরে তাতাই এর।। স্যান্টা ক্লজ… এমনও কেউ আছে বলে তো তাতাই জানতোই না এতদিন। আচ্ছা সিনেমায় তো দেখালো স্যান্টা সব বাচ্চাকে গিফট দেন, সব বাচ্চাকে ভালোবাসেন। তাহলে তাতাইকে কেন তিনি কোনোদিনও উপহার দেননি! তাতাইকে কি স্যান্টা ভালোবাসেন না!!
---- এই দিঠি।
---- কিরে?
---- বলছি তোকেও স্যান্টা গিফট দেন?
---- ইয়েস। দেবে না কেন?
এই তাতাই তোকে দেয়না নাকি?
---- না মানে…
---- সেকি কথা! তুই কি কোনো দুষ্টু করেছিস ঐজন্য স্যান্টা দাদু তোর ওপর রেগে আছেন?
---- কই নাতো। আমি তো খুব সোনা।
---- তাহলে ব্যাপারটা কি! আচ্ছা তুই কি খুব নোংরা মোজা রাখিস? স্যান্টা দাদু কিন্তু একদম নোংরা পছন্দ করেননা।
---- মোজা!!!
---- হ্যাঁ। বড়দিনের আগের দিন রাতে তো নিজের মনের ইচ্ছে লিখে একটা মোজায় ভরে মাথার ওপর রেখে দিতে হয়। তাহলে রাত্রে বেলা স্যান্টা দাদু এসে চুপিচুপি গিফট রেখে দিয়ে যান মোজার ভেতর।
----- ওহঃ
এমন ব্যাপার! তাই তো তাতাইকে স্যান্টা দাদু গিফট দেননি কখনও। তাতাই তো মোজাই রাখে না তাহলে দাদু গিফটটা দেবেন কোথায়!
---- আচ্ছা স্যান্টা দাদু গল্প করেন তোর সঙ্গে?
---- ধুরর বোকা স্যান্টা দাদু তো গভীর রাতে আসেন। তখন ছোটো বাচ্চাদের জেগে থাকতে নেই।
---- হুমম।
★★★★★
----- মা মা…
----- কিরে?
---- আমার সেই মিকিমাউস মোজাটা কই গো?
---- কেন রে?
---- আমি সেটা আজ মাথার কাছে রেখে শোবো। স্যান্টা দাদু গিফট দিয়ে যাবেন।
আচ্ছা মা তুমি স্যান্টা দাদুকে চেনো?
---- হুমম চিনি।
---- তোমাকেও স্যান্টা দাদু গিফট দিতো।
---- হ্যাঁ সোনা।
---- তাহলে তুমি এতদিন আমাকে বলোনি কেন? আমিও মোজা রাখতাম!
---- আসলে সোনা…
---- তোমার সঙ্গে আড়ি।
---- আমার সঙ্গে আড়ি করে কি হবে! আমি তোমাকে কেন বলিনি জানো?
---- কেন?
---- স্যান্টা বায়না করা বাচ্চা একদম পছন্দ করেন না। আর তাতাই তো সারাক্ষণ এটা চাই সেটা চাই বলে বায়না করে, মা বাবার কথা শোনে না। তাই তো স্যান্টা আসেননা তাতাই এর কাছে।
মায়ের জবাব শুনে মুখটা শুকিয়ে যায় তাতাই এর। সে আর ছোটাছুটি না করে এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের দুধটা শেষ করে মা'কে বলে,
---- আচ্ছা আমি যদি এই দুদিন একটুও দুষ্টু না করি তাহলে স্যান্টা কি আসবেন?
---- তুমি কি পারবে দুষ্টু না করে থাকতে?
---- খুব পারব। তুমি দেখো।
★★★★★
২৪ শে ডিসেম্বর রাত্রিবেলা তাতাই তার প্রিয় মিকিমাউস মোজাটা মাথার কাছে রেখে ঘুমোতে যায়। মোজাটার ভেতর ভাঙাভাঙ্গা অক্ষরে লিখে রাখে তার মনের ইচ্ছে। সে ঠাকুরকে খুব করে বলেছে সে আর বায়না করবে না, স্যান্টা দাদু যেন তার বাড়ি আসেন। তাতাই ভেবেছিল সে চোখ বন্ধ করে চুপটি করে ঘুমোবার ভান করবে, তারপর স্যান্টা দাদু এলো কিনা দেখবে। কিন্তু রাত ঘন হতে না হতেই ঘুমের দেশের পরিরা এসে এমন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তাতাই এর যে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল তাতাই।
তাতাই ঘুমিয়ে যেতেই দীপিকা দেবী আর দেবেশ বাবু গুটিগুটি পায়ে তাতাইয়ের মাথার কাছে হাত পড়লেন মিকি মাউস মোজায়।
---- কি মনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে তোমার কন্যে? জিজ্ঞেস করলেন দেবেশ বাবু।
---- নিজেই দেখে নাও।
এই বলে চিরকুটটা দেবেশ বাবুর হাতে দিলেন দীপিকা দেবী। দেবেশ বাবু দেখলেন কাগজটায় লেখা ----
"প্রিয় স্যান্টা দাদু, মা বলেছে আমি বায়না করি বলে তুমি নাকি আমার কাছে আসোনা। সরি সরি অনেক সরি দাদু, প্লিজ আমার কাছে এসো। এই দুদিন কিন্তু আমি খুব সোনা হয়েছিলাম। আসলে দাদু কি জানোতো বাড়িতে আমার সঙ্গে খেলার তো কেউ নেই তাই তো আমি নতুন নতুন খেলনা চাই। প্লিজ স্যান্টা দাদু আমার খেলার জন্য একটা জ্যান্ত পুতুল দেবে? আমি তাহলে প্রমিস করছি আমি আর কক্ষনো বায়না করবো না।"
চিরকুটের লেখাটা দেখে দীপিকা দেবীর মুখের দিকে তাকান দেবেশ বাবু,
---- মা তাহলে ঠিকই বলেছিল, এই জন্যই এতো দুস্টুমি করে তাতাই।
এই বলে দুজনের মুখে খেলে যায় রহস্যময় হাসি।
★★★★★
এদিকে সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই মোজায় হাত ভরে তাতাই, কিন্তু মোজা ছিল ফাঁকা। স্যান্টা দাদু আসেননি!!!! ভ্যাঁ করে কেঁদে ওঠে তাতাই। ঠাম্মি ছুটে আসেন ঘরে
---- কি হল দিদিভাই?
সকালবেলা ঠাম্মিকে একটু অবাক হয় তাতাই। রোজ তো এসময় মা বা বাবা যে কেউ আসেন তাকে ঘুম থেকে তুলতে, আর ঠাম্মি তো এসময় ঠাকুর নাম করেন। কিন্তু আজ কি হল?
---- মা কই?
কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে তাতাই।
---- মা বাবা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আনতে গিয়েছেন। এখন তুমি গুড গার্লের মতো ব্রাশ করে খাবার খেয়ে নাও তো।
---- নাহ।
---- আবার তুমি জেদ করছো দিদিভাই? তাহলে মা বাবাকে গিফটটা আনতে না বলে দিই?
তাতাই পড়ে যায় মহা ফাঁপরে। একদিকে মা বাবার ওপর অভিমান হচ্ছে, অন্যদিকে আবার গিফটের ব্যাপারে লোভও হচ্ছে খুব। অগত্যা তাই ঠাম্মির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে। ব্রাশ করে ঠাম্মিকে অনেক ছুটিয়ে ছুটিয়ে কোনোমতে দু'খানা টোস্ট খায় সে। কলাটা পড়েই থাকে প্লেটে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায় মা বাবা তাও ফেরেন না। ঠাম্মির ফোন ঘনঘন বাজতে থাকে, ঠাম্মিও কাকে যেন ঘনঘন ফোন করতে থাকেন। গুজগুজ ফুসফুস করে কথা চলে দুপ্রান্তে। কিচ্ছু বুঝতে পারেনা তাতাই। ঠাম্মিকে জিজ্ঞেস করেন সদুত্তর মেলে না। দুপুরে চিকেন দিয়েও ভাতটা কেমন যেন বেস্বাদ লাগে। ঠাম্মিকে নাস্তানাবুদ করেও শেষ অবধি আর খায়না তাতাই। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে দেখে ঠাম্মি তাকে খুব একটা জোর করে না, ঠাম্মি কেমন যেন অন্যমনস্ক, মুখে চিন্তার ভাঁজ। ভাত খাওয়া হতে ঠাম্মি তাতাই কে ঘুম পাড়াতে যান। স্যান্টার গিফট না দেওয়ার দুঃখ, মা বাবার কি হল সেই ভেবে চিন্তা---- সব মিলিয়ে ঘুম আসতে চায়না তাতাইয়ের, কিন্তু জোর করে ঘুমোবার চেষ্টা করে সে।
---- বেটু, এই বেটু উঠে পড় সোনা, এক জায়গায় যেতে হবে আমাদের।
বাবার গলা শুনে ঘুম ভেঙে মিটমিট করে তাকায় তাতাই। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে, কিন্তু মা নেই। তখনই চট জলদি ঘরে ঢোকেন ঠাম্মি, তার পরনে বাইরে যাওয়ার পোশাক। ঠাম্মি এসে তাতাই এর চোখ মুখ ধুইয়ে ওকে ভালো জামা পরিয়ে দেন। তারপর ওরা বাবার গাড়িতে চেপে পৌঁছে যায় একটা জায়গায়। জায়গাটা দেখেই বুকটা ধক করে ওঠে তাতাইয়ের। এটা তো নার্সিংহোম! মায়ের কি কিছু হয়েছে!!!
বাবার হাত ধরে কাঁপাকাঁপা পায়ে সিঁড়ি বেয়ে একটা কেবিনে ঢোকে তাতাই। দেখে মা শুয়ে আছে বিছানায়। মাকে কেমন যেন শীর্ণ দেখাচ্ছে, মায়ের হাত থেকে একটা নল বেরিয়ে পাশে থাকা একটা স্ট্যান্ডে লাগানো। ভয় পেয়ে যায় তাতাই। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই বাবা বলেন, "ওদিকে দেখ।"
চমকে উঠে ঘরের একপাশে তাকাতেই তাতাইয়ের নজর পড়ে ব্যাপারটা। একটা লোহার দোলনায় নরম বিছানার মধ্যে শোয়ানো একটা লালচে সাদা নরম তুলতুলে জিনিস, তার আবার দুটো চোখ, দুটো কান, নাক সব আছে। গায়ের ঢাকা কাঁথাটার ভেতর থেকে একটা হাত বের করে সে ধরে আছে দোলনার একটা রড।
---- এটা কে বাবা?
---- বিস্ময় ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তাতাই।
---- তুই জ্যান্ত পুতুল চেয়েছিলি না,এটাই তোর জ্যান্ত পুতুল।
---- আমার…!!!
আনন্দে তাতাই ছুটে যায় তার কাছে। সে তার কুতকুতে চোখদুটো একটু খুলে তাতাইকে দেখে আবার বন্ধ করে ফেলে। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায় তাতাই। ক্ষীণ কণ্ঠে মা জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
---- কি নাম রাখবি ওর?
---- উমম… তাতাইয়ের ভাই পিচাই।
---- ধুরর এ আবার কেমন নাম!
বলে ওঠেন ঠাম্মি।
তাতাই গাল ফুলিয়ে বলে,
---- সুন্দর নাম।
তারপরেই তার খেয়াল হয় কিছু। সে বলে ওঠে,
---- আমি তো স্যান্টাকে জ্যান্ত পুতুল চেয়েছিলাম। তোমরা জানলে কি করে?
বাবা মা কেউ কোনো উত্তর দেননা, শুধু চোখাচোখি হয় তাদের মধ্যে। তাতাই এবার সন্দিগ্ধ স্বরে বলে ওঠে,
---- তবে কি মা বাবাই আসলে স্যান্টা ক্লজ?
ওর কথা শুনে হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন সকলে।