SHUBHAMOY MONDAL

Drama Horror Thriller

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Horror Thriller

সত্যি নাকি কল্প?

সত্যি নাকি কল্প?

10 mins
256



শীতটা যাই যাই করেও যাচ্ছিল না, আর গিন্নিও কয়েকদিন ধরে বায়না করছিল দক্ষিণ ভারত ঘুরতে যাবেন বলে। তো তাঁরই আবদারে মার্চের শেষ দিকে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ভারতে বেড়াতে। আমাদের ঘোরাফেরা প্রায় কমপ্লিট হয়ে গেল সব, এমন সময় এল অফিসের সেই ভয়ঙ্কর কলটা। কোন একটা আর্জেন্ট মিটিং-এর জন্য আমাদের জোন থেকে কাউকে এখানেই অ্যাটেন্ড করতে আসতে হতো। বড় সাহেব কিভাবে নাকি জানতে পেরেছেন যে আমার ট্যুর এখানেই শেষ হচ্ছে এই সময়ে। তাই ফ্যামিলিকে কলকাতা পাঠিয়ে দিয়ে আমায় এখানেই থেকে যেতে বললেন। অফিসের গাড়িতে তাদের পিকআপ করে নেবে এয়ারপোর্ট থেকে, বাড়িও পৌঁছে যাবে তারা নিশ্চিন্তে - সেসব নিয়ে অবশ্য কোনো অসুবিধা নেই। 


কিন্তু আমার মুশকিল হলো অন্য জায়গায়, আমি এখানে কয়েকদিন টানা এদিক ওদিক ঘোরার পর ভেবেছিলাম, বাড়ি ফিরে হাত-পা ছড়িয়ে দিন দুয়েক বিশ্রাম নেব - সে বোধহয় আর হল না। যাই হোক, কপাল আমার নেহাত মন্দ নয় অতটা তাই, সাইলেন্ট ভ্যালিতে ক'টা দিন আয়েশ করে ইচ্ছে মত কাটাবার এক অযাচিত সুযোগ এসে গেল – থ্যাঙ্কস্ টু আমার এক প্রিয় রেঞ্জার বন্ধু এবং সেই সময়েই সারাদেশে লাগু লকডাউন-এর কারণেও। মিটিংটা কোনোমতে শেষ হলেও, লকডাউন-এর কারণে বাড়ি ফেরার আর কোন সুযোগ ছিলনা আমার। 


বাড়িতে সবাই আছেন, তাই তাদের নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু আমি এই লকডাউন-এর মধ্যে একা এই দাক্ষিণাত্যে কিভাবে কাটাবো, এ নিয়ে মহা চিন্তায় পড়লাম। এমন সময় হোটেলের লবিতে দেখা হয়ে গেল আমার ঐ রেঞ্জার বন্ধুর সাথে। সব শুনে সে আমাকে তার সঙ্গে নিয়ে এলো এই গভীর বনে ক'টা দিন কাটিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার তখন এই অসময়ে একজন পরিচিত বন্ধুকে পেয়ে যাওয়াটা যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল, তাই কোনোরকম ভাবনা চিন্তা না করে তার সাথে পাড়ি দিলাম সেই গহীন অরণ্যে।


এমন সুবিশাল বনের মধ্যে এভাবে একা থাকার অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয়নি। অবশ্য ঠিক একা না, আমার সঙ্গে ঐ বন্ধুটি এবং তার অফিসের লোকজন ছিল, কিন্তু ভাষা একটা বড় সমস্যা। তাদের কারোরই কথ্য ভাষা বোঝার সামর্থ্য আমার কোনো কালেই ছিল না, আজও নেই। আমার সেই বন্ধুটিও দক্ষিণ ভারতীয়, কিন্তু দীর্ঘদিন আমরা একসাথে দিল্লিতে থাকার ফলে, হিন্দিটা তার ভালই আয়ত্তে আছে এখনও। তাই তার সাথে বাক্কালাপে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছিল না। 


আসলে কি বলুন তো, মাতৃভাষায় কথা বলার মত কোন লোক আশেপাশে না থাকলে আমার যেটা হয়, তা' হল হাজার লোকের ভিড়ের মাঝেও যেন কেমন নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। আমার মধ্যে এটা এত ভীষণভাবে অনুভূত হয় যে এক অর্থে আমি একাই ছিলাম মনে হচ্ছিল ওই বনে। আর তাছাড়া আমন্ত্রিত হয়ে গেলেও, আসলে তো আমি বাধ্য হয়েই সেখানে থাকার জন্য গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। আর সত্যি বলতে কি, পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে একা এভাবে বনের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতাও আমার এই প্রথমই।


যাই হোক, আমার ঐ বন্ধুটির দৌলতে খোলা মনে বনের ভিতর ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা অবশ্য পেয়েছিলাম আমি। আর জীবজন্তুর আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য যা যা করণীয় ছিল সেগুলোও আমি সবসময়ই মেনে চলছিলাম। সে তো আমার সঙ্গে ওর একজন অধঃস্তন সহকর্মীকে নেওয়ার জন্যও বলেছিল, কিন্তু তার কাজ কামাই করিয়ে একজন সরকারি কর্মচারীকে, সে যে পদাধিকারীই হোক না কেন, তাকে এভাবে নিজের ব্যক্তিগত কাজে ইনভল্ভড্ করতে মন চাইলো না আমার।


অবশ্য, আমি বনের এত ভিতরেও যাচ্ছিলাম না যে, ভয়ের কোন কারণ হতে পারতো বা সঙ্গে পরিচিত কেউ না থাকলে বিশেষ কোনো অসুবিধা হতো আমার। স্থানীয় ভাষা না জানার কারণে, সেই স্থানীয় লোকদের সাথে মৌখিক যোগাযোগ স্থাপনে কিঞ্চিৎ বাধা তো আমার হচ্ছিলই, আর সেটা থেকেই নিজের মনেও কেমন জানি একটু হীনমন্যতা বোধ হচ্ছিল। তাই আমি একা একাই এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করছিলাম। সেই একই কারণে, তাদের সাহায্য নেওয়া থেকেও বিরতই থাকছিলাম আমি।


আর সেটা করাই আমার কাল হলো। একা একা, নদীর ধার ধরে বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম আমি। হঠাৎ করেই বেখেয়ালে একটা পাথরের উপর হোঁচট খেলাম, সামনের জায়গাটায় খুব শ্যাওলা জমে থাকার কারণে যথেষ্টই পিছল ছিল। তাই নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে, পা হড়কে পিছলে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেলাম একটা বড় গাছের গুঁড়িতে। আমার মাথার পিছনটা এত জোড়ে ঠুকে গেল সেই গাছের ডালে যে, আছাড় খেয়ে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের চেতনা হারালাম আমি।


কতক্ষণ বেহুঁশ অবস্থায় পড়েছিলাম ওখানে তা' তো জানিনা। জ্ঞান যখন ফিরল তখন আমি এক সম্পূর্ণ অজানা জায়গায় মাটিতে ঘাসের ওপর শুয়ে। মাথায় তখনও বেশ ব্যথা, তাই বিশেষ ওঠা উঠির চেষ্টাই করলাম না। ঘাড় বেঁকিয়ে যতটুকু দেখতে পেলাম চারপাশটা, তাতে মনে হলো - এটা কোন মুনি ঋষির আবাসস্থল বা আশ্রম জাতীয় কিছু হবে। ছোটবেলায় পড়া রূপকথার গল্পের বইয়ে যে সমস্ত মুনি ঋষিদের কুটিরের ছবি দেখেছিলাম, সেই অনুযায়ী জায়গাটা দেখে আমার মনে প্রাচীন তপোবনের সেই সব কুটিরের ছবিই ভেসে উঠলো।


আশেপাশে কাউকেই দেখতে না পেয়ে, নিজেই একা উঠে বসার চেষ্টা করবো কি করবো না এই ভাবছি, এমন সময় একজন জটাজুটধারী সন্ন্যাসীর আগমন ঘটল সেখানে। তাঁর পরনে একখানি গেরুয়া কৌপিন এবং হাতে একটি সিঁদুর মাখা তামার কমণ্ডলু। আমায় চোখ খুলতে দেখে তিনি স্মিত হেসে বললেন - কি, কেমন বোধ করছ তুমি এখন?


আমিও একটু কাষ্ঠহাসি হেসে তাকে উত্তর দিতেই যাচ্ছিলাম 'ভালো', হঠাৎ আমার মনে হল - উনি বাংলা বলছেন কেন? এই দাক্ষিণাত্যের গভীর বনে বাঙালি সন্ন্যাসীর আগমন কি করে ঘটলো? উনি বোধ করি আমার কপালে ভাঁজ পড়া দেখে বিষয়টা বুঝতে পারলেন অথবা তিনি অন্তর্যামী হবেন হয়তো, তাই বললেন - আমি বাঙালি নই সত্য, কিন্তু দীর্ঘদিন পন্ডিচেরিতে শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে কাটানোর সময় বাংলাটা পড়তে, বলতে এবং বুঝতে শিখেছিলাম।


আমার কপালের ভাঁজটা কিছুটা কমলেও, সম্পূর্ণ গেল না দেখে তিনি আবার বললেন - কি ভাবছো, তুমি যে বাঙ্গালী সেটা আমি বুঝলাম কি করে? খুব সহজ, ওই যে তোমার হাতে উল্কি করে লেখা 'জয় মা কালী', ওটা দেখেই বুঝলাম যে তুমি বাঙ্গালী। তাঁর এই কথাটা শুনে, আমি এবার নিজেই একটু লজ্জিত হলাম - তাই তো, আমার এই ভাবনাটা তো বড্ড বোকা বোকা হয়ে গেল! 


তিনি আবার বললেন - তোমার মাথার ব্যাথাটা এখন কেমন বোধ করছো? যেভাবে ফুলে গিয়েছিল মাথার পিছনটা, তাতে মনে হয় তুমি বেশ উঁচু থেকে পড়ে গিয়েছিলে, আর বেশ জোরে আঘাত পেয়েছিলে মাথায়, তাই না? ওই জায়গায় যে অত শ্যাওলা, তুমি খেয়াল করোনি? আমার এই সাঙ্গ-পাঙ্গরা ওখানে না থাকলে তোমার কি অবস্থা হতো ভেবে দেখেছো?


আমি তাঁর ঐ কথা শুনে, আমার প্রাণ রক্ষাকারী তাঁর সেই সব সাঙ্গ পাঙ্গদের ধন্যবাদ জানাবো বলে, তাঁর নির্দেশিত অভিমুখে নিজের ঘাড়টা যথাসম্ভব ঘুরিয়ে তাকাতেই যা দেখলাম, তাতে আর মুখ দিয়ে তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য একটি শব্দও উচ্চারিত হলো না আমার। ভয়ে গলা শুকিয়ে, আমার কন্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।


দেখি, সেখানে দাঁড়িয়ে একটি হাতি, যার দুটি গজদন্ত ভেঙে নেওয়া হয়েছে এবং তার মুখের নিচ দিয়ে গড়াচ্ছে রক্ত। তার পাশে দণ্ডায়মান একটি একশৃঙ্গ গন্ডার, যার শৃঙ্গটি ভেঙে নেওয়া হয়েছে এবং তারও সেখান থেকে গল গল করে ঝরে পড়ছে তাজা রক্ত। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে একটি নধরকান্তি বাঘ, যার পায়ের সমস্ত নখ উপরে নেওয়া হয়েছে এবং রক্তে মাখামাখি তার চারটি পা। সেই মুহূর্তে মাথায় আসেনি কিন্তু এখন বুঝতে পারি, আমার সামনে তখন তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও, আসলে তারা কেউই জীবিত ছিল না!


প্রতিটা প্রাণীই রক্তাক্ত এবং মানুষের কারণেই তারা তাদের নিজ বাসভূমে অবস্থান করার সময়ই আক্রান্ত হয়ে, বিনা অপরাধেই মৃত্যুপথযাত্রী। তাদের প্রত্যেকের চোখেই যেন ঝরে পড়ছে প্রচন্ড ঘৃণা, রাগ এবং প্রতিশোধ স্পৃহা। একথা সত্য যে আমি নিজে কখনও কোন প্রাণী হত্যার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকিনি, কিন্তু আমারই গোত্রের অসংখ্য প্রাণী - যাদের আমরা মানুষ বলেই মনে করে থাকি - তারা এই সমস্ত বন্য জীব জন্তুর জীবন ধারণের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে।


তখন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি - একাধারে আমার রক্ষাকর্তা ওই সমস্ত প্রাণীগুলো, যারা আমারই মত অন্য মানুষের হিংসার বলি; আবার ঐ একই কারণে আমার প্রতি তাদের চোখে ঝরে পড়ছে ঘৃণা, ক্রোধ এবং তীব্র আক্রোশ, যেটা কোনোভাবেই আমি অহেতুক কিংবা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে পারি না।(তখনও অবধি তারা যে বাস্তবে মৃত এই বোধ আমার মনে জাগেনি)।


তবে কি এখন সেই সব অপরাধী মানুষদেরই একজন প্রতিনিধি হিসেবে, আমায় নিজেকেই উৎসর্গ করতে হবে এই সমস্ত নিরাপরাধ বন্য প্রাণীগুলোর কাছে, যাদের অস্তিত্ব এবং জীবন সংকটে পড়েছে আমাদেরই নৃশংসতা ও লোভের কারণে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নির্বাক শুয়ে রয়েছি আমি, এমন সময় সেই সন্ন্যাসী আমার পাশে এসে বললেন - এদের কেউই কখনও সরাসরি কোন মানুষের অনিষ্টের কারণ হয়নি, তবু এদের মৃত্যু ঘটেছে মানুষেরই হাতে, বলতে পারো কোন অপরাধে?


আমার মানুষ হিসাবে লজ্জায় তখন মাথা কাটা গেল যেন, তাই শুয়ে শুয়েই শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তিনি ঈষৎ হেসে বললেন - তাহলে এরা সেই অপরাধী মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে তোমায় যদি এখন মেরে ফেলে, তুমি নিশ্চয়ই তার জন্য তাদের দোষী সাব্যস্ত করবে না? কিন্তু দেখো, এদের পশুত্ব তোমাদের মনুষ্যত্বের থেকে কত উপরে - তারা তোমাদের জন্য নিজেদের এত ক্ষতি এবং অকারণ অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হলেও, বনে আহত এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেও তোমাকে কিন্তু হত্যা করেনি, বরং তোমার প্রাণ রক্ষার জন্য আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে তোমাকে উদ্ধার করতে।


লজ্জায় আমার সত্যিই মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছিলো, কিন্তু মাথায় যন্ত্রণা নিয়ে উঠে বসবার মত ক্ষমতাও তখন ছিল না আমার। সেই সন্ন্যাসী বললেন - আমি অনুভব করতে পারছি, এদের খুন করার অপরাধে অপরাধী সেই সব মানুষদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তুমি প্রাণ হারাতে মন থেকে অসম্মত নও। আমরাও তোমারই মতো একজন বিশুদ্ধ আত্মার মানুষের জন্যই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে রয়েছি। এইসব বিনা অপরাধে প্রাণ হারানো অসহায় প্রাণীদের আত্মার মঙ্গল কামনার্থে, আমি যে দীর্ঘদিন তপস্যা করেছি এই গভীর বনের মধ্যে দুর্গম পাহাড়ের পাদদেশে, তা আজ তোমাকে যজ্ঞাহুতি দিয়ে সার্থক হতে চলেছে। এক তোমার প্রাণের বিনিময়ে এদের সবার আত্মার কল্যাণ এবং মুক্তি হবে, তুমিও তো নিশ্চয়ই তাই চাইবে?


আমার তখন সেই চলচ্ছক্তিহীন অবস্থায় কিছুই করণীয় ছিল না। একে তো আমি শারীরিকভাবে এতটাই দুর্বল যে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবো না কোনোভাবেই, আর সে চেষ্টা করলেও ওই বন্য জন্তুদের (বা আমার সামনে অবয়বধারী তাদের ঐসব অশরীরীদের) কবল থেকে আমার যে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনাও নেই, সে তো বলাই বাহুল্য। তার উপর আছেন আবার এই সন্ন্যাসী নিজে, তিনিও কি আমায় ছেড়ে দেবেন? এই সমস্ত বন্য জীবজন্তু বা তাদের আত্মারা যাঁর বশীভূত, তাঁর হাত থেকে তাঁর অনুমতি বিনা আমার রেহাই পাওয়া যে অসম্ভব, তাও বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তাঁর কাছে আমার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার গুরুত্ব যে আসলে বিন্দুমাত্র নেই তা বুঝতে পেরে, আমি নীরব থাকাই শ্রেয় বলে গণ্য করলাম।


সেই সন্ন্যাসী এরপর তাঁর সেই কুটিরের দ্বারটি খুলে দিলেন। দেখি, এক করালবদনা দেবীমূর্তি কুটির মধ্যে দণ্ডায়মান, আর দ্বার খুলতেই একে একে বনের ভেতর থেকে সেই কুটিরের সামনে এসে হাজির হতে থাকলো অসংখ্য বিকলাঙ্গ সব পশুর দল। তাদের সবাই কোন না কোনভাবে বিনা দোষেই মানুষের আক্রমণে অঙ্গহানির শিকার। 


বুঝতে পারলাম, আমাকে সেই দেবীর যজ্ঞেই আহুতি দেবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন ওই সন্ন্যাসী। বোধ হয় ওখানে এসে জড়ো হওয়া সেই সমস্ত জন্তু জানোয়ারগুলোও বুঝতে পেরেছিল সেটা! তাই যেন তাদের তুমুল উৎফুল্ল আচরণ এবং তদ্রুপ আওয়াজ বের হচ্ছিল মুখ থেকে - ঠিক যেমন পশুবলির আগে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির ভেকধারী মানুষের দল 'মা মা' করে চিৎকার করে নিজেদের উল্লাস প্রকাশ করে, তেমনই!


কুটিরের ভিতর থেকে একটি কাঠের তশলা বের করে নিয়ে এলেন সেই সন্ন্যাসী, তার সঙ্গে একটি বিরাট বড় ভয়ানক দর্শন খাঁড়াও। বুঝলাম, তাঁর ওই তশলায় বেঁধে এই খাঁড়া দিয়েই আমায় বলি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। আমার মন থেকে তখন সেই পশুদের জন্য সমস্ত প্রেম এবং তাদের আত্মার কল্যাণ সাধনের ইচ্ছা, সব উবে গেছে। নিজের আশু প্রাণহানির আশঙ্কায় তখন সম্পূর্ণ দিশেহারা আমি।


মাটিতে সেই তশলাটা পোঁতা হয়ে যেতেই, আমার কাছে এসে কপালে একটা সিঁদুরের তিলক লাগিয়ে দিয়ে, আমার গলায় একটা জবা ফুল এবং বেলপাতার মালা পরিয়ে দিলেন সন্ন্যাসী। তারপর প্রায় চ্যাংদোলা করে আমায় তুলে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন সেই তশলায়! লতাপাতার দড়ি দিয়ে, হাত দু'টোকে পিছমোড়া করে বেঁধে দিলেন, পা দু'টো রেহাই পেল না। সেই হারকাঠে আটকে গেছে আমার গলা, সন্ন্যাসী 'জয় মা' বলে চিৎকার করে তাঁর খাঁড়াটা মাথার উপর ওঠালেন - শিরশ্ছেদ করে আমায় বলি দেবার জন্য! প্রাণভয়ে, শেষবার বাঁচার আকুল আকাঙ্ক্ষায় সজোরে উঠে দাঁড়াবার একটা আপ্রাণ চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ঐ হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় আমি বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারলাম না। সেই অসহায় অবস্থায় অকালে প্রাণ হারানোর ভয়ে আবার নিজের চেতনা হারালাম আমি।


আমার জ্ঞান ফিরলো যে তার ঠিক কতক্ষণ পর জানি না, কিন্তু জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফারিত হয়ে খুলে গেল আমার চোখদুটো - আমি বেঁচে আছি? দেখলাম, আমি শুয়ে আছি আমার ওই বন্ধুর বাংলোর বারান্দায় একটি ক্যাম্প খাটে। আমার কপালে এবং মাথায় দেওয়া হয়েছে বেশ ভালো পরিমাণ বরফের শীতল পট্টি, হাতের নাড়ি দেখছিলেন কেউ একজন, সম্ভবত কোন ডাক্তার হবেন। আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল আমার বন্ধু এবং তার অন্যান্য সহকর্মীরাও!


দীর্ঘক্ষণ বেহুঁশ থাকার পর আমি চোখ খোলায়, বোধ হয় তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শুনলাম, প্রায় চব্বিশ ঘন্টা আমি নিখোঁজ থাকার পর, তারা সেখান থেকে অনেকটা উপরে, ঐ পাহাড়ের একটা গুহার সামনে আমায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় উদ্ধার করেছিল। গা হাত পায়ে একগাদা লতাপাতা জড়ানো অবস্থায়, সেখানে অচেতন হয়ে ঘাসের উপর আমাকে পড়ে থাকতে দেখে, ওরা বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল! তারপর এই বাংলোয় এনে চোখে মুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল তারা। তার ওপর, মাথার পিছনটাও নাকি আঘাত লেগে প্রায় থেঁতলে গেছে দেখে, শহর থেকে ঐ ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল গিয়ে। আগের দিন সারা রাত ঐ ডাক্তারবাবু নানাভাবে চেষ্টা করেও আমার জ্ঞান ফেরাতে পারেননি বলে, সবাই ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।


এখন আমার জ্ঞান ফেরায় তারা তো চিন্তামুক্ত হল, কিন্তু তাদের মুখে সব কথা শুনে আমি নিজে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আগেই বলেছি, আমি হাঁটছিলাম নিচে নদীর ধার ধরে, যখন পিছলে পড়ে যাই। তাহলে, সেখান থেকে অত উপরে পাহাড়ের সেই পাদদেশে আমি গেলাম কি করে? এটা আমার নিজের কাছেই আজও রহস্য! তবে কি সত্যিই আমাকে তারা এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওখানে? তাহলে, তাদের হাত থেকে আমি ছাড়াই বা পেলাম কিভাবে? সেই কথাটা কিছুতেই মনে পড়ছে না আমার।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama