সরলা
সরলা
সেদিন ভঞ্জিপুর গ্রামে একটা শোরগোল পড়ে গেলো। গ্রামের সরলা বউ নাকি নিরুদ্দেশ। পুরো দুটো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরে সরলার শাশুড়ি আজ গ্রামের মোড়লকে জানিয়েছে। ফলে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে সরলার শশুর বাড়িতে। শাশুড়ি নির্বিকার, যেনো এটা একটা সাধারণ ঘটনা, যার মধ্যে আশর্য হওয়ার মতো কিছুই নেই। মুখেও অনর্গল বউয়ের গুষ্টির তুষ্টি করছে। তার বাপের বাড়ি থেকেই নাকি কোনো সভ্যতা ভব্যতা শেখায় নি, তাই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সাহস করেছে। গ্রামের দু চারজন তাকে মনে করিয়ে দিতে ভুললো না সরলা মাত্র বারো বছর বয়সে বউ হয়ে শশুর বাড়িতে এসেছিল। তার অভাবী বাবা দুটো পেট ভরে খেতে পাবে বলে ওই ছোট্ট মেয়েটিকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছিলো।
অবশ্য তখন এটা জানতো না জামাই মানসিক অসুস্থ। সরলার শশুর শাশুড়ি ভেবেছিলো ছেলে বিয়ে করলে আর পাগলামি করবে না। নিজেদের স্বার্থে এক সরল সাধাসিধা গ্রামের মেয়ের জীবনটা তছনছ করে দিয়েছিল। তবু গরীব বাবা মা একটি কথাও বলে নি। মেয়ের কপালের দোহাই দিয়ে সব মেনে নিয়েছিল। আর নিজেদেরই খাওয়ার সংস্থান নেই তাতে মেয়েকে বিয়ের পর কাছে রাখতে হলে খাওয়াই জুটবে না। বরং মেয়ের পিঠে কালশিটে দাগ দেখে তাকে দু কথা বলে সান্তনা দেওয়াই শ্রেয় মনে করতো। মেয়ে দুদিন বাপের বাড়ি এসে থাকতে চাইলে তাকে পরদিনই শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলত, বাহানার অভাব ছিল না, শাশুড়ি শশুর রাগ করবে বা জামাইয়ের ঠিকমতো ওষুধ খাওয়া হবে না, এইরকম আর কি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এইসব কথা শশুরবাড়ি থেকে না শুনে নিজের বাবা মায়ের থেকেই শুনতে হতো সরলাকে। আর শ্বশুর বাড়ি অবশ্য অনেকদিন মুখে বলা ছেড়েই দিয়েছিল, তাদের হাতেই বলা শুরু হয়েছিল। সামান্য কারণে শ্বশুর শ্বাশুড়ি গায়ে হাত তুলতো সরলার। শুধু তাই নয় মুখে কোনো উত্তর করলে গরম খুন্তির ছেঁকাও তার গায়ে পড়ত। সরলা লেখাপড়া একেবারে জানত না তা নয়, তার অক্ষর জ্ঞান ছিল।
গল্পের বই পেলে সঙ্গে সঙ্গে পড়তে শুরু করতো। কোনো জটিল শব্দ বুঝতে না পারলে পাশের বাড়ির ছেলে বঙ্কুর কাছে হাজির হতো। সেই নিয়ে শাশুড়ি এক লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে দিতে একটুও সময় নিত না। শেষে বউকে পিটিয়ে শান্তি হতো। বঙ্কু সরলার থেকে অনেকটাই বয়সে ছোট। তবু একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আসলে সারাদিন শ্বাশুড়ির গঞ্জনা শুনে শুনে সরলা বিরক্ত হয়ে যেত, তাই বঙ্কুর কাছে গিয়ে ওর গল্পের বই নিয়ে পড়ত, আবার কখনো বংকুর হাতে আঁকা ছবিতে জল রং করতে বসে যেত। বঙ্কু সরলার এই সঠিক রং নির্বাচন দেখে এক এক সময় খুব অবাক হয়ে যেত। কোথাও আঁকা না শিখেও সরলার আঁকা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তবে শাশুড়ির ভয়ে খুব বেশি সময় দিতে পারতো না, লুকিয়ে লুকিয়ে বংকুর দেওয়া রং তুলি নিয়ে রাতের বেলা বসে যেত। সরলার স্বামী রাতের ওষুধ খেলে আর ইহ জগতে থাকতো না। অনেক রাত পর্যন্ত নিজের মনে এঁকে যেত সরলা। পরদিন বঙ্কুকে দেখালে সে আশর্য হয়ে যেত,বলতো "বৌদি, তুমি যেমন সুন্দর আঁকো, আমার স্যার দেখলে তোমাকে ডেকে পাঠাবে, জানো তো" সরলা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠতো "ছাড়ো, শুধু তুমিই বলো সুন্দর, কই আর তো কেউ বলে না?" বঙ্কু এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে "আচ্ছা তাই তো, তবে দেখো কাল তোমার আঁকা ছবি আমি স্কুলের নতুন স্যার কে দেখবো, তখন দেখো কি বলে" সরলা এবার আঁকা কাগজ বঙ্কুর থেকে কেড়ে নিতে যায় কিন্তু সমর্থ না হয়ে বঙ্কুকে সতর্ক করে যায়, তার শাশুড়ি যেনো ওই আঁকা কোনোভাবেই দেখতে না পারে, পেলে ওর আর নিস্তার থাকবে না।
এত জটলার মাঝে সরলার শাশুড়ি বঙ্কুকে দেখেই চিৎকার করে উঠলো "অ্যাই বঙ্কু তুই তো সরলার সাথে খুব গল্প করতিস, কথায় পালিয়েছে কিছু জানিস?" বঙ্কু চুপ করে থাকলো। তার চোখের সামনে তখন একটি ছবিই ভাসছে। এক গ্রামের বধূ উনুনের সামনে বসে রান্না করছে, তার হাতে ধরা তুলি, কোলে রাখা একটা সাদা কাগজ, মুখখানি এত সুন্দর যে সেটা ছবি নয়, মনে হচ্ছে যেনো সরলা বৌদি নিজেই নিজের ছবি এঁকেছে। আজ এই ছবি প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। নতুন স্যার ছবিটি পাঠিয়েছেন প্রতিযোগিতায়। সরলা বৌদির কোনো আপত্তি না শুনে বরং তাকে রাজি করিয়েছে পুরস্কার আনতে কলকাতা যাওয়ার জন্য। বঙ্কু র বুদ্ধিতেই প্রথমবার বাপের বাড়ির নাম করে নতুন স্যারের কাছে গিয়েছিল স্যার সামনে তার আঁকা দেখে হীরা চিনতে একটুও ভুল করেননি। সরলা তার গুণের কদরে প্রথম প্রথম হতবাক হলেও পরে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সে ছিল এক কুয়োর ব্যাঙ কিন্তু তার আঁকা তাকে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে এলো। কিন্তু সমস্যায় পড়লো কলকাতা যাওয়া নিয়ে। এখানেও মুশকিল আসান করলো বঙ্কু। কথা ছিলো সরলার স্বামীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার নাম করে কলকাতায় যাবে কিন্তু বাদ সাধলো শাশুড়ি। সে সরলাকে না পাঠিয়ে নিজে যাওয়াই মনস্থির করলো। বঙ্কু ধরেই নিয়েছিলো সরলা বৌদির আর কিছুতেই যাওয়া হবে না। তবে পরদিন বৌদির কথায় প্রথমে অবাক হলেও মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল। সরলা কাউকে না বলেই কলকাতায় পুরস্কার নিতে যাবে বলে ঠিক করেই নিয়েছিলো। গেলও তাই । শুধু বঙ্কু ছাড়া গ্রামের আর কেউ জানলো না তাদের গ্রামের এক অল্প শিক্ষিতা গৃহ বধূ এত বড় আঁকার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। অবশ্য তা জানলে আর সরলার পুরস্কার নিতে যাওয়া হতো না। বঙ্কু এতক্ষণ কোনো উত্তর দেয় নি। এবার বললো "সরলা বৌদি যেখানেই যাক, চিন্তা নেই, তোমার মুখে কালি দেবে না" শেষের কথাটা সরলার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো। শাশুড়িও চেঁচিয়ে এত লোকের সামনে প্রতিজ্ঞা করতে ছাড়লো না যে সরলা ফিরলে তার ঘরে আর ঠাঁই হবে না।
সরলা সত্যি ফিরলো পরদিন। সাথে একটি নতুন ব্যাগ। বঙ্কু দেখেই সাবধান করলো "বৌদি, ও বাড়ি যেও না গো, তোমাকে ওরা আর ঘরে ঢুকতে দেবে না বলেছে" সরলা এ কথা শুনে মুচকি হেসে উত্তর দিলো "ঠিক আছে বঙ্কু তোর চিন্তা নেই, আমি আর ওদের বাড়ি থাকবো না, সেটাই বলতে এসেছি" বঙ্কু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। সরল গ্রাম্য বৌদির এই পরিবর্তন যেনো সে বিশ্বাস করতেই পারছিল না। সরলার অন্তর ভেঙে চুরে নতুন করে কেউ গড়েছে। নিজের প্রতি বিশ্বাস, যা ছিল শূন্য, তা এখন ভরপুর। নতুন স্যার সরলার গুনকে এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে করেছেন যথেষ্ট সাহায্য। সরলা সেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে চিরদিনের মত চলে এসেছিল। না আর অত্যাচারিত হতে দেয় নি নিজেকে। নিজের চারপাশের ফাঁকা জায়গাটা ভরিয়ে তুলেছিল আত্মবিশ্বাস দিয়ে। নতুন স্যারের আঁকার স্কুলের চাকরি তাকে সংস্থান করে দিয়েছিলো থাকা খাওয়ার। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি সরলাকে।
