STORYMIRROR

Ariful Islam

Others

4.4  

Ariful Islam

Others

সফলতার আক্ষেপ

সফলতার আক্ষেপ

6 mins
368


"মাম্মু, স্কুলে ক্লাস হয় না, শুধু শুধু স্কুলে বসে থেকে লাভ নাই। বাসায় পড়ব।" রান্নাঘর থেকে মা," কাল তো বললি না। এখন স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে আর তালবাহানা শুরু হয়েছে। তমা এসে কি কানপরা দিয়ে গেছে শুনি। বাসায় পড়বো! পড়ে উল্টে দেবে!স্কুলে গিয়ে বসে থাকবি তাও ভালো। তমার সাথে ঘুরাঘুরি আমার একদম পছন্দ না। এই নে খেয়ে স্কুলের জন্য রেডী হ।" 

মিসেস রিনা খান অভিজাত এলাকায় বাস করা এক অভিজাত গৃহীনি । ছেলে মেয়ের লেখাপড়া আর স্বামীর সেবা এটাকে একপ্রকার চাকুরী বলেই মেনে নিয়েছেন। নিজে রান্না করে খেতে পছন্দ করেন। স্বামী ব্যবসায়ী। তেমন ছুটি কাটান না। তাই তাকেই সম্পূর্ন সময় দিতে হয় বাচ্চাদের। অবসরে বই আর কেনাকাটা। অঢেল সম্পদ। এই তো গোছালো জীবন। কত সুখ!

কিন্তু মাঝেমধ্যে তাকে আকাশের দিকে উদাস তাকিয়ে থাকতে দেখলে অবাক লাগে। মনের মধ্যে কিছুতো একটা আছে। 

"মাম্মু, আমি স্কুলে যাচ্ছি।"

মেয়ের সাথে স্কুলে যায় আইরিন। আইরিনকে অনেক ভরসা করেন রিনা খান। গ্রামের মেয়ে কিন্তু অনেক বুদ্ধিমতি। আসলে গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। রিনা খানও গ্রামে বড় হয়েছেন। আইরিন তার দুসম্পর্কের ভাগনি হয়। গতবার এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করার পর আইরিনের বাবা এসেছিল রিনা খানের কাছে তার একটা কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না? তখন রিনা খান বাড়িতে ছিল। আইরিন শুদ্ধ কথা বলে যে কারনেই সে তাকে নিয়ে এসেছে। 

(কলিং বেলের শব্দ) বুয়া এসেছে। 

বুয়া কে তার সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দেয়া হবে। সবকিছু গুছিয়ে ম্যাডামকে ডাকবে রান্নার জন্য। সে পর্যন্ত ম্যাডাম বই পড়বে আর অতিতের কথা ভাববে। 

লতার মা, "হাফসার আসার সময় হলো, গোসলের পানি বসাও।" 

"জ্বী, আফা বসাইতাছি।"

কিছুক্ষন পর, " দেখোতো, হাফসা এলো মনে হয়।"

"জ্বী,আফা।"

"মাম্মু, আইরিন আমাকে ফুল কিনে দিয়েছে।"

"হাফসা, তোমাকে না বলেছি নাম ধরে ডাকবে না, আপু বলবে।"

আইরিন বলল," খালামনি, আলামিন ভাই(ড্রাইভার) আজকেও আসতে দেরি করছে।"

" আচ্ছা, তোর খালুকে জানাবো। হাফসার ড্রেস চেন্জ করে দে আর গোসল করিয়ে দে।"

"মাম্মু, আজকে গোসল করব না।"

" কালকেও গোসল করোনি, যাও, আজকে রোদ উঠেছে। গোসল করে এসো ছাদে নিয়ে যাব।" 

" ম্যাডাম রান্না করতে আসেন" বুয়ার ডাক।

"আসতেছি, তুমি বাচ্চাদের ঘরটা আগে মুছে দাও।"

"জ্বী, ম্যাডাম।"

"কদিন টানা বৃষ্টির পর আজকে রোদ উঠেছিল ভালই। হাফসার বাবা ইদানিং সন্ধা সন্ধাই বাড়ি ফিরে। আজকে দেরী করছে। দুপুরে ফোন দিয়েছিল। কেমন যেন রহস্য রহস্য ভাব ছিল কথার মধ্যে।"রিনা খান ভাবছেন।

" আইরিন, দেখতো তোর খালু মনে হয় এসেছে।"

"আচ্ছা, দেখছি খালামনি।"

রিসাব আর সপ্না প্রবেশ করল।

" তোর খালামনি কই।"

"ছোট বাবুর সাথে খেলা করে।"

" কেমন আছেন সপ্না আন্টি?"

" হ্যা, ভালো আছি। তুই আমাকে আন্টি বলিছ না তো। ধর, এগুলো নিয়ে ভিতরে রাখ।"

" আচ্ছা, আন্টি!( মুচকি হাঁসি)"

এক গুচ্ছ রজনিগন্ধা হাতে 

 রিসাব: "হ্যাপি বার্থডে মাই হার্ট" 

রিনা: "ওহ মাই গড, এজন্যই এতো রহস্য।হুম"

সপ্না: "শুভ পয়দা দিবস, জানুরে।"

রিনা: "ধন্যবাদ রে! আমার তো মনেই ছিল না। এখন জন্মদিন পালন বাচ্চা বাচ্চা লাগে।"

চার বছরের সাদমান বলে উঠল, "হ্যাপি বাড্ডে মাম্মু, আমার জন্মদিন আর কতদিন পরে মাম্মু।"

সবাই হেসে ফেললো।

সবাই মিলে কেক কেটে একটা ছোট খাট অনুষ্ঠান হলো।

সপ্না,রিনা আর রিসাব ছাদে বসেছে।

রিনা: "রাকিব এসেছে ইন্ডিয়া থেকে?"

সপ্না: "না, ও আগামি সপ্তাহে আসবে।" 

রিনা: "এত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে সময় দিস অনেক ভালো লাগে।"

সপ্না: "আপনজনদেরকে দেওয়া সময়টুকুই তো আপন সময়। তা সারাদিন বাসায় বসে কি করিস বোরিং লাগে না। কিছু একটা কর! রিসাব ভাই কি বল?"

রিসাব: "হ্যা, অবশ্যই। ও যদি চায়! এখন বাচ্চাদের দেখাশুনা আইরিন করতে পারে। আমরাও মাঝে মধ্যে সময় দিব।"

সপ্না: "কিছু করলে তোরও সময়টা ভালো কাটবে।" 

রিনা: "নারে, এখন আর ওসব মনে আসে না। এই তো ভালো আছি।"

সপ্না: "তোর থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি জীবনে। কিন্তু তোর স্পিরিটটা এখন খুজে পাই না। কথায় সেই উচ্ছলতা নেই। এমন তোকে বড্ড অপছন্দ আমার।"

রিসাব: "হ্যা, আমি বুঝি এই সংসার, বাচ্চা তোমার জীবন থেকে অনেকটা সময় কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এখন তুমি আবার শুরু কর।" 

রিনা: "আমার ওসবে কোন আক্ষেপ নেই। মায়ের দায়িত্ব পালন করাও তো একটা কাজ। তা তুই চেক আপ করাচ্ছিস ঠিকমতো। সাবধানে চলিস এতো কাজের চাপ নিস না।"

সপ্না: "হ্যা, আগামীমাস থেকে প্রেগন্যান্সির ছুটি শুরু হবে। তাহলে তো এখন উঠতে হয় অনেক রাত হলো।"

রিসাব: "চলো আমরাও উঠি।"

রিনা: "তোমরা যাও আমি আরেকটু বসব।"

রিসাব: "আচ্ছা, আমি তবে সপ্নাকে বিদায় জানিয়ে আসছি।"

রিনা আকাশের দিকে তাকালো। আর আমার তার অতিতের কিছু কথা মনে পড়ে গেল।

সপ্না, রিনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবি। ভার্সিটি ভর্তির দিন থেকে আজ অবধি টিকে আছে তাদের সম্পর্ক।মনে হয় এইতো

সেদিন সপ্না পিছন থেকে ডাক দিল, "বইন আমি ফর্মটা পূরন করতে পারছি না, একটু হেল্প করবা।" রিনা বলল, ''আচ্ছা, ঠিক আছে আমি বলছি তুমি লিখ।" সেই থেকেই বলাবলি চলছে। তিনজনেই ভর্তি হয়েছিল বিবিএ কোর্সে। রিসাব ছিল থার্ড ইয়ারে। হ্যান্ডসাম তকমাটা পেয়েছিল মেয়েদের থেকে। 

একটা সেমিনারে রিনার পাশের সিটে বসেছিল রিসাব। সেখানে কি হয়েছিল ওর কে জানে!! প্রতিদিন কোন না কোন বাহানায় রিনার সামনেই হাজির হতো রিসাব। তারপর বন্ধুত্ব। হঠাৎ রিসাবের সাথে ঝগড়া কথা বন্ধ। কি কারন? কারন রিসাব তাকে প্রপোজ করেছে। ঝগড়ার মাঝে ঝামেলাটা পোহাতে হয়েছিল সপ্নাকে। রিনা প্রেম একদম পছন্দ করে না। সে মেধাবী ছাত্রী। তার সপ্ন অনেক বিশাল। প্রেমের কাছে সে পরাজিত হবে না। সে মাস্টার্স করবে তারপর নিজে প্রতিষ্ঠিত হবে। বিয়ে তার কাছে অপশনাল। সপ্না এসব রিসাবকে বুঝায়। সপ্না রিসাবকে অনেক পছন্দ করে। সপ্নার ইচ্ছা রিসাব রিনাকে ছেড়ে তার কাছে চলে আসুক। রিসাব সপ্নাকে বুঝায় ওকে তো আমি এখনি বিয়ে করতে বলছি না। আচ্ছা প্রেম করতে হবে না। আমরা বন্ধুই ভালো। সপ্না রিনার সাথে কিছুটা হিংসা করে। ইস, রিসাবকে পেলে আমি পড়াশুনা কেন, এই জীবন ছেড়ে দেব। সপ্নার এসব কথা শুনে রিনা ভাবে রিসাবকে সপ্নার ব্যপারে ইমপ্রেস করবে। সপ্নাকে সে বলে আমি চেষ্টা করব রিসাবকে তোর সাথে জুড়ে দিতে। এতে আমার ঝামেলাও কমবে। ওর ইমপ্রেস মার্কা কথা শুনতে আমার বিরক্ত লাগে। রিসাবকে রিনা সপ্নার আবেগের কথা বলেছিল। রিসাব সেদিন অনেকটাই কষ্ট পেয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল রিনা আমাকে এতটাই অপছন্দ করে যে সে আমাকে সরানোর জন্য এসব করছে। মেয়েদের মন বুঝতে পারাটাই বোকামি। রিনাকে সে বলেছিল তুমি আমাকে পছন্দ করো না ভালো কথা। তোমাকে অন্যের চামচামি তো করতে বলি নাই। সেদিন থেকেই সপ্না রিনা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল রিসাব। কালে ভদ্রে দেখা হতো তাদের। দু-মাস পর যখন সপ্না খবর নিয়ে এলো রিসাব অন্য একটা মেয়ের সাথে ভালোই সময় কাটাচ্ছে তখন রিনার ভাবগতি দেখে একটা জিনিস তো বুঝলাম। ভালবাসি কথাকে তো অবহেলা করা যায় কিন্তু ভালোবাসাকে নয়। তারপর দীর্ঘ শর্ত সম্বলিত একটা প্রেমপত্র লিখেছিল রিনা। যার মূল বিষয় ছিল নিজের ক্যারিয়ার। রিনার কাছে তো শর্ত বড় ছিল কিন্তু রিসাবের কাছে বড় ছিল ভালবাসা। অতএব ভালবাসা বাসি। সপ্না কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার চেয়ে পড়াশুনায় মনোযোগ দেওয়াকেই ভালো মনে করেছিল। এর মধ্যেই মাস্টার্স কমপ্লিট রিসাবের। নিজের বাবার ফার্মেই যোগদান করতে হলো। সবই ঠিক ছিল কিন্তু রিসাবের বাবা মা ছেলেকে বিয়ে করাবে। 

"বাবা রিসাব, পছন্দ থাকলে বল না থাকলে আমরা পাত্রী খুজবো।" রিসাবকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বলতে হলো রিনার কথা। কিন্তু সে বলেছিল রিনার পড়াশুনার পরই তারা বিয়ে করবে। রিসাবের বাবা মার মাথায় হাত সে তো অনেক দেরি। তাই তারা আগ্রহ করেই রিনাকে না জানিয়েই রিনার বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করেছিল। রিনার বাবা মা ছেলের আর্থিক অবস্থা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই অবাক। 

"রিনা মা, তোরা তো দুজন দুজনাকে পছন্দ করিস, তারাও আগ্রহ করে এসেছে। লেখাপড়া তো মা বিয়ের পরেও করা যায়।" সংকট সমাধান করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না রিনার। বিয়েতে সপ্না অনেক আনন্দ করেছিল। সপ্নার কি আফসোস ছিল কিছুটা! যাওয়ার সময় বলেছিল "বান্ধবি তুই অনেক ভাগ্যবতী। এমন সফল প্রেম কাহিনী সবাই লিখতে পারে না।"

সপ্তাহখানেক পর।

"তুমি কাল থেকে ক্লাসে যাও। সামনে পরীক্ষা। এতদিন ক্লাস মিস করা উচিত হবে না।" রিসাবের এই সাপোর্ট অনেক আশা দিয়েছিল রিনাকে।কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার তিন মাস আগে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল সে। ডাক্তারখানায় রিনার হাতে হাত রেখে রিসাব বলছিল "কত বলি এত রাত জেগে পড়ো না। এখন হলো তো।" কি হল? ডাক্তার নতুন সফলতার কথা বলে গেলেন। সেটা হলো মা হওয়ার সফলতা। রিসাব সেদিন কিছুই বলতে পারে নি রিনাকে। শুধু বলেছিল, " তুমি যদি বল ব্যাপারটা গোপন রাখব।" কিন্তু রিনা বুঝেছিল রিসাবের মতো মানুষের এ চিন্তা বাহ্যিক। তাই রিনাই আগ্রহ করে জানিয়েছিল খুশির সংবাদ। তারপরে রিসাবের মুখের সেই হাসিটা সত্যি অসাধারন ছিল। সপ্না বাড়িতে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছিল। তুই তো আরেকধাপ এগিয়ে গেলি রে বান্ধবী। 

ডেলিভারির দিন রেজাল্ট এসেছিল অনার্সের। সেকেন্ড ক্লাস আর বেবী দুই সফলতা একদিনে। কোনটা উৎযাপন করবে রীনা। সপ্না রেজাল্ট আনতে যায়নি। বান্ধবীর কাছে এসেছে সে। বান্ধবীর সাথে রক্তের গ্রুপ মিল তার। তবে খবর নিয়েছে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার। একটা রমরমা আনন্দ সবার। 

কিছুদিন পরে সপ্না মাস্টার্সে ভর্তি হলেও রিনাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তার বাবুকে নিয়ে। সপ্না জিজ্ঞেস করেছিল " কিরে ভর্তি হবি?" রিনা," নারে বোন এবার না।"

তারপর কেটে গেল তিনটি বছর। হঠাৎ একদিন সপ্না এসেছিল বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। বান্ধবীকে পেয়ে এক অসাধারন মুহুর্ত। দুজনের কাছেই ছিল খুশির সংবাদ। সপ্না বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে সিলেক্ট হয়েছে। রিনা আবার মা হবে। তবে রিনার এবারের সফলতা তার ঐচ্ছিক। দুজনের সুখ দুঃখ বিনিময়ের পর সপ্না যখন চলে গেল তখন রিনার মনের ভেতরের ঝাকুনি গুলো অনুভব করার ক্ষমতা কারো ছিল না। শুধু আমি ছাড়া। হ্যাঁ আমি! কি ভাবছেন? আমি তাহলে কে? আমার নাম আক্ষেপ।

"চলে এসো রিনা বৃষ্টি নামবে মনে হয়।"



Rate this content
Log in