সন্ন্যাসী
সন্ন্যাসী
ভুবন প্রায় তিন দিন হলো ধুম জ্বরে বেঘোর হয়ে পড়েছিল মন্দিরের সামনে, অশ্বত্থ গাছের বাঁধানো বেদীতে। আজ একটু উঠে বসতে পেরেছে। সন্ন্যাস নেওয়ার পর থেকে এই প্রথম একা পরিভ্রমণে বেরিয়েছে। এর আগে যতবার ভ্রমণ করেছে সাথে গুরু ভাই বংশী ছিল। গুরু যেদিন বললেন "এবার তুই একা যাবি, জীবনের সব কিছু একা করলে অভিজ্ঞতা অনেক বেশি হয়"। গুরুর কথা শিরোধার্য করে পরদিনই বেরিয়ে পড়ে সে। সাথে
একটা লাঠি আর পুঁটুলি তে একটা গেরুয়া কাপড় বই আর কিছু নেই নি। সন্ন্যাসীদের আর কী ই বা নেওয়ার আছে। সাতদিন হলো বেরিয়েছে। এই ছাতিম তলার গ্রামে এসেছে দিন চার আগে। এখনও অনেক পথ বাকি রাধা মাধব মন্দিরে পৌঁছুতে। শরীরটা ঠিক যুত না থাকায় ভেবেছিল গ্রামের শিব মন্দিরের পাশে গাছের বেদীতে শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবে কিন্তু কখন যে দু চোখ বুজে এসেছে টের পায় নি। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে দ্যাখে গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেই ঘোর ভাঙতে প্রায় তিন দিন লাগলো। ভুবন আস্তে আস্তে উঠে দীঘির জলে হাত মুখ ধুয়ে মন্দিরে বিগ্রহ প্রণাম করে। তিনদিন কোনো খাবার পড়ে নি পেটে। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছিল। এই মন্দির গ্রামের শেষ প্রান্তে তাই লোকজন তেমন আসেনা। ভুবন খিদের জ্বালায় বনের মধ্যে ঢোকে, যদি কিছু ফল পাকর পাওয়া যায় সেই আশায়। কিন্তু শুধু পাতায় ভরা জঙ্গল। ভুবন রাগে নিজের মনেই বলে উঠলো "দেখছি ছাগল হলেই ভালো হতো, অন্তত খাদ্যের অভাব হতো না"। যদিও কিছু পেয়ারা দেখতে পেলো তাও অনেক উঁচুতে। খালি পেটে ই ফিরে এলো মন্দিরে। মনে মনে স্থির করলো কালই রাধা মাধব মন্দিরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে। রাতে পেট ভরে দীঘির জল খেয়ে বেদীতে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে এক শব্দে ঘুম ভেংগে গেল। দেখলো তার শিয়রে এক মহিলা। এক হা
তে একটি বাটি, অন্য হয়ে একটি ঘটি। ভুবন ধড়ফড় করে উঠে বসে। মহিলাটির পরনে সাদা ধবধবে কাপড়, দেহ অলঙ্কার শূন্য, বয়স চল্লিশের বেশী নয়। ভুবনকে উঠতে দেখে হাতের বাটি আর জলভরা ঘটি নিচে নামিয়ে রেখে হাত জোড় করে প্রণাম করে বললো "বাবা, আমার রান্না করা এই ভোগ টুকু তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে,আমি জানি তুমি অভূক্ত"। ভুবন এতটাই অবাক হয়েছিল যে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না। ঘোর কাটতে দু হাত তুলে মহিলাটিকে
আশীর্বাদ করে বলে উঠলো "তোমার ভালো হোক মা"। সেদিন মহিলার আনা একবাটি পায়েস খেয়ে পরম তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ভুবন। পরদিন ভ্রমণে বেরিয়ে প্রায় সাতদিন পদব্রজে পৌঁছল রাধামাধব মন্দিরে। ওখানে পরিচিত কয়েকজন গুরুভাইয়ের সাথে দেখা হলো। রাতের বেলা মহিলাটির রান্না করা ভোগের কথা উঠলো। এক গুরু ভাই ভুবনকে জানালো ওই মন্দিরের কাছেই এক বিধবা মহিলা থাকতো, তার দশ বছরের ছেলে সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মায়ের অঝোর ধারায় কান্না, মায়ের স্নেহ তাকে রুখতে পারে নি। মহিলা তারপর খুব বেশিদিন বাঁচে নি। সারাদিন ছেলের ফেরার আশায় ওই মন্দিরে বসে থাকত। খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিয়েছিলো। এরপর ওই মন্দির খালিই পরে থাকে। তবে কোনো সন্ন্যাসীর কষ্ট দেখলে মহিলা এভাবে তাকে সাহায্য করে। ভুবনের আগেও নাকি এইরকম ঘটনা ঘটেছে।
সেদিন ভুবনের রাতে ঘুম এলো না। ভাবলো ওর মাও এইরকম কষ্ট পেয়েছে। যে মা মৃত্যুর পরেও ছেলের কষ্ট ভুলতে পারছে না, তাকে কষ্ট দিয়ে ছেলে কি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছুতে পারবে, তার সন্ন্যাস জীবন কি সার্থক হবে? এমন কত প্রশ্ন সারারাত মাথায় পাক খেতে লাগলো। সকালে উঠে গুরুভাইকে বলে নিজের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল।