Sourya Chatterjee

Drama Classics Inspirational

4.5  

Sourya Chatterjee

Drama Classics Inspirational

সনাতন বাবুর ২৬শে জানুয়ারি

সনাতন বাবুর ২৬শে জানুয়ারি

6 mins
304


-বাবু, দরজাটা একটু বন্ধ করে দে তো।

সনাতন বাবুর ছেলে তখন গভীরভাবে নিদ্রাচ্ছন্ন। ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটে।

-বাবা! সাড়ে তিনটে বাজে তো! অনেক দেরি আছে। সকাল সাতটায় তো পতাকা তুলবে ওরা। শোও তো এখন!!

-না রে একটু কাজ আছে অন্য একটা। বেরোতে হবে রে একটু।

-যখন স্কুলে চাকরি করতে তখন সকাল সাড়ে পাঁচটায় বেরোতে। জানি, কাজ ফাজ থাকতো। রিটায়ারমেন্টের পর তো শেষের দুটো বছর সাতটাতেই যেতে। আমি জানি বাবা, তুমি তোমার স্কুলকে তুমি কতটা ভালোবাসো। কিন্তু এখন সাড়ে তিনটে বাবা। কেউ থাকবে না। স্কুলের গেট ও ছটার আগে খুলবে না। তুমি এখন …

-আঃ! মেলা ফ্যাচফ্যাচ করিস না বাবু। এসে বলব কি কাজ ছিল। আর শোন, মাকে বলতে হবে না আমি যে এখন বের হয়েছি। মা উঠলে বলিস আমি সকাল সাড়ে ছটাতেই বেরিয়েছি। দরজাটা দিয়ে দে, কেমন। চলি।


রাতের অন্ধকারে স্ট্রিট ল্যাম্পগুলো তখন একাকীত্বের প্রহর গুনছে। পায়ের শব্দে কুকুরগুলো উঠে দাঁড়িয়ে ভউ ভউ করে ডেকে অসময়ের আগন্তুকের উপস্থিতি জানান দিল। সনাতন বাবু এগিয়ে চলছেন। তার মনের মাঝে দুশ্চিন্তাগুলো এলোমেলো আঁকিবুকি টানছে।


সনাতন রায়, জগৎবন্ধু স্কুলের সাফাইকর্মী ছিলেন। দু বছর হল অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। খুবই সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন। সাফাইকর্মী হলে কি হবে! স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র সবার ই খুব প্রিয় মানুষ সনাতনদা। যেদিন অবসর নিয়েছিলেন স্কুল থেকে সেদিন সনাতন বাবুর চোখের জল যেমন বাঁধ মানেনি, তেমনই মন খারাপের সুর বেজেছিল প্রতি শিক্ষক, প্রতিটি ছাত্রের মনে। তবে এখনও নিয়ম করে সনাতন বাবু স্কুলে হাজির হন ২৬শে জানুয়ারী, ১৫ই আগস্ট, সরস্বতী পূজা , এইসব দিনগুলোতে। এই বিশেষ দিনগুলোর আগের দিন বিকেলে স্কুল সাজানো ,সে দিন সকালে ৬টায় এসে সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা.. এই সব কাজগুলো যে সনাতন বাবু শুধু নিষ্ঠা ভরে করতেন, তা নয়, এই সব কাজগুলো ওনার কাছে ছিল দেবতার চরণে নিজেকে নিবেদনের মত। প্রজাতন্ত্র দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের সব ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সেই পতাকা বা সাজানোর জন্য দড়িতে টানানো কাগজের পতাকা গুলোকে সন্ধ্যেবেলা আবার সসম্মানে আলমারির ভেতরে রেখে দেওয়া, এই সব কাজে স্কুলের সবাই ওনাকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করতেন। সনাতন বাবু শিক্ষিত হয়তো নন, ক্লাস ফাইভের গন্ডিও হয়তো পেরোননি। কিন্তু স্কুলের প্রতি, মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি ওনার ভালোবাসা, সম্মান সত্যিই অতুলনীয়।

চৌমাথার মোড়ে পৌঁছালেন সনাতন বাবু। ঘড়িতে রাত চারটে। ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে। ঢোক গিললেন সনাতন বাবু। ঠিক করছেন তো উনি! মনে মনে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

-বস, সনাদা এসে গেছে।

-সাবাস, বুঝিয়ে দে সব।

-চারটে বাজে। আর লেট করা ঠিক হবে না বস। রাস্তায় বলছি সনাদা কে সব।

বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করছে সনাতন বাবুর। আর হয়তো ফিরে আসার কোনো রাস্তা নেই। ছেলেটার চাকরিটা একবার হয়ে যাক! তারপর এসব আর করতে হবে না! এবার-ই প্রথম, আর এবার-ই শেষ। একটু শান্তিতে শেষ জীবনটা কাটাবেন তারপর। ছেলেটার চাকরির খুব দরকার। একটা কোম্পানি নিশ্চিত চাকরি দেবে বলেছে ছেলেকে। কিন্তু তার জন্য একটা ট্রেনিংয়ের দরকার, আর সেই ট্রেনিংয়ের জন্য দরকার আশি হাজার টাকার।

তিরিশ হাজার মত জোগাড় করেছেন সনাতন বাবু এখান সেখান থেকে। তবুও আরো বাকি পঞ্চাশ। এরা চল্লিশ হাজার দেবে বলেছে। অগ্রিম পাঁচ হাজার দিয়েওছে। সনাতন বাবু জানেন, উনি যা করছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও উনি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ছেলেটার যে চাকরিটা বড্ড দরকার।

-সনাদা উঠে এস। 

ট্রাকটায় উঠলেন সনাতন বাবু। ড্রাইভারের সিটে বিলু, বিলুর পাশের সিটে বিলুর বস। এখন সনাতন বাবুর বসও বটে! বসের পাশের সিটে অর্থাৎ হেলপারের সিটে বসলেন সনাতন বাবু। আর ট্রাকের পেছনে ভরা আছে প্রচুর ড্রাগ! পাচার হবে। রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে বিকট শব্দে স্টার্ট নিলো ট্রাকটি। সনাতন বাবুর জীবনেও সাথে সাথে শুরু হল এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের ভাগীদার হওয়ার অধ্যায়। তখনও রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ স্পষ্ট। মেঘ নেই তেমন। চাঁদের কলঙ্কর দাগগুলো ধরা পড়ছে সনাতন বাবুর চোখে। অত্যন্ত রূঢ় ভাবে সনাতন বাবুর কোলে একটা কাপড়ের পুটুলী রাখল বস।

-শোনো, সনাদা, তোমার কাজ টা খুব সিম্পল আছে। এই পোটলাটায় , কাল কিসব পোজাতন্ত্র দিবস না কিসব আছে, তো তার পতাকা, রিস্টব্যান্ড, ফুল ঠুল এসব আছে। বুঝেছ। তো রাস্তায় পুলিশ ফুলিস ট্রাক চেক ফেক করে। তোমার কাজ হল, তুমি পুলিশ কে এগুলো দেখিয়ে দেবে যখন পুলিশ হেনা তেনা জিজ্ঞেস করবে। বলবে এসব স্বাধীনতা দিবোসের মাল! ক্লিয়ার?

-আসলে প্রজাতন্ত্র দিবস তো!

-ধুর মশাই, যে দিবোস ই হোক না! বলে দেবে। দেখতে চাইলে দেখিয়ে দেবে। ব্যাস! 

চুপ হয়ে গেলেন সনাতন বাবু। তার বুকের ভিতর যেন বেতের ছড়ি দিয়ে অবিরাম কেউ মেরে চলেছে। সহ্য করতে পারছেন না উনি। কত ছোট ছোট স্কুলের ছেলে তাদের প্রিয় সনাতনদার কাছে এই প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন ছুটে আসত, এই দিনটাকে নিয়ে জানবে বলে। না, সনাতন বাবু প্রজাতন্ত্র দিবসের ইতিহাস বা সংবিধানের ব্যাপারে জানতেন না। তবুও তিনি সেই ছোট্ট ছেলেগুলো কে তার নিজের মতো করে কি করে দেশের পতাকাকে সম্মান করতে হয়, কি করে দেশকে আপন করতে হয়, কি করে দেশের মাটিকে ভালোবাসতে হয় সে বিষয়ে বলতেন। বারবার চোখের জল মুছছেন সনাতন বাবু। ছেলেটার চাকরিটার জন্য আসলে…

সজোড়ে ব্রেক কসলো ট্রাক টা। কিছু পুলিশ ট্রাকটাকে আটকেছে।

-কি যাচ্ছে!?

সনাতন বাবু ঢোক গিললেন। 

-কি যাচ্ছে! বলো?

মুখ টা জানলা দিয়ে বার করে এবার সনাতন বাবু বললেন “কাল তো প্রজাতন্ত্র দিবস। তার কিছু জিনিসপত্র আর কি!”

-নামো ট্রাক থেকে, সার্চ করব। 

সনাতন বাবু ভয়ে ভয়ে তাকালেন বসের দিকে। বস চোখের ইশারায় বললেন হাতের পুটলিটা খুলে দেখাতে। খুলতে যাচ্ছেন সনাতন বাবু। হঠাৎ ই একজন পুলিশ বলে উঠল

-আরে সনাতনদা না? চিনতে পারছো? আমি সুবল। স্কুলের কোনো কাজে? নাকি গো?

সনাতন বাবু তাকালেন। না, চিনতে পারলেন না। শুধু এটুকু বুঝলেন জগৎবন্ধু স্কুলের কোনো প্রাক্তন ছাত্র হবে। একটা মেকি হাসি হেসে হ্যাঁ বললেন উনি।

-এই ছেড়ে দে রে! স্কুলের জিনিস যাচ্ছে। ভালো আছো তো গো সনাতনদা?

আবার চলতে শুরু ট্রাকটা। বস সনাতন বাবুর পিঠ চাপড়ে বললেন 

-সাবাস , সনা দা। আর একটুখানি রাস্তা। কাটিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে।

-বাকি পঁয়ত্রিশ হাজার টা কখন পাবো?

-পেয়ে যাবে। শোনো, হাত কাটা কেল্টুদা মানুষ খুন করে, ড্রাগ পাচার করে, কিন্তু কোনোদিন ও কারো টাকা মারে না। কিরে বিলু! তাই তো!?

ভোরের আলো ফুটছে তখন আস্তে আস্তে। অপরাধ বোধ, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তাগুলো গ্যাট হয়ে বসে আছে। ঘড়ির কাঁটা থেমে বসে যেন মজা দেখছে আর সনাতন বাবুর দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

পুলিশ চেক-পয়েন্টগুলো সব পেরিয়ে গেছে মোটামুটি। নিজেদের মধ্যে অশ্রাব্য ভাষায় হাসি মস্করা করছে ওরা দুজন। সনাতন বাবু হাত মুঠো করে পোটলাটাকে কোলের উপর ধরে বসে আছেন। ওরা কখন টাকাটা দেবে কে জানে! টাকাটা পেয়ে গেলেই মুক্তি! অপেক্ষার প্রহর ক্রমশ দীর্ঘতর হয়ে ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। 

হঠাৎই পাশ থেকে একটা পুলিশের গাড়ি ট্রাকটাকে ওভারটেক করে সামনে এসে দাঁড়ালো। তিন চার জন পুলিশ বেরিয়ে এসেছে। মুহূর্তে বিলু আর বস ঐদিক কার দরজা টা খুলে দে ছুট! কোথায় চলে গেল! ঠাওর করতে পারলেন না সনাতন বাবু।

-নেমে আয় তাড়াতাড়ি! 

সনাতন বাবুর মুখটা চুপসে গেছে পুরো। কি হবে এবার!

-এই বুড়ো, নেমে আয় শিগগির! শালা! কতদিন এসব কারবার করছিস!?

ট্রাকের দরজাটা খুলে ধীরে ধীরে নামলেন সনাতন বাবু। নিতম্বে পুলিশের লাঠির একটা সজোড়ে আঘাত! টাল সামলাতে পারলেন না সনাতন বাবু। মুখ থুবড়ে উল্টে পড়লেন রাস্তাতে। হাত থেকে ছিটকে দূরে রাস্তার উপর পড়ল তার কোলের উপর রাখা পোটলা টা। গিট খুলে গিয়ে রাস্তার উপর তখন গড়াগড়ি খাচ্ছে দেশের পতাকা, পতাকা আঁকা রিস্ট ব্যান্ডগুলো। হাইওয়ের উপর দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলছে সব গাড়ি। পতাকা গুলো পিষ্ট হচ্ছে সেসব গাড়ির চাকার তলায়। কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে পতাকা গুলোর কাছে পৌঁছাতে চাইলেন সনাতন বাবু। ওগুলো ওরকম ভাবে রাস্তায় পড়ে থাকলে গাড়ি ঘোড়া মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে তো!

-ওয়ে বুড়ো! পালাচ্ছিস নাকি!?

-না স্যার! পতাকাগুলো ওভাবে রাস্তায়!

-বেশি নাটক না! ভ্যানে ওঠ!

তিন চার জন পুলিশ ধাক্কা মেরে পুলিশের ভ্যানে তুলে দিলেন সনাতন বাবুকে। তারপর ভাগ হয়ে একদল ট্রাকটা সার্চ করছে আর আরেকদল খুঁজে বেড়াচ্ছে বিলু আর হাত কাটা কেল্টুকে। 

আচ্ছা! ওদের যদি পুলিশ ধরতে না পারে ওরা কী বাকি পঁয়ত্রিশ হাজার পৌঁছে দেবে বাড়িতে! আর কিছুক্ষণ পরই তো ফ্ল্যাগ হোস্টিং শুরু হবে স্কুলে স্কুলে, স্কুলের কারোর কি মনে পড়বে সনাতন বাবুর কথা! অবশ্য একজন প্রাক্তন সাফাইকর্মী স্কুলে এলো কি এলো না, তাতে আর কার কি যায় এসে যায়! রাস্তার উপর পড়ে থাকা পতাকাগুলোর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছেন সনাতন বাবু। অঝোর ধারায় জল বেয়ে চলেছে চোখ থেকে।

একটা গাড়ি এসে থামল। একজন ছোট স্কুল পড়ুয়া সেই গাড়ি থেকে নেমে পতাকা, রিস্টব্যান্ডগুলোকে যত্ন নিয়ে তুলছে। ছেলেটির বাবা পাশে দাঁড়িয়ে।

-একবার নমো করে নাও খোকা, দেশের পতাকা। নমো করে নাও। 

ছেলেটি সশ্রদ্ধ নমস্কার করল পতাকায়। যেমন করে প্রতিবার ২৬শে জানুয়ারি সনাতন বাবু স্কুলের ছোট ছোট ছেলে গুলোকে দেশের পতাকার মাহাত্ম বুঝিয়ে স-স্নেহে চুম্বন খান, ঠিক তেমন করেই কোলে তুলে ছেলেটির বাবা ছেলেটিকে কপালে দিলেন স্নেহের চুম্বন। 

চোখের জলের ঝর্ণার মাঝেও নিজের অজান্তেই কখন যে মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে, সনাতন বাবু খেয়াল করেননি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama