*****সময়ের আকুতি*******
*****সময়ের আকুতি*******
- " দ্যাখ; সারাদিন একটা মেসেজ বা টেক্সট তো করতে পারিস? এতো তো ব্যস্ত আম্বানিও নয় বোধহয়" দিশা রাগত স্বরে অঙ্কুশকে বলে বসল।
দিশা আর অঙ্কুশ। সেই স্কুল জীবন থেকে একসঙ্গে। একে অপরকে পাগলের মত ভালবাসে ওরা। তবে ইদানিং পেশার জগতে প্রতিষ্ঠিত হবার চাপে একে অপরকে সময় না দেবার কারনে প্রায়ই এদের মনোমালিন্য হচ্ছে। অঙ্কুশের খালি মনে হয় যে নিজের পায়ে দাড়াতে না পারলে কি করে দিশার হাত চাইবে বাবার কাছে। সে চায় দিশাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের জিনিষ হাতের মুঠোয় এনে দিতে। তা দিতে গিয়ে সে রক্তজল করা পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে দিশা চায় সারাদিন অঙ্কুশ তার সঙ্গে দেখা না করুক, অন্তত একটা " সুপ্রভাত" লিখে পাঠাক। একটু অন্তত খোঁজ খবর নিক। সে কিছুই চায়না , শুধু একটু সময় ছাড়া। সে অল্পেতেই খুশি ।
সেই চাওয়া পাওয়া নিয়েই এদের ঝগড়া লেগেই আছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় দিশার সর্ম্পক টা সত্যিই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এ একে গালি দেওয়া, এরপর দুজনেরই চোখের জল, কথা না বলা ঠিক করা, আবার সেই একই জায়গায় আশা, নিত্যদিন ঘ্যান ঘ্যাণ জ্ঞান - কত ভাললাগে।
এই ভাবে চলতে চলতে একদিন সত্যিই একে অপরকে ব্লক করে দিল এরা।
দিশা :" দ্যাখ অঙ্কুশ, আমার পক্ষে না এভাবে আর সম্পর্ক টানা সম্ভব হচ্ছেনা। তুই সারাদিনই ব্যস্ত। একটা খবর দিতে , গল্প করা তো বাদই দিলাম, তোর একটুও সময় হয়না। সবসময় আমিই করি। এক এক সময় মনে হয় আমিই আছি এই সম্পর্কে। পুরো সম্পর্ক টানার ঘানি আমার। এইভাবে সম্ভব হয়না ভাই। আর পারবোনা।"
অঙ্কুশ :" তোর কি মনে হয় আমি বেকার কোনো কাজ করিনা। বুঝিনা তোকে আমি কষ্ট দেই। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি চাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খুশি আমি তোর পায়ে এনে দেই। তোকে রাজরানীর মতো রাখি। তোর যাতে কোন কষ্ট নাহয়, সে জন্যই খাটি । রাতের পর রাত ঘুমাইনা যাতে একটা ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারি, তারপর তোর বাড়ি গিয়ে নির্দ্বিধায় তোর হাত চাইতে পারি। তুই তার জন্য কি এতটুকু ছাড়তে রাজিনা।এতটা নিজের দেখিস খালি। এত্ত স্বার্থপর তুই।"
দিশার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। এই ভাবলো তাকে অঙ্কুশ শেষ অব্দি।
দিশা :" ঠিকই বুঝলি অঙ্কুশ। শোন আজকের পর আমায় আর কোনো কল বা মেসেজ করবিনা। আমিও করবনা। আজকের পর থেকে তুই আমার অপরিচিত। আমিও তোর। তুই যখন আমার ভবিষ্যৎ, আমার চরিত্র নিজেই সব ঠিক করছিস, আমারও অধিকার আছে আমারটা নিজেই ঠিক করার। ভাল থাক তুই। তবে আমার জন্য আর কষ্ট করিসনে। থাক, এত বড় উপকার আমি চাইনা। "
অঙ্কুশের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো । তবুও মেল ইগো বজায় রেখে বলল " যাহ, ভালো থাকিস।"
বলে দুজন দুজনকে ব্লক করে দিল।
( পাঁচ বছর পর)
" দ্যাখ দিশা; তোর মোবাইল এ একটা ছেলের ফটো পাঠিয়েছি। ছেলে সরকারি চাকুরে। খুব ভাল। একটু কথা বলে টলে আমাদের জানা। নাম আর ফোন নম্বর পাঠিয়েছি।" - ফোনের ওপাশ থেকে দিশার মার গলা।
" দেখো মা, এসব ফালতু জিনিষ এ আমার সময় নেই, আর আমার বিয়ে থা এসব ভালও লাগেনা। সেই তোমার প্রত্যেকদিন এক ভাঙ্গা ক্যাসেট বাজে।" কীবোর্ড এ গ্রাহকদের কোড টাইপ করতে করতে দিশার বিরক্তি প্রকাশ।
অঙ্কুশের সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর অনেকবছর অনেকরাত কেঁদেছে দিশা। মনে হয় বারবার ফিরে যেতে। বারকয়েক ফোন ও তুলেছিল। কিন্তু আর ফোন করা হয় উঠেনি।
মানুষ এক সময় একা থাকা শিখেই যায়। বা বাধ্য হয় । দিশা ও অঙ্কুশ কে ভুলতে পারেনি। তবে জীবনটাকেও ফেলনা হতে দেয়নি। পরীক্ষা দিয়ে একটা সরকারি ব্যাংক এ চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে। অঙ্কুশ তার হৃদয়ের এক কোনাতেই পড়ে আছে।
কিন্তু তাই বলে দিশার মা বাবা তো বসে থাকেনা। তারা তাদের মত করে পাত্র খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু যেই ছেলেই আনে, দিশা স্পষ্ট মানা করে দেয়।
সেরকমই একটা পাত্রর খোঁজ পেয়ে দিশার মা পাঠিয়েছেন মেয়ের মোবাইল এ।
পাত্র পূর্ত তে কর্মরত। বাস্তুকার। নাম রক্তিম হাজরা।
দিশা কাজ করতে করতে একবার মোবাইলটা চেক করলো। করে এই প্রথমবার থমকে গেলো ।
বেশ লম্বা চওড়া দোহারা ছেলে।
" আচ্ছা দেখা করেই নি। নাহলে মা পিছু ছাড়বেনা।" সাত পাঁচ ভেবে দিশা মেসেজ করলো ছেলেটাকে।
--" হ্যালো দিশা এই দিকে। আমার মা আপনার নম্বর পাঠিয়েছিল আমাকে। "
-"হ্যাঁ।" সংক্ষিপ্ত উত্তর ওপাশে।
-- " অসুবিধা না হলে কি দেখা করবেন?"
-" নাহ বলতে আগে মেসেজেই কথা সারি। পরে নাহয় দেখা যাবে।"
দিশা ঢোক গিলো। এ কি ছেলেরে বাবা। মেয়ে নিজে দেখা করতে চাইছে। মুখের ওপর না।
-- " ঠিক আছে তাই হবে " বলে পাঠিয়ে দিলো।
মেসেজ এ কথা বলতে বলতে দিশার আস্তে আস্তে ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগতে লাগলো। একটু মুখচোরা ঠিকই, কিন্তু ঠিক ঠাক জায়গা পেলে ঠিকই ছয় মেরে বেরিয়ে যায়।
যেমন দিশা একদিন জিজ্ঞেস করলো "আচ্ছা তোমার রবীন্দ্র সঙ্গীত ভালও লাগে?"
ওপাশের উত্তর " কোন পর্যায়ের?"
দিশা ভাবলো, বাবাহ্ জানে দেখছি।
বললো " তোমারই পছন্দের?"
ওপাশ থেকে
" আমার মেসেজ তোমার আপন হাতের মেসেজের সাথে দোলাও, দোলাও দোলাও আমার মেসেজ
তুমি আমারে কী-যে বলে ভোলাও ভোলাও ॥
আমার মেসেজ।
তুমি কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে,
টুংটাং ডাকে সকল বাঁধন খোলাও ॥
আমার মেসেজ।।। " বলে কত গুলো হাসির ইমোজি পাঠিয়ে বললো - " একটু পরিবর্তন করে সমউপযোগী করলাম গানটাকে।"
দিশা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল ।
দিশা "কাল দেখা করতে পারি? "
রক্তিম " যদি অনুগ্রহ করে দেখা দেন। আপনি চিনবেন তো "
দিশা " হ্যাঁ হ্যাঁ, ছবি আছে তো।"
রক্তিম " ধুর, ভাবলাম উত্তরটা এভাবে দেবে
যদি তারে নাই চিনি গো সেকি
সেকি আমায় নেবে চিনে ?
এই নব ফাল্গুনের দিনে
জানি নে
জানি নে
যদি তারে নাই চিনি গো সেকি।"
দিশা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
এইভাবে ওরা প্রায়ই দেখা করতে লাগলো। দিশার ভাল লাগলো তাকে। তবে সেই পাগলপারা টান টা অনুভব করেনা সে। সবকিছুই মনে হয় রক্তিম দুঃখ পাবে দেখে করছে। রক্তিম এর নজর এড়ালো না ব্যাপারটা।
একদিন ওরা আপনমনে রবীন্দ্র সদনে বসে ছিল।
রক্তিম " দিশা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?"
দিশা " বলোনা।"
রক্তিম " আমাকে তোমার সত্যিই কেমন লাগে?"
দিশা " ভালও তো।"
রক্তিম ( চোখে চোখ রেখে) " আবার একই প্রশ্ন করছি। আমার দিকে তাকিয়ে বোলো। আমায় কি সত্যি ভালো লাগে?"
দিশা " আসলে কি জানো , তোমায় আমার ভালো মনে খুবই ভালো লাগে। কিন্তু কেনো জানি কোথাও একটা আটকে যায়। কিসের একটা অপরাধ বোধ জেগে ওঠে । তাই দু পা এগিয়েও পিছিয়ে যাই। তুমি খারাপ পেওনা। আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠবো হয়তো।"
রক্তিম " দেখো, আমরা একটা দরকারে দেখা করছিলাম। একে অপরকে জীবনসাথী করব বলে। সেটা করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তো উঠেছে। তাই তুমি নির্দ্বিধায় বলো । কিছু হবেনা।"
দিশা " জানো, একটা ছেলেকে খুব ভালো বাসতাম। অঙ্কুশ নাম। ও আমায় খুব পছন্দ করত। কিন্তু একে অপরকে ঠিকভাবে সময় না দেবার কারনে, কথা না বলার কারণে সে সময় বিচ্ছেদ করে নি। এখন মাঝে মাঝে খারাপ লাগে যে আরেকটু সময় ধৈর্য ধরা যেতো। আরেকটু সময় সম্পর্ক টাকে টানা যেতো। আরেকটু একে অপরকে বোঝা যেতো। কিন্তু দুজনের অভিমানের কারণে ভেঙেই গেলো। আমিও যোগাযোগ করিনি। ও তাই। শুনেছি এই শহরেই আছে। ভালো চাকুরী ও পেয়েছে। কিন্তু দেখা আর হয়নি। আজ যে কানের দুল পরে এলাম, সেটাও ওর দেওয়া।" বলে এক শ্বাসে সব কথা বলে ফেললো।
রক্তিমের মুখটা ম্লান হয়ে গেলো। এতটা প্রাণোচ্ছল দিশাকে কখনো দেখেনি। অঙ্কুশের নাম নেওয়াতে যেনো নতুন প্রাণ সঞ্চার হলো।
দিশার হটাৎ খেয়াল হলো রক্তিম চুপচাপ বসে আছে।
দিশা " এইরে সরি সরি। আমার তোমাকে আঘাত করা উদ্দেশ্য ছিলনা। এরাম ভুল হয়ে গেছে। ভেরি সরি। "
রক্তিম " আরেনা। মনের কথা খুলে বলে ফেলেছো। খুব ভালো। আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন।"
দিশা " হ্যাঁ বলোনা"
রক্তিম " ধরো আমি যদি অঙ্কুশের কোনো হদিস পাই, তোমায় বলব তো এসে?"
দিশা নিরুত্তর।
রক্তিম " দিশা, তোমার চোখ দুটো মিথ্যে কথা বলেনা। আমি আমার জবাব পেয়ে গেছি । আচ্ছা আজ আসি ।"
রক্তিম এরপর আস্তে আস্তে অঙ্কুশের পুরো ঠিকুজি দিশার থেকে নিলো। বিভিন্ন জায়গায় খবর নিতে শুরু করলো।
আস্তে আস্তে দিশার সঙ্গেও কথা বলা কমিয়ে দিলো। দিশার অঙ্কুশের প্রতি ভালবাসায় ভাগ বসাবে - এ কাজ রক্তিম হাজরা কখনও করবেনা। কারণ সে সবসময় জেনে বা মেনে এসেছে, ভালোবাসা মানেই ছেড়ে দেওয়া, তাকে তার মতো। তার জন্যে নিজের কম হোক, আপত্তি নেই। তার খুশিতেই নিজের খুশি। হয়তো দুটি হৃদয় সময় মতো মিলতে পারেনি পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু তাই বলে চির বিচ্ছেদে থাকবে, নাহ তা হয়না।
এইভাবে একদিন ঠিকই অঙ্কুশের খোঁজ পেলো। রক্তিমের এক দুর সম্পর্কের ভাই এর বন্ধুর বন্ধু অঙ্কুশ। ওখান থেকেই নম্বর নিয়ে অঙ্কুশের সাথে পরিচয় করলো।
রক্তিম " আচ্ছা, আপনি হয়তো আমায় চিনবেন না। আমি রক্তিম হাজরা। আপনার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল। "
অঙ্কুশ " হ্যাঁ নিশ্চয়। বলুন কি সাহায্য করতে পারি।"
রক্তিম " সব কথা তো ফোনে বলা যাবেনা। বাইরে বিস্ট্রো ক্যাফে তে দুকাপ কফি তে হবে খন?"
অঙ্কুশ " একদম। যখন বলবেন।"
একদিন ওরা দেখা করলো।
রক্তিম ( এ কথা সে কথার পর) " আচ্ছা, যদি কিছু মনে না করেন , একটা কথা জানার ছিল"
অঙ্কুশ " বলুন না।"
রক্তিম " আপনি দিশাকে চেনেন? বা চিনতেন?"
অঙ্কুশ এর মুখ আরক্ত হয়ে উঠল ।
রক্তিম " দেখুন দিশা আমাকে বলেছে আপনাদের কথা। আসলে আমাদের দেখা হয়েছিল এক বিয়ের আলাপের সূত্র ধরে। কিন্তু সেখানে জানতে পারলাম আপনার কথা ।"
অঙ্কুশ " কেমন আছে ও? নিশ্চয় আমার উপর খুব রাগ। সত্যিই। একটা ভুল বোঝাবুঝি হওয়াতে পুরোটা ভেঙে গেলো। আশা করি আপনি সবটাই জানেন।"
রক্তিম " হ্যাঁ খানিকটা।"
অঙ্কুশ " যাক ভালোই হয়েছে। ও এগিয়ে যাক, ভালো থাকুক, সেটাই আমি চাই। সত্যি কথা বলতে কি একদিকে ভাবতেও অবাক লাগছে যে দীর্ঘ পাঁচ বছর ও আর কোনোখানে চেষ্টা করেনি। আবার খারাপও লাগছে যে নিজের অভিমান ত্যাগ করে যেটা আমি অনেক আগে শেষ করতে পারতাম, শেষ অব্দি করা হয় উঠলোই না। আর বোধহয় ভগবান সুযোগও দেবেন না। যাইহোক নতুন জীবনের শুভেচ্ছা।"
রক্তিম " অঙ্কুশ, এতটুকুই বলব, ভগবান কিন্তু অপেক্ষা করিয়েছেন বটে, কিন্তু আপনাদের আলাদা করেননি। আমি দিশার সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝেছি, ও এখনও আপনার থেকে সরেনি। হয়তোবা আপনাকে জীবনের অংশ করেই এগিয়ে গেছে। তাই বলব কি, দোয়া করে আরেকবার চেষ্টা করেই দেখুন না।সময়ের যে কালচক্রে দুজন আলাদা হয়েছিলেন, সেই সময়ই হয়তো আপনাদের দুজনকে আবার এক করতে চাইছে।"
অঙ্কুশ ( রক্তিমের হাত ধরে) " আপনি পারবেন?"
রক্তিম " ভরসা রাখুন।"
|| কয়েকদিন পর ||
রক্তিম :" একটু দেখা করা যাবে বিকেলের দিকে? "
দিশা : " হ্যাঁ, কোথায় বলো?"
রক্তিম : " এই রবীন্দ্র সদনের দিকেই"
দিশা : " ঠিক আছে।"
বিকেলে দিশা রবীন্দ্র সদনে ঢুকতেই ----
স্পিকার এ হাল্কা গান বাজছে
" সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ । "
পেছনে একটা চেনা পরিচিত গলা। অঙ্কুশের গলা।
দিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এ কি স্বপ্ন দেখছে সে।
অঙ্কুশ " দিশা, জানি অনেক না বলা কথা, অনেক অভিমান, অনেক কান্নার পর আজকে আমরা দুজন সামনাসামনি হয়েছি। হ্যাঁ আমার ভুল, আমি তোকে যাতা বলেছি, স্বার্থপর বলেছি, একটু শুধু সময় চেয়েছিলি, তার বদলে তোকে স্বার্থপর বলেছি। বিশ্বাস কর দিশা, তুই চলে যাবার পর কতবার তোর ছবি, তোর খবর পাওয়ার চেষ্টা করেছি, পাইনি। কত যন্ত্রণায় কত রাত্রি করিয়েছি। তুই আমি যেখানে দেখা করতাম, কতবার রাতের বেলা গিয়ে বসে থাকতাম একা একা, ভাবতাম, যদি একবার দেখা হয়ে যায়। ঈশ্বরের অনেক কৃপা, আজকে তোকে আবার সামনে দেখলাম।"
দিশা ( রাগত স্বরে) " থাম। আর নাটক করিসনে। কি মনে করেছিস। পাঁচ বছর কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে, কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে, হঠাৎ করে সামনে উদয় হয়ে আমার হৃদয় জয় করবি? এতটা সস্তা আমি? এইসব বুদ্ধি রক্তিমের না? কই ও? কি পেয়েছিস তুই আমায়?"
অঙ্কুশ " দিশা , মেনেছি আমার ভুল হয়েছে। একশোবার। হাজারবার। কিন্তু তোকে আমি কি করে বোঝাই প্রত্যেকটা মূহর্ত কি দুর্বিষহ কাটত আমার। মনে হয় মরণ যন্ত্রণা এর থেকে বেশী সুখদায়ক। কিন্তু আশা ছিল একদিন না একদিন তোকে এমন পেয়ে সব কথা খুলে বলব। "
দিশা " একটা ফোন করতে পারলিনা, পাঁচ বছরে।"
অঙ্কুশ " তুইও তো করিসনি।"
দিশা " সেই তুই তোর আগের জায়গাতেই ফিরে গেলি, ধুর "
রক্তিম আড়াল থেকে দেখে হাসছিল।
রক্তিম " শোনো, ভুল তো দুজনেরই। কে আগে সরি বলবে, কে মাথা ঝোকাবে, তা নিয়েই এতগুলো বছর কেটে গেলো। মূল সমস্যা কিন্তু সমাধান করলেনা এখনো। তোমাদের সমস্যা কিন্তু ছিল যে কেউ কাউকে একটু সময় দাওনি। একটু আদরে, আবদারে, আড়ালে, আবডালে রাখতে চাওনি। কিন্তু এইটা তো ঠিক। দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসো, তাই সেই টান এখনো অটুট। দিশা, তুমি যতই আমার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করেছ, বা করতে, কোনদিন সেই নিখাদ টান , বা আবেগ দেখিনি যেটা আজ দেখলাম। তোমার চোখের কোনায় জমা অভিমানের বাষ্পই তার প্রমাণ । আমার সঙ্গে খুনসুটি করতে, ঘুরতে ঠিকই। কিন্তু সেটা যেভাবে দুটো বন্ধু করে । আজও তুমি ভালও বাসও অঙ্কুশ কেই। আর অঙ্কুশ, ভাই, দয়া করে এবার আর ভুল করোনা। দু হাত চার হাত করো, আর দু পক্ষ থেকেই বিয়ের কার্ড চাই।" বলে হাসতে শুরু করলো।
দিশা - আর অঙ্কুশ এর চোখে তখন কান্না ভেজা হাসি। অঙ্কুশ সবকিছু ভুলে সময়কাল এর পরোয়া না করে দিশাকে জড়িয়ে বলল " ভালবাসি প্রিয়, খুব ভালবাসি।"
দিশাও বাধা আর দিলনা। বা দিতে চাইলনা।
রক্তিম বেরিয়ে গেলো আস্তে আস্তে।
মাসকয়েক পর বিয়ের মণ্ডপে দেখা। লাল বেনারসী তে নাকে সিঁদুর নিয়ে দিশা - অঙ্কুশ আজ সম্পূর্ণ রূপে দম্পতি। অপূর্ব লাগছিল দুজনকে।
রক্তিম এলো শুভেচ্ছা জানাতে।
দিশা - অঙ্কুশ " সত্যিই, তুমি না থাকলে আমাদের হয়তো দেখাই হতনা আর। কি ভাবে কি করে সব হয়ে গেলো। অশেষ অশেষ ধন্যবাদ। চির ঋণী হয়ে রইলাম।"
রক্তিম " আর বলোনা, এসেছিলাম পাত্র হতে, দিলাম পাত্র জুটিয়ে।"
তিনজনে হা হা করে হেসে উঠলো।
বাড়ি ফিরে রক্তিম একাকী বসে একটা গান ধরলো। সেটা কি গান, না রক্তিমের অতৃপ্ততার বহিঃপ্রকাশ, সেটা আর বোঝা হয়ে উঠলনা।
গানটি
"আমি তোমারো বিরহে রহিবো বিলীন
তোমাতে করিবো বাস
দীর্ঘ দিবসো দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস
যদি আর কারে ভালোবাসো
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেনো পাও
আমি যতো দুঃখ পাই গো
আমারো পরানো যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমারো পরানো যাহা চায় …"
কেনো শুনছে রক্তিম গানটা? তার উত্তর হয়ত সময়েই প্রকাশ্য হবে। বা হয়ত তার উত্তর আর কেউ জানতেও চাইবেনা। কারণ রক্তিমের প্রাণ যা চেয়েছিল, তাই তো হলো। দুটো ভালোবাসার প্রাণ শেষ অব্দি মিলেই গেল।
তারাও খুশি। রক্তিম ও খুশি।

