STORYMIRROR

Anindya Biswas

Romance

4  

Anindya Biswas

Romance

------- মৃত্যু সততই সুখের ------

------- মৃত্যু সততই সুখের ------

11 mins
17


" নিন, ডিভোর্স কমপ্লিট হয়ে গেল "
- আকাশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সত্যিই, কতো হ্যাপা।
কোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে সেঁজুতির দিকে শেষ বারের মতো তাকিয়ে আকাশ বললো -
" ধন্যবাদ, এতো মসৃন ভাবে শেষ অবদি শেষ হবে আশা ছিলোনা। "
সেঁজুতি- " তুমিও ভালো থেকো। এগিয়ে যেও। "
আকাশ (মজার ছলে ) " নিজের তো জোগাড় করে নিয়েছ, আমার জন্যেও দেখতে। "
সেঁজুতি (লজ্জা পেয়ে ) " দাড়াও, ধীমানের সংগে সেটল হয়ে নি, তারপর  দেখছি। "
আকাশ : " থাক ভালো থেকো, বিয়েতে বলো, বৌ - দান করবো নাহয়।"
সেঁজুতি (হাসতে হাসতে ) " নিশ্চয় নিশ্চয়। "
-----------------------------------
ঘরে আসার পর পুরোনো ফাইল পত্র ঘেঁটে যা পুরোনো কিছু স্মৃতি ছিল সব আসতে আসতে আলাদা করে রাখলো। ওদের বিয়ের এলবাম, পুরোনো ভিডিও, দুজনে কেনা প্রথম মিক্সি-- দেখতে দেখতে আকাশ পুরোনো স্মৃতিতে ডুব দিলো। হাসি ও আসছিলো  হালকা। পারিবারিক দেখা শোনার ভিত্তিতেই বিয়ে। সেই প্রথম কাছে আশা, ভালো লাগা --- সব। কিন্তু বাধ সাধলো হটাৎ একদিন মলে শপিং করতে করতে সেঁজুতির প্রাক্তন প্রেমিক যখন সামনে এসে উপস্থিত হয়।
তারপর সেঁজুতির সারাক্ষন মুখে তার প্রাক্তন প্রেমিকেরই কথা। প্রায়ই রাত বিরেতে আকাশ টের পেতো ফিস ফাশ করে কথার আওয়াজ। সবই বুঝতো আকাশ, স্ত্রীকে আরো বেশি করে সময় দেওয়ার চেষ্টাও করতো। কিন্তু বুঝছিলো, কেমন যেন রাশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। যে সেঁজুতি আকাশের আসার অপেক্ষা করে থাকতো, দেরি করে আসলে বারবার খোঁজ খবর নিতো, রেগে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকতো, আবার ডিনার টেবিল এ মান অভিমানের সব কথা, খুনসুটি তে শেষ হতো, সেই যেমন কেমন আনমনা হয়ে গেলো। ১০০ টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ১ টার উত্তর দিতো। অনেকসময় তো দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলেই যেত।
এরকম যেতে যেতে একদিন আকাশকে বলেই ফেললো ধীমানের কথা। নাহ, অবাক হয়নি আকাশ। এটা তো ভবিতব্য ছিল।
সেঁজুতি " সরি আকাশ, আসলে। "
আকাশ ( শান্ত ভাবে ) " বলতে হবেনা। তো কবে আর কত নেবে?"
সেঁজুতি " একই, তুমি রাগ হওনি, আমি তো ভাবলাম রেগেমেগে কতো কথা শোনাবে? একটুও রাগ হলেনা? "
আকাশ " রাগটা কোথায় হয় জানো, যেখানে কাউকে পাওয়ার, কাউকে আঁকড়ে রাখার ; কারুর থেকে একটা নিদারুন অভিমান, তীব্র ভালোবাসা থাকে। মনের, শরীরের টান থাকে। সেসব তো কবেই গেছে। আসলে কি জানো সেঁজু,  তুমি তো অনেকদিন আগেই মানসিক ভাবে বিচ্ছেদ নিয়ে নিয়েছ, এখন তো খালি সই এর অপেক্ষা। "
সেঁজুতি " আমায় আটকাতে একটুও ইচ্ছে করলোনা? "
আকাশ " কেন আটকাবো? আর জোর করে বেঁধে রেখে কি লাভ? শরীর থাকবে এখানে, মন ধীমানের কাছে। তোমার চোখে আমার প্রতি সেই ভালোবাসা, টান তো অনেকদিন আগেই অবলুপ্ত। আমি তো যদ্দুর পারি চেষ্টা করেছি তবুও। কিন্তু আঁকড়ে রাখার দায়িত্ব কি আমার একার? তোমার না? "
সেঁজুতি " খারাপ লাগছে। ইসস। "
আকাশ ( হালকা রাগত স্বরে )" থামো, দয়া দেখিয়োনা। কারুর ভালোবাসা ভিক্ষে চাইনা। "
সেঁজুতি আর কথা না বাড়িয়ে অন্য ঘরে চলে গেল। সেই তাঁদের একসাথে শেষ রাত। পরেরদিন ধীমান এসে সেঁজুতি কে নিয়ে গেলো। আকাশ ফিরেও চাইলোনা।
---------------------------
আজ কোর্ট থেকে এসে আকাশের হটাৎ যেন ঘরটাকে ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। চেয়ার এ ধপ করে বসে বসে আকাশ ভাবছিলো, সত্যিই কি সে সেঁজুতি কে ভালোবেসে ছিল। তাহলে যেতে দিলো কেন? সেঁজুতি কি এতদিন থেকেও আকাশকে মেকি ভালোবাসা দিয়ে গেছে? সত্যিই, মানুষকে চেনা বড়ো কঠিন।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আকাশ গাড়ির চাবিটা নিয়ে উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে বের হলো।  উদ্দেশ্য জিম এ যাবে। কেউ না থাকুক, এই শরীরটা তো পঞ্চভুতে যাবে। এটাকেই ঠিক রাখা যাক।

----------( বছর খানেক পর )---
সেঁজুতির ফেইসবুক আর দেখেনা আকাশ। সারা ফেইসবুক জুড়ে খালি ওদের ছবি। আগে জ্বলতো আকাশ। বিশেষ করে সেঁজুতি যখন ধীমান কে পিছন থেকে জড়িয়ে, বা ধীমানের কাঁধের উপর মাথা রেখে ছবি দিতো, আকাশের বুকটা জ্বলে যেত। এখন সেই জ্বলন্ত আগুন ও নেই, রাগ ও নেই। আসলে এ কয়েকবছর এ আকাশ অনেক শান্ত, বিচক্ষন হয়ে গেছে, যাকে বলে লাভ গুরু 😁। তার বোন,ভাইদের প্রেম সম্বন্ধে বিভিন্ন জীবনদর্শন দেই, সম্পর্ক কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে, সেই সম্বন্ধে বোন দের বয় ফ্রেন্ড দের বেনামে চিঠিও লিখে দেয়-- সত্যিই আজকাল ছেলেগুলো না প্রেম করতে জানেও না-- ভাবে আকাশ। আবার ভাবে সে জেনেও তো ডিভোর্সড। হাসে আকাশ, একলা একলা এসব কথা ভেবে।
আরেকটা কারণও আছে তার  খুশির। আকাশের ফেইসবুক এও নতুন এক বন্ধুর আগমন হয়েছে। শ্রীজিতা। প্রথম দিনের আলাপ এই আকাশ বুঝেছিলো, এ মেয়ে আলাদা। আর পাঁচটা মেয়ের মতো নেইলপলিশ, লিপস্টিক, সাজগোজ এর দিকে আগ্রহ থাকলেও, সে একটু আলাদা। বিশেষ করে এই  মেয়ের মুখে যখন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, আর নেতাজি স্তুতি শুনেছিলো আকাশ, সঙ্গে তার কথাবার্তায় বুদ্ধিমত্ততা, সবাইকে একসাথে নিয়ে চলার মানসিকতা যখন বুঝেছিলো, তখনি তার বিশ্বাস জন্মেছিলো, যে এই মেয়ে আলাদা। তারপর তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেন অনেকদিন পর জং লাগা লোহার হৃদয়ে একটু চকচক করে উঠলো। বিশেষ করে এই মেয়েটার গান আকাশ মন্ত্র মুগ্ধ সাপের মতো শান্ত হয়ে শুনতো। মনে হতো, তার একা, ব্যথায় আক্রান্ত, জীবন জ্বালায় তপ্ত হৃদয় ভূমিতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শীতল ফোঁটা পড়ছে।
সেই স্বস্তির বৃষ্টিতে ভিজতে চাইতো আকাশ, একা কাঁদতে চাইতো, ইচ্ছে করতো তার কোলে মাথা রেখে বুকফেটে কাঁদতে, আর চাইতো সে যেন আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জীবন থেকেও অনীহা এসে পড়েছিল তার। হটাৎ যেন কাউকে হারানোর ভয় আবার পেয়ে বসছিলো। মরুভূমির তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন শীতল ঠান্ডা জল এর জন্য হাঁক পাঁক করে, সে রাগ হয়ে কথা না বললে আকাশের সেই অবস্থা হতো। তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে দুদন্ড শান্তিতে বসতে পারতোনা।
স্পষ্ট বুঝছিলো আকাশ। অঙ্কুরোদ্গম হচ্ছে তার এক নতুন জীবনের দুটি পাতার । বহুদিনের ছাইচাপা জমিতে আবার জীবন বৃক্ষ উঠতে চাইছে।

এক এক সময় আকাশ ভাবতো বলেই দিই। যে তাকে সে কতটা পছন্দ করে।কিন্তু আকাশের মাথায় অন্য চিন্তাও আসতো। ভালো মন, সুন্দর বাচন ভঙ্গি। ওদিকে আকাশ বড়ো, ডিভোর্সড। এই বয়সে তার আবার বিয়ে করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তো এইরকম সম্ভাবনাময় মেয়েকে ভালোবেসে, বিয়ে করে, সংসার সংগ্রামে ফেলতে অনেক বার চিন্তায় পরতো আকাশ। তার উপর মেয়ে রাজি হলেও, পরিবার মানবে কিনা, কারণ আকাশ এখনো বিশ্বাস করে, বিয়েটা দুটো পরিবারের মিলন। তাই এতো কিছু না ভেবে সুপ্রভাত, শুভরাত্রি, আর খুনসুটি, আর দুস্টু - মিষ্টি ভালোবাসাতেই মেতে থাকতো শ্রীজিতার সাথে।
(কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক, যা ভাবাও যায়না, তাই হয়)
একদিন শ্রান্ত, ক্লান্ত আকাশ শ্রীজিতা কে শুভরাত্রি বলে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম থেকে যখন উঠলো, তখন তার চক্ষু চরকগাছ। এ সে কোথায়? চারিদিকে বরফের মরুভূমি। তার মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কঙ্কাল। কারুর মাথার খুলি। কারুর হাড়গোড়।
আকাশ ( অবাক হয়ে ) :"  এ কি হলো? আমি কোথায়? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম। একই, কি হচ্ছে? কেউ আছে? এটা কোন জায়গা? কি করে এলাম? "
পিছন থেকে গুরু গম্ভীর ডাক " আকাশ। এদিকে দেখ। "
ঘুরে দেখে আকাশ থ। এ যে স্বয়ং পরম হংস। ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
আকাশ " ঠাকুর আপনি? আমার পরম সৌভাগ্য। আপনি দেখা দিলেন। "
রামকৃষ্ণ " আমি দেখা দিইনি আকাশ। তুমি এসেছো। তোমার নশ্বর শরীর ছেড়ে। এটা রামকৃষ্ণ লোক যাওয়ার রাস্তা। "
আকাশ ( রেগে মেগে ) " কি যাচ্ছেতাই। মরতে যাবো কেন। আর আপনি আদৌ ঠাকুর তো? "
রামকৃষ্ণ " বিশ্বাস হচ্ছেনা, তাইনা। তোর দোষ না। নরেন এরও প্রথম হয়নি। করাতে হয়েছে।  চল তোকে দেখিয়ে আসি। আয় আমার সঙ্গে। চোখ বন্ধ কর। "
আকাশ চোখ বন্ধ করলো।
খুলতেই দেখলো সে তার নিজের ঘরে। নিজেই হাসলো বসে বসে, কি যে ছাইপাশ স্বপ্ন দেখলাম। আমি নাকি মারা গেছি। ধুরর। এম্মা, দুটো আকাশ কেন বিছানায় । এ কে।
এরই মধ্যে ঠাকুর আবির্ভাব হলেন।
রামকৃষ্ণ " এখন তোর বাড়ির লোক জানেনি। তোর বাড়ির মালিক দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকবে। দেখ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। "
ঠিকই। একটু পরেই বাড়ির মালিক দরজা ভেঙে ঢুকলো। সাথে পুলিশ। একটু। পরেই ডাক্তার এলেন। আকাশের সামনেই নাড়ি ধরে বললেন, ডেড।
আকাশ স্তম্ভহিত। মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছেনা তার।

আকাশের মা বাবা ভাই  আত্মীয় স্বজন সবাই একে একে এলো। আকাশের মা বাবার তো একদমই খারাপ অবস্থা। দুজনেই মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার। আকাশের খুব ইচ্ছে হলো কাছে গিয়ে একবার বলবে মা বাবাকে, এই দেখো আমি। কোথাও যাইনি। কিন্তু যতই চেষ্টা করে, তার তো নশ্বর দেহ নেই। ঠাকুর এসে পিঠে হাত রাখলেন তার।
রামকৃষ্ণ " বিশ্বাস হলো? "
আকাশ " এ তুমি ঠিক করনি ঠাকুর। আমার মা বাবা তোমায় এতো ভালোবাসেন। শ্রদ্ধা ভক্তি করেন। আর তুমি এই করলে। "
রামকৃষ্ণ " আমায় ভুল বোঝোনা আকাশ। তোমার মৃত্যু তোমার পরিবারকে বিশাল বড়ো বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। "
আকাশ " বিপদ? কিসের বিপদ? "
রামকৃষ্ণ " শোনো, তুমি একটি রাহু মহা দশার মধ্যে যাচ্চো, যা সবাই যায়। কিন্তু তোমারটা একটু আলাদা। এতে তুমি মোদ্দা কথায় পুরো পরিবারের রাহু হয়ে এসেছো। মানে সর্বনাশা রাক্ষস হয়ে। সেজন্য পরিবারের যত দুঃখ কষ্টের কারণ তুমিই হবে। বা যাকে তুমি ভালোবাসো, তার দুঃখের কারণ হবে। কিন্তু একটা লাভ, তুমি নশ্বর দেহ ছেড়ে পুরো রামকৃষ্ণলোকএ এমনিতেই আসতে পারবে, সজ্ঞানে। তবে হ্যাঁ, তোমার কাছে একটা বর আছে বাছার।"
আকাশ " বলুন, শুনছি "
রামকৃষ্ণ " ইচ্ছা হলে, তুমি এখনই তোমার দেহে আবার ফিরে যেতে পারো, মা বাবার কাছে। কিন্তু পরিণতি সম্বন্ধে তোমাকে জানালাম। "
আকাশ ( একটু ভেবে ) " একটা জিনিস চাইতে পারি? বলুন না করবেনা। "
রামকৃষ্ণ " হ্যাঁ বলো। "
আকাশ " আপনি ত্রিকালজ্ঞ। অবতার পুরুষ। আমাদের ভূত- ভবিষ্যত সম্বন্ধে সবই জানেন। যেহেতু আপনি বলেছেন, যে আমিই পরিবারের কালসর্প, আমি আমার বর ফেরত চাইনা। তার বদলে আমার অন্য একটা ইচ্ছে পূরণ করবেন? "
রামকৃষ্ণ " শুনি, জানি যদিও, তবুও বলো ।"
আকাশ " আপনি আজকের থেকে পাঁচ বছর পরে, আমি আমার পরিবারের বা প্রিয়জনদের কি অবস্থা হবে, একটু দেখতে দেবেন? মানে আমি ছেড়ে চলে গেলে কিরকম থাকবে ওরা, তা একবার স্বচক্ষে দেখতে চাই।"
রামকৃষ্ণ (স্মিত হেসে ) " তথাস্তু, তবে আমিও যাবো তোর সাথে, শুনবো তোর অভিমত।"

--------( পাঁচ বছর পর )-------

* আকাশের মা, বাবা, ভাই *
আকাশ সুক্ষদেহে গেল নিজের পরিবারের কাছে। পাঁচ বছর পর। সন্ধ্যাবেলা। দেখলো, মা বাবা, দুজনেই শারীরিক ভাবে সুস্থ। খালি যেমন মনমরা। হটাৎ কোথেকে এসে একটা বাচ্চা ছেলে দৌড় দিয়ে এসে ঠাম্মি বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আকাশের মা তখন একদৃষ্টিতে আকাশের দেয়ালের ছবিটায় ধুপ দিচ্ছিলো।
আকাশের মা ". এই ছাড়, এখন না, দেখছিস না ধুপ দিচ্ছি তোর জেঠুকে। ছাড় লক্ষী বাবা আমার। কৈ ; রাই, ওকে ধরো।"
আকাশ দেখলো এক সুন্দরী, তন্নী তরুণী এসে ছেলেটাকে কোলে তোলে নিলো।
আকাশ মনে মনে খুশি হলো। এটা তার ভাইয়ের ছেলে। ভাই বিয়ে করেছে তাহলে। যাক। এই বিয়ে দেখার খুব সাধ ছিল।
রাই " মা, আর কেঁদোনা, তোমার আকাশ যেখানেই আছে, ভালো আছে। সবসময় ধুপ দেখালেই তার কথা মনে পরে তোমার। কষ্ট পাও তুমি "
আকাশের মা ( ডুকরে কেঁদে উঠে ) " জানো, আজ ও যখন ধুপ দেই, তখন মনে হয় দেয়ালের ফটোতে আকাশ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।  মনে হয় আমার চুল নিয়ে আবার খেলা করছে। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে। জানি। তবুও।"
আকাশ এর হটাৎ বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। পাশে ঘুরে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বললো " একবার ছোঁয়ার সুযোগ দেবেন? "
ঠাকুর রামকৃষ্ণ সম্মতি দিলেন।
আকাশ এক পা এক পা এগিয়ে মার চুলে একটু নাড়া দিয়ে দিলো। চমকে উঠলো আকাশের মা।
আকাশের মা " আকাশ, আকাশ, তুই এলি বাবা? আমি ভুল হতে, থাক মনের ভুল "
আকাশ আর কিছু বলতে পারলোনা। আস্তে আস্তে তার ভাইয়ের ছেলের মাথায় একটা হাত রেখে নিঃশব্দে সান্ধ্য বাতাসে মিলিয়ে গেল। নাহ, তার পরিবার সামলে নিয়েছে। ভালোই আছে।

*সেঁজুতি -ধীমান *
রামকৃষ্ণ " ওদের দেখতে যাবি? "
আকাশ " নাহ, কোনো ইচ্ছে নেই, বিচ্ছেদ বিচ্ছেদই থাকুক "
*বোন *
আজ আকাশের বোন এর বিয়ে। পাত্র রাজস্থানের। আনমনা হয়ে রয়েছে সে বিবাহ বাসরে । আজ আকাশদাদা থাকলে কি মজাই না হতো। হটাৎ করে সে অনুভব করল, তার মাথায় কে জানি হাত রাখলো। সেই স্নেহের পরশ। চমকে উঠলো সে। দাদা বলে। সাথে সাথে একটা হিমেল স্পর্শ তাকে ছুঁয়ে চলে গেল।
আকাশ তাকে ও জামাইকে আশীর্বাদ করল দূর থেকে। তার ছোট বোনকেও। ভালো থাকুক তারা। উন্নতি করুক। জীবনের পথে আরো এগিয়ে যাক। 

*শ্রীজিতা*
আকাশ, যদিও তার দেহে কোনো অনুভূতি নেই, তবুও শ্রীজিতাকে দেখার জন্য কেন জানি মন চাইলো।
সেদিনের দুস্টু মিষ্টি শ্রীজিতা আজকে ডক্টরেট। খ্যাতি তার বিশ্ব জোড়া। ভারত সরকারের পারমাণবিক সংস্থায় গবেষণারত। বেশ রাশভারী হয়ে গেছে এখন । যদিও চোখেমুখে সেই মিষ্টি ভাব রয়েই গেছে ।
আজ অফিস থেকে এসে ব্যালকনি তে বসে ফোনে প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই মাথায় একটা চেনা হাতের স্পর্শ পেলো। ঘুরে দেখে কেউ নেই ।
শ্রীজিতা ( আপনমনে) : " নাহ্, মনের ভুল হবে। তবে কেনই লাগলো এই হাতের চেনা বড় কাছের। বহুযুগ আগের ?" সাতপাঁচ ভেবে আবার গল্পে মেতে উঠল।
ওদিকে আকাশ হটাৎ অনেকদিন পর শ্রীজিতাকে দেখে কোনসময় আপনমনে তাকে স্পর্শ করেছিল নিজেরও খেয়াল নেই । সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিলো।
আকাশ ( ঠাকুরের দিকে ) : " চলুন, দেখা হয়ে গেছে। ভালো আছে। নতুন করে আর আমার স্মৃতি নদী উছলে উঠানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করিনা।"
রামকৃষ্ণ : " সত্যিই? ।"
আকাশ :"হ্যাঁ। আচ্ছা দাড়ান। চলেই যেহেতু যাব, একবার শেষবার ছুঁয়ে নি?।"
রামকৃষ্ণ : " তোর যা ইচ্ছে।"
আকাশ সূক্ষদেহে শ্রীজিতার সামনে গেলো। কেনো জানি হৃদয়ে দোলাচল উঠলো আবার। ইচ্ছে করলো শ্রীজিতাকে কোমর ধরে কাছে টেনে কপালে একটা চুমু খাবার। ইচ্ছে করলো যেভাবে নাকে হাল্কা কামড় দিয়ে শ্রীজিতাকে রাগিয়ে দিত , তা আবার করার। কিন্তু করতে গিয়েও থমকে গেলো। ভাবলো, ও তো আর আমার নয়, কিসের অধিকার দেখাতে যাবো, থাক ভালো থাকুক, সুখে থাকুক, বলে আবার শ্রীজিতার মাথাতে হাতটা রাখলো।
শ্রীজিতা ( ফোন রেখে) : " আকাশ, তুমি এখানে , না?"
আকাশ চমকে গেলো। তাকে কি দেখা যাচ্ছে নাকি?
ঠাকুরও গেলেন কোথায় ?
শ্রীজিতা: " আমি জানি আকাশ । তুমি আমার আশে পাশে আছো। তোমার ছোঁয়া আমি ভুলিনি । হয়তো তোমায় দেখতে পারছিনা, ছুঁতে পারছিনা, শুনতে পারছিনা, কিন্তু অনুভব করতে পারছি ঠিকই । তুমি জানোনা আকাশ, তোমায় ছাড়া আমি কয়েকবছর কি পাগল পাগল ছিলাম। উদাস হয়ে বসে থাকতাম, কিচ্ছু ভাল লাগতোনা, কিছুই মুখে রচতো না। ভাবতাম ঠাকুর এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, যে তোমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে? তারপরই জীবনে প্রত্যয় এলো আকাশ, জানো।  ও সবকিছু জেনে আমায় আবার ভালবাসতে শেখালো। নতুন করে বাঁচতে শিখলাম। তা বলে তোমায় আমি ভুলিনি আকাশ। কখনোই ভুলবোনা। প্রার্থনা করি, তুমি যেখানেই থাকো, সুখে থেকো আকাশ। খুব ভালো থেকো। আর উপর থেকে তোমার ভালবাসা বৃষ্টির মতো আমাদের দুজনের উপর বর্ষণ করো। ভালো থেকো আকাশ।"
আকাশ হঠাৎই যেন একটা পরম তৃপ্তির ছোঁয়া পেলো মনে মনে। আর যেনো কোনকিছুই তার জানার নেই, পাওয়ার নেই, বোঝার নেই।
আকাশ "ঠাকুর, চলুন, আমার আর কিছু দেখতে হবেনা। যা আমি মনে মনে পরিবারের জন্য চেয়েছিলাম,  শ্রীর জন্য চেয়েছিলাম তাই হয়েছে। হয়তো আমিই অভিশাপ ছিলাম। আমার যাওয়াটা এতবড় আশীর্বাদ যদি হয়, তাহলে আর আমার নশ্বর জীবন দরকার নেই। চলুন তাহলে। তবে একটা শেষ প্রশ্ন।"
রামকৃষ্ণ " এই তো, যে শ্রীজিতা কিভাবে টের পেলো? "
আকাশ " হ্যাঁ, তাই।"
রামকৃষ্ণ " ভালবাসা এমনই রে। তোর মাও যেমন তোর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়, শ্রীজিতাও তাই। দ্যাখ, পুরো সংসার, জীবজন্তু কিন্তু এই ভালবাসার মায়াতেই বাঁধা। এই মায়াজাল আছে বলেই তুই যখন স্পর্শের অধিকার চাইলি অশরীরী ভাবে, সেই জালেরই অংশ হয়ে গেলি। সেই দেহাতীত ভালবাসাই তোকে কিছু ক্ষণের জন্য হলেও তাদের কাছ থেকে দেখার অনুভূতি প্রদান করেছে। বুঝলি? "
আকাশ " হ্যাঁ। এইবার বুঝলাম। চলুন।"
------( পাঁচ বছর আগে , মৃত্যুদিনে)---
আকাশের অন্তিম সংস্কার চলছে। আকাশের মা বাবা, দুজনেই মূর্ছা যাচ্ছেন। শ্রীজিতারও তথৈবচ অবস্থা। সব আত্মীয়স্বজন , বন্ধু বান্ধব শেষ যাত্রায় উপস্থিত।
দেখছে আকাশ সবই। কিন্তু আর তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই সেই দেহে। 
কারণ সে জানে এই যাত্রার ফল যে অসামান্য, অসাধারন, মঙ্গলময়।
তাই এই মৃত্যুই সুন্দর। এই শেষ যাত্রাই কাম্য।






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance