সম্পর্ক
সম্পর্ক
ঘোমটাটা সরাতেই কালশিটেটা চোখে পড়'ল চোখের পাশে।মুখটা ও ফুলে ঢোল।দাঁতে দাঁত চেপে রাগটাকে কোনোমতে গিলে নিল সুলেখা।-"দাঁড়া আজ আসছি, এখন দেরি হয়ে গেছে বিকালে ফিরে মজা দেখাবো।আর শোন কাউকে কিছু বল'বি না।কত আর সহ্য করবি?কিসের এত ভয় তোর?খাওয়া পরা তো? সে ব্যবস্থা আমি করে দেব।খবরদার আর সহ্য করবি না অনেক হয়েছে।"-বলেই হন হন করে হেঁটে বেড়িয়ে গেল সুলেখা।মোড়ে দাঁড়াতেই অটো পেল।সবাই চেনে অটোচালকরা সুলেখা যেতেই বললো-"এই যে দিদি বাইপাস এটা।"
"উফ যাক্ এবার শান্তি"-গুছিয়ে বসলো সুলেখা।অটোটা বেরিয়ে গেলেই দূর্ভোগ।সব অটো যায় না।সুলেখা বছর 35 এর একটা মেয়ে।সবার বড় সুলেখা। পাঁচবোন ওরা,বাবা নেই।বোনেদের মানুষ করতে গিয়ে, ওদের বিয়ে দিতে গিয়ে, নিজের আর বিয়ে করা হয়নি।কতইবা কখন বয়স.....
18কি 19।হঠাত্ বাবা মারা যেতে পাঁচবোন কে আর একভাইকে নিয়ে পথে বসে ওরা।তখনি সরলা মাসি কাজটা জুটিয়ে দেয়।নামকরা প্রাইভেট হসপিটালের আয়ার কাজ।পড়াশোনা মাধ্যমিক, আর কি জুটবে?ওই অনেক।ধীরে ধীরে কাজে বেশ অভ্যস্থ হয়ে যায় প্রথম প্রথম ঘৃণা লাগলেও।আর বুঝে যায় হসপিটালের ভেতরের রাজনীতি ও।এখানে টিঁকে থাকতে হলে মুখ খুলতে হবে।তখন থেকেই সুলেখার টিঁকে থাকার কারণে লড়াই শুরু।স্বল্পবাক্ ভীতু সুলেখা অচিরেই সাহসী চালাকচতুর হয়ে ওঠে।মাধ্যমিক এ পড়া ডারউইনবাদটা মাথায় যেন এতদিনে ঠিকঠাক ঢুকলো সুলেখার।একেই বোধায় বলে টিঁকে থাকার লড়াই।ধীরে ধীরে বোনেদের বিয়ে দেয়।এক বোন নার্স ও হয়ে ওঠে।ভাইটা একটা টাইপিং এর কাজ পায় ছোট একটা কোম্পানীতে।বলা যায় কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখে পরিবারটা।কিন্তু সুলেখার ততদিনে বিয়ের বয়স বা ঠিক ভাবে বলা যায় ইচ্ছাটা চলে গেছে।আর ওদের বস্তিতে মুখরা নামটাও কুড়িয়ে নিয়েছে।কারণ কোনো খারাপ কাজেই প্রতিবাদ না করে ও থাকতে পারে না।যদিও বস্তির ব্যাপারে বিশেষ ও থাকে না।কিন্তু এই একবছর মত আগে সকালবেলা উঠে মোড়ের কলে জল আনতে গিয়েই নজর পড়ে নয়নকে সুলেখার।বেশ মিষ্টি তো মেয়েটা।এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে,কাছে গিয়ে বলে, -"এই মেয়ে নাম কি তোমার?"
"নয়ন"-আস্তে করে বলে নয়ন।
"ও তা কার বাড়িতে থাক?"
"ঐ যে গলির ভেতর ঐ বাড়িটাই।"
"ও মদনার বউ তুমি?ভগবান! আর ছেলে পেল না তোমার বাপ? এই নোংরা চরিত্রের,নেশাখোরটার সাথে ঝুলিয়ে দিল।"
"বাবা নেই আমার।মা ও কিছুদিন আগে মারা যান।আমি দিদির বাড়িতে থাকতাম।দিদিই....."
"বা বোনকে তো উদ্ধার করে দিয়েছে।যাকগে আর কি হবে।শোন নয়ন এই দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে আজ কেন সারা বছর ভোর জল পাবে না। কেউ দয়া করে সরে দাঁড়াবে না।চল আমার সাথে ওখানে কেড়ে নিতে হবে বাছা, আজ আমি ভরে দিচ্ছি।পরের দিন থেকে এমন ভাবেই নেবে।"
তারপরেও বেশ কিছুদিন দেখেছে সুলেখা প্রতিযোগীতায় নয়ন পেরে ওঠে না।মনে মনে ভাবে -"বেচারী এই রকম অবস্থায় অভ্যস্থ নয় মনে হচ্ছে ভাল ঘরের মেয়ে।দিদি জামাইবাবু সম্পত্তির লোভে বোনটাকে....."
ধীরে ধীরে নয়নের প্রতি একটা মায়া পড়ে যায়।আশপাশের লোকজন আবার নয়নকে দুচক্ষে দেখতে পারেনা-"ঐ যে দেমাকী রুপসী আসছেন।মরণ, আমরা যেন মানুষ নয়।কথা বলবেন না একেবারে,জানা আছে সব।না'হলে আর মাতালটা বর জুটতো?"-এইসব কথা আশপাল থেকে সুলেখার কানে আসত।সুলেখা বুঝতে পারে নয়ন চুপচাপ ওদের মত হি হি, হা হা করতে পারে না বলে পাড়ার মোড়ে মোড়ে তাই এত রাগ।সুলেখা একদিন রাতে ডিউটি সেরে ফিরে এসে দেখল ওর মা ঘরে নেই।ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো নয়নকে মদন মদ খেয়ে এসে খুব মেরেছে।মাথা ফেটে গেছে।তাই দেখতে ছুটেছে।পরের দুদিন কলতলায় আর দেখতে পায় না নয়নকে, দুদিন পর নয়ন কলতলায় এলে সকলের মুখ টিপে হাসি সুলেখার চোখ এড়ায় না।এরপর থেকে নয়নের উপর অত্যাচার রোজই চলতে থাকে।কিন্তু কোনো মানুষই রুখে দাঁড়াতো না।ওদের কাছে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার।আজ নয়নের মুখে ঘোমটার আড়ালটা দেখেই সুলেখার সন্দেহ হয়।না এবার ও কিছু করবে আর সহ্য নয়।মদন তখনও আসেনি।রাতে ফেরে আকন্ঠ মদ গিলে।এসেই অকথ্য গালাগালি দিয়ে নয়নের চুলের মুঠিটা ধরে কোনো কারণ ছাড়াই সুলেখার সামনে।সুলেখা সোজা গিয়ে ঠাস করে এক চড় বসায়। মদন গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে।সব লোক জড়ো হয়ে যায় চেঁচামেচিতে।সুলেখা নয়নকে বলে,-"আজ থেকে তুই আমার বাড়িতে থাকবি।আর আজ ই কথা বলেছি, একটা আয়ার কাজ তোর হয়ে যাবে।পরে ভাড়া বাড়ি দেখে উঠে যাবি।আর একদিনও জানোয়ারটার সাথে থাকবি না।আর এই যে আপনাদের নাটক দেখা হয়ে গেছে তো দয়া করে বাড়ি গিয়ে এবার খাওয়া দাওয়া করুন।"
সকলে 'ছিঃ ছিঃ' করতে করতে বাড়ি যায় সুলেখার কাজ দেখে।সুলেখা কানে তোলে না।জানে, ওরা মার খেতে জানে বাঁচতে জানে না, বাঁচাতেও জানে না।শুধু অপরাধের সাথে সমঝোতাটাই ওরা শিখেছে।ওদের দেখে করুণাই লাগে।মদনকে সুলেখা বলে,-"যদি আর নয়নকে বিরক্ত করিস তোকে জেলের ভাত না খাওয়ালে আমার নাম সুলেখা নয়।"নয়ন সুলেখার বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে।নয়নের হাত ধরে সুলেখা বাড়ির দিকে যায়, নরক থেকে বার করে।চাঁদের আলোটা বেশ পথ দেখাচ্ছে। আজ বোধায় পূর্ণিমা।দিব্যি পথ দেখা যাচ্ছে।নয়ন এতদিনে ওর ছোট্ট বেলায় হারিয়ে যাওয়া দিদিকে পেল যে, তার ছোট্ট বোনকে বুকে নিয়ে স্কুলে যেত।অথচ সেই বড় হয়ে বোনের সম্পত্তি গ্রাস করবে বলে জোর করে সই করিয়ে বিক্রী করে দিল অমানুষ মদনের কাছে!সেই ছোট্ট বেলায় হারিয়ে যাওয়া দিদিটা যেন ফিরে এল সুলেখার হাত ধরে।কে বলেছে শুধু রক্তের সম্পর্কই বড়?