শূন্য থেকে শুরু
শূন্য থেকে শুরু


সাবেকি ধাঁচের ছোটখাটো একতলা বাড়ি। বেশ অনেকখানি জমির ওপর। সামনে পিছনে খানিকটা করে খোলা জমি। সামনেটায় মরশুমি ফুলের আর নানা জাতের গোলাপের বাগান। পেছনে সব্জি বাগান। পাঁচিলের ধার বরাবর নারকেল সুপারি আম পেয়ারা জামরুল আতা বাতাবিলেবু কাগজি লেবু নিমগাছ আর ফলসাগাছ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট মাপা দূরত্বে। বাড়ির চত্বরে ঢোকবার কালো রং করা লোহার বাহারি গেট। পাঁচিলের এককোণে ছোট আরেকটা লোহার গেট, জমাদার ঢোকার জন্য। গেটের বাঁ-ধারে চিঠিপত্র ফেলবার কাঠের বাক্সের ওপরে শেড বারকরা সাদা ধবধবে মার্বেল ফলকে লেখা বাড়ির নাম... "শান্তি নীড়", তলায় মালিকের নাম... অবিনাশচন্দ্র মজুমদার।
ছাদের একধারে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন- পুরুষের বুড়ো আমগাছ। পাশেই একটা নবীন আমগাছ মাথা উঁচু করেছে বটে, তবে যেন বেশ ভয়ে ভয়ে। বাতাসে সদ্যধরা কচি আমের মুকুলের সুবাস ভাসছে। নরম সবুজ দূর্বা ঘাসে ঢাকা পড়েছে বাগানের মাটি। জমাদারের গেটের পাশে পাঁচিলের গা ঘেঁষে এক গন্ধরাজ ফুলের গাছ। সাদা ফুলে ফুলে পাতা ঢাকা পড়েছে। পাঁচিলের ঠিক বাইরেটায় দুটো বেলগাছ দাঁড়িয়ে আছে জড়াজড়ি করে। দেখে দেখে অবিনাশ বাবু ভাবেন, "এমন কীকরে হলো? ঠিক যেন সোহাগ করছে স্বামী-স্ত্রী!" বেলগাছ দুটোয় শেষ ফাল্গুনের নরম কচিপাতা পাতা, ছোট ছোট কচি বেল। পাকলে ভারী মিষ্টি। পাকা বেল বোঁটা আলগা হয়ে অবিনাশ বাবুর বাগানের ভেতর আপনাআপনিই ঝরে পড়ে। ইরাবতী পানা-সরবৎ বানিয়ে দেন অবিনাশ বাবুকে। গ্রীষ্মের বিকেলে বেলের পানার গ্লাসে চুমুক দিয়ে অবিনাশ বাবু ইরাবতীকে বলেন, "সামান্য একটু মিছরি দিলে আরো ভালো খেতে লাগতো।" ইরাবতী মুচকি হেসে গ্লাস ফেরত নিয়ে বলেন, "আজই রক্তের রিপোর্ট এসেছে। চিনি বেড়েছে আবার।" অবিনাশ বাবু অসহায় মুষড়ে পড়া চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন, "ইরাটা বড্ডো বেশি বুড়িয়ে গেছে। খালি দুশ্চিন্তা আর দুশ্চিন্তা।"
বাড়ির সামনের দিকে একখানা অর্ধেক চাঁদের মতো বারান্দা। গোটা বারান্দা জুড়ে লাল কালো খুপরি কাটা নকশা। পুরোনো দিনের সিমেন্টের সাধারণ মেঝে। বারান্দায় একজোড়া বেতের চেয়ার পাতা।বিকেলে সেই বেতের চেয়ারে বসে চা খান সস্ত্রীক অবিনাশ বাবু। চিনি ছাড়া চা আর চৌকো চৌকো কড়কড়ে ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুট... কোনো স্বাদ পান না অবিনাশ বাবু। অবিনাশ বাবুর আবার মিষ্টি ছাড়া চা মুখে রোচে না... এদিকে রক্তের চিনি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সুযোগ পেলে অবিনাশ বাবু প্রায়ই ইরাবতীকে লুকিয়ে চায়ে বড়ো একচামচ চিনি মিশিয়ে আনেন রান্নাঘর থেকে। তবে আজকাল ইরাবতীও খুব চালাকি করেন। হঠাৎ হঠাৎ অবিনাশ বাবুর কাপের চায়ে একটা চুমুক দিয়ে যাচাই করে নেন, চিনি মিশিয়েছেন কিনা! আর নির্ভুলভাবে প্রতিদিনই ধরা পড়ে যান অবিনাশ বাবু। কপট রাগে চোখ পাকান ইরাবতী, "আবার চিনি মিশিয়েছো?"
"এই তোমায় ছুঁয়ে বলছি... বিশ্বাস করো, আজ দিইনি। তোমার মুখটাই মিষ্টি হয়ে আছে মনেহয়।" হেসে ফেলেন ইরাবতী, "আজকাল মহা মিথ্যেবাদী হয়েছো দেখছি। আমিও তোমার স্বভাব খুব জানি... চিনি দাওনি তো তোমার চা এতো মিষ্টি কেন?" মোক্ষম প্রশ্ন ইরাবতীর। অপ্রস্তুতের একশেষ অবিনাশ বাবু... তবুও স্ত্রীকে বোঝাবার ক্ষীণ চেষ্টা, "ওই যে রান্নাঘরে জল ছাঁকনি যন্তর বসিয়েছো না? ওথেকেই মিষ্টি মিষ্টি জল বেরোয় গো! খেয়ে তো আমার তাই মনে হয়।" এবার ইরাবতী হাসিতে ফেটে পড়েন, "আচ্ছা বোকা পেয়েছো আমাকে! কী ভাবো বলোতো আমাকে? ছেলেমানুষ পেয়েছো নাকি তুমি আমাকে?"
কথোপকথন আর বেশীদূর এগোয় না এরপর। দুজনেই হেসে ফেলেন। ওনাদের ঝমঝমে হাসিতে আর বিকেলের মরা হলদেটে আলোয় ওনাদের বয়সের ভারে চিড়ধরা অতি সাধারণ লাল কালো খুপরি কাটা অর্ধগোলাকার বারান্দা হঠাৎ করেই যেন ষোড়শী তন্বী রূপসী হয়ে ওঠে। ওদিকে তখন প্রাণপণে গলা ফাটিয়ে আমগাছের মগডালটা থেকে কোকিলটা ডেকেই চলে অবিরাম। ইরাবতীর কানের হিরের ফুল, গলার কামরাঙা চেন আর হাতের শুধুসোনার মটর চুড়ি দুগাছি ঝিকমিক করে বিগতযৌবনা বিকেলের মায়াবী আলোয়। নীচু স্বরে বলেন ইরাবতী, "তোমার শরীরের জন্যইতো বলি! ছেলে তো উঁকি দিয়েও দেখতে আসবে না বিদেশ থেকে! কিছু হলে সব হ্যাপা পোয়াতে তো আমারই হবে!" অবিনাশ বাবু কিচ্ছু বলেন না। মোটা পুরোনো কালো ফ্রেমের চশমাটা শুধু চোখ থেকে খুলে পরনের সাদা ফতুয়ার পকেটে রাখেন। মাথাভর্তি সাদা চুল। ভাঙা তোবড়ানো গালে সাদা গুঁড়িগুঁড়ি দাড়ি, নাকের নীচে গুঁড়িগুঁড়ি বরফদানার মতো গোঁফ। ইরাবতীর দিকে চোখ তুলে তাকান একবার, "এখনও কী রূপ ইরার! পরনে চওড়া লালপেড়ে সাদা শাড়ি। পান-খয়েরের রসে টুকটুকে লাল ঠোঁটদুটি। চাবির ধুমসো গোছা বাঁধা আঁচলখানা পিঠে ফেলা। সাদা চুলের মাঝবরাবর সিঁথিটা রাঙানো টকটকে লাল সিঁদুরে। বিদায়ী সূর্যদেব যেন কপালে গনগনে লাল টিপ হয়ে জ্বলছে। অপলক খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে অবিনাশ বাবু বলেন, "একটু সাজগোজ করলে... মানে একটু কাজল ঠোঁটপালিশ পরে সাজগোজ করলেও তো পারো! আরো সুন্দর দেখায় তবে!" ইরাবতীর ফর্সাগালে রং ধরে... গলায় ছদ্মরাগ, "মরণদশা! ঢং দেখে বাঁচি না! তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে... এখন আবার সাজগোজ!" অবিনাশ বাবু স্ত্রীর মন ভোলাতে চেষ্টা করেন, "বারে, তাতে কী? মেয়েদের সাজগোজের আবার বয়স হয় নাকি?" নদীর কুলুকুলু তানের মতো খিলখিল করে হেসে ওঠেন ইরাবতী। মুখ জুড়ে ষোড়শী কিশোরীর উজ্জ্বল আলো আর গলায় মধুমাখা ছদ্ম রাগ! তখন বাইরে ফাগুনের ষড়যন্ত্রকারী আগুনে বাতাস ঝটকা দিয়ে এলোমেলো বয়ে যায়। তার যে বয়স বাড়ে না। আদি অনন্তকাল ধরে অদৃশ্য এক বাজিগরের অলৌকিক কমণ্ডলু থেকে প্রকৃতির শরীরে ছিটিয়ে দেয় কচি আমের মুকুল, গন্ধরাজফুল, নিমফুলের সুরভিত সুবাস। অস্তগামী দিবাকর নিপুণ দক্ষতায় আলোক সম্পাত করেন অবিনাশ আর ইরাবতীর আটান্ন বছরের পুরোনো দাম্পত্যের মাধুরীতে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নেমেছে অবিনাশ বাবুর বাড়িতে, বাগানে, বারান্দায়, ছাতে... শোবার ঘরের বাসুকি নাগের ফণা তোলা নকশাদার মেহগনি কাঠের উঁচু পালঙ্কের উপরে পাতা ধবধবে বিছানায়। সহস্রখণ্ডে বিভাজিত পূর্ণিমার চাঁদ গঙ্গাবক্ষে... আর অবিনাশ বাবুর বাড়িটির মাথায়। তখন হয়তো ঘরের মধ্যেও ঘোরলাগা আরও একটি চাঁদ। খোলা জানালার লোহার শিকের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে আছে ঘরের লাল কালো খুপরি কাটা পুরোনো সিমেন্টের মেঝেয়।নাম না জানা রাতফুলের সৌরভ আর রাতচরা পাখির তীক্ষ্ণ নজর উঁকি দিয়ে যায় জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে। পালঙ্কের উপরে অবিনাশ বাবু ঘুমে অচেতন, পরম মমতায় ইরাবতীর নিদ্রিত অলস বাহু স্পর্শ করে আছেন। আর থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ পাহারাদারি করছে অবিনাশ ও ইরাবতীর এই মধুযামিনীর। মানুষের শরীর তো নষ্ট হবেই একদিন। তারপর ? তারপর আবার কালের নিয়মে গৃহ ভরে উঠবে নবাগত অতিথিদের আখ্যানে। "শান্তি নীড়" সত্যিই শান্তির আবাস। এক অপরূপ পান্থশালা যেন। শূন্য থেকে শুরু হয়েছিলো একদিন অবিনাশ আর ইরাবতীর সংসার এই আবাসে। আজ তাঁদের যাবার বেলা। কালের এইই নিয়ম। একদল যায়, আবার নতুন একদল আসে, তারপর তারা চলে গেলে আরো এক নতুনদল আসে। ঋতুচক্রের মতো চলতেই থাকে এই আসা যাওয়ার অমোঘ খেলা!
******
"হ্যালো, অখিলেশদা... হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বাবলু। গতকাল রাতে জ্যেঠু জ্যেঠিমা একসাথে... হ্যাঁ আজ সকালে এসে মণি প্রথম জানতে পারে..."!
ফোনের ওপারে অবিনাশ বাবু আর ইরাবতীর একমাত্র ছেলে অখিলেশ তখন বাঁ-হাতে চোখ মুছছে... তেরো বছর দেশে যাওয়া হয়নি তার। বাবা মায়ের খবর তো সপ্তাহে কি দু-সপ্তাহে একবার ফোনে দু-এক মিনিট। গত দু'মাসে কাজের চাপে একদিনও বাবা-মাকে ফোন করার সময় বার করা হয়ে ওঠেনি অখিলেশের। অখিলেশ চশমা খুলে বাইরের বাগানে এসে দাঁড়ায়... ওর হাতঘড়িতে সময় রাত যখন দশটা, ওদিকে পৃথিবীর উল্টোপিঠে ভারতীয় সময় তখন সকাল আটটা। অখিলেশের বাবা মা অপেক্ষায় আছেন অন্ত্যেষ্টির... শূন্য থেকে শুরু হওয়া জীবন তাঁদের আবার মহাশূন্যেই শেষ। আমেরিকায় এখনও অনেক শীত। ঐ তীব্র শীতেও অখিলেশের কপাল ঘেমে উঠলো, আর গাল বেয়ে টপটপ করে গরম নোনা জল গড়িয়ে এলো কয়েকফোঁটা।