শুধু চোখের দোষী
শুধু চোখের দোষী
আদিত্য অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিন বাস স্টপেজে এক বছর কুড়ির মেয়েকে কোনায় দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখে। পরনে ছেঁড়া না হলেও রং চটা শাড়ি, কাঁধের ব্যাগটির অবস্থাযও তাথৈবচ। দৃষ্টি মাটি ছোঁয়া। আদিত্য মুখ ভালো করে লক্ষ্য করে নি তবে ওর ধারণা কারো জন্য অপেক্ষা করে মেয়েটি। এতদিনে তাকে কোনো বাসে উঠতে দ্যাখে নি। একদিন বন্ধুর সাথে গল্প করে বেশ রাত হয়েছিল বাস স্ট্যান্ডে আসতে, সেদিনও মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে দেখলো। অবশ্য সেদিন ওর ধারণাটা একটু বদলে গিয়েছিল। ভেবেছিল মেয়েটি নিঘাত দেহ পসারিনী, নইলে এত রাত অবধি কেনো দাঁড়িয়ে থাকবে, আর কখনো তো কোনো বাসেই ওঠে না। পরদিন থেকে আদিত্য ওই বাসস্ট্যান্ডে যাওয়া বন্ধ করলো। তারপর একদিন মেয়েটির কথা ভুলেও গেলো।
বেশ কয়েক ঋতু কাটিয়ে আদিত্য এখন রীতিমতো সংসারী। বউ আর মেয়ে নিয়ে সে সুখের নীড় গড়েছে এক বহুতলে। মা বাবা তাদের পৈতৃক বাড়ী ছেড়ে আসতে খুব একটা রাজি ছিলো না। আসলে বউ রিনির আবার একা থাকার ইচ্ছেটাই প্রবল তাই বাবা মা আসতে না চাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বলা যেতে পারে। অন্তত সবাইকে বলার একটা মোক্ষম কারণ তো পেয়েছে। তবে এক দেড় মাস অন্তর একাই বেলগাছিয়ার বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে দেখে আসে। রিনি আর মেয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ওরা নানা বাহানা করে এড়িয়ে যায়। তাই অগত্যা আদিত্য একাই যায়। সেদিন বেলগাছিয়ার বাড়িতে ঢুকেই খুব অবাক হয়ে যায়। মা খাটে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর পাশে বসা মহিলাটি ওর মায়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কি যেনো বলে চলেছে। আদিত্য অস্বীকার করার উপায় নেই মেয়েটির মুখ তার খুব চেনা। কিন্তু কে ঠিক মনে করতে না পেরে ঘরে ঢুকে বেশ জোরে বলে "মা, কি হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন?" ওর কথায় দুজনের সম্বিত ফেরে। আদিত্যকে দেখে মহিলাটি উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু আদিত্যর মা বিপাশা তাকে টেনে বসিয়ে বলে উঠলো "এই আমার ছেলে আদিত্য, তুমি বসো" এবার আদিত্যর দিকে ফিরে যা বললো তার সারমর্ম হলো আদিত্যর বাবা ভূষণ সকালে বাজার করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল রাস্তায়, এই মহিলা কয়েকজন লোক জোগাড় করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়, কারণ ডাক্তার দেখেই বলেছিলেন ওনার সেরিব্রাল অ্যার্টাক হয়েছে। পরে ভূষণের পকেট থেকে পাওয়া কাগজ দেখে বাড়ির ঠিকানা পায়। এখন বিপাশাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতেই দিতে এসেছে। বিপাশা এটাও জানালো যে মোবাইলে এই খবর জানানোর জন্য বার দুয়েক ফোন করেছে আদিত্যকে কিন্তু ফোনটা রিসিভ হয় নি। আদিত্য মায়ের বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো "এই কারণেই তোমাদের ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছিলাম, এখন বুঝলে তো " বিপাশা এই কথার উত্তর সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বলে উঠলো "রিনি আর মেয়ে কেমন আছে, সব ভালো তো?" আদিত্যর মন ঠিক বুঝেছে মা কেনো তার কথার উত্তর এড়িয়ে গেলো। মায়ের মন সব বুঝতে পারে। সেদিন ফ্ল্যাটে ফিরলো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। যেনো ওর বুকে কেউ কয়েক মণ ওজনের পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। না বাবার জন্য নয়, কারণ সেদিন ফেরার পথে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলেই এসেছে। বাবার অবস্থা আগের থেকে ভালই বলা যেতে পারে। কিন্তু ওই মহিলার সাথে কথা বলে ওর সব ধারণা পাল্টে যেতে বসেছে। হ্যাঁ এই সেই মেয়ে, যাকে সে রোজ বাস স্ট্যান্ডে দেখতো। আদিত্যর মনে পড়ায় সে জিজ্ঞেস করেছিল "আপনি ওই বাস স্ট্যান্ডে রোজ কেনো দাঁড়িয়ে থাকতেন? যদি আপত্তি না থাকে তো.......
" কথা শেষ হওয়ার আগেই রমা বলতে শুরু করে "আমি তখন একজনের অপেক্ষা করতাম, কারণ তিনি রাতে চোখে দেখতে পেতেন না, বাস থেকে নামলে ওনাকে নিয়ে বাড়ি যেতাম। আসলে আমার বাবার আসার কোনো সময় ঠিক থাকতো না, এক বেসরকারি অফিসের পিয়ন ছিলেন, প্রতিদিন এক সময়ে কাজ শেষ হতো না, তাই যতক্ষণ না বাবা আসতেন আমি অপেক্ষা করতাম" রমা কথাগুলো বলে আদিত্যর দিকে তাকায়। আবার বলে ওঠে " বাবা মায়ের জন্য এটুকু করা আমার কর্তব্য বলে মনে করি, তাই এতে আশর্জ্য হওয়ার কিছু নেই"। সেদিন আদিত্যর সাথে অনেক গল্প হলেও শেষের কথাটি যেনো ওর মনে গেঁথে গেছে। রমা বলেছিল "আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আশা তখনই করবো, যখন আমরা আগের প্রজন্মের লাঠি হতে পারবো"। আদিত্য আর দেরী করে নি। রিনিকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে বাবা মায়ের ছোটো একতলা বাড়িতেই ফিরে গিয়েছিল। যে মেয়েটিকে একসময় খারাপ ভেবে ওই বাস স্ট্যান্ড যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল সেই মেয়ে আজ ওর মনের অনেক উঁচুতে স্থান পেলো। মানুষ অনেকসময় উপর থেকে শুধু চোখের দেখা দেখেই কারো সম্বন্ধে খারাপ ভেবে নেয়, কিন্তু বিচার করে না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
