শ্রাদ্ধের ডায়েরি
শ্রাদ্ধের ডায়েরি
দুপুরে ইজি চেয়ারে বসে মক্কেলের কাগজপত্র গোছাচ্ছিলেন হাইকোর্টের নামজাদা উকিল 'দেবাংশ সিনহা'। কানে ভেসে আসল পোষ্টমাস্টারের গলার শব্দ "উকিলবাবু চিঠি আছে"
হ্যাঁ দিন।
খাম টা খুলতেই বেরিয়ে এল তার সহকর্মী 'ভবানেশ্বর রায়ের' কাকা রিটায়ার্ড জর্জ রাজনাথ রায়ের শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্র।
অবশ্য ফোনে ভবানেশ্বর বাবু তাকে বলেছে, এটি শুধু নিয়ম রক্ষার্থে।
আগামী ২২ শে জানুয়ারি শ্রাদ্ধ, ও তার পরের দিন মৎসমুখী অনুষ্ঠান।
দেবাংশ বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে গ্লাসের অবশিষ্ট জলটুকু এক নিশ্বাসে খেয়ে, ফোন করে ভবানেশ্বর বাবুকে-
হ্যালো।
হ্যা নমস্কার, বলুন বলুন।
আপনার নিমন্ত্রণ পত্র পেলাম।
আচ্ছা, বেশ বেশ। সময় মতো চলে আসবেন কিন্ত।
হুম চেষ্টা করব, তা ভালো আছেন তো?
হ্যা আছি, আপনিও ভালো তো?
হুম এই তো আছি, যাই হোক বলছি একটু ব্যস্ত আছি, মক্কেলের কিছু কাজে। এখন রাখি যদি কিছু মনে না করেন!
আরে না না ঠিক আছে।
ফোন টা টেবিলে ছুড়ে, বাকি কাজটুকু সেরে নেন।
তারপর ঘরে গিয়ে কিছু জামাকাপড় ব্যাগে কোনোরকমে গুছিয়ে নেন। বিছানায় মাথা দিতেই ঘুমিয়ে পড়েন, যখন চোখ খুলল সোনালি আলো মুখে খেলা করছে।
চা বানিয়ে খেয়ে বেড়িয়ে পড়েন ভবানেশ্বর বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে, প্রায় ৪ ঘন্টার রাস্তা তাই ২দিন থাকবেন বলেই ঠিক করে এসেছেন বাড়ি থেকে। যাই হোক স্টেশনে পৌছে দেখেন ট্রেন ১ ঘন্টা লেট, মহেশপুরের এই এক সমস্যা, সময়ে ট্রেন পাওয়া যায় না। যাই হোক একখানi Times of India কিনে তাতে চোখ বোলাতে থাকেন, আর চায়ে চুমুক দেন কিছু। ইতিমধ্যে ট্রেন উপস্থিত, ভাগ্যিস সক্কাল সক্কাল এসে পড়েছিলেন নয়ত বিষ্ণুপুর পৌছাতে বিকেল হয়ে যেত।
ট্রেনে উঠে পরেন, আর ভাগ্যবশত বসার জায়গাও পেয়ে যান। বসতে না বসতেই শুরু হল ট্রেনে রুমালওয়ালা, বাদামওয়ালা, লেবুওয়ালার, শশাওয়ালার ভিড়।
শশাওয়ালা ভদ্রলোক তো দেবাংশ বাবুর কানের কাছে এসে বলে উঠল " কি দাদা, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে!"
না না, ধন্যবাদ।
অবশেষে ট্রেন টা স্টেশন ছাড়ল, ফেরিওয়ালাদের থেকেও খানিক স্বস্তি পাওয়া গেল। দেবাংশ বাবু তার ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে চোখ রাখলেন পাতায়, খানিকক্ষণ পরে চোখ টা লেগে আসে।বিষ্ণুপুর স্টেশনে নেমে প্লাটফর্ম এ নামলেন। চোখ গেল এক ব্যক্তি একখানি প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাতে লেখা 'দেবাংশ সিনহা'।
কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাস করে - আপনি চেনেন দেবাংশ বাবুকে?
না চিনি না বাবু, আমারে বাবু পাটাইচে।
আমিই দেবাংশ সিনহা।
ও আসেন বাবু, আসেন। বলি আসতে অসুবিধা হয় নাই তো?
না তা হয় নি, আপনাকে কে পাঠিয়েছে?
আমায় বড় বাবু মানে ভবানেশ্বর বাবু পাটিইচে, তিনি আসতে পারে নাই।
আচ্ছা চলুন দিকি এবার অনেকটা বেলা হয়েছে।
বাড়িতে সবাই কিরকম একটা যেন করছে, এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ আবার একটা ডায়েরি নিয়ে ছুটোছুটি করছে, বেশ হতভম্বিত হলেন। এদিকে ভবা বাবুকেও দেখা যাচ্ছে না!
ওই, ওই তো ভবানেশ্বর বাবু।
আরে দেবু বাবু যে, আসুন আসুন।
হুম এই তো, একটা কথা ছিল যদি কিছু মনে না করেন...
আরে মনে করার কি আছে, বলুন বলুন।
আচ্ছা, ওনারা ডায়েরি টা নিয়ে ছুটোছুটি করছে কেন?
হো হো করে হেসে ওঠে ভবানেশ্বর বাবু।
কিছু কি ভুল বললাম?
আরে না না, আচ্ছা আপনি অনেকটা পথ এসছেন হাত মুখ ধুয়ে নিন তারপর না হয় শুনবেন।
দেবাংশ বাবু আর কথা না বাড়িয়ে, ওপরতলার দিকে পা বাড়ান।
জামাকাপড় পরিবর্তন করে, একখানা ঢোলা পাজামা আর একখানা পাঞ্জাবি পরে নিচে নেমে আসেন।
কোথায় যে গেল ভবানেশ্বর বাবু।
আরে ও দেবাংশ বাবু কি খুঁজছেন।
আপনারেই তো খুঁজছিলাম।
চলুন ঘরে গিয়ে বসা যাক।
তাই চলুন।
এবার বলুন তো ওটা কি!
একটু চা হলে ভালো হয়, দাঁড়ান আমি বলে আসি।
দেবাংশ ঘরটিকে ভালোভাবে দেখতে লাগলেন বেশ গুছোনো, গ্রাম্য গন্ধ রয়েছে।
মাথার উপর পুরোনো আমলের ফ্যান ঘুরছে, পর্দা গুলো বেশ পরিষ্কার, জানালা খুলে দিতে মৌসুমি হাওয়ার ঝোকা এসে শরীর ছুঁয়ে গেল।
এসে গেছেন, বলুন তো দেখি এবার কি ঘটনা।
প্রথম থেকে বলি তাহলে, শুনুন।
আমার কাকা ঈশ্বর রাজনাথ রায় খুব আময়িক মানুষ ছিলেন, সময় মেনে চলতেন ,তার দাপটে বাড়িটা কাঁপত। মৃত্যুর পরেও এর অনথ্যা হয় নি।
খলসে করে বলুন তো কি ব্যপার।
আরে বলছি বলছি, তিনি ডায়েরি লিখতে ভালোবাসতেন, আমরা এটা জানতাম তবে ব্যপারটা এতদূর গড়াবে আশা করিনি।
দাড়ান আপনাকে দেখাই।
"আমি রাজনাথ রায়, কোনো অগোছালো জিনিস আমার যেমন পছন্দ না, কেউ করবে সেটাও দেখতে পারব না। তাই এই পরিকল্পনা। এই সমস্ত কিছু দেখাশুনা করবে রামকৃষ্ণ ট্রাস্ট, আমার বর্ণনার অন্যথা হলে আমার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি চলে যাবে ট্রাস্টে।
আমার মৃত্যু হলে কি কি করতে হবে তার বর্ণনা লেখা রয়েছে,
আমার মৃত্যুর ঠিক চার ঘন্টা ১০ মিনিটের মাথায় বাড়ির বাইরে বের করতে হবে, এর অনথ্যা যেন না হয়।
এই চার ঘন্টায় শ্মশানের পাশে কৃষ্ণেন্দুর দোকান থেকে
খাট -২৩০০ টাকা
বাঁশ- ২০০ টাকা
আতর - ১৬ টাকা
চন্দন ধুপ - ৩০ টাকা
মোমবাতি -১০ টাকা
খই -৬০ টাকা
মালা - ১০০ টাকা
দড়ি - ৪০ টাকা
ইত্যাদি কিনতে হবে।
শ্মশান খরচ :
চুল্লি - ৫৫০ টাকা
ব্রাহ্মণ - ২০১ টাকা
উপরি - ১০০ টাকা
শ্মশান যাত্রী ২৪ জন, এর মধ্যে আমার ২ ভাইপো, ৪ ভাগ্নে আমায় কাঁধ দেবে।
আমার মুখাগ্নি করবে বড় ভাইপো মানে ভবানেশ্বর।
হুম চলুন বেশি দেরি হলে সমস্যা হবে, ডায়েরি টা খোঁজা খুঁজি শুরু হয়ে যাবে।
তাই হোক।
তা বলছি এই ডায়েরির ভিতরের কাহিনী তো শুনলাম বাইরের কাহিনী বলবেন না!
সেটা নাহয় পরেই শুনবেন।
আসলে কাকা যেদিন মারা যান তার ৩ দিন আগে কিছু একটা কথা বলতে বলতে ডায়েরির কথা ওঠে সেখানেই তিনি বলেন যে তিনি বেঁচে না থাকলে এই ডায়েরিটা দেখতে, আগে গুরুত্ব না দিলেও এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি।