শিক্ষার মাধ্যম
শিক্ষার মাধ্যম
না, এই স্কুলটাতেও চান্স পায়নি রাইমা। লিষ্টে নেই ওর নাম। এই নিয়ে চারটে স্কুলের রেজাল্ট এলো। অথচ ওর আগের দুটো বাচ্চা কি কাঁদছিল!! ভেতরেই ঢুকতে চাইছিল না। তাদের নাম এসেছে। রাইমা কিন্তু এই বয়সেই ভীষণ স্মার্ট, অনেক কিছু জানে। ফুল ফলের পশু পাখির নাম, রঙ, নম্বর এছাড়া রাইমস।
মনটা খুব খারাপ আরশির। ইমনের একটাই জেদ টাকা দিয়ে মেয়েকে ভর্তি করবে না কিছুতেই। অথচ আরশি বুঝতে পারছে সবটাই টাকার খেলা। রুহির মা বলছিল কয়েক লাখ লেগেছে রুহিকে সেন্ট জোন্সে ঢোকাতে। ওদিকে এম এম ইন্টারন্যাশনেলে দাদাভাই এর ছোট ছেলে পড়ে। সে ও নাকি তিন লাখ দিয়ে ভর্তি হয়েছিল।
আর্থিক অবস্থা ইমনের যথেষ্ট ভালো। কিন্তু এই সব নামি দামি স্কুলে সারা বছরে যা খরচ ইমন বা আরশির পেছনে সারা জীবনেও সে টাকা খরচ করেনি ওদের বাবারা।
আরশি ইমনকে বোঝাতে পারে না যে দিনকাল বদলেছে। শিক্ষাও এখন পণ্য। রঙচঙে মোড়কে মুড়ে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করছে একদল ব্যবসাদার। বড়দির ছেলে কয়েকলাখ টাকা খরচ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে সাউথের দিকে। ছোড়দির ননদ ডাক্তারি পাশ করে এলো হায়দ্রাবাদের এক প্রাইভেট কলেজ থেকে। টাকার অঙ্ক শুনলে চমকে উঠতে হয়। ইমনের অফিস কলিগ রমেশদার ছেলে ভালো রেজাল্ট করে বারো ক্লাস পাশ করেছে বলে সেদিন পার্টি ছিল। তাকেই বহু টাকা খরচ করে রাজস্থানের কোটায় পড়তে পাঠাচ্ছে রমেশদা।
কিন্তু ইমনের এক গো, এইটুকু মেয়ের পেছনে এভাবে টাকা খরচ করবো না!
আরশি রাইমাকে পড়তে বসায় সন্ধ্যায়। নতুন করে তৈরি করে ওকে। যে প্লে স্কুলে মেয়েটা পড়ত প্রায় সব বাচ্চা বিভিন্ন বড় স্কুলে চলে গেছে। পাড়ায় সদ্য গজিয়ে ওঠা ইংরেজী স্কুলগুলোতে ভর্তির ফিজও পঞ্চাশের উপর।
-''মেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়াবো। খোঁজ নিয়েছি সব। দিদি যে স্কুলে পড়েছে ওখানেই ভর্তি করবো।'' খেতে বসে ইমন বলে কথাটা।
-''বাংলা মাধ্যম?'' চমকে ওঠে আরশি। নিজে ভুক্তভোগী। আজকাল যে কেউ পড়ে না বাংলা মাধ্যমে। পেপারে পড়েছিল ভালো ভালো স্কুল গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পড়ুয়ার অভাবে।
-''আমরা যদি বাংলা মাধ্যমে পড়ে জীবনে দাঁড়াতে পারি রাইমাও পারবে। ওকে ভালো করে ইংরাজীর শেখাবো।''
আরশি জানে ইমন কতটা জেদি। ওকে বোঝানো অসম্ভব।
পরদিন শ্বশুরকে ফোনে সব জানায় আরশি।
-''মা, শিক্ষা যে ভাষাতেই পাক না কেনো সেটা শিক্ষাই। তোমার মেয়ে যদি মাতৃভাষায় শিক্ষা পায় ক্ষতি কি?''
-''প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারবে না যে। সবাই ইংরেজী মাধ্যমে পড়লে ও যে পাত্তাই পাবে না। '' আরশি শ্বশুরকে বোঝাতে চেষ্টা করে।
-''মেয়েকে যদি সঠিক শিক্ষা দিতে চাও মাধ্যমটা সমস্যা নয়। ও যে ভাষাতেই পড়ুক এগিয়ে যাবেই।''
-''কিন্তু আজকাল বাংলা স্কুলে যে ভালো পরিবারের কেউ ভর্তিই হয় না। এতো নিচুস্তরের শিশুরা আসে যাদের সঙ্গে মিশলে.....''
-''ছিঃ মা, এভাবে বলে না। ও যাদের সঙ্গেই মিশুক ওকে সঠিক শিক্ষা দেবে তুমি। ভালো খারাপ চিনতে শেখাবে।''
শ্বশুরকে ডেকে তো বিপদ আরো বাড়ল আরশির। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারে না মেয়ের এই বাংলা স্কুলে ভর্তি করার আলোচনা।
এর মাঝেই একটু আশার আলো দেখায় ননদ। তার মেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়ে সরকারি কলেজের থেকে পাশ করে সিভিল সার্ভিসে চান্স পেয়েছে। খরচ কিছুই নেই প্রায়। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ইংরেজী ভাষার উপর তিন বছরের কোর্স করেছিল ননদের মেয়ে। ওদিকে আত্মীয় স্বজনের সবাই বোঝায় টাকা ছাড়া উচ্চশিক্ষা হয় না আজকাল।
-''বৌদি, মিষ্টি খাও। আমার মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিকে জেলায় দ্বিতীয় হয়েছে সবার আশীর্বাদে।''
ঠিকা কাজের মাসির কথায় চমকে ওঠে আরশি। কাজের মাসির মেয়ে চম্পা মা অসুস্থ থাকলে কত দিন বাসন মেজে দিয়ে গেছে। লজ্জাই লাগে শুনে।
মুখে হাসি টেনে আরশি বলে -''বাঃ খুব ভালো। তা কি পড়াবে মেয়েকে?''
-''তোমাদের আশির্বাদে ও ডাক্তারিতেও চান্স পেয়ছে গো বৌদি। সরকারি বৃত্তিও পাবে হেড সার বলেছে। আর পাশের বাড়ির ডাক্তার দাদা বাকি খরচ দেবে বলেছে।''
অবাক হয়ে যায় আরশি। কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না চম্পার। এন্ট্রান্সের জন্য পাশের বাড়ির ডঃ রায় নিজেই বই কিনে দিয়েছিলেন নাকি। ওঁর ছেলেও গতবার সুযোগ পেয়েছিল জয়েন্টে। তারাই যা দেখিয়ে দিতেন।মেধা আছে চম্পার মানতে হবে।
রাতে শুয়ে ইমনকে বলে আরশি -''তাহলে কবে ভর্তি করছ মেয়েকে ? খোঁজ নিলে কিছু?''
-''বাংলা মাধ্যমের স্কুলে তো ফাইভ প্লাসে ভর্তি। এখনো এক বছর রাইমা বাড়িতেই থাকবে। যে প্লে স্কুলে যাচ্ছে যাক। তুমি তৈরি কর ওকে। পরের বছর ও ভর্তি হবে সরকারি স্কুলে। তবে তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে। ঐ সরকারি স্কুলটাও এ বছর থেকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়াবে। মেয়ে রাজ্য সরকারের স্কুলেই পড়বে।''
-''মাধ্যম নিয়ে আমি আর ভাবছি না। আজকাল সব ডিগ্ৰি আর সব শিক্ষাই টাকা দিয়ে কেনা যায় যেমন তেমনি চম্পার মত মেয়েরা টাকা ছাড়াই পথ খুঁজে নিচ্ছে। রাইমাও পারবে। বস্তিতে থেকে মিউনিসিপ্যালেটির স্কুলে পড়েও চম্পা ডাক্তার হতে চলেছে। তাহলে আমি এত ভাবছি কেনো?''
-''এটাই আমারও কথা, লোকে টাকা দিয়ে শিক্ষা কিনছে বলেই বিক্রি হচ্ছে। না কিনলেও তো পথ রয়েছে। আমরা সবাই যদি অর্থ'র পথ পরিহার করি, সবাই যদি বলি শিক্ষা কিনব না ওটাও একদিন বন্ধ হবে। আমরা টাকা দিয়ে দিয়ে ওদের চাহিদা বাড়াচ্ছি। সবাই যদি
প্রাইভেট স্কুলের পেছনে টাকার থলি নিয়ে ছোটে ব্যাঙের ছাতার মত স্কুল ও গজাবে, শিক্ষাও বিক্রি হবে।''
ইমন ধীরে ধীরে বলে।
ঘুমন্ত রাইমার দিকে তাকিয়ে আরশি বলে বলে -''অর্থ দিয়ে নয়, জ্ঞান দিয়েই মেয়েকে প্রকৃত শিক্ষিত করবো আমরা। ওকে সরকারী বাংলা স্কুলেই পড়াবো।''
বহুদিন পর শান্তিতে ঘুমায় আরশি। এসব নিয়ে আর ভাববে না।
(সমাপ্ত)