শেষ দেখা
শেষ দেখা
সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। বাসস্ট্যান্ড একটি মেয়েকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। কারণ আমি অনেক বছর পর নিশাকে দেখলাম সম্ভবত বাসের অপেক্ষায় আছে। আগের মতোই দেখতে সুন্দর, সুশীল আর ওর ওই কাজল কালো চোখ, ঠোঁটের হালকা হাসি মন কেড়ে নেয়। স্কুলে পড়াকালীন আমি মেয়ে বলতে কেবল নিশার সাথেই কথা বলতাম। কারণ ও বড়ই মিশুকে স্বভাবের, তোর ওর কথার মধ্যে আলাদা একটা আদব ছিল যা ব্যাখা করা কঠিন। বলা যায় নিশাই আমার পরম প্রিয় বন্ধু ছিল। পরবর্তীতে আমাকে কেরল যেতে হয় পড়তে । তারপর বেশ কয়েকবছর যোগাযোগ ছিল না। নিশার বিয়েতে একবার ওর সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু তারপর আবার কেরল চলে যেতে হয়। তাই গত কয়েকবছর আবার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। আমি নিশার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- কি রে কেমন আছিস?
- নিশা অন্য প্রান্তে চেয়েছিল। আমার আওয়াজ শুনে সাড়া দেয়,
- - আরে আবির যে! এইতো ভালোই রে।
- তা এই সন্ধ্যেবেলা কোথায় গেছিলি?
- - কোথায় আবার যাব রে আমার মেয়েকে প্রাইভেটে দিয়ে এলাম?
- ও কত বছর হলো তোর মেয়ের?
- - দিয়ার বয়স ৭।
- এখন ফ্রি আছিস?
- - হ্যাঁ কেন?
- না, তাহলে একটু একসাথে ঘুরে আসতে পারা যায়।
- - হ্যাঁ করাই যায়। চল তাহলে।
আমি আর নিশা বেরিয়ে পড়ি ঘুরতে। নিশার সব কিছু ঠিক থাকলেও কিন্তু একটা বিষয় খুবই অন্যরকম লাগল। ওর হাতের একটা অংশ অনেকটাই পোড়া ছিল। আমি ওকে একবার জিজ্ঞেস করব ভাবলাম কিন্তু করলাম না।
কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম আমরা দুজন। নিশার প্রথম কথা বলা শুরু করে
- তারপর বল কি করছিস এখন? সেই বিয়ের পর আর তো দেখায় পাওয়া যায় নি তোর।
- আরে বেশি কিছু না রে। আমি একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।
- - বাহ। ভালই তো রে। তা বিয়ে করেছিস?
- আরে ধুর বিয়ে! বাড়িতে এই নিয়ে কত কথা হয় আবার এখন তুই বলতে বসলে, আমি কিন্তু কথা বলব না।
- আমি কিছুটা অভিমান করেই বলি। সেটা বুঝতে পেরে নিশা মজা করে বলে,
- - হ্যাঁ অবশ্যই এখন তো কেবল গার্লফ্রেন্ডের সাথেই কথা বলবি আমরা কে তাই।
- কথা ছিল আমার রাগার আর তুই রেগে গেলি। এইটা ঠিক না!!
- নিশা খিল খিল করে হেসে ওঠে। আমি হাসি দেখে পুনরায় মুগ্ধ হয়ে যায়। আমি আজও নিশাকে ভালবাসি,সেইটা অবশ্য বলিনি কোনদিন ওকে। হঠাৎ খেয়াল হতেই হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৮টা বেজে গেছে। আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে ও বলে,
- - চল অনেক হল। আবার কোনদিন আসর হবে। এইবার বাড়ি যা। নাহলে কাকীমা চিন্তা করবে।
- হু। কিন্তু তুই এমন ভাবে বলছিস যেন তোর বাড়িতে কেউ চিন্তা করবে নাকি?
- না রে করবে না। করার মতো কেউ নেই রে।
- মানে!!
- এইখান থেকে বেরিয়ে বলি।
চারপাশের দিকে তাকিয়ে ও বলে।
- আচ্ছা।
- যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম আমার দিকে রেস্টুরেন্টের সবাই কেমন যেন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আমি সাধারনত এইরকম তাকানোকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আমরা আবার ওই বাসস্ট্যান্ডের দিকের পথ ধরলাম। যাওয়ার সময় কেমন যেন করছিল নিশা। আমি প্রশ্ন করতে ও বলে ওঠে আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি বললাম,
- বল কি বলবি!
- আমার মেয়েকে একটু দেখে রাখবি। আমার কাছে বেশি সময় নেই।
নিশার গলায় কাতর প্রার্থনা শোনা যায়। যেমন কোন মানুষ ভগবানের কাছে নিজের শেষ ইচ্ছে চায়।
- মানে বুঝলাম না ঠিক!
- এই যে হাতের পোড়া দাগটা দেখছিস। এইটা কোন সাধারণ পোড়া দাগ না। আমার পুরো শরীর জ্বলে গেছে। আমি তোকেই খুঁজছিলাম এতো দিন ধরে।
- মানে কি সব বলছিস। প্রথম থেকে বল।
- নিশা একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে।
- আমার বিয়েটা খুব ভাল জায়গায় দিয়েছিল, বাবা ভেবেছিল কিন্তু ওইটা যে কত বড় কারাগার ছিল সেইটা আমি বিয়ের তিন বছর পর আচ্চ পাই।ওদের অত্যাচার ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কারণ আমি কোন সন্তান জন্ম দিতে ব্যার্থ হচ্ছিলাম। তার দুই বছর পর আমি শেষমেশ অনেক ভাল ডাক্তার দেখিয়ে কনসিভ করি। কিন্তু হয় মেয়ে সন্তান। যা আমার কাছে আরো পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। দিয়ার তিনবছর সম্পূর্নের পর সেইদিনটি আসে। একদিন রাতে আমি ঘুমাচ্ছিলাম, পাশে সুজয়। হঠাৎ একটা পোড়া গন্ধ আমার নাকে ভেসে আসে, যা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আমি বোঝার চেস্টা করছিলাম গন্ধটা কোথা থেকে আসছে। জানিস কোথা থেকে আসছিল!! আমার ঘর থেকে। আমি এইটা বুঝতে পেরেই আমার বিছানার দিকে চোখ যায়। দেখি যে না আমার মেয়ে আছে আর না সুজয়।বুঝে যাই আমার শেষ সময় এসে গেছে। দ্রুত ফোন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম শেষ চেষ্টা বাচার। কিন্ত পারলাম না। তখন আমার তোর কথা মনে পড়ে। আমি জানতাম তুই আমাকে ভালবাসিস আর এইটাও জানতাম আমার মেয়ে একমাত্র তোর কাছেই সুরক্ষিত। তাই আমার শেষ ইচ্ছে ছিল যেন আমি তোর সাথে কোন ভাবে দেখা করতে। তারপর আসতে আসতে ধোঁয়া বাড়তে থাকে, আগুন ছড়িয়ে যায় ঘরের চারিদিকে। ধোঁয়ার কারনে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। আর তার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান হারালেও আমি বুঝতে পারছিলাম আমার দেহ জ্বলছে। আমি চিৎকার দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু পারিনি। আমার ধীরে ধীরে শরীর পুড়ে যেতে শুরু করে।
এতো দূর বলে নিশা থামে।
- তারপর!!
- তারপর ওরা আগুন নেভায়। ততক্ষনে আমার শরীর পুড়ে গেলেও প্রানটা বেচে ছিল্ কিছুটা। কিন্তু সেইটা ওরা টের পায়না। ভাবে মৃত। তাই শরীরটাকে সুজয় নিজ হাতে কেটে ফেলে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মেয়ে খুব কাদছেআর ওর ঠাম ওকে বারবার না কাঁদার কথা বলে চুপ করানোর চেষ্টা করছিল। আমি একবার ছুতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তখন আমি বুঝতে পারি আমার আত্মার শান্তি হয়নি। তারপর আমি তোকে অনেক খুজতে শুরু করলাম আর এইদিকে আমার মেয়েকে একটি অতৃপ্ত আত্মা হয়ে দেখে রাখতাম। আমাকে এখন কেবল তুই দেখতে পাবি আর অন্য কেউ না। তাই জন্য রেস্টুরেন্টেরলোকেরা তোর দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল।
- ছাড় তো ওদের তাকানোতে আমার কাছে যায় আসে না। বিশ্বাস কর আমার খুব রাগ হচ্ছে সুজয়ের উপর ওদের তো আমি জেলে পুড়ব।
মুখে রাগ ও বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠি।
- না তার দরকার নেই। পরবর্তীতে আমার বাবা সব সত্য জানতে পেরে ওদের জেলে দেয়। কিন্তু আমার মা নেই তুই জানিস। আমার বাবার হাতেও বেশিদিন নেই বর্তমানে। আমি মারা যাবার আগেই বাবার হার্টের সমস্যা শুরু হয়। তাই দিয়াকে বাবার কাছে রেখে যাওয়া সম্ভব না। । তাই জন্য তোকে দরকার । তুই ছাড়া এই কাজ কেউ পারবে না। আমার মেয়েকে একটু দেখে রাখবি? তোর পরিচয়ে ওকে বড় করবি?
- অবশ্যই। আমি ওকে মানুষের মতোই মানুষ করব।
হালকা হেসে দায়িত্বটা গ্রহণ করি।
-বেশ। এইবার আমাকে যেতে হবে-নিশা হালকা হেসে বলে। আমার চোখে জল কিন্তু মুখে হাসি। এইটাই হয়তো আমাদের শেষ বারের মতো দেখা। আমি দেখছিলাম নিশা ওই আকাশের সাথে মিশে যাচ্ছিল।
সেইদিনের পর থেকে দুইমাস কেটে গিয়েছে। আমার কাছে দিয়া বড় হচ্ছে— আমার পরিচয়ে — যেমনটা নিশা বলেছিল। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে এক মাস হয়েছে। আমি স্মৃতিকে একটাই শর্ত দিয়েছিলাম দিয়া আমার সবার আগের ভালবাসা, তাই আমাকে বিয়ে করতে হলে দিয়াকে আগে মানতে হবে নিজের মেয়ে বলে। এতে স্মৃতি রাজি হয়ে যায়। একমাসের মধ্যেই স্মৃতি দিয়াকে অনেক আপন করে নেয়।ওর সাথে রোজ খেলতে আসে। এখনও মাঝে মাঝে নিশার কথা মনে পড়লে, আমি দিয়াকে কাছে ডেকে নিই। কারন আমি খুঁজে নিয়েছি নিশাকে দিয়ার মধ্যে।
#সমাপ্ত