Snigdha Jha

Inspirational Others

2  

Snigdha Jha

Inspirational Others

সেই সময়

সেই সময়

4 mins
1.3K


(১)

---বৌমা অ বৌমা, এদিকে আয় দেখি মা.....

বড়মার শান্ত অথচ দৃঢ় ডাক কানে যেতেই ঝুমঝুম নূপুরের আওয়াজ তুলে ছুটে এলাম বড়মার পাশে। কোলের কাছে টেনে নিয়ে একমাথা কালো কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,

----যা তেলের বাটি আর চিরুনি নিয়ে আয় চুলটা বেঁধে দিই।


"আমি লুডো খেলছিলাম, মন ছটপট করছিল খেলায় ফিরে যেতে। কিন্তু বড়মাকে কিছু বলা যায় না, চুপচাপ চুল বাঁধতে বসে গেলাম। উনি আমার শাশুড়িমা। বাড়ীতে সবাই বড়মা বলে ডাকে, তাই আমিও। ন'বছর বয়সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ী এসেছি। কোলে বসিয়ে খাবার খাইয়ে দিতেন বড়মা। বড়মার একমাত্র ছেলের বৌ আমি। কিন্তু খুড়তুতোদের মিলিয়ে বিরাট একান্নবর্তী পরিবার। কে যে খুড়তুতো আর কে যে কি বোঝার উপায় ছিল না! সবাই মনে হত একই বাবা-মায়ের সন্তান। সেই হিসেবে আমি বাড়ীর বড় বৌমা। আমার বিয়ের পর তিনবছর পার হয়ে গেছে। বাড়ীতে আরও ছেলেদের বিয়ে হয়েছে, মানে আমার খেলার সাথী বেড়েছে। আমার বাকী শাশুড়িরা বড়মার পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করতেন না। সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে।"


 ওপরের অংশ আমার দিদার মানে ঠাকুমার জবানবন্দী। পরিবর্তন না করেই লিখলাম। আমাদের জেনারেশনের আর সেই ধরনের একান্নবর্তীতা দেখার সৌভাগ্য হয় নি। তবে তখনও সবার প্রতি সবার একনিষ্ঠতা বজায় ছিল। আমি জ্ঞান হয়ে বড়মাকে দেখেছি। টুকটুকে ফরসা গায়ের রং, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, মাঝারি উচ্চতার অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী চেহারা। দেখলেই শ্রদ্ধা হয়। সেই বয়সেও দেখতাম তাঁর পরামর্শ ছাড়া কেউ কোন কাজ করার কথা ভাবতো না। অথচ তিনি কখনই কর্তৃত্ব ফলাতেন না। তাঁর ব্যক্তিত্বই সবাইকে তাঁর কাছে নত করে রেখেছিল। বাড়ীর কাজের লোকেদেরও ভরসাস্থল ছিলেন তিনি। রাত্রে সব কচিকাঁচারা ঘুমিয়ে পড়লে সবার বিছানার কাছে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতেন কারও গায়ের চাদর সরে গেছে কি না, কারও মাথা বালিশ থেকে নেমে গেছে কি না, আর সব ঠিক করে দিতেন। কখনও ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পেতাম এসব। আমার তখন বয়েস বছর দশেক হবে তিনি আমাদের ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন। তাঁর সেই মমতামাখা বড় বড় চোখের দৃষ্টি আজও আমার বুকে যেন শ্যামল ছায়ার মত ছেয়ে আছে। 


এর পরবর্তী সময়ে আমার জীবনের বোধিবৃক্ষ ছিলেন বড়মার একমাত্র সন্তান আমার দাদু ( ঠাকুরদাদা) তিনিও ছিলেন তাঁরই অনুকরণে তৈরী। আমার যা কিছু শিক্ষাদীক্ষা বেশীরভাগ তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু জানি না কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছি। কখনও কোন প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পারলে ছুটে যেতাম ওঁর কাছে। অনেক বিষয়েই অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। এক্কেবারে সহজ গল্পের মত করে বুঝিয়ে দিতেন সবকিছু যা মনে গেঁথে যেত। ভুত- জীবন- ভগবান সব বিষয়েরই আমাদের যে কোন প্রশ্নের উত্তর ছিল তাঁর ঝুলিতে গল্পের আকারে। শান্ত-ধীর -স্থির, মৃদুভাষী মানুষটির কোন প্রশ্নেই বিরক্তি ছিল না উত্তর দিতে। কোন গল্পের শেষে আমাদের ক্রমাগত তারপরেরও জবাব তিনি হাসিমুখে দিয়ে গিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতেন।


তাঁর কাছে শিখেছিলাম সহজ-সরল- সাদামাটা ভাবে জীবন কাটিয়েও কি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যশালী বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারের মা- বাবার একমাত্র আদরের সন্তান হয়েও মোটা খাদির পোশাক আর সাধারণ পাম্পশু ছিল তাঁর পরিধান। উচ্চশিক্ষিত, নিরহংকারী, নির্লোভী এবং বিপুল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষটি ছিলেন নিজের জেলার সুদীর্ঘকালের অগ্রণী ও সুপরিচিত স্বাধীনতা -সংগ্রামী, সমাজসেবী এবং শিক্ষাসংস্কারক। আমাদের গর্বের মানুষ।  


ছোটবেলায় ভাবতাম যে যখন দাদু থাকবেন না তখন অজানা উত্তরগুলো আমরা কার কাছ থেকে পাবো!


দাদুর কথা লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। একটি ছোট্ট ঘটনা বলে শেষ করি। আমি জেলা শহরের একটি মেয়েস্কুলে পড়তাম, থাকতাম হস্টেলে। আমাদের গ্রাম থেকে ন-দশ কিলোমিটার দূরে। নতুন নতুন ভর্তি হয়েছি, বাড়ীর জন্য মন কেমন করে বলে প্রত্যেক রবিবার কেউ না কেউ দেখা করতে আসতো। এক রবিবার হস্টেল সুপার ভিজিটিং রুমে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি দাদু! খুব খুশী হলাম। এমন সময় আর একটি মেয়ের বাবা এলেন দেখা করতে। উনি একজন নামকরা ডাক্তার। দাদুকে দেখেই ডাক্তারবাবু সাষ্টাঙ্গে শুয়ে প্রণাম করলেন। এরকম নাটকীয় ব্যাপার দেখে আমরা হতবাক। দাদুও হতচকিত হয়ে,"আরে... আরে..." বলে তুলে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে।


ভদ্রলোক বললেন, " স্যার, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলবো না....." ইত্যাদি। দাদু শুধু একটু একটু হাসতে লাগলেন। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠলো। 


লাঞ্চের টেবিলে দাদুর প্রশংশায় সুপার পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন, যার ছিঁটে আমার ভাগেও জুটলো। হস্টেলে প্রতিষ্ঠা বেড়ে গেল। এইরকম অনেক জায়গাতেই দাদুর নামেই অনেকভাবে আমরাও সম্মানিত হয়েছি। 


অতীতের এই স্মৃতি আজও সুখময়।


  (২)

আজ এখন এই বোধিবৃক্ষের ছায়া আর আমার মাথার ওপরে নেই, কিন্তু সেই ছত্রছায়া অনুভূতিতে ছেয়ে আছে। এখনও জীবনে কোন সমস্যা এলে মনে মনে প্রথমে তাঁকেই স্মরণ করি, অনেক ভরসা পাই। 

বাড়ীর প্রাচীনের ওপর এই ধরনের ভরসা বা অনুভূতি বর্তমান জেনারেশানের মধ্যে খুব কম দেখতে পাই, যেটা আমাদের সেই সময় ছিল খুব স্বাভাবিক। সত্যি বলতে কি যে ছায়াকে তখন সুরক্ষার বর্ম বলে ভাবা হতো তা আজকাল অন্ধকার প্রদানকারী বলে ভেবে তা দূর করার ইচ্ছেমত উপায় নেওয়ার সবরকমের প্রচেষ্টা চালানো হয়। পুরাতন শরীরের অক্ষমতাকে সহ্য করার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গেছে যেন!


(সমাপ্ত) 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational