অন্দরমহল
অন্দরমহল


__ সভ্যতার আদিযুগে ধর্মীয় সঙ্ঘ, মঠ, মসজিদ এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আগেই নারী-পুরুষ জীবনে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করতো। নারীরও পুরুষের মত যজ্ঞ করার অধিকার ছিল। আমাদের দেশে প্রাচীন যুগে নারীরা ঋষি হতে পারতো, ব্রহ্মচর্যাশ্রমেও নারী শামিল হত। এমন কি উপনয়ন সংস্কারেও নারীর অধিকার ছিল। ব্রহ্মবিদ্যায় অধিকার ছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদে বহু মন্ত্রের প্রণেতা ছিল নারী। সেইসময় সব ক্ষেত্রেই নারীকে এক পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবেই গণ্য করা হতো। কিন্তু মনুর যুগে নারী-স্বাধীনতা কিছুটা কমে গেলেও নারী তখনও যথেষ্ট সম্মানিতা ছিলেন । মনু নিজেই বলেছেন,"যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে তত্র রমন্তে দেবতা" অর্থাৎ যেখানে নারী সম্মানিত সেখানে দেবতার বাস। মধ্যযুগ কিন্তু আসে নারীর জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে। ধর্মের নামে হতো গৌরীদান, হতো সতীদাহ। নারী হলো অসূর্যম্পশ্যা। আজ আমরা এত অগ্রগতির যুগে এসেও দেখছি ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ধর্মের নামে অধর্মাচরণ করে নারীকে পায়ের তলায় পেষণের চেষ্টা চলছে। আজ আমাদের এই দুশ্চেতনা থেকে মুক্তি পেতে হবে। নারীকে তার যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি আমার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। আপনারা আমার সাথে থাকুন। ধন্যবাদ।
হাততালির আওয়াজে ফেটে পড়লো জনসভা। বক্তা সুনির্মলবাবুর মুখ স্মিত হাসিতে ভরে উঠলো। জনতার মধ্যে থেকে রতনমণি মহিলা কলেজের ছাত্রী ইউনিয়নের সেক্রেটারী অবন্তিকা এসে একটি গোলাপফুলের মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। তার সাথে আসা বাকী মেয়েরা জনসেবক দলের নেতা সুনির্মলবাবুর জয় জয়কারে বাতাস ভরিয়ে তুললো,
__ আমরা সবসময় আপনার সাথে আছি স্যর।
অবন্তিকা গদগদ হয়ে বলে উঠলো,
__ আপনি আমাদের ভগবান।
সুনির্মলবাবু যেন কিছুটা সংকুচিত হয়ে বললেন,
__ না না... এসব কি যে বলছো! আমি তো জনতার সেবক মাত্র। আমি মহিলাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তাদের স্বাধীনতা বা সম্মান রক্ষা আমার কর্তব্য।
অবন্তিকা নমস্কার করে মঞ্চ থেকে নেমে নিজের নারীবাহিনী নিয়ে জনসভা ত্যাগ করলো। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়াতে সভার ইতি ঘোষণা করা হলো।
কিছুদিন পরে রতনমণি মহিলা কলেজের বার্ষিক প্রতিষ্ঠা দিবসের সমারোহের আয়োজন শুরু হলো। অবন্তিকা প্রিন্সিপ্যালের কাছে অনুষ্ঠানের প্রধান অথিতি হিসেবে সুনির্মলবাবুর নাম সাজেস্ট করলো। প্রিন্সিপ্যাল অপরাজিতা গাঙ্গুলী একটু অবাক হলেও কি ভেবে রাজী হয়ে গেলেন। অবন্তিকা নিজে গিয়ে তাঁকে ইনভাইট করে আসবে স্থির করে।
তিন / চার জন মিলে ইনভাইটেশন কার্ড হাতে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হয় ওনার বাড়ীতে। বিশাল বাড়ী। তারা মেইন গেটে গেট কীপারকে আসার কারণ জানাতে সে তাদের নিয়ে গিয়ে ড্রইংরুমে বসিয়ে অপেক্ষা করতে বললো। হঠাৎ ভেতর থেকে ভেসে আসা সুনির্মলবাবুর ক্রুদ্ধ গর্জন শুনে চমকে ওঠে মেয়ের দল। যে শব্দ গুলো তাদের কানে ভেসে আসছিল তা যেন তারা ঠিক হজম করতে পারছিল না। একি ওনারই আওয়াজ না অন্য কারও! তারা হতভম্ব হয়ে একে অন্যের মুখের দিকে চাইতে লাগলো। এত কুৎসিত ভাষা কোন শিক্ষিত ব্যক্তির মুখ থেকে আশা করা যায় না, তার ওপর আবার সুনির্মলবাবু..... ভাবাই যায় না! ওরা ফিরে যাওয়ার জন্য উঠবো উঠবো করছে এমন সময় একজন পরিচারিকা ওদের জন্য একটা ট্রেতে শরবত নিয়ে হাজির হলো। অবন্তিকা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
__ কিগো, বাড়ীর ভেতরে এত চেঁচামিছি কেন?
সে একবার ভীত দৃষ্টিতে ভেতরের দিকে তাকিয়ে যা জানালো তা হলো এই যে, কর্তাবাবু অর্থাৎ সুনির্মলবাবুর ছোটছেলের বৌ অত্যন্ত গরীব ঘরের মেয়ে। সুন্দরী বলে এবাড়ীতে প্রবেশের অধিকার সে পেয়েছে। কিন্তু তার বাপের বাড়ীর কারও এখানে পা ফেলারও হুকুম নেই। ছোটবৌরানী কলেজে পড়তো এবং খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। বিয়ের পর তার পড়াশোনা তো বন্ধ হয়েইছে,বাড়ীর বাইরে একা কোথাও যাওয়ারও অনুমতি নেই। বাড়ীতে প্রায় বন্দীদশায় অতিষ্ঠ হয়ে আজ সে তার দাদাকে তার পড়ার বইগুলো এনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফোনে খবর করেছিল। সে বেচারী তাই বোনের কাছে এসেছিল আর বোন তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল। এবাড়ীতে অন্দরমহলে বাহিরের পুরুষমানুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই এত হুলুস্থুল কান্ড। আজ আর ছোটবৌরানীর রক্ষা নেই। এত কথা ফিসফিসিয়ে জানিয়েই পরিচারিকাটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের সামনে থেকে যেন পালিয়ে গেল।
এর পর অবন্তিকারা আর এক সেকেন্ডও সেখানে বসার প্রয়োজন বোধ করলো না।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সব শুনে একটু হেসে অবন্তিকাকে বললেন,
__ তোমার প্রস্তাব শুনে তখনই আমি অবাক হয়েছিলাম,কেন জানো?
বলেই তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে চুপ করে গেলেন। মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বছর দু'য়েক আগেকার কিছু কথা তাঁর সামনে যেন ছবির মত ফুটে উঠলো। রাজলক্ষ্মী অফিসের মধ্যে কিছু জরুরী কাজে এসে তাঁর সাথে কথা বলে বেরিয়ে গেল। আগের থেকেই অফিসে নিজের বন্ধুর মেয়ের অ্যাডমিশনের সিফারিশের জন্য বসে থাকা এক ভদ্রলোক অবাক হয়ে চেয়ে দেখলেন রাজলক্ষ্মীকে।
__ ম্যাডাম, মেয়েটির অ্যাড্রেস দেবেন, কাইন্ডলি...
ভদ্রলোক প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দিকে চেয়ে বলে ওঠেন।
__কেন?
অবাক হন উনি।
__ আমার ছোটছেলের বিয়ে দেবো এবার। ভালো মেয়ে খুঁজছি। এখনই যে মেয়েটি এসেছিল খুব পছন্দ হয়েছে আমার। তার বাড়ীতে যোগাযোগ করবো ভাবছি।
__ কিন্তু আর মাত্র ছ'মাস বাকী আছে ওর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে, পড়াশোনাতে খুবই ভালো। এখন ওর প্যারেন্টস বিয়ের জন্য রাজী হবেন বলে মনে হয় না ।
__ আরে মাডাম, গ্র্যাজুয়েশন কোথায় পালচ্ছে, বিয়ের পরও হতে পারে। ছেলের মা ছেলের জন্য হন্যে হয়ে মেয়ে খুঁজছে। ছ'মাস অপেক্ষা করতে রাজী হবে না।
__ আচ্ছা, আমি দেখছি কথা বলে। তারপর আপনার সাথে কন্ট্যাক্ট করবো।
ভদ্রলোক নমস্কার করে সেদিন চলে গেছিলেন। তারপর উনি ভুলেই গেছিলেন এসব। তিন/ চার দিন পর ভদ্রলোকের ফোন আসাতে তিনি রাজলক্ষ্মীর বাড়ীতে গিয়ে এব্যাপারে আলোচনা করেন। তারা এত বড়লোকের সাথে সম্বন্ধ জুড়তে প্রথমে ইতস্তত করে। মোটামুটি তাঁর আগ্রহেই তারা বিয়ের জন্য রাজী হয়ে যায়। আজ রাজলক্ষ্মী আর ওর কষ্টের কারণে তার পরিবারের মনোকষ্টের জন্য তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দোষী মানেন।
হঠাৎ চমক ভাঙে ওনার। অবন্তিকা অবাক হয়ে তাঁর মুখে বিষন্নতার যে ছায়া পড়েছে তারই দিকে চেয়ে বসে রয়েছে। উনি জানালেন যে সুনির্মলবাবুর ছোটছেলের বৌ ওনার বড়দিদির মেয়ে। এই বিয়ে ওনারই আগ্রহে হয়েছিল। আর এই দুঃখ আজ পর্য্যন্ত তাঁর বুকে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। অবন্তিকা স্তব্ধ হয়ে যায়।