বিচার
বিচার
দ্রুতগতিতে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলেছে শহরের সদর হাস্পাতালের দিকে। গ্রামের থেকে ডাক্তার সদরে রেফার করে দিলেন। গ্রামের হেলথ সেন্টারে সবরকম সুবিধে নেই। মোড়লমশায়ের আঠবছরের একমাত্র নাতি কয়েক দিন থেকে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছে। সাথে মাথায় খুব যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব,গায়ে হাতে ব্যথা। কাল রাত থেকে কয়েকবার পায়খানা ও হয়ে যাচ্ছে। হেলথ সেন্টারের ডাক্তার দেখে প্রাথমিকভাবে কিছু ওষুধ দেন। আর রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষার কথা বলেন যেটা এখানে সম্ভব নয়। আজ সকালে অবস্থা আরও খারাপ হলে হাস্পাতালের একমাত্র ঝরঝরে অ্যাম্বুলেন্সে পেশেন্টকে নিয়ে মোড়লমশাই এবং আরও কয়েকজনের সাথে ডাক্তারবাবু নিজেও রওনা হয়ে গেলেন।
সেখানে পৌঁছে ডক্টর মহাপাত্রের হাতে বাচ্চাটিকে তুলে দেওয়া হলো। ডাক্তার হিসেবে তাঁর খুব নামডাক। তিনি দেখেই রক্ত পরীক্ষা আর সি টি স্ক্যানের ব্যবস্থা করে দিলেন। রিপোর্ট পেলেই বাকী চিকিৎসা শুরু হবে। কিন্তু রিপোর্ট আসতে তো একটু সময় লাগবে। পেশেন্টকে এমার্জেন্সি কেয়ারে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। মোড়লমশাই ছটপট করছেন। গ্রামের হেলথ্ সেন্টারের ডাক্তারবাবু তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফিরে গেলেন।
__হ্যালো...
ফোন রিসিভ করেন ডক্টর মহাপাত্র।
__ শিগগির বাড়ী এসো...কুণাল কেমন যেন করছে...!
স্ত্রীর কান্নাজড়ানো আওয়াজে ঘাবড়ে যান তিনি। একমাত্র ছেলে কুণাল কয়েকদিন থেকে অসুস্থ। সবকিছু টেস্ট করার পরও কিছু ধরা পড়ে নি। তাঁর স্ত্রী ছেলেকে হাস্পাতালে অ্যাডমিট করতে চান না। তাই বাড়ীতে রেখেই তার চিকিৎসা চলছে। খবর নিয়ে জানলেন যে নতুন আসা বাচ্চা পেশেন্টটির রিপোর্ট আসতে এখনও ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। তাঁর বাড়ী বেশী দূরে নয়। অন্য একজন ডাক্তারকে কিছুক্ষণের জন্য তার জিম্মেদারী দিয়ে তিনি বাড়ীর দিকে বেড়িয়ে পড়লেন। এমনিতে স্ত্রীর অভিযোগ যে তাঁর মনপ্রাণ সমস্ত নাকি সবসময় হাসপাতালেই পড়ে থাকে। সত্যিই, তিনি ফ্যামিলির জন্য এক্কেবারে সময় দিতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে ছেলে বা স্ত্রীর প্রতি তাঁর অ্যাফেকশন কম নেই। সেই অ্যাফেকশনই তো সময় না থাকা সত্বেও এই মুহূর্তে হাস্পাতাল থেকে তাঁকে বাড়ীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ী পৌঁছেই ছেলের কন্ডিশন দেখে তাড়াতাড়ি চিকিৎসায় লেগে গেলেন। অবস্থা সিরিয়াসের দিকেই মোড় নিয়েছে। স্ত্রী ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে,
__ নিজের ফ্যামিলীর চেয়েও তোমার কাছে কাজের জায়গা বেশী প্রিয়?
__ তুমি একজন শিক্ষিতা মহিলা হয়ে কি যা তা বলে যাচ্ছো! আমাদের প্রফেশনের গুরুত্ব তুমি খুব ভালোই জানো। তা সত্বেও.....
অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকান তিনি,
__ আর কোন কথা নয়... আজ কুণালকে হাস্পাতা
লে অ্যাডমিট করতেই হবে, বাড়ীতে রেখে চিকিৎসা সম্ভব নয়।
হঠাৎ ব্যাগে রাখা ফোন বেজে ওঠে। কানে নিয়ে ডক্টর রিপ্লাই করেন,
__ হ্যাঁ হ্যাঁ.... শিগগির আসছি... তোমরা ব্যবস্থা করে রাখো।
স্ত্রীর দিকে চেয়ে,
__ আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি,কুণাল একটু আরাম পাবে। একটা এমার্জেন্সি কেস আছে। আমায় এক্ষুণি যেতে হবে। ওখানে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। কুণালকে নিয়ে হাস্পাতালে চলে আসবে,
বলেই ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন ডক্টর মহাপাত্র।
হাসপাতালে পৌঁছে ডক্টর মহাপাত্র গাড়ী থেকে নামতেই...
__ আহ্,
বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পেছন থেকে কেউ মোটা লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে চারপাশ থেকে পাঁচ/ ছয়জন লোক ঘিরে ফেলে লাঠি দিয়ে বীভৎস আক্রোশে মারতে লাগলো,
__ শালা ডাক্তার, এমার্জেন্সি কেসের পেশেন্ট ফেলে বাড়ী ফূর্তি করতে যাওয়া হয়েছিল!
ইত্যাদি অকথ্য ভাষার প্রহারও চলতে লাগলো।
মোড়লমশাই উন্মাদের মত কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন,
__ মার, মার... মেরে ফেল শালাকে... আমার একমাত্র নাতি যখন বাঁচলো না তখন ওরও বেঁচে থাকার অধিকার নেই। চিকিৎসা তো জানেই না, তার ওপর ডাক্তার হয়ে কোন জিম্মেদারি নেই...মেরে ফেললো আমার নাতিকে... থুঃ....
বলেই একদলা থুতু ছুঁড়ে ফেলেন ডক্টরের মুখের ওপর।
ততক্ষণে হৈ হৈ করে ছুটে এসেছে হাস্পাতালের সমস্ত স্টাফ। মুমূর্ষু ডক্টরকে স্ট্রেচারে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এসে মোড়লমশায়ের শাগরেদদের অ্যারেস্ট করে।
মোড়লমশায়কে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে, ডাক্তার ভগবান নন। তাঁরা নিজেদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারেন এবং তাই করেও যান। তাঁর নাতির রিপোর্ট দেখে জানা গেছে যে তার ব্রেনে এনকোফেলাইটিস নামের অসুখ বাসা বেঁধে ছিল। গ্রামে শুরুতেই তাঁরা উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করেন নি। বাড়ীতে নিজেরাই টোনা টোটকা চালিয়েছিলেন। অসুখের চূড়ান্ত পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে আনা হয়,যখন আর কিছু করার থাকে না।
ডাক্তার মহাপাত্র রিপোর্ট আসার দেরী ছিল বলে বাড়ীতে নিজের অসুস্থ ছেলের কাছে যান, কোন ফূর্তি করতে যান নি। রিপোর্ট আসার খবর পাওয়ামাত্র অসুস্থ ছেলেকে ফেলে হাস্পাতালে ছুটে আসেন। আর এখানে পৌঁছানোমাত্র অনাবশ্যক হিংসার শিকার হন।
এত বোঝানোর পরও মোড়লমশায়ের নাতির প্রতি অ্যাফেকশন ডাক্তারের প্রতি কিছুতেই ঝুঁকতে দিতে রাজী নয়। কিছুতেই বুঝতে চান না যে ডাক্তারও একজন মানুষ। তাঁরও ফ্যামিলী আছে, সুখ/ দুখে ভরা একটা মন আছে। তাঁর ফ্যামিলীও তাঁর কাছ থেকে একটু অ্যাফেকশন, একটু সময় আশা করে।