ভালোবাসি যারে
ভালোবাসি যারে
ভোঁ...ও...ও... আওয়াজে চমকে গিয়ে শক্ত করে ধরে থাকা হাতের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। বানিজ্যিক জাহাজটি বিশাখাপটনমের বন্দরঘাট ছাড়ার সূচনা দিল। অভীক আর নাতাশা ছটপট করে ওঠে। নাতাশার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে হাত ছাড়িয়ে জাহাজের দিকে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গেল অভীক। জাহাজটিতে এক সেলারের চাকরী নিয়ে সে তার প্রিয়তমাকে ছেড়ে সিঙ্গাপুর পাড়ি দিচ্ছে আড়াই মাসের জন্য। ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছিল। কিন্তু জাহাজ ছাড়ার দিন পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগে আজই হয়ে যাওয়াতে তাড়াহুড়ো করে কেবল এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতে হলো। জাহাজ ফিরলেই বিয়ের বাকী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। দু'জনেই অনাথ আশ্রমে মানুষ। একটু বড় হতেই শহরের বড় চার্চের ফাদার তাদের চার্চে নিজের কাছে আশ্রয় দেন এবং নিজের ফ্যামিলী মেম্বারের মতই স্নেহ করেন তাদের। খুব দয়ালু তিনি। পড়াশোনাতেও যথেষ্ট সাহায্য করে গেছেন। সাদামাটা মেরিটের হলেও কলেজের গণ্ডী তারা এক চান্সেই পার করে ফেলে। এরপর পড়াশোনাতে ক্ষান্ত দেয়। ফাদারও বিশেষ জোর করেন না। একসাথে ছোটবেলা থেকেই প্রায় এভাবে বড় হওয়াতে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গভীর সম্পর্কে পরিণত হয়। দু'জনের মনে এক অচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরী হয়ে যায়। অভীক নাতাশাকে বিয়ে করবে স্থির করে। কিন্তু এর জন্য ফাদারের অনুমতি প্রয়োজন। ফাদার শান্তস্বভাবের নাতাশাকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসেন। অভীক যতদিন না নিজে উপার্জন করে সংসার চালাবার উপযুক্ত হয় ততদিন ফাদার তার হাতে নাতাশাকে দিতে রাজী হবেন বলে মনেও হয় না। তারা দু'জনেই তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। তাঁর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। অভীক চাকরীর জন্য এদিকওদিক হন্যে হয়ে চেষ্টা চালাতে থাকে। তার কলেজের এক বন্ধু একদিন তাকে এই জাহাজের চাকরীর খবরটা দেয়। ছোটখাটো কয়েকটি বিভিন্ন টেস্ট আর মেডিকেল টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে গেলে জাহাজ কোম্পানী তাকে সিলেক্ট করে নেয়। বলা হয় যে জাহাজ ছাড়ার দিন ফিক্সড হলেই খবর দেওয়া হবে,আর সেটা হবে সম্ভবত মার্চের প্রথম সপ্তাহে। এখন তার আর নাতাশার এক হওয়ার মধ্যে যেটুকু বাধা ছিল তা দূর হয়ে গেলো। খুশীতে আত্মহারা হয়ে অভীক বাড়ী ফিরে নাতাশাকে সব জানায়।
এবার পরবর্তী স্টেপ নেওয়ার জন্য মনস্থির করে তারা। একদিন ফাদার বাগানে ফুলগাছের দেখাশোনা করছেন। এটি তাঁর একটি অন্যতম প্রিয় শখ। অভীক নাতাশার হাত ধরে এসে তাঁর সামনে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সাহস জুটিয়ে তাদের মনের কথা বলেই ফেলে। ফাদার স্মিত হাসি হেসে তাদের মাথায় হাত রাখলেন। অভীক তার চাকরী পাওয়ার কথা জানাতে তিনি খুব খুশী হলেন। এবার তাদের জীবনে আনন্দ যেন সাত রঙের জোয়ার এনে দিল। ফাদার তাদের বিয়ের দিন স্থির করে ফেললেন। তাঁর ইচ্ছে অভীকের জাহাজযাত্রার আগেই বিয়েটা হয়ে যাক। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই জাহাজের অফিস থেকে ডাক এলো এবং জানানো হলো যে দশই জানুয়ারি জাহাজ বন্দর থেকে রওয়ানা হবে। এত তাড়াতাড়ি...! অভীক আর নাতাশা হতভম্ব। অগত্যা ফাদার তাদের এনগেজমেন্টের ব্যবস্থা করে ফেললেন আর ঠিক করলেন যে জাহাজ ফিরলেই বিয়ের ব্যবস্থা করা যাবে। এখন এত অল্প সময়ের মধ্যে আর কোন উপায়ও নেই। তিনি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে অভীককে কোনরকম চিন্তা করতে বারন করলেন। কিছু করার ছিলো না। অভীক চাকরীটা ছাড়তে চায় না। কয়েকটা তো মাসের ব্যাপার... দেখতে দেখতে কেটে যাবে,নাতাশাকে বোঝায় সে।
দশই জানুয়ারি জাহাজ তার গন্তব্যে পাড়ি দিল অভীককে নিয়ে। নাতাশা অভীককে বিদায় দিয়ে বিষন্নমুখে বাড়ী ফিরলো। এই প্রথম অভীক তাকে ছেড়ে এতদিনের জন্য অতদূরে গেল। সে ভাবতে পারছিলো না কি করে তাকে না দেখে দিন কাটাবে! অভীক তার জীবনে রোজ সকালে সূর্য ওঠার মতই ছিলো। নিজের মনের ব্যথাকে লুকিয়ে ফাদারের সামনে হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করে,তাঁকে কোনরকম দুঃখ দিতে চায় না। সময় বসে থাকে না। অবশেষে আড়াই মাসের যেন অন্তহীন প্রতীক্ষা শেষ হয়েই গেলো। অপেক্ষার উৎকন্ঠা এবার যেন বাঁধন ছিঁড়ে ফেলবে। ফাদারের কাছে গিয়ে মুখ নীচু করে দাঁড়ায় নাতাশা। স্বল্পভাষী এই মেয়েটির মুখ দেখেই তার মনের কথা বুঝতে পারেন তিনি,ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে একটু হেসে বলেন,
__ তোমার অপেক্ষার সময় শেষ হলো। শিগগির এবার অভীক বাড়ী ফিরে আসবে।
কিন্তু তিনিও উৎকন্ঠার চাপে ছিলেন। সময় তো হয়ে গেছে, এখনও সে ফিরলো না কেন! তিনি লোক পাঠালেন জাহাজ কোম্পানীর অফিসে। খবর পেলেন সিঙ্গাপুরের জাহাজ দিন দুয়েক আগে ফিরেছে। কিন্তু অভীকের ব্যাপারে কোন সন্তোষজনক খবর পেলেন না। একথা নাতাশাকে তিনি জানাতে পারলেন না। তিনি জানতেন একথা শুনলেই সে এক্কেবারে ভেঙ্গে পড়বে,তাকে সামলানো মুশকিল হবে। অত্যন্ত চিন্তায় পড়লেন... কি হলো ছেলেটার ! একটা অজানা আশঙ্কা তাঁকে ঘিরে ধরলো। অনেক চেষ্টা করেও কিছু জানতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে হাল ছাড়লেন। নাতাশার মুখোমুখি হলে তাঁর চোখ তুলে চাইতে ভয় হয় আজকাল।
এদিকে নাতাশা ধৈর্য হারিয়ে দু/এক দিন পর সকালে কাউকে কিছু না বলে একা একা বন্দরঘাটে গিয়ে উপস্থিত হলো। অবাক হয়ে দেখে এক জাহাজ নোঙ্গর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবতে লাগলো কি ভাবে জানা যায় যে জাহাজটা কোথা থেকে এসেছে। এমন সময় দেখে দু'জন সেলার ওই জাহাজ থেকে নেমে এদিকেই আসছে। তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে এগিয়ে গিয়ে এক চায়ের দোকানে বসলো। নাতাশা তাদের কাছে গিয়ে একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করে ,
__দাদা, এ জাহাজ কি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছে?
তারা অবাক হয়ে অচেনা মেয়েটির দিকে চায়। তারপর বলে ,
__হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
নাতাশা জানায় যে অভীক নামে তার এক আত্মীয় এই জাহাজে সেলারের কাজ নিয়ে সিঙ্গাপুর গেছিলো আর সেখান থেকে ফেরার কথা ছিলো এই ট্রিপেই। কিন্তু সে এখনও বাড়ী না ফেরাতে তারা খুব দুশ্চিন্তায় আছে। অভীকের সম্বন্ধে তারা কিছু জানে কি না জিজ্ঞেস করাতে তারা বললো,
__আমরা তো জাহাজ ফেরার সময় সিঙ্গাপুর থেকে উঠেছি। কিছু সেলার অসুস্থ হয়ে পড়াতে আমাদের নেওয়া হয়েছে। তাই অভীকের সম্বন্ধে জানি না কিছু। আর জাহাজ যখন এখানে পৌঁছোয় তখন অভীক নামের কোন সেলার তো ছিল না। জাহাজ তো কয়েকদিন আগেই ফিরেছে এখানে।
নাতাশার পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠলো যেন। ছেলে দু'টি বললো,
__ আজ বিকেল চারটে নাগাদ জাহাজ ছাড়বে এখান থেকে। সেখানে গিয়ে খোঁজ করবো,যদি অভীকের কোন খবর পাই নিশ্চয় জানাবো আপনাকে।
নাতাশা তাদের থেকে সহানুভূতি পেয়ে অভীক আর তার সম্পর্কের কথা খুলে বলে এবং পার্স থেকে নিজের একটি ফটো বের করে তাদের হাতে দিয়ে বলে ,
__দাদা, যদি দেখা হয় এটা তাকে দেবেন আর বলবেন যে আমি তার অপেক্ষায় আছি আর আজীবন থাকবো।
ছেলেদু'টির মুখ সহানুভূতিতে কোমল হয়ে ওঠে। আর কোন কথা বেরোয় না তাদের মুখ থেকে। ফটো নিয়ে নাতাশার মাথায় হাত বুলিয়ে জাহাজের দিকে রওয়ানা হয় তারা । নাতাশার দু'চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। কোনরকমে নিজেকে সামলে বাড়ী ফিরলো। একথা ফাদারকে জানিয়ে তাঁকে চিন্তায় ফেলার তার ইচ্ছে হলো না। ওনার বয়েস হয়েছে,আজকাল মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিজের রুমে গিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। আজ তার চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার কেউ নেই পাশে।
যথাসময়ে জাহাজ সিঙ্গাপুরে নোঙ্গর করলো। জাহাজ দশদিন সেখানে থাকবে। সেলার দুটি নাতাশার কথা ভোলে নি। তারা সময় পেলেই এদিকওদিক খোঁজ নেয়। হঠাৎ একদিন ডেকেরই এক খাবারের দোকানের ক্যাশিয়ারের দিকে তাদের নজর গেল। তাদেরই বয়সী এক ভারতীয়। কাছে গিয়ে দেখে তার একটি পা নেই। কৌতুহল নিয়ে পরিচয় করার জন্য চেয়ার টেনে তার পাশে বসে পড়ে। পরিচয়ের প্রসঙ্গে ছেলেটি জানালো যে সে ভারতীয়,তার নাম অভীক এবং সে ওই জাহাজেরই সেলার হয়ে এখানে আসে। চমকে ওঠে তারা। তার পা কিভাবে কাটলো জিজ্ঞেস করাতে অভীক বললো,
__ জাহাজ এখানে পৌঁছোনোর একদিন পরেই জিনিষ ওঠানোনামানো করার সময় এক দুর্ঘটনা ঘটে আর তাতে আমার একটি পা কেটে যায়। জাহাজকোম্পানীর তরফ থেকেই আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে উঠে আর বাড়ী ফিরতে না চাইলে এই দোকানের কাজে লাগিয়ে দেয়।
সেলারদুটি কোন কথা না বলে তার দিকে নাতাশার ফটোটা এগিয়ে দেয়।
__এ ফটো তোমরা কোথায় পেলে?
অবাক হয়ে নিজেকে কোনরকমে সংযত রাখার চেষ্টা করে অভীক। বুকের ভেতর তার মুচড়ে যাচ্ছে যেন। কি করে...কি করে নিজেকে সামলাবে সে! অনেক চেষ্টা করে মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছিল তার ভাবনাকে ,আজ বাঁধ ভেঙে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বুঝি।
সেলারটি সব ঘটনা বলে তাকে জিজ্ঞেস করে,
__ বাড়ী ফিরলে না কেন? আর কোন খবরই বা পাঠাও নি কেন?
অভীক জবাব দিল,
__সেই জাহাজে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। সুস্থ হয়ে ফিরতে পারতাম। কিন্তু এইভাবে পঙ্গু হয়ে নাতাশার সামনে দাঁড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তোমরা তো শুনেইছো যে আমাদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছিল। নাতাশা আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। সে এই অবস্থাতেও আমাকেই বিয়ে করতে চাইতো। কিন্তু আমি তার জীবনে আমার দুর্ভাগ্য চাপিয়ে দিতে চাই নি। আর ফাদারকে একথা জানালে তিনি হয়তো কোন মুহূর্তে নাতাশাকে সব বলে ফেলতেন। তাই তাঁকেও জানাই নি বা জানাতে দিই নি। এইভাবে হারিয়ে গিয়ে নাতাশাকে সুখী করার চেষ্টা করেছি।
__নাতাশা কি তোমায় ছেড়ে সুখে থাকবে? আমার মনে হয় না। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই তার চোখে তোমার জন্য যে ছবি দেখেছি আর তার কথার থেকে এটুকুই বুঝেছি যে সে খুব দুশ্চিন্তায় আছে আর তার পক্ষে তোমায় ভুলে যাওয়া অসম্ভব ...
একজন সেলার বলে ওঠে।
অভীক আনমনা হয়ে বলে...
__সময় সব ভুলিয়ে দেবে,ভাই। ফাদার ওকে মেয়ের মত স্নেহ করেন। তিনি তাকে কষ্ট পেতে দেবেন না। খুব ভালোভাবেই তাকে জীবনে সেটল্ড করে দেবেন, আমি জানি।
একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভীক জিজ্ঞেস করে,
__তোমরা আর ক'দিন এখানে আছো?
তারা জবাব দেয়,
__চার/পাঁচ দিন আরও।
__তাহলে তোমরা এখানকার কাছকাছি যে চার্চটি আছে সেখানে কালকে আমার সাথে দেখা করলে খুব উপকৃত হবো,
অভীক তাদের হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে। অভীকের কাঁধে হাত রাখে তারা, ঠিকানা নিয়ে রাজী হয়ে যায়।
পরদিন তারা চার্চে পৌঁছে দেখে অভীক সেখানে আগে থেকেই হাজির। তার পরনে বিয়ের পোষাক আর এক টেবিলে নাতাশার ফটোটা বিয়ে কনের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দেখে অভীক এগিয়ে এসে তাদের জড়িয়ে ধরে, তার মুখে এক অলৌকিক হাসি ছেয়ে আছে... বলে ,
__ নাতাশা তোমাদের দাদা বলে ডেকেছিল,তাই তোমাদের উপস্থিতিতে তোমাদের বোনের ফটোর সাথে আজ আমার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। পাদ্রীসাহেবকে বলা আছে, উনি এখুনি আসবেন।
সেলার দু'জন হতভম্ব। এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখেশুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে তারা। কেবল অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে... ভালোবাসার এক নতুন রূপ তাদের সামনে। অভীক বলে যায়...
__এই ফটোই আমার পরবর্তী জীবনের সঙ্গিনী হয়ে থাকবে। আমি আর ভারতে ফিরে যাবো না,কারণ তোমাদের আগেই বলেছি। তবে তোমাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ যে ভারতে ফিরে গিয়ে আমার এই হারিয়ে যাওয়ার খবরটাই বজায় রেখো বন্ধুরা।
"এত দিন নয়নধারা বয়েছে বাঁধনহারা,
কেন বয় পাইনি যে তার কূলকিনারা---
আজ গাঁথল কে সেই অশ্রুমালা,
তোমার গলার হার হল।"
@@@@@@@