সেই দিনের অপেক্ষায়
সেই দিনের অপেক্ষায়
সকালে ঘুম থেকে উঠে মালবিকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে নেট খুলতেই একসাথে গাদা নোটিফিকেশন এবং ম্যাসেজ আসতে শুরু করল। মালবিকা একটা ম্যাসেজ ওপেন করে দেখলো বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে, হ্যাপি..... ওমেন্স......ডে..... । মালবিকা মনে মনে একটু হেসে বলল, আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমি ভুলেই গেছিলাম। শুরু হবে আজ রাস্তার ধারে ধারে কত মানুষের কত নাটক, বক্তৃতা দেবেন গুনিজনেরা, ভালো ভালো কথা বলা হবে লেখা হবে আমাদের লড়াই, স্যাক্রিফাইস নিয়ে, শুধুমাত্র এই একটা দিনের জন্য!!!! তারপর সেই একই!!!! কি..... দরকার এই একটা দিনের জন্য নাটক করে????
মোবাইলটা পাশে রেখে ঘুমন্ত মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে স্নেহের পরশ দিয়ে মালবিকা বিছানা ছাড়ল। তারপর শুরু হলো মালবিকার প্রত্যেকদিনের রুটিন। স্নান সেরে পূজো করে রান্নাঘরে ঢুকলো মালবিকা। রান্নাবান্না সেরে এক কাপ চা.... আর বিস্কুট হাত নিয়ে... বাইরের ঝুল বারান্দায় গিয়ে একটুখানি দাঁড়ালো। এই সময়টুকু একান্ত নিজের মালবিকার। মালবিকা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্য সবে সবে ঘুম থেকে উঠেছে তাই তার আলোর তেজ খুব মৃদু। এই সকালের মৃদু রোদ্দুর গায়ে মাখতে খুব ভালো লাগে মালবিকার। চারিদিকের পরিবেশটা শান্ত আর শীতল থাকে, কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে কেমন রুক্ষ হয়ে ওঠে। বেশ কিছুটা সময় নিজের মত কাটিয়ে মালবিকা ঘরে ঢুকলো মেয়েকে ঘুম থেকে ওঠাতে।
রোজ সকালে মিঠিকে আদর করে ঘুম থেকে ওঠাতে হয়। মালবিকা এক... এক সময় মিঠিকে দেখে খুব অবাক হয়!!!! এত অল্প বয়সে মিঠি সব বুঝতে পারে!! এমনকি.... অনেক সময় মায়ের মনের জোড় বাড়াতে সাহায্য করে। মিঠি যেন... অল্প বয়সেই সবকিছু বুঝতে শিখে গেছে!!!! আসলে ব্যাপারটা ঠিক তা.... নয়??? মাথার ওপর বাবার ছত্রছায়া নেই....!!!! তাই সমাজ মিঠিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে সব কিছু বুঝতে শিখিয়েছে। আসলে মায়ের পরিচয়ে পরিচিত মিঠি, ওর বাবার পরিচয় নেই তাই.... হয়তো সমাজ ওকে অন্য নজরে দেখে!!! সেটা এতদিনে ভালো মত বুঝে গেছে মিঠি!!! আচ্ছা যে.... বাবা মেয়ে হয়েছে বলে, নিজের রক্তকে অস্বীকার করে!!! তাহলে কেন..... সেই মেয়ে তার পরিচয়ে বড় হবে!!!! হবেনা!!!! কখনও হবেনা!!!! সে.... নিজের পরিচয় নিজেই তৈরী করবে!!!! যতই সমাজ জোড় করে পথ....... আটকানোর চেষ্টা করুক!!! সাহস নিয়ে নতুন করে নতুন পথের উন্মোচন করবে সে... নিজে।
মেয়েকে আদর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে মা... মেয়ে খাওয়া দাওয়া করে রেডি হয়ে এক সাথে বেড়লো স্কুলের উদ্দেশ্যে। আজ যদি মালবিকার এই..... স্কুলের চাকরিটা না.... থাকত তাহলে মালবিকা ছোট্ট মিঠিকে নিয়ে হয়তো ভেসে যেত!!!সমাজ তাদের সুস্থ ভাবে বাঁচতে দিত না....!! কোন অন্ধকার গলির, ঘুপচি ঘরে ঠাঁই হতো মালবিকার!!!! সমাজের নোংরা দিকটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে মালবিকা!!! এইসব কথা ভাবলে মালবিকার বুকটা ভয়ে কেঁপে ওঠে!!!
স্কুলে ঢোকার সাথে সাথে সবাই হ্যাপি.... ওমেন্স... ডে....বলে উইশ করতে লাগল। তবে মালবিকা মনে করে একটাদিন নয়!!!!প্রতিটাদিন ওমেন্স... ডে... হওয়া উচিত!!!কারন নারীরা প্রতিটাদিন প্রতি পদক্ষেপে কোথাও না.... কোথাও লড়াই করে চলেছে..... নিজের অস্তিত্বের সাথে সমাজের সাথে। স্কুলে গিয়ে জানতে পারল মালবিকা আজ ওমেন্স.... ডে... উপলক্ষ্যে একটা ছোট্ট করে অনুষ্ঠান হবে। শুরু হল অনুষ্ঠানের তোরজোড়।
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে স্কুলের সমস্ত বাচ্ছা এবং টিচার্সরা এসে উপস্থিত হল হলঘরে। বাচ্ছারা নিজেদের মত করে কেউ গান, কেউ নাচ আবার কেউ আবৃত্তি করল। সবম্ত টিচার্সদের কিছু বলতে বলা হল। সবাই যে.... যার নিজের মত করে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলল। মালবিকা কে..... অনুরোধ করা হল কিছু বলতে, কারন মালবিকা নিজের জীবনে অনেক ঝড়, ঝাপটা, অপমান, অবহেলা সহ্য করে গোটা সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছে!!!!!
----------------মলবিকা একটা কথাই বলল সবার উদ্দেশ্যে......................
আমি মনে করি একটা দিন নয়..... প্রতিটাদিন হোক নিজেদের কাছে ওমেন্স.... ডে!!!! একদিন কারোর মুখ থেকে হ্যাপি..... ওমেন্স.... ডে.... শোনার থেকে রোজ নিজের মনে.... মনে... নিজেকে বলো হ্যাপি..... ওমেন্স..... ডে। আমরা নারী আমরা সব পারি!!!! ছোট থেকে এটাই মেয়েদের শেখান। আমরা যেমন একটা ছোট্ট প্রানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারি তেমন মহিষাশুরমর্দ্দিনী হয়ে সমাজের বুকে বেড়ে ওঠা মানুষ রূপি অশুর দের নিশ্চিহ্নও করতে পারি। নারী..... বলে বিশেষ কোনো সুযোগ সুবিধা কারোর কাছ থেকে প্রত্যাশা করা বন্ধ করে সম্মান আশা করুন!!!! জোর গলায় বলুন আমরা সহানুভূতি চাইনা সমতা চাই!!!! আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চাই!!!! আমরা সাহসের সাথে নিরাপদে চলাফেরা করতে চাই!!!আমরা ভয়ে নয় প্রানখুলে বাঁচতে চাই!!!! আমরা অন্যের পরিচয়ে নয়...... নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই!!!! আর যেদিন আমরা সবাই এইগুলো অর্জন করতে পারবো..... তখন প্রত্যেকটাদিন হবে নারীদিবস এবং সেইদিন আনন্দ সহকারে সবাই সবাইকে উইশ করবো হ্যাপি..... ওমেন্স..... ডে.....।