STORYMIRROR

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Thriller

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Thriller

সেই বইটা

সেই বইটা

6 mins
289

সেই বইটা

শুভময় মণ্ডল


বইটা 'অনলাইন কেনাকাটায় ফ্রী'তে পেয়েছিল রীতা। প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকার দেশি এবং বিদেশি ভাষার গোটা বিশেক বইয়ের সাথে এই বইটা ফ্রী এসেছিল। সব থেকে মজার বিষয় ছিল - বুক-লিস্ট যা ছিল পার্সেলের ভিতরে, তা'তে কেবল সেই ক্রীত কুড়িটা বইয়ের কথাই এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত সিরিয়াল করে উল্লেখ করা ছিল। 


এই বইটা ছিল ম্যাজেণ্ডা কাগজে মোড়া, আর উপরে লেখা ছিল - মোট ক্রয়মূল্য একটি বিশেষ মানের অধিক হওয়ায় বইটি কোম্পানির তরফ থেকে তাকে উপহার দেওয়া হয়েছে! মোড়ক খুলে দেখে, ভিতরে রয়েছে একটা অনেক পুরানো কালো মলাটে বাঁধা জীর্ণ এক ইউরোপীয় হরর ফিকশন বুক, গোদাবাংলায় পাশ্চাত্যের পৌরাণিক ও লোককথার একটি পুরানো দিনের বই। তার পাতাগুলো অক্ষত থাকলেও বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। রীতা প্রথমে মনে করেছিল বুঝি কোম্পানির কোনো বিজ্ঞাপনের জন্য ফ্রী দিয়েছে বইটা। তা' নাহলে আজকালকার দিনে ফ্রীতে লোকে গালাগালও দেয়না, আর আস্ত বই দেওয়া তো অনেক বড় কথা! 


যাকগে, ক্রীত বইগুলোর মধ্যে তার পছন্দের বই বিশেষ ছিল না, বেশিরভাগই ওর বরের নিজের প্রয়োজনের এবং ক্লাসে পড়ানোর জন্য দরকার বলে আনানো হয়েছিল। কেবল ভাইঝিকে পড়তে দিয়ে হাতছাড়া হওয়ায় একটা গীতবিতান তার জন্য কেনা হয়েছিল। আর এখন উপরি পাওনা হিসেবে এই পাশ্চাত্যের হরর ফিকশন বইটা তারই হস্তগত হল। পাঠ্যবই আর সিলেবাসের বাইরে বই পড়ার সময় কোথায় তার কর্তার? তার উপর হরর ফিকশন নিয়ে তো কোন কথাই নেই।


এই ধরনের কাহিনী রীতার যে খুব ভালো লাগে এমন না, তবু বইটার প্রতি কেমন যেন আকর্ষণ বোধ করছিল সে প্রথম থেকেই। সেদিন রাতে বইটা হাতে নিয়েই বিছানায় উঠেছিল রীতা। রাতে পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। অনেক রাত্রে হঠাৎ বরের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার - কি করছো? এভাবে কেউ কামড়ায়? উফ রক্ত বেরিয়ে গেছে বোধ হয় আমার।


রীতা দেখে - ঘুমের ঘোরে সে তার বরের ঘাড়ে কামড়ে ধরেছিল কখন, আর তার দাঁতের চাপে সেখান থেকে চামড়া কেটে অল্প রক্তও বেরিয়ে এসেছে, কিছুটা লেগেছিল তার ঠোঁটেও। নিজের অজান্তেই রীতা জিভ দিয়ে চেঁটে নেয় তার ঠোঁট দুটো। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভুতি হয় তার - রক্তের স্বাদটা তো সত্যিই মন্দ নয়, ঠিক যেমনটা বলেছে বইটার কাহিনীতে, তেমনই!


পরের দিন শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় সমরের - কি ভীষণ ধরে গেছে ঘাড়টা, নাড়াতে পারছে না সে। তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা তার স্ত্রী রীতাকে ডাকে সে কিন্তু কোনো সাড়া পেল না! রীতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, তার দু'ঠোঁটে লেগে রক্ত! নিজের ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখে, তার সেই গতরাতের ক্ষতস্থান থেকেও বের হয়েছে রক্ত আর ক্ষতটাও যেন বেশ বড় হয়ে গেছে! খুব ভয় পেয়ে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে জাগায় সে রীতাকে - কি করছো বলো তো তুমি?


ঘুম চোখে বিছানায় উঠে বসে, রক্তে মাখা নিজের শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে অজান্তেই চেটে নেয় রীতা। ঘুমের ঘোরে কিছুক্ষণ আগে অবধি তার কাঁধ কামড়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তা' রীতা নিজেও জানে বলে মনে হয় না সমরের! অথচ তার ঠোঁটে লেগে থাকা রক্তের দাগ, আর কোনো অভিব্যক্তি ছাড়াই তার সেই রক্ত চেটে খাওয়াও দেখেছে সমর! বেশ ভীত এবং অবাক হয় সে, কিন্তু আপাতত তাকে কিছু না বলে, বাথরুমে গিয়ে গরম জলে ক্ষত জায়গাটা ভালো করে সাফ করে অ্যান্টিসেপ্টিক লাগায়।


ফিরে এসে রীতাকে বসে বসেই বেঘোরে ঘুমাতে দেখে আরও অবাক হলো সমর। সে'রাতে আর বিছানায় গেল না সে, সোফায় বসে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রীতার দিকে। এ কোন রীতা? যে ঘরে একটু আওয়াজ হলে কি সামান্য একটু আলো ঢুকলেও ঘুমাতে পারে না, সে'ই এমন করে এই আলোময় ঘরে বসে বসেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে? বাথরুমে গিয়ে সে যে এত শব্দ করলো, ঘরে তার চলাফেরার আওয়াজ - এতদসত্ত্বেও তার এভাবে ঘুমানো মোটেই ভালো লাগলো না দেখে সমরের।


পরের দিন ক্লাসের পর স্টাফরুমের পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ঘাড়ের ব্যথাটায় হাত বোলাতে বোলাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে আনমনে রাতের ঘটনার কথাটা ভাবছিল সমর। সত্যিই কি রীতার মধ্যে ঐ অদ্ভুত পরিবর্তন দেখেছে সে, নাকি স্বপ্ন? কিন্তু তা কি করে হবে, তার ঘাড়ের ব্যথাটা তো আর মিথ্যা নয়! তাহলে, সত্যিই রীতা অস্বাভাবিক আচরণ করছে, কিন্তু কেন? হঠাৎ এমনটা হবেই বা কেন?


সনাতনবাবু সংস্কৃতের পণ্ডিত, অলৌকিক এবং অতিলৌকিক বিষয়ে তিনি চর্চাও করেন এবং এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞানও নাকি খুব গভীর। কিন্তু সমর তাঁর কাছে এই বিষয়ে কিভাবে যে বলবে কথাটা সেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না। তার সমস্যার সমাধান অবশ্য করে দিলেন সনাতনবাবু নিজেই - তাকে ঐরকম উদাসীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে এগিয়ে এসে। 


তিনি তাকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই, রীতার আচরণগত অদ্ভুত পরিবর্তনের কথা সব খুলে বলে তাঁকে সমর। তার ঘাড়ের ক্ষতটাও তাঁকে দেখায় সে। সনাতনবাবু কোনো অতিলৌকিক জিনিস সাম্প্রতিক বাড়িতে আনা হয়েছে কিনা বা এসব চর্চা করেন এমন কেউ বাড়িতে এসেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে, সমর স্বভাবতই তাঁকে না-ই বলে। সনাতনবাবু তাকে বাড়িতে গিয়ে রীতাকে একবার জিজ্ঞাসা করতে বললেন। 


সমর বাড়িতে এসে রীতাকে জিজ্ঞাসা করে সে নতুন কিছু কেনাকাটা করেছে কিনা। বইগুলোর অর্ডার সমর নিজেই দিয়েছিল, তাই রীতাও তাকে যথারীতি না বলে দেয়। এখন ফ্রীতে যে আরও একটা বই এসেছে, স্বভাবতই সেটা থেকে যায় অপ্রকাশিত। সেদিন রাতে চিন্তায় ঘুমই এলো না সমরের, উল্টে তার মাথাব্যথা শুরু হলো। সনাতনবাবুর কথাটা তো আর ফেলনা নয়, তিনি বলেছেন যখন তখন কিছু না কিছু অস্বাভাবিক তো বাড়িতে এসেছে অবশ্যই, কিন্তু কি সেটাই জানতে পারছিল না সে।


সে'রাতে শরীরটা ভালো লাগছে না বলে বিছানায় রীতার পাশে না শুয়ে সোফায় বসে রইলো সমর। রীতা ডাকলেও মাথাব্যথার কারণ দেখিয়ে বসে থাকে সে। রীতাও সেদিন রাতে শোবার সময় আর বইটা পড়তে বসলো না, আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে রইলো সমর। সেখানেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে খেয়াল নেই, তবে ঘুমের মধ্যেই উপলব্ধি করতে পারে যে রীতা এসে তার পাশে বসে মাথাটা টিপে দিচ্ছে তার।


সেদিন ভোরেও সমরের ঘুম ভাঙলো সেই ঘাড়ে ব্যথার জন্যই। তার মাথা টিপে দিতে দিতে সোফাতেই কখন রীতাও ঘুমিয়ে পড়েছিল তার কাঁধে মাথা রেখে। আর যথারীতি ভোরে রীতার দাঁতের কামড়ে সমরের ঘাড় বেয়ে নেমে রক্তের ধারা ঢুকছিল তার মুখে। তারই ব্যথায় জেগে উঠলেও সে এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখন যে রীতাকে সরিয়ে দিতেও পারছিল না। এদিকে ঘুমের মধ্যেই রীতা যেন তার ঘাড় কামড়ে শুঁষে নিচ্ছে শরীরের সব রক্ত! প্রাণপণে চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত ধাক্কা দিয়েই সোফা থেকে ফেলে দেয় সে রীতাকে।


অনেক কষ্টে ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখে তখনও রক্তের ধারা বইছে সেখান থেকে। রীতার মুখ ও দু'ঠোঁট রক্তে মাখামাখি কিন্তু সোফা থেকে পড়ে গিয়েও তার ঘুম ভাঙেনি! শুধু যেন, মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ায় এক পাশবিক ক্রোধের ক্ষীণ অভিব্যক্তি ঘুমের মধ্যেই তার মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। 


রক্তাক্ত মুখের এই রীতা সত্যিই ভীষণ অচেনা ও ভয়ঙ্কর ঠেকলো আজ সমরের কাছে। ভয় আর জড়তা গ্রাস করতে থাকে তাকে। সে তার সংজ্ঞা পুরোপুরি খোয়ানোর আগে কোনমতে পাশে থাকা মোবাইলটা নিয়ে সনাতনবাবুকে কল করে। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করলেন যখন সমর ততক্ষণে চেতনা খুইয়েছে। তার চেতনা যখন ফিরল তখন সে হাসপাতালে, রীতিমতো রক্ত দিতে হয়েছে তাকে! রীতাকেও ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল বাড়িতে।


সনাতনবাবু ফোনে তার কোনো সাড়া না পেয়ে আর দেরি করেননি, যত দ্রুত সম্ভব এসে হাজির হন তার বাড়িতে। অচেতন সমরকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করান। রক্ত মাখা মুখে রীতাকে পড়ে থাকতে দেখে, তাকে ভালো ভাবে সাফ সুতরো করে বিছানায় শুইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে রাখার ব্যবস্থাও করেন। ঐ ঘরেরই বেড সাইড টেবিল থেকে সহজেই সেই বইটাকেও উদ্ধার করেন তিনি। সমরের গৃহপরিচারিকা অঞ্জলীকে বইটা পুড়িয়ে ফেলতে দিয়ে বলেন - যত নষ্টের গোড়া এই বইটা, এটাকে আজই পুড়িয়ে ফেলো।


পরের দিনটা ছিল বড় অদ্ভুত ও ঘটনাবহুল - সমর সুস্থ হয়ে উঠে বাড়ি ফিরলো, রীতা যেন এক দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠলো ঘুম থেকে! সনাতনবাবুর কথা মেনে, সমর রীতাকে তার সেই অস্বাভাবিক আচরণের কথা মনে করায়নি আর। অঞ্জলী কাজে আসেনি সেদিন, সকালে হঠাৎ তার স্বামী মারা যাওয়ায়। তার অ্যানিমিয়া জাতীয় সমস্যা কখনও না থাকলেও, ডাক্তার পরীক্ষা করে রক্তাল্পতাজনিত কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন! 


শবদাহ করতে সবাই শ্মশানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলে, অঞ্জলী খাটের নিচে থেকে সেই বইটা বের করে দেওয়ালে বইয়ের তাকে সাজিয়ে রাখে যত্ন করে।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama