Ananya Podder

Romance Tragedy Classics

4.6  

Ananya Podder

Romance Tragedy Classics

সে যে মানে না মানা

সে যে মানে না মানা

7 mins
613


ভিড় বাসটাতে উঠেই বেশ বেসামাল হয়ে পড়লো স্নিগ্ধা | সাথে ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়ে সৃজনী | স্কুল শেষে একটা টিউশন নিয়ে তবে বাড়ি ফেরা | এই সময় যে দুদিন মেয়ের টিউশন থাকে, সেই দুদিন মেয়েকে নিতে স্নিগ্ধাই আসে | স্কুলের পরে মেয়ে বাড়িতে না থাকলে মনটা কেমন যেন করে ওর | তাই শাশুড়িই বলেন, "যাও স্নিগ্ধা, দিদিভাইকে স্কুল থেকে তুমিই নিয়ে আসো |"


আজ প্রায় দুবছর হয়ে গেছে অনির্বান তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে | ছেলে চলে যাবার পরে ছেলে বৌকে আর বাবার বাড়িতে ফিরতে দেননি অনির্বানের বাবা উজ্জ্বলবাবু ও তাঁর স্ত্রী শিখা | তাদের স্বামী স্ত্রী দুজনেরই স্নিগ্ধার কাছে বক্তব্য ছিল, "তোমার বাবা মা যখন আর বেঁচে নেই, তখন দাদাদের সংসারে গিয়ে উঠবে কেন তুমি ?? এই সংসারটা এখনও তো তোমারই আছে | দিদিভাইয়ের সাথে জীবনের শেষ কটা দিন আমাদের থাকতে দাও স্নিগ্ধা | "


তারপরে আর দাদাদের কাছে ফেরত যাওয়া হয়নি স্নিগ্ধার | দাদারা বোনকে না নিয়ে খালি হাতেই ফিরে গিয়েছিলো | দুই বুড়ো বুড়ি আর এগারো বছরের সন্তানকে নিয়ে এখন জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধা |


এই সময় বাসে বেশ ভিড় হয়, তাই মেয়ের স্কুলব্যাগটা নিজের কাঁধেই বয় স্নিগ্ধা | মেয়ে সৃজনী বারণ করে, বলে, "মা আমাকে দাও, আমি বইছি | "


কিন্তু স্নিগ্ধা দেয় না | বলে, অন্য দিন তো তোকেই বইতে হয় | তাই এই দুদিন আমাকে বইতে দে | "


কিন্তু আজ ভীষণ ঘাড়ে ব্যথা স্নিগ্ধার | স্পন্ডেলাইসিসটা আবার যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে | তাই সৃজনী আজ আর তার স্কুলব্যাগটা মায়ের কাঁধে না চাপিয়ে নিজেই বয়ে বেড়াচ্ছে | গড়িয়া মিনিটা সামনে পেতেই উঠে পড়ে মা মেয়ে, কিন্তু বাসটা বেশ ভিড় | স্নিগ্ধা মেয়েকে বলে, " ভিতরে ঢোকার চেষ্টা কর, নামবো তো সবার শেষেই | "


সৃজনী একটু একটু করে ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে যায় বাসের ভিতরের দিকে | স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে থাকে গেটের সামনেই, তবে নজরটা রাখে মেয়ের উপরে | হঠাৎ দেখে স্নিগ্ধা, সৃজনী কারোর সাথে কথা বলছে | তারপরে লক্ষ্য করে, মেয়ে সিট পেয়ে বসে গেলো | সৃজনী সিট্ পেয়েই ডাকাডাকি শুরু করলো মাকে, "মা, এদিকে এসো না, এই আঙ্কেল - আন্টি যাদবপুরে নামবেন | "


স্নিগ্ধা বুঝলো, যে ভদ্রলোক স্নিগ্ধাকে নিজের সিটটা ছেড়ে দিলেন, তিনি সস্ত্রীক বাসে ট্রাভেল করছেন | তাঁদের গন্তব্য যাদবপুর | কিন্তু বালিগঞ্জেই ভদ্রলোক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন সৃজনীর বসার জন্য | আজকের দিনে যখন সবাই সিট পেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে বসার জন্য, সেখানে নিজের সিটটা যে ভদ্রলোক ছেড়ে দেন একটি বাচ্চা মেয়ের জন্য, তাকে ধন্যবাদ না জানালেই নয় | কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারা দেখা যাচ্ছে না | ভিড়ের মাঝেই ঢাকা পড়ে আছে | যদিও বা দেখা যেত ভিড় টপকিয়ে, তবুও দেখা যাচ্ছে না ভদ্রলোক বাম হাত দিয়ে হ্যান্ডেলটা ধরে রাখায় | উনার হাতের জন্য উনার চেহারা ঢাকা পড়ে গেছে |


এদিকে সৃজনী চিৎকার করেই যাচ্ছে, " মা, এদিকে এসো না | "


ভিড় কাটিয়ে কোনোরকমে মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে স্নিগ্ধা বলল, "আপনাকে আন্তরিক ধন্য..... | ধন্যবাদের "বাদ" শব্দটুকু বাদই থেকে গেলো, মুখ থেকে আর বেরোলো না | এ যে অর্ঘ্য !! আজ কত বছর বাদে আবার মুখোমুখি তারা দুজনে !!


অর্ঘ্য মুখ ঘুরিয়ে ছোট্ট হাসি দিলো, মুখে কিছু বলল না | সিটে বসে তখন অর্ঘ্যর স্ত্রী আর স্নিগ্ধার মেয়ে সৃজনী | দুজনে বসে বসে নানারকমের গল্প জুড়েছে |


স্নিগ্ধা মুখ ঘুরিয়ে বাসের জানলা দিয়ে দৃষ্টিটাকে বাইরে করে দিলো | আজ থেকে কত বছর আগের কথা | একই জায়গায় ইংলিশ পড়তে যেত স্নিগ্ধা আর অর্ঘ্য | অর্ঘ্যর বাবা অটো চালাতেন, আর স্নিগ্ধার বাবা ছিলেন থানার বড়োবাবু মানে ওসি |


শান্ত স্বভাবের অর্ঘ্য খুব ভালো গান গাইতো | কিন্তু লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো ছিল না | তবে খেলাধুলা আর মার্শাল আর্টসে দুর্দান্ত ছিল | সেই অর্ঘ্যর সাথে অসম প্রেম হোলো স্নিগ্ধার, যা মেনে নিলেন না স্নিগ্ধার বাবা | লুকিয়ে চুরিয়েও ধরা পড়ে গেলো বাবার সামনে | একজন অটো ড্রাইভারের ছেলে তার জামাই হবে, এটা স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেননি স্নিগ্ধার বাবা | তবুও লড়াইটা চালিয়ে ছিল স্নিগ্ধা | বাবার চোখের উপরে চোখ রেখে বলেছিলো, " অর্ঘ্যর বাবা অটো চালান তো, কী হয়েছে, অর্ঘ্য তো আর অটো চালায় না | অর্ঘ্য যদি লেখাপড়া শিখে নিজের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তাহলেই ওকে বিয়ে করবো আমি | অতএব, এই সময়টুকুতে তুমি কিচ্ছু বলতে পারবে না | "


স্নিগ্ধার বাবা শর্ত দিলেন, " যেদিন অর্ঘ্য, তোমার চেয়ে এক কদম পিছিয়ে যাবে, সেদিনই তোমাদের এই প্রেমের ইতি ঘটাবো আমি, এটা তুমি জেনে নিও স্নিগ্ধা | "


তাই অর্ঘ্যকে বলেছিল স্নিগ্ধা, "আর যাই হোক, লেখাপড়াটা মন দিয়ে কোরো | একমাত্র লেখাপড়াই আমাদের সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে | "


কিন্তু অর্ঘ্য শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না ওদের প্রেমের সম্পর্কটাকে | উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টের রেজাল্ট বেরোবার আগেই অর্ঘ্যর বাবার ব্লাড রিপোর্ট ও আরও বেশ কয়েকটি টেস্টের রেজাল্ট বলে দিলো, অর্ঘ্যর বাবার শরীরে ক্যান্সার আছে | বাবার ট্রিটমেন্টের জন্য লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে অটোর চালক হয়ে গেলো অর্ঘ্য | ফলস্বরূপ, উচ্চমাধ্যমিকে দুটো বিষয়ে ব্যাক এল অর্ঘ্যর |


নিয়তি স্নিগ্ধার বাবার হাত ধরেছিলেন, তাই হেরে গেলো স্নিগ্ধা | যেখানে স্নিগ্ধা ফার্স্ট ডিভিশনে দুর্দান্ত মার্কস নিয়ে পাশ করলো, সেখানে অর্ঘ্য দুটো বিষয়ে ব্যাক |


স্নিগ্ধার বাবা মেয়েকে বললেন, "এর পরেও কী তুমি বলতে চাও, অর্ঘ্যকে মেনে নিতে ?? "


স্নিগ্ধা তবুও লড়াইটা থামায়নি | সাহস করে বলেছিল, "জীবনে লেখাপড়াটাই কী মানুষের পরিচয় হতে পারে বাবা ?? এই যে অর্ঘ্য, নিজের ক্যরিয়ারের কথা না ভেবে বাবার কেমোর জন্য রোজগার করে যাচ্ছে, সেটা কী ওর মানুষ হওয়ার পরিচয় নয় ?? "


স্নিগ্ধার বাবা স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন, "তুমি তোমার শর্তে হেরে গেছো স্নিগ্ধা | এর পরেও যদি অর্ঘ্যর সাথে সম্পর্ক রেখে দাও তুমি, তাহলে একদিন অর্ঘ্যকে হয় জেলে, না হয় শ্মশানে দেখতে পাবে তুমি | সুস্থ জীবন তো আমি ওর থাকতে দেবো না | আর এটা আমার হুমকি ভেবো না, এটা আমার সিদ্ধান্ত | যদি অর্ঘ্যর জীবন চাও, তবে অর্ঘ্যর জীবন থেকে সরে আসো | তোমাকে আমি দুদিন সময় দিলাম, এই দুদিনেই অর্ঘ্যকে তোমার মতামত জানিয়ে দেবে তুমি | "


স্নিগ্ধা জানতো, তার দারোগা বাবা অর্ঘ্যর সাথে যা খুশি করতে পারেন!! এই পরিস্থিতিতে অর্ঘ্যর বাবার পাশে অর্ঘ্যর থাকাটা খুব জরুরী | ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বেঁচে থাকলেও বাবা মায়ের জন্য বেঁচে তো থাকবে অর্ঘ্য | কিন্তু তার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে তো মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর মুখোমুখি হবেন ওর বাবা |


তাই পরেরদিন অর্ঘ্যকে ডেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, " তোমার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে পারবো না অর্ঘ্য | তোমার জন্য আমার বাবার কাছে ছোট হয়ে গেছি আমি | কী জবাব দেবো সমাজের কাছে , আমি যে ছেলেকে ভালোবাসি, সে একটা অটো ড্রাইভার !! তোমার মনে হয়না, এটা আমার ও আমার পরিবারের জন্য বড়ো লজ্জার !! তাই আমার মনে হয়, এখানেই আমাদের সম্পর্কের ইতি টানা ভালো |"


সেদিন অর্ঘ্য স্নিগ্ধার কথায় একটাও উত্তর দিয়েছিলো না | চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল | শুধু যখন স্নিগ্ধা ফিরে চলে আসছিলো, তখন অর্ঘ্য বলেছিল, "এর চেয়ে ঢের ভালো হতো, তুমি যদি আমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে | "


স্নিগ্ধা চুপচাপ চলে আসে সেখান থেকে | চোখের জলকে বুকে চেপে রেখেছিলো সে, চোখে আসতে দেয়নি, পাছে অর্ঘ্য তার অভিনয়টাকে ধরে ফেলে !!


সেই শেষ দেখা অর্ঘ্যর সাথে | এরপরে মাসির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে স্নিগ্ধা | লেডি ব্রাবনে ইংলিশ অনার্স নিয়ে পাশ করে তারপরে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ | তারপরে দুটো বছরের মধ্যেই হাই স্কুলের দিদিমনির চাকরি |


বাড়ি ছাড়ার পরে সব বন্ধু বান্ধবদের সাথেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল স্নিগ্ধা | তাই, অর্ঘ্যর খোঁজ আর সে পায়নি | এমনকি নিতেও চায়নি কোনোদিন খোঁজ | খোঁজ নিলেই যদি আবার দুর্বল মুহূর্তে একে অপরের কাছে চলে আসে ওরা !!


তবুও মন মানেনি | বারবার প্রতিটা ক্ষনে মনে পড়েছে অর্ঘ্যর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো | মনকে যতই বোঝাতে চেয়েছে, মন ততই ছুটে গেছে অর্ঘ্যর দিকে | তাকে মানা করলেও সে মানা মানে না কোনো |


তবুও সেই মনকে নিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসলো স্নিগ্ধা, স্বামী রূপে জীবনে এল অনির্বান | পেশায় ডাক্তার অনির্বান স্নিগ্ধার বাবার পছন্দের ছিল | মান অর্থ সব কিছুই উপচে পড়ছে জীবনে | স্নিগ্ধা খুব সুখে থাকবে তার বিবাহিত জীবনে, এই বিশ্বাসে মেয়েকে পাত্রস্থ করেন স্নিগ্ধার বাবা |


ফুলসজ্জার রাতেও যখন অনির্বান ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিলো স্নিগ্ধার শরীরে, তখনও স্নিগ্ধার চোখের সামনে ফুটে উঠছিলো অর্ঘ্যর মুখটা | কী এমন ক্ষতি হতো, যদি মুহূর্তটা অর্ঘ্যর সাথে কাটতো তার!!


তারপরে স্নিগ্ধার জীবনে সৃজনী এলো | স্বামীর সাথেও সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছে স্নিগ্ধা | কোনোদিন স্বামীকে বুঝতে দেয়নি, তার মনে অন্য কোনো পুরুষ আজও নীরবে বাস করে চলেছে | আর শুধু অনির্বান কেন, স্নিগ্ধা নিজে ছাড়া পৃথিবীর আর কেউই তো জানতে পারলো না, মনে মনে সে অর্ঘ্যকে কতটা ভালোবাসে |


মাঝখানে কেটে গেছে অনেক গুলো বছর | একবার বাসে এক বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় জানতে পেরেছিলো, অর্ঘ্যর বিয়ে হয়ে গেছে, সে এখন বিএসএফ এ কর্মরত | ব্যস ওইটুকুই যা জেনেছিলো স্নিগ্ধা | নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করেনি আর | কী দরকার, মিথ্যে আগ্রহ বাড়িয়ে !!


তারপরে অনির্বানের নিঃশব্দে চলে যাওয়া | লাস্ট স্টেজে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল অনির্বানের | জলের তোড়ে টাকা উড়িয়েও বাঁচানো যায়নি অনির্বানকে | অনির্বান চলে যাওয়ার পরে এখন শুধু একাই পথ চলা স্নিগ্ধার, তার চলার পথে এখন তার এক মাত্র সঙ্গী তার মেয়ে সৃজনী |


কিন্তু আজও মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে পড়ে শেষ দেখা অর্ঘ্যর সেই মুখটা | কী অন্যায় সে করেছিল, যার জন্য এতো বড়ো শাস্তি তাকে দিয়েছিলো স্নিগ্ধা ?? এ ভগবানের মার !! তাই তো অর্ঘ্যর ক্যান্সার আক্রান্ত বাবার সেবা করার অপরাধে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই ভগবানও অনির্বানকে কেড়ে নিলো, সেই একই ক্যান্সারে | একেই বলে নিয়তির অভিশাপ |


হঠাৎ অর্ঘ্যর স্ত্রী ডাকতে থাকেন স্নিগ্ধাকে, "দিদি, আপনি বসুন আমার জায়গায় | আমি এবার নামবো |


স্নিগ্ধা লক্ষ্য করে কন্ডাকটর চেঁচাচ্ছে, "যাদবপুর আসছে, গেটের কাছে এগিয়ে আসবেন | "

অর্ঘ্য আর ওর স্ত্রী দুজনেই এগিয়ে যায় গেটের কাছে | নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে স্নিগ্ধাকে জায়গা করে দেয় অর্ঘ্যর স্ত্রী | কিন্তু সত্যিই কী এতো সহজ, নিজের জায়গা ছেড়ে চলে আসা !! মন যে মানে না মানা | তাই তো আজও এই মুহূর্তেও অর্ঘ্য স্নিগ্ধার মনটাকে সঙ্গে করেই নেমে যাচ্ছে বাস থেকে | সৃজনীর পাশের সিটে বসে আসছে শুধু সৃজনীর মায়ের শরীরটা |



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance