STORYMIRROR

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Others

সবুজ-সাথী

সবুজ-সাথী

6 mins
209


নিকষ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকারে পরিপূর্ণ একটা ছোট্ট ঘর, বন্ধ কাঠের জানলার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ঝাপসা নিয়ন আলো কিছুটা আসার চেষ্টা করছে, কিন্তু অন্ধকারের মোটা চাদরকে ভেদ করতে পারছেনা....!!!! ঘরের চারিদিকে নিঃস্তব্ধ পরিবেশে বিরাজ করছে, শুধু থেকে থেকে একটা ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। ঘরের একদম মাঝ খানে চেয়ারে নববধূর সাজে সজ্জিত একটা মেয়ে বাঁধা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে ঘার এলিয়ে পড়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর ঠিক তার পায়ের কাছে বসে আছে একটা ছেলে, মেয়েটির দু... হাতের মাঝে মুখটাকে ঢেকে রেখেছে, আর কিছু সময় অন্তর অন্তর মুখ তুলে দেখছে সামনে বসে থাকা অপরূপ সাজে সজ্জিত মেয়েটিকে।


-----------হঠাৎ করে চেয়ারটা যেন একটু নড়ে উঠল।ছেলেটি সাথে সাথে উত্তেজিত হয়ে মেয়েটির হাতটা ধরে... জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কিরে..... তুই ঠিক আছিস তো....??? কষ্ট হচ্ছে....??? কিরে কিছু বল.....???


মেয়েটি আবার একটু নড়ে উঠল, চোখটা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু খুলতে পারছেনা!!!!চোখের পাতা দুটো যেন ভীষন ভারি হয়ে আছে, কথা গুলো যেন মনে হচ্ছে কেউ দূর থেকে বলছে, তাই অস্পষ্ট শোনাচ্ছে!!! তার সাথে হাত দুটো বাঁধা মনে হচ্ছে, আস্তে আস্তে চোখের পাতাটা তুলতে লাগল, সামনে সমস্ত কিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার কোথাও ঝলমলে আলো, সানাই এর সুর নেই, তবুও ভয় করছেনা!!!! কেমন যেন একটা চেনা মানুষের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে মেয়েটি!!!


ছেলেটি এইবার উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির একদম কাছে এসে গালে হাত দিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কিরে... তুই ঠিক আছিস তো....??? কষ্ট হচ্ছে.....??? কিরে কিছু বল.....???? 


মেয়েটির চোখের সামনে এইবার ফুটে উঠতে লাগল কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা। নব বধুর সাজে বসেছিল ঘরে, হঠাৎ করে বর এসেছে শুনে সবাই দল বেঁধে চলে গেল বর দেখতে। আর ও মনের মধ‍্যে একরাশ কষ্ট এবং পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের একফালি চাঁদটাকে দেখছিল, ঠিক সেই সময় ঘরের আলো নিভে গিয়ে পুরো অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক, এবং পিছন থেকে কেউ একটা কিছু চেপে ধরেছিল ওর নাকের কাছে!!!! তারপর সবকিছু চোখের সামনে ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে গেল, আর তো..... কিছুই মনে পড়ছেনা!!!


মেয়েটিকে সাড়া দিতে না দেখে ছেলেটি একটু ভয় পেয়ে গেল এবং সাথে সাথে ঘরের বন্ধ জানলাটা খুলে দিল, এবং আলোর পাশাপাশি এক রাশ মিষ্টি বাতাস ঘরে ঢুকলো। চোখের ওপর আলো পড়ায় মেয়েটি চোখটা বন্ধ করে নিল এবং পরক্ষনেই আবার তাকালো এবং চারিদিক ভালো করে চেয়ে দেখল, না এটাতো ওর ঘর নয়!!! এই সব ভাবতে ভাবতে সামনের মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে বলে উঠল সবুজ... তুই.!!!


ছেলেটি মেয়েটির মুখের সামনে এক গ্লাস জল ধরে বলল হ‍্যাঁ..... আমি তোর সবুজ!!! নে..... জলটা আগে খেয়েনে.... তারপর প্রশ্ন করিস।


মেয়েটি চুপচাপ জলটা খেয়ে নিল এক নিঃশ্বাসে, তারপর বলে উঠল তুই..... আমাকে তুলে নিয়ে এসেছিস বিয়ের আসর থেকে??????


সবুজ কান্নাভেজা কন্ঠে বলে উঠল, এছাড়া আর কিই.... বা... করার ছিল আমার???? তুইতো কোন রাস্তই খোলা রাখিস নি... সাথী!!! আর আমি অন‍্য কারোর সাথে তোকে বিয়ে করতে দেব না....!!! কারন তুই শুধু আমার, আর তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবনা।


সাথী অভিমানে ভরা রাগি কন্ঠে বলে উঠল...., আমার বাঁধন এখুনি খুলে দে....., আমি বাড়ি যাবো!!! আর আজ যা..... কিছু হচ্ছে এর জন‍্য তুই দায়ি!!!!তবে তোর.... জন‍্য আমি আমার পরিবারের অসম্মান হতে দিতে পারিনা!!!! তুই আমাকে তুলে নিয়ে চলে এলি.... একবারও ভাবলিনা বাড়ির পরিস্থিতি কি..... রকম হবে!!!


সবুজ ধপ করে সাথীর পায়ের কাছে বসে পড়ল, এবং নিজের মাথাটা সাথীর কোলের মধ‍্যে রেখে বলল, মানছি আমি একটু,বেপরোয়া, অবুঝ, অগোছালো, রাগি, বদমেজাজি, আজ যা..... কিছু হচ্ছে আমাদের লাইফে সব আমার জন‍্য!!!! কিন্তু সত‍্যি করে বলছি আমি তোকে ছাড়া কিছু বুঝিনা সাথী!!! তুই আমার সাথে না..... থাকলে আমার কোনো অস্তিত্ব থাকবেনা, তুই এই অগোছালো ছেলেটার দায়িত্ব নিয়ে জীবনটা গুছিয়ে দেনা!!!!


এই কথা গুলো শুনে এবং সবুজের কান্না দেখে সাথীর রাগ কোথায় যেন উবে গেল।এবং দুই নয়ন বেয়ে প্রবল বর্ষন শুরু হলো, সাথী কান্নায় বুজে আসা গলায় বলে উঠল, নিতেই তো.... চেয়ে ছিলাম দায়িত্ব!!!! কিন্তু তুই তো..... দিলিনা নিতে....!!


সবুজ, সাথীর কোল থেকে মাথাটা তুলে সাথীর হাতের বাঁধন খুলে দিল এবং নিজের হাতে করে আলতো ভাবে চোখের জলটা মুছে দিয়ে বলল, তুই.... জানিস তো.... আমি কি রকম!!!! এই নিয়ে বহুবার আমি তোর হাত ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু তুই ছাড়িসনি!!!! তাহলে এবার কেন.... ছেড়ে দিলি???? আর আমি রাগের মাথায় বললাম যে.... তোকে কেউ কোনদিন বিয়ে করার জন‍্য পচ্ছন্দ করবে না...!!! আর তুই সেটা প্রমান করবি বলে.... বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলি, একবার ভাবলিনা আমাদের স্বপ্নের খেলাঘরের কথা!! আমার কথা!!! 


সাথী বলে উঠল, কেন এখন এইরকম করছিস??? সেইদিন তুইতো বললি আমার নাকি কোনো যোগ‍্যতা নেই সবুজ চ‍্যাটার্জ্জীর অর্ধাঙ্গীনি হওয়ার!!! আর আমার থেকে কত ভালো ভালো মেয়ে তোকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পাওয়ার জন‍্য বসে আছে, তাহলে আজ তাদের কাছে না.... গিয়ে আমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে আনলি কেন......?????


সবুজ বলে উঠল, এই ভাবে বলিসনা প্লীজ...... আমি মানছি সব দোষ আমার, রাগের মাথায় আমি কি.... বলি তার কোনো হিসাব থাকেনা, তুইতো সে..... কথা ভালো করে জানিস সাথী। এইবারের মত ক্ষমা করেদে..... এই রকম ভুল আর কোনদিনও হবে না..... আমি কথা দিচ্ছি।


সাথী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, প্রত‍্যেকবার তুই একই কথা বলিস, তবে এখন আর কিছুই করার নেই!!!! আমি আসি....... আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে।


সবুজ, সাথীর হাতটা ধরে বলল, আমি জানি তুই....... আমাকে ছাড়া অন‍্য কারোর সাথে ভালো থাকতে পারবিনা!!!! তাহলে কেন জেদ করছিস???? প্লিজ...... একটু বোঝার চেষ্টা কর, তুই সাথ দে..... আমি সব পরস্থিতি ঠিক করে দেব, সবাই কে.... বুঝিয়ে বলব, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।


সাথী বলল ওটা তোর ভুল ধারনা!!!! আমি ভালো থাকব তোকে ছাড়া, শুধু ভালো না.... খুব খুব ভালো থাকব!!! এখন আমাকে ছাড়।


সবুজ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জলটা মুছে নিয়ে সাথীর মুখোমুখি দাঁড়াল, এবং দুচোখ ভরে দেখতে লাগল তার সাথীকে। সবুজ সাথীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক আছে তুই..... যদি ভালো থাকিস তাহলে আমিও ভালো থাকব!!!! তুই ভালো থাক, সুখে থাক, এটা আমি সব সময় চাই , সথীর কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে সবুজ বলল, যা.... চলে যা.... আর আটকাবোনা তোকে।


ধীরে ধীরে বন্ধন আলগা করে দিল সবুজ, সাথী এক পা.... এক পা..... করে এগিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।


সবুজ করুন সুরে ডেকে উঠল সাথী


এই ডাককে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় সাথীর!!!! তাই সাথী আর এগিয়ে যেতে পারলনা, পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার কাছে।


সবুজ ছুটে এসে সাথীকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোকে খুব ভালোবাসি সাথী, তোকে ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার, আলো হয়ে আসবি আমার জীবনে!!! এই লগ্নে বিয়ে করবি আমাকে??? হবি আমার অর্ধাঙ্গীনি????


সাথী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা, কাঁদতে কাঁদতে ধপ করে বসে পড়ল এবং কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগল, তুই.... খুব খারাপ সবুজ!!! খুব..... খারাপ!!!! সবসময় তুই..... এই রকম করিস আমার সাথে, আর আমি চলে যেতে গিয়েও যেতে পারিনা!!!! কারন আমিও যে.... তোকে ভীষন ভালোবাসি। 


সবুজ, সাথীকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল, ভুল হয়ে গেছে, আর এই রকম ভুল হবেনা!!!! প্লীজ কাঁদিসনা, চল..... তাড়াতাড়ি,এই লগ্নেই বিয়ে করব আমি তোকে, যাতে দ্বিতীয় বার এই রকম ভুল আর না..... হয়!!!


সাথী বলল,বাড়ির সবাই যদি না.... মানে!!!! তোকে যদি আমার থেকে আলাদা করে দেয়.......!!!


সবুজ বলল চিন্তা করিসনা আমি ঠিক মানিয়ে নেব, আর তোকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা!!!! আমরা একে অপরের পরিপূরক।


কিছুক্ষনের মধ‍্যে সাথী, সবুজের হাত ধরে বাড়ি ঢুকলো, সাথীকে আসতে দেখে সবাই দৌড়ে গেল, তারপর অনেক প্রশ্নের বান, রাগ, আরও অনেক ঝড়, ঝাপটা পেরিয়ে, সবাই কে..... রাজি করিয়ে শুরু হল সবুজ-সাথীর বিয়ের অনুষ্ঠান। সমস্ত নিয়ম কানুন এবং বৈদিক মন্ত্রের...... উচ্চারণের মধ‍্যেদিয়ে সবুজের নামের সিঁদুরে রঙিন হয়ে উঠল সাথীর সিঁথি, শুরু হলো নতুন জীবন, এক সাথে, একে অপরের পাশে থেকে পথ চলা। আর অন‍্যদিকে ওদের সাথে সাথে প্রকৃতিও রাতের অন্ধকারকে কাটিয়ে চাঁদকে বিদায় জানিয়ে, সূর্যের আলোয় নিজেকে আলোকিত করে নতুন দিনের নতুন একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর সকাল সাজিয়ে তুলল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance