স্বপ্নবার্তা
স্বপ্নবার্তা


১
ঘটনা – ১
রাত তখন ফুরিয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ভোরের আলো ফুটবে। সুজাতা তার ছ’বছরের ছেলে ধীমানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। চাঁদের ম্লান আলো জানালার মধ্যে দিয়ে এসে তাদের গায়ের ওপর পড়ছে। যদিও সুজাতা ভেবেছিলো আজকে রাতে জেগে থাকবে, কিন্তু পারেনি। ঠিক কখন যেন ঘুমটা খুব গাঢ় হয়ে তার দুচোখে লেগে এসেছিলো, টের পায়নি। হঠাৎ একটা গোঙানির শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেলো। জেগেই সে অনুভব করলো খাটটা যেন কেউ নাড়াচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে তার পাশে শোয়া ধীমানের সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপুনির সাথে সাথে অস্পষ্ট একটা গোঙানি। ছেলের এই সমস্যাটার সাথে সুজাতা পরিচিত আছে। ‘কি হয়েছে, বাবা, কি হয়েছে?’ বলতে বলতে প্রাণপণে সে তার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে চেষ্টা করলো। আর ঠিক সেই সময়েই অস্পষ্ট গোঙানিটা স্পষ্ট হয়ে উচ্চারণ করে উঠলো, ‘রানা, রানা ঘোষ।’
ঘটনা – ২
পরেরদিন সকালে মলিনাদি বাসন মাজতে এসে এক খবর শোনালো। ‘জানো বৌদি, তোমাদের পাড়ায় একটা খুন হৈসে।’ মলিনা যেখানে বসে বাসন মাজছিলো, তার অদূরেই রান্নাঘর। সুজাতা সেখানে ধীমানের জন্য টিফিন বানাচ্ছিলো। সে জানে মলিনার সব খবরেই একটু জল মেশানো থাকে। তবু খুনের খবর বলে সে একটু সতর্ক হলো। জিগ্যেস করলো, ‘সে কি গো? কে খুন হয়েছে?’ মলিনা ভয়-ধরা গলায় চোখ পাকিয়ে বলে, ‘ঘোষাল বাড়ির লোকটা গো। রথীন ঘোষাল। কি ভয়ানক ব্যাপার!! নামটা শুনে চমকে ওঠে সুজাতা। কিন্তু তার মনের ভাব গোপন করে সে জানতে চাইলো, ‘কিভাবে খুন হয়েছে?’ মলিনা চটপট জবাব দেয়, ‘ঐ যেভাবে আগের জন হয়েছে। রাত্তির থেকে হঠাৎ বেপাত্তা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেলো না। আজ সকালে শ্মশানের কাছে দেহ পাওয়া গেছে। আধ-খাওয়া দেহ। মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে গেছে। অনেক পুলিশ এসেছে গো।’ মলিনা আরো কি যেন বলছিলো, কিন্তু সুজাতার সেসব শোনার যেন আর এতটুকু ইচ্ছা নেই। সে তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গ পেড়ে ওর কথা বন্ধ করার চেষ্টা করলো।
২
বাড়ির ছাদে পায়চারি করছিলো দেবরাজ। সঙ্গে তার বারো বছরের মেয়ে রত্না। অফিস থেকে ফিরে এই একটু সময় দেবরাজ তার পরিবারকে দিতে পারে। মৌমিতা নিচের ঘরে চা বানাচ্ছে। সে চা নিয়ে এলে দুজনে মিলে চা খাওয়া হবে। রত্নার জন্য বরাদ্দ যদিও হরলিক্স। তবে যতক্ষণ সে না আসে, ততক্ষণ বাপ বেটি দুজনে আকাশটাকে ভালো করে দেখছিলো। মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ। অনেকগুলো তারা আকাশটাকে যেন রত্নখচিত করে তুলেছে। আঙুল তুলে একসারি তারার দিকে ইঙ্গিত করে দেবরাজ বলে, ‘ঐ দেখ, রতু, সপ্তর্ষিমণ্ডল।’ এই বলে রত্নাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলে, ‘সাতটা তারা কেমন জিজ্ঞাসা চিহ্ন এঁকে দিয়েছে আকাশটার মধ্যে। আসলে গোটা মহাবিশ্বটাই তো একটা রহস্য। তাই অতো বড়ো একটা প্রশ্নচিহ্ন আঁকা আকাশটার গায়ে।’ রত্না বলে ওঠে, ‘বাবা, আমি কিন্তু বড়ো হয়ে মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করবো। আর ঐ রহস্যের সমাধান করবো।’
দেবরাজ স্মিত হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, মা। নিশ্চয়ই করবি।’
আচ্ছা বাবা। এই পৃথিবীতেও কত রহস্য আছে, তাই না?আছে তো। অসংখ্য রহস্য আছে।তুমি সেসব সমাধান করতে পারবে বাবা?ধুর, পাগল। আমি আর ক’টা পারি রে মা। আমি যা পারবো না, তুই বড়ো হয়ে করবি।কিন্তু আমি তো মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করবো।ও হ্যাঁ, তাও তো বটে।এমনভাবে বাবা আর মেয়ের গল্প যখন জমে উঠেছে, তখন চায়ের কাপ আর হরলিক্সের গ্লাস হাতে নিয়ে হাজির হলো মৌমিতা। ‘কি রে, কি গল্প হচ্ছে? আমি একটু শুনি।’ রত্না বলে উঠলো, ‘বাবা বলছিলো, আমাকে রহস্য সমাধান করতে। কিন্তু আমি তো মহাকাশ…’ রত্নার কথা শেষ না হতেই মৌমিতা বলে উঠলো, ‘বুঝেছি বুঝেছি। হয়েছে। বাবা আছেন রহস্য সমাধান করতে। আর মেয়েকেও নাচাচ্ছেন।’
কিন্তু ছাদগল্পে এখানেই একটা ছেদ পড়লো। অসময়ে বেজে উঠলো দেবরাজের ফোন। স্ক্রিনে নাম ঝলকাচ্ছে জয়দীপ। ‘হ্যাঁ, হ্যালো। বল।’ বলতে বলতে দেবরাজ একটু দূরে চলে গেলো।
ওপার থেকে জয়দীপের গলার আওয়াজ। তবে তার গলায় বেশ স্পষ্ট একটা উদ্বেগ রয়েছে। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই একটা চাপা উত্তেজনায় সে বলতে শুরু করলো, ‘শোন, একবার আমার বাড়িতে আসবার সময় হবে তোর?’ দেবরাজ একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে বলে, ‘বাড়িতে মানে? দেবকের বাড়িতে? এখন?’
হ্যাঁ, দেবকের বাড়িতে। তবে এখন না হলেও চলবে। কিন্তু ভাই, কাল সকালেই আসা চাই কিন্তু। তোর হেল্প লাগবে আমার। খুব দরকার।কেন রে? বিপদ কিছু? সিরিয়াস?হ্যাঁ, ব্যাপারটা সিরিয়াস। আর আমার পরিবার এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। তোকে ভাই প্লিজ হেল্প করতে হবে।দেবরাজ আগামীকাল খুব সকালে তার বাড়িতে চলে যাবে বলে কথা দিলো। তবে জয়দীপের কাছ থেকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে আরেকটু বিশদে সে জানতে চাইছিলো। কিন্তু জয়দীপ তখন বিশেষ কিছু বলতে রাজী হলো না। সে অবিলম্বেই ফোনটা কেটে দিলো।
তবে কি তার আশৈশবের বন্ধু জয়দীপ সান্যাল খুব গুরুতর কিছু সমস্যার মধ্যে পড়েছে? জয়দীপকে সে খুব বুদ্ধিমান ছেলে বলেই চেনে। ছোটবেলায় ক্লাসে তো বরাবরই ফার্স্ট হয়ে এসেছে। উচ্চমাধ্যমিকে চারটে বিষয়ে লেটার মার্ক্স নিয়ে পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলো। এখন একটা নামজাদা বহুজাতিক সংস্থার সহকারী কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। কাজের প্রয়োজনে তাকে এখন ভুবনেশ্বরে থাকতে হয়। পরিবার বলতে স্ত্রী আর এক ছেলে। বাবা মা দুজনেই বছর দুয়েক হলো গত হয়েছেন। দেবকের বাড়িতে তাই এখন ওর বৌ আর ছেলেই থাকে। ছেলের স্কুল, পড়াশুনার জন্য আর জয়দীপের ঘন ঘন বদলির কারণে সে পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারে না। তবে উঁচু পোস্টে উঠে গেলেও দেবরাজের সঙ্গে বন্ধুত্বে তার ছেদ পড়েনি বিশেষ। দুজনেই ফাঁক পেলে ফোন করে খবরাখবর নেয় দুজনার। দেখাসাক্ষাৎও চলে মাঝেমধ্যে। ইদানীং অবশ্য ওকে বিশেষ একটা ফোনটোন করাও হয়ে ওঠেনি দেবরাজের। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ কি এমন হলো যে কাল সকালেই দেখা করার জন্য ওর এতো তাড়া?
৩
পরেরদিন বেশ সকালেই দেবরাজ রওনা দিয়েছিলো জয়দীপের বাড়িতে। ওর বাড়িতে যেতে যেতে তার মনে হচ্ছিলো দেবক জায়গাটা ইদানীং খুব খারাপ হয়ে গেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে সেখানে তিন-চারটে খুন হয়ে গেছে বলে খবরে বেরিয়েছে। যদিও পুলিশ এখনও একটা খুনেরও কিনারা করতে পারেনি। জয়দীপ যে কিভাবে ওর পরিবারকে এমন একটা জায়গায় ফেলে রেখে অতদূর পড়ে থাকে, তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
দেবরাজ যখন জয়দীপের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোলো, তখন সকাল সাড়ে ন’টা। বেশ ঝলমলে রোদ উঠেছে। হিমেল হাওয়া বইছে বেশ ভালোই। বাতাসে একটা ঠাণ্ডা আমেজ আছে। এমন পরিবেশে মনটা চনমনে হয়ে যায়। কিন্তু জয়দীপের বাড়িতে গিয়েই দেবরাজ টের পেলো সেখানে এখন বিরাজ করছে একটা থমথমে পরিবেশ।
সে আসতেই জয়দীপ ওকে নিয়ে গেলো বাড়ির ভিতরে। বৈঠকখানাটা বেশ বড়ো এবং সুসজ্জিত। ঘরের মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের কাঁচের টেবিল যার পায়াগুলো সেগুন কাঠের। তার চারিদিকে মেহগনি কাঠের ভারী চারখানা চেয়ার। তাতে বসার সুবিধার জন্য গদি আর বালিশও রয়েছে। এছাড়া তেতাল্লিশ ইঞ্চির একটা এল.ই.ডি টিভি আর একটা বড়োসড়ো অ্যাকোয়ারিয়ামও ঘরটার শোভা বাড়িয়েছে। দেবরাজ একটা চেয়ারে বসে বালিশটা কোলের ওপর রাখলো। পরিবারের সকলেই সেখানে ছিলো। জয়দীপের স্ত্রী সুজাতা খুব বন্ধুত্বসুলভ ভঙ্গীতে তাকে আপ্যায়ন করলো। ওদের একমাত্র ছেলে ধীমান তাকে প্রণাম করে, ‘কেমন আছো কাকু’ জিগ্যেস করলো। দেবরাজও ওকে ‘বেশ আছি, তুমি কেমন আছো সান্যালবাবু?’ বলে ইয়ার্কির ছলে সম্বোধন করলো। কিন্তু সবটাতেই রয়েছে একটা বিমর্ষভাব যেটা দেবরাজকে খুব স্পর্শ করে গেলো।
যাই হোক, বন্ধুর বাড়িতে এসে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সামান্য মিষ্টিমুখ করতেই হলো দেবরাজকে। তারপর কিছুক্ষণ সুজাতার সঙ্গে, কিছুক্ষণ ধীমানের সঙ্গে সে সাধারণ কথাবার্তা সারলো। এমন সময় জয়দীপ কোনো একটা অছিলায় ধীমানকে ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে দরজাটা ভালো বন্ধ করে দিলো। তারপর শুরু করলো তার বক্তব্য –
তুই হয়ত শুনে থাকবি, এই অঞ্চলে ইদানীং কয়েকটা খুন হয়ে গেছে। ব্যাপারটা আমার এতোই সিরিয়াস মনে হয়েছে যে সুজাতার কাছে গতমাসে এটা শোনার পর আমি ঠিকই করে ফেলেছিলাম যে ওদের ভুবনেশ্বরে নিয়ে যাবো। ওখানে সপরিবারে থাকবার ব্যবস্থাও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু তারপরে সুজাতার মুখে শুনতে পেলাম একটা আশ্চর্য ঘটনা। ব্যাপারটা আমার প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু গত পরশুদিন আমি নিজে এটা দেখেছি। আর তারপর থেকে আমিও ব্যাপারটা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। ঘটনাটা তুই সুজাতার কাছ থেকেই শুনবি, কারণ ও ব্যাপারটার সাথে বেশি পরিচিত। তার আগে আমি একটা ব্যাপার তোকে বলতে চাই।
দেবরাজ হাল্কা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘কি ব্যাপার?’
জয়দীপ বলে, যে খুনগুলো হচ্ছে, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই কিন্তু একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে আর মাথার ঘিলু আর যকৃত একটা মৃতদেহেও পাওয়া যায়নি। এ থেকে কি বোঝা যাচ্ছে?
দেবরাজ বলে, ‘যে বা যারা খুনটা করছে তারা একই ব্যক্তি বা দল।’
জয়দীপ সম্মতির সুরে বলে, ‘এক্স্যাক্টলি। পুলিশেরও অনুমান এটাই। কাগজেও এমনটাই লিখেছে। আর একটা বিষয় হলো, খুনটা হয় প্রায় মধ্যরাতে। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। এমন সময়ে কোনো অজানা কারণবশত ভিক্টিম ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে আর পাওয়া যায় না। কোথাও পাওয়া যায় না। না ঘরে, না বাইরে। পাওয়া যায় পরের দিন সকালে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে, সাধারণত জনবিরল এলাকায়। ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা। মাথার ঘিলু আর যকৃত মিসিং।
দেবরাজ বলে, ‘দেখ, যেহেতু এখন নরখাদক নামে কোন শ্রেণীর মানুষ আমাদের আশেপাশে রয়েছে বলে জানা নেই। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে এটা নরবলি দিতে চাওয়া কোনো পিশাচের কাজ, অথবা এমনটাও তো হতে পারে যে কোন বিকৃতমনস্ক আততায়ী এই কাজ করছে খুব সুচারু উপায়ে।
জয়দীপ মাথা নাড়ালো, ‘উহু। যদি তাই হতো, তবে ভিক্টিম নিজে থেকে কেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে? যেসব বাড়িতে এই ধরনের খুন হয়েছে তাদের পরিবারের লোকেরা কিন্তু কাউকে তাদের বাড়িতে আসতে দেখেনি কিংবা বেরোতেও দেখেনি। এমনকি পুলিশের রিপোর্টেও কিন্তু বাড়িতে কারুর আসার বা সেখান থেকে বেরোনোর কোনো ইভিডেন্স নেই।
দেবরাজ এর কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। জয়দীপই তারপর বললো, ‘এরপরেও যদি তোর মনে হয় এটা কোন আততায়ীর কাজ, তবে সুজাতার কাছ থেকে শুনলে তোর সেটুকু বিশ্বাসও উবে যাবে।’
দেবরাজ চমকে ওঠে, ‘ব্যাপারটা কিরকম?’
ঠিক এই সময়ে ঘর থেকে ধীমান বেরিয়ে এলো। ‘বাবা, কার্টুনটা বন্ধ হয়ে গেলো, একটু দেখো না।’ এই বলে সে জয়দীপকে টানতে টানতে অন্য ঘরে নিয়ে গেলো। যদিও জয়দীপের যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু উপায়ান্তর না দেখে সে দেবরাজকে বললো, ‘দেবু, তুই বাকীটা সুজাতার থেকে শোন। আমি আসছি। আমার আরো কিছু বলার আছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে সে ছেলের হাত ধরে অন্য ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিলো।
বৈঠকখানার ঘর থেকে জয়দীপদের বাড়ির বাগানটাকে খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। সূর্যের উজ্জ্বল আলো বাগানটাকে ভরিয়ে তুলেছে। বাহারি রঙিন ফুলগুলো সুন্দরভাবে ফুটে আছে। এমন একটা পরিবেশে এরকম একটা বাজে ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতেই ভালো লাগে না। দেবরাজ ভাবে, পাড়ায় খুন হচ্ছে তো আমি কী করবো?
এমন সময় সুজাতা বলে ওঠে, ‘আসলে আপনাকে হয়ত আমরা ডিস্টার্ব করছি। কিন্তু জানেন, সত্যিই বাধ্য না হলে আজ আমরা আপনাকে আসতে বলতাম না।’
দেবরাজ বললো, ‘বেশ তো। বলুন না।’
সুজাতা শুরু করে –
জানেন, গতমাসে ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করেছিলাম। আমার ছেলে আর আমি রাতে একইসাথে শুই। ভোর হওয়ার ঠিক আগে, কটা বাজে জানি না, হঠাৎ দেখি ওর সারাটা শরীর কাঁপছে। সে কি অসহ্য কাঁপুনি আর ছটফটানি। ওর ঐ ছটফটানিতে খাটটা এতোই কাঁপছিলো যে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি তো ভেবেছিলাম ও কোন বাজে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। মাঝেমধ্যেই তো ভূতের সিনেমা দেখে। তাই আমি চেষ্টা করলাম ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিতে। কিন্তু ওর ঘুম সহজে ভাঙলো না। একটুবাদেই শুনতে পেলাম ও যেন অস্ফুট স্বরে কি একটা বলার চেষ্টা করছে। ভালোভাবে শোনবার চেষ্টা করলাম। ও একটা নাম বলছিলো। নামটা ছিলো রথীন ঘোষাল। ভদ্রলোক আমাদের পাড়াতেই থাকেন। আমি ভাবলাম বোধহয় ও রথীনদার কাছ থেকে কোন ভয়ের কথা শুনেছে, তাই ঐ নামটা বলছে।
যাই হোক, পরের দুদিন কিছু হলো না। কিন্তু তারও একদিন পরে ঘটলো একটা অদ্ভুত কাণ্ড। রথীনদা হঠাৎ বাড়ি থেকে নিখোঁজ। হঠাৎ রাত্তিরে সে কোনো এক অজানা কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, তারপর সে আর ফেরেনি। আমরা যারা ওকে চিনি, তারা তো খুব অবাক হয়ে গেছিলাম। রথীনদার মতো লোক হঠাৎ নিখোঁজ হলো কি ব্যাপার। কিন্তু তারপরেই শুনি একটা বাজে খবর। রথীনদার মৃত্যু হয়েছে। আর কি বীভৎস সেই মৃত্যু! আমাদের বাড়িতে যে কাজ করতে আসে সেই প্রথম খবরটা দিয়েছিলো।
প্রথমটায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম বটে। কিন্তু সেভাবে কিছু ভাবিনি। বিশেষত যেখানে এইভাবে ভয়ঙ্কর রকমের খুন হতে পারে, সেখানে আমাদের থাকাটা কতখানি নিরাপদ এই ভাবনাতেই আমি বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। আপনার বন্ধুকে আমি তখনই ফোন করি। তারপর আমরা দুজনেই ঠিক করি যে এখান থেকে চলে যাবো। কিন্তু এরপর একের পর এক সেই একই ঘটনা ঘটতে থাকে। রাত্তিরে ছেলের বাজে স্বপ্ন দেখে কাঁপুনি। তারপর একটা পরিচিত নাম উচ্চারণ। আর তার ঠিক তিনদিনের মধ্যে সেই ব্যক্তির মৃত্যু। এভাবে কম করেও ছ’টা খুন হয়েছে এই পাড়ায়। আর সবাই আমাদের খুব পরিচিত। এটা কি হচ্ছে দেবরাজদা? আমি তো এর কিছুই বুঝতে পারছি না।
সুজাতার গলায় একটা আকুতি টের পায় দেবরাজ। কিন্তু সে নিজেও এতো অবাক হয়ে গেছে এর কোনো উত্তরও সে দিতে পারে না। খানিকক্ষণ পর সে বলে, ‘আচ্ছা, যেসব বাড়িতে খুনগুলো হচ্ছে, তাদের প্রত্যেককেই তো আপনারা চেনেন বললেন, তাই তো?’
সুজাতা বলে, ‘হ্যাঁ চিনি।’
তো তাদের বাড়িতে গিয়ে কখনো খোঁজ নিয়েছেন?প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই হয় আমি, নয় আপনার বন্ধু গিয়ে খোঁজ নিয়েছে। আর প্রত্যেকের কাছ থেকেই আমরা একই কথা শুনতে পাচ্ছি। প্রত্যেকটা খুনই একইধরনের।তারপর কিছুক্ষণ থেমে সুজাতা আবার বলে, ‘আর একটা ব্যাপারে আমার ভয় হচ্ছে জানেন। আমার ছেলে যে ওদের নামগুলো আগে থেকে জানতে পারছে এ কথা এখনও কেউ জানে না। পুলিশ যদি কোনোরকমে এটা জানতে পারে, তবে, বলা যায় না, হয়তো আমাদেরকেই সন্দেহ করে বসবে। আমাদের কথা হয়তো তারা বিশ্বাসই করবে না। এই ভয়েতেই আমরা এটা বাইরের কাউকেই জানাতে পারছি না। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমার ছেলে কিভাবে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়লো?
সুজাতার কথা চলাকালীনই ঘরে এসে ঢুকলো জয়দীপ। দেবরাজ জয়দীপকে জিগ্যেস করে, ‘কি রে? ধীমান কি করছে?’ দেবরাজের উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসতে বসতে জয়দীপ বলে, ‘ঐ কার্টুন দেখছে।’
আচ্ছা ওকে কি এর মধ্যে খুব ভয়ের কিছু দেখানো হয়েছে?সেরকম তো আমরা কিছু দেখাইনি। আর বাইরে থেকে ও খুব ভয়ের কিছু দেখে থাকলে, নিশ্চয়ই ওর মাকে বলতো।দেবরাজ মিনিট খানেক ধরে কনুইদুটোকে টেবিলের ওপর রেখে দুই হাতের তালুতে মুখটাকে ধরে খুব গভীরভাবে কিছু ভাবলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা, ধীমানকে তোরা এই স্বপ্নের ব্যাপারে প্রশ্ন করিসনি?’ উত্তরটা সুজাতাই দিলো, ‘ও বলেছে। কিন্তু সেভাবে ভালোভাবে কিছু বলতে পারে না। একটা ছকের কথা ও বলে। ছকটায় নাকি অনেকগুলো নাম লেখা। আমরা ব্যাপারটা ঠিক বুঝিনি।’ জয়দীপ বলে, ‘তুই নিজেই ওর কাছ থেকে জিগ্যেস করে নে না। সেটাই মনে হয় ভালো হবে।’ দেবরাজ বলে, ‘ঠিক বলেছিস, ওর সাথে একটু কথা বলে নিই।’
৪
দেবরাজ মুখোপাধ্যায়ের ডায়রি থেকে –
১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
আজ যেটা সবথেকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো তা হলো ধীমানের স্বপ্ন। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন। আর বাস্তবের সাথে আশ্চর্য তার সমাপতন। ধীমান স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পায়, অজস্র নাম লেখা একটা বিরাট বড়ো ছক। এতো ছোট ছোট নাম যে তার একটাও পড়া যায় না। ধীরে ধীরে সেই ছকটা কাছে আসতে শুরু করে। তারপর অসংখ্য নামের মধ্যে থেকে ঠিক একটা নাম পড়া যায়। নামটা চেনা, একজন পরিচিত প্রতিবেশীর নাম। ধীমানের কাছ থেকে জিগ্যেস করে ওর স্বপ্ন সম্বন্ধে এইটুকুই জানতে পেরেছি। আর ওর এই স্বপ্ন দেখার তিনদিন পর অর্থাৎ ঠিক চতুর্থ দিন রাত্রে সেই প্রতিবেশীর খুন হয় যার নাম সে স্বপ্নে দেখেছিলো। অত্যন্ত নৃশংসভাবে করা খুন। পুরো ব্যাপারটা মোট ছ’বার ঘটেছে। ছ’খানা খুন করা হয়েছে এভাবে। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব?
এরপর জয়দীপ যা বললো, তাতে ভয় হবারই কথা। ওর কথাতেই লিখি-
‘ওর মায়ের যেহেতু এই ক’দিন সারারাত ঘুম হয়নি। তাই গতকাল রাতে আমিই ধীমানের পাশে শুয়েছিলাম। সারারাত জেগে থাকবার পরে প্রায় চারটে – সাড়ে চারটে নাগাদ যখন আমার চোখটা ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময়ে টের পেলাম খাটটা ধরে যেন কেউ নাড়াচ্ছে। অত্যন্ত ভয়ানকভাবে নাড়াচ্ছে। আলোটা যেহেতু রাতে জ্বালিয়েই রেখেছিলাম, তাই দেখতে আমার সমস্যা হয়নি। কিন্তু যা দেখলাম তাতে আমার রাতের সমস্ত ঘুম ছুটে গেলো। দেখলাম, ধীমানের শরীরটাকে কেউ যেন অসম্ভব রকমের জোরে নাড়াচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ এতো জোরে না নাড়ালে একটা মানুষের দেহ ঘুমের মধ্যে এভাবে নড়তে পারে না। আর তার সাথে একটা বিশ্রীরকমের গোঙানি। অমন ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে আমি জোরে চিৎকার করতে যাবো এমন সময় হঠাৎ ওর মুখে একটা নাম শুনলাম। আর নামটা শুনেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেলো।’
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘নামটা কি?’
জয়দীপ বলে, ‘ধীমান স্যান্যাল।’ নামটা উচ্চারণ করতেই তার মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
ছেলে যে তার নিজের নাম বলেছে এটা জয়দীপ কাউকে জানায়নি। সুজাতা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে ভেবে সে ওকেও কিছু জানায়নি। কিন্তু সে নিজেই এতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে প্রায় নিরুপায় হয়েই গতকাল আমাকে ফোন করেছে।
তবে এখন এই স্বপ্নের রহস্যটাকে ভেদ করতে হবে। এর জন্য অনেক পড়াশুনো দরকার, অনেক ভাবনাচিন্তাও করতে হবে। কিন্তু হাতে আছে কালকের দিনটা আর পরশু। পরশু রাত্তিরবেলার মধ্যেই যা করবার তা করে ফেলতে হবে। জয়দীপ যদি গতকাল সকালে আমাকে সব জানাতো, তাহলে আরেকটু সময় পেতাম। তবে ধীমানের সাথে কথা বলে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পেরেছি –ছেলেটা কিন্তু অসম্ভব রকমের বুদ্ধিমান।
আজ বিকেলে ওদের ওখানে একবার যেতে হবে। তার আগে কিছু পড়াশুনো করে নিই।
১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
হিসেবমতো আজ আমার পরীক্ষার দিন। আর আমার এই পরীক্ষার সাফল্য বা ব্যর্থতার সাথে আমার বন্ধুর ছেলের জীবন জড়িত রয়েছে। তাই এটা আমার কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। অথচ এই ধরনের ঘটনা সম্বন্ধে আমার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তো নেই-ই, এমনকি এমন কোনো অপার্থিব ঘটনা যে ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে আমি কোনদিন আন্দাজও করতে পারিনি।
তবে এই দুদিন আমি অনেক পড়াশুনা করেছি। সারারাত জেগে পড়েছি এবং নোট নিয়েছি। আর সকালে এবং বিকেলে একবার করে জয়দীপের বাড়ি গিয়ে এই তিনদিন ধরে ধীমানকে একটা মানসিক ব্যায়াম শিখিয়েছি। এই ব্যায়ামে ইচ্ছাশক্তি বাড়ে। এর নাম – আত্ম-সম্মোহন। জানি না, এইভাবে কতদূর আমি সফল হবো। তবে সমস্তটা বিশ্লেষণ করে আমি যতদূর বুঝেছি, তা যদি সঠিক হয় তবে আমি সাফল্য অর্জন করতে পারবো বলেই আমার বিশ্বাস। তবে একথাও ঠিক, এখানে একটা সামান্য ভুলও হয়ে উঠতে পারে আমার অথবা আমার কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণ।
আর কিছুক্ষণ পরেই বেরোতে হবে। দেখা যাক, কি হয়।
৫
দেবরাজ যখন জয়দীপের বাড়ি গিয়ে পৌঁছোলো তখন ওদের সকলের ডিনার হয়ে গেছে। জয়দীপ আর সুজাতা তারই আসবার প্রতীক্ষায় বাইরের গেটে দাঁড়িয়েছিলো। দেবরাজ এসেই বললো, ‘আজ রাতে আমি ধীমানের সাথে থাকবো। অন্য কেউ থাকবে না।’ সুজাতা এর উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু জয়দীপ ওকে থামিয়ে বলে উঠলো, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। কিন্তু ভাই, দেখিস, সবকিছু কিন্তু তোর ওপর নির্ভর করছে।’ বলতে বলতে জয়দীপের গলাটা ঈষৎ ধরে এলো। দেবরাজ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘তুই চিন্তা করিস না জয়। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। তবে একটা রিকোয়েস্ট। রাত্তিরে তোরা কেউ যেন এই ঘরে ঢুকবি না। তাতে বিপদ বাড়তে পারে।’ এই বলে আর ওদের সাথে কথা বাড়াতে চাইলো না দেবরাজ। ধীমানকে তার নিজের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার সুজাতা আর জয়দীপ সেখানে গিয়ে ধীমানকে বুঝিয়ে দিলো, ‘আজ রাতে দেবুকাকু তোমার সাথে থাকবে। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’ দেবরাজ সেই ঘরে যেতেই ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আত্ম-সম্মোহনের মাধ্যমে ধীমানকে প্রথমে ঘুম পাড়ালো দেবরাজ। তারপর মোবাইলে রাত সাড়ে তিনটের সময় অ্যালার্ম দিয়ে সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। রাতে ভালো ঘুম হলো না। এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা অন্তর তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো। পাশের ঘরে জয়দীপ আর সুজাতা রয়েছে। কথাবার্তার আওয়াজে বুঝতে পারলো, ওরাও রাতে ঘুমোতে পারছে না। সাড়ে তিনটের সময় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো তার। ঘুম থেকে উঠে আগে আলোটা জ্বাললো সে। তারপর ধীমানকে ধাক্কা দিয়ে জাগালো। ধীমানের ঘুম অত্যন্ত গাঢ়। তাই তাকে ঠিকমতো জাগাতে বিশেষ বেগ পেতে হলো তাকে। ধীমানের ঘুম যখন কিছুটা ভাঙলো ঘড়িতে তখন পৌনে চারটে বেজে গেছে। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে ধীমানের ঘুমজড়িত ভাবটা কাটিয়ে তাকে শুয়ে চোখ বন্ধ করতে বললো দেবরাজ। ও চোখ বন্ধ করলে ওর কানের কাছে খুব আস্তে আস্তে দেবরাজ বলতে লাগলো, ‘তোমার সামনে দেখো একটা বিরাট বড়ো ছক। তার মধ্যে অজস্র নাম লেখা। তুমি একটা নামও পড়তে পারছো না। ভালো করে ছকটাকে দেখো…ছকটাকে দেখো….এইভাবে কিছুক্ষণ বলতে বলতে দেবরাজ থামলো। তারপর আবার বলতে লাগলো, ‘তোমার সামনে যে ছকটা আছে সেটা তুমি মুছে ফেলো ধীমান। ছকটাকে মুছে ফেলো ধীমান। মুছে ফেলো।’ এইভাবে বলতে বলতে দেবরাজ টের পেলো ধীমান আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
ঠিক এই সময়েই ঘরের মধ্যে একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে এলো। আর তার সাথে সাথে বাতাস যেন খুব ভারী হয়ে আসতে লাগলো। দম আটকে আসছে দেবরাজের। হঠাৎ ঘরের আলোটা নিভে গেলো। দেবরাজ ভাবলো লোডশেডিং। কিন্তু রাস্তার স্ট্রীটলাইটগুলো সব জ্বলছিলো। সে দ্রুত উঠে একটা টর্চ জ্বাললো। কিন্তু একমুহূর্তের জন্য টর্চটা জ্বলেই নিভে গেলো। ঘরে একেবারে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আর ঠিক সেই সময় দেবরাজের চোখে পড়লো একটা অদ্ভুত জিনিস। যা দেখে তার সারা গায়ে শিহরণ দিয়ে উঠলো। সে দেখতে পেলো ঘরের এক প্রান্তে দুটো আলোর বিন্দু। হলুদাভ লাল সেই বিন্দু দুটো দেখলে মনে হয় যেন কোনো হিংস্র শ্বাপদের দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। সেই বিন্দুদুটো ঘরের ঐ প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে ওদের দিকে আসতে লাগলো। আর সেটা যত কাছে আসছে, বিশ্রী গন্ধটা ততই আরো প্রকট হতে লাগলো। দেবরাজ বুঝতে পারলো, এই হলো সেই আততায়ী। এখানে যত নৃশংস খুন হচ্ছে, তার জন্য দায়ী এই শয়তান। এবার সে ধীমানকে লক্ষ্য করেছে। একে থামাতেই হবে। সামনের দিকে কিছুক্ষণ হাতড়াতেই সে একটা পেপারওয়েট পেলো। সজোরে সেই পেপারওয়েটটাকেই সে ছুঁড়ে মারলো ঐ চোখদুটোকে লক্ষ্য করে। পেপারওয়েটটা মেঝেতে পড়বার আওয়াজ হলো জোরে, কিন্তু আলোর বিন্দুদুটো যেমন এগিয়ে আসছিলো, তেমনই আসতে লাগলো। সামান্য পেপারওয়েটের আঘাত তার কিছুমাত্র ক্ষতি করতে পারলো না।
এবার? এবার ধীমানকে এই অশরীরীর হাত থেকে বাঁচাবে কি করে সে? হঠাৎ দেবরাজের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। সে ধীমানের কানের কাছে এসে আবার বলতে লাগলো, ‘ধীমান, তোমার সামনে যে ছকটা দেখছো সেটাকে মুছে ফেলো। খুব তাড়াতাড়ি মুছে ফেলো ধীমান। আর সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি মুছে ফেলো। এই নাও ইরেজার।’ এই বলে সে তার হাতের টর্চটাকেই ধীমানের হাতে ধরিয়ে দিলো। আর তখনই এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো। ধীমান ঘুমের মধ্যেই টর্চটাকে নিয়ে খুব জোরে নাড়াতে লাগলো। আর সাথে সাথে তার সামনের ঐ রক্তিমাভ আলোকবিন্দু দুটো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর শুরু হলো একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ। যেন কেউ একটা চাপা আক্রোশে ফুঁসছে। এইভাবে কতক্ষণ চললো বলতে পারি না। হঠাৎ একসময় টিউবলাইটটা জ্বলে উঠলো। দেবরাজ দেখলো, ধীমান অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে। টর্চটা তখনও তার হাতে ধরা। কিন্তু ঘরে কোথাও কোন প্রাণী তো দূরস্থ একটা টিকটিকিও খুঁজে পাওয়া গেলো না।
দেবরাজ খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লো। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর হয়ে গেছে। সকাল ছ’টার সময় সে জয়দীপ আর সুজাতাকে এ ঘরে ডাকলো। ওরা এসে দেখলো ধীমান ঘুমিয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণ সুস্থ। আজকের রাতে দেবরাজেরই জয় হয়েছে। তাই দেখে ওদের আনন্দ আর ধরে না। ছেলেকে আদর করে, চুমু খেয়ে তারা ওর ঘুমটাই ভাঙিয়ে দিলো। তারপর জয়দীপ দেবরাজের কাছে এসে ওর হাত দুটো ধরে বলে ওঠে, ‘ভাই, ধন্যবাদ দিয়ে তোকে আর ছোটো করবো না। তুই আমার যা উপকার করলি, কোন বন্ধু এমনটা করতে পারে? তোকে যে কি বলবো…’ আর কিছু কথা না খুঁজে পেয়ে সে আনন্দে দেবরাজকে জড়িয়ে ধরলো। সুজাতাও এসে তাকে অনেকবার ধন্যবাদ জানালো। তাকে আজকের দিনটা খেয়ে যেতেও বললো ওরা। কিন্তু দেবরাজকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিলো। সে ওদের কোনো উৎসাহেই যোগ দিতে পারছিলো না।
জয়দীপ ওকে এমন দেখে জিগ্যেস করলো, ‘কি হয়েছে ভাই? কোনো সমস্যা?’
দেবরাজ বললো, ‘অ্যাঁ, না। সমস্যা নয়। তবে আমার অসতর্কতার জন্যে আজ একটা বড়ো ভুল হয়ে গেলো রে।’
সুজাতা বলে, ‘কি ভুল দেবরাজদা?’
জয়দীপ বললো, ‘ওসব ছাড়। তার আগে বল, তুই এই অসম্ভব কাজটাকে সম্ভব করলি কি করে?’
দেবরাজ একটু গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘দেখ, মূল ঘটনাটা আমি যা বুঝেছি সেটা বলছি। আমার ধারণা, অন্য কোনো বিজাতীয় শক্তি এসে ধীমানকে ব্যবহার করছিলো। সেই শক্তিটা আধিভৌতিক অথবা আধিদৈবিক হতে পারে। তবে তার পছন্দের জিনিস হলো মানুষের মাথার ঘিলু আর যকৃত। যে কারণেই হোক, সে এই দুটো জিনিসকে পেতে চায়। কিন্তু এখানকার আটঘাট সে বিশেষ বোঝে না। কোনো একটা সূত্র ধরে তাকে সমস্তটা বুঝতে হয়। সে তাই ধীমানের স্মৃতিটাকে ব্যবহার করে। ধীমান যে ছকটা দেখছিলো সেটা তার স্মৃতিতে থাকা লোকের নাম। আততায়ী সেইসব লোকের নাম আর তাদের সমস্ত বিবরণ ধীমানের স্মৃতি থেকে সংগ্রহ করে ছকটা প্রস্তুত করেছিলো। তারপর যাকে সুবিধাজনক মনে হচ্ছিলো, তাকে সে খুন করে তার উদ্দেশ্য সাধন করছিলো। ঐ ছকটাই ছিলো ওর মূল হাতিয়ার।’
জয়দীপ বলে, ‘কিন্তু তাহলে ধীমানকেই ও মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে কেন?’
প্রশ্নটা শুনে সুজাতা হঠাৎ চমকে উঠে জয়দীপের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু দেবরাজের সামনে সে বিশেষ কিছু প্রকাশ করলো না। দেবরাজ বলে, ‘তার কারণ, আমার ধারণা, ধীমানের স্মৃতি থেকে তার আর কিছু পাওয়ার ছিলো না। তাই সে তাকে হত্যা করে সে তার যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করতে চাইছিলো।’
জয়দীপ বলে, ‘যাই হোক, সে তো আর তা পারেনি। আমার ছেলে বেঁচে গেছে।’
দেবরাজ বলে, ‘তোর ছেলে তো বেঁচে গেলো। কারণ ওর ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়ে স্বপ্নের মধ্যে কিভাবে ছকটা মুছে ফেলতে হয় সেটা আমি ওকে শিখিয়ে দিয়েছি। ঐ ছকটাকে মুছে ফেলে আততায়ীর প্রধান অবলম্বনটাকেই সে ধ্বংস করে দিয়েছে। তোর ছেলের আর বিপদ নেই।’
জয়দীপ বলে, ‘তাহলে তো আর চিন্তাই নেই।’
দেবরাজ অধৈর্যের ভঙ্গীতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘না রে, না। চিন্তা আছে। রাত্তিরবেলায় যার হিংস্র চোখদুটো আমি দেখেছিলাম সে পালিয়ে গেছে।
জয়দীপ অবাক হয়ে যায়, ‘হিংস্র চোখ?’
দেবরাজ রাত্তিরবেলায় যা দেখেছিলো সেটা বর্ণনা করে। তারপর বলে, ‘ঐ চোখদুটোই হচ্ছে সর্বনাশ। তুই বলতিস না, যে খুন হবে, সে নিজেই রাত্তিরবেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো? তারপর তাকে আর কোথাও পাওয়া যেতো না। এই চোখদুটোই তার কারণ। ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ঘুমের মধ্যে সে প্রলুব্ধ করে তাকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতো। তারপর জনবিরল এলাকায় নিয়ে গিয়ে সে তার কাজ সারতো।
সুজাতা বলে ওঠে, ‘ওঃ কি সাঙ্ঘাতিক!!’
দেবরাজ ম্রিয়মাণভাবে বলে, ‘সেই কারণেই তো আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। পালিয়ে তো গেলো, এবার সে কিভাবে কাকে আক্রমণ করবে আমরা এখনও তার বিন্দুবিসর্গও জানি না।’
দেবরাজের কথা শুনে জয়দীপ আর সুজাতা দুজনেরই মুখ শুকিয়ে এলো। তাদের আনন্দে সেই আগের উচ্ছ্বাস আর রইলো না।
৬
সেইদিন আর তার পরেরদিন দেবরাজ খুব ভালো করে বিশ্রাম নিলো। আগের দিনগুলোর ধকল সহ্য করে তার আর কোনো কাজেই মন বসছিলো না, বাড়ির লোকের সাথেও বেশি একটা সময় দিতে পারলো না। দুদিন ধরে বিশ্রাম করে একটু চাঙ্গা হলো সে। তারপর একদিন বিকেলে রত্না তাকে ধরলো, ‘বাবা, জয়দীপকাকুদের বাড়িতে কি হয়েছিলো বলো না।’ দেবরাজ বললো, ‘এখন নয়, সন্ধেবেলা চা খাওয়ার সময় বলবো। কেমন?’
সন্ধেবেলার ছাদগল্পে আজকে জয়দীপদের বাড়ির ঘটনাটাই পুঙ্খনাপুঙ্খরূপে বর্ণনা করতে লাগলো দেবরাজ। ধীমানের স্বপ্নের ব্যাপারটা যখন সে বলছে, তখন দেবরাজকে থামিয়ে রত্না হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবা, জানো, এই স্বপ্নটাই কাল আমি দেখেছি। একটা ছক, আর তার মধ্যে অজস্র নাম লেখা।’
বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে দেবরাজ, ‘বলিস কি?’
এবার মৌমিতা বলতে শুরু করে, ‘হ্যাঁ গো। তোমার শরীরটা ক্লান্ত ছিলো না বলে কিছু জানাইনি। মেয়ে কাল রাতে স্বপ্ন দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছিলো। সে কি ছটফটানি আর গোঙানি! আমি ওকে যত থামাতে চাই ততই ও গোঙাতে থাকে। কিন্তু পরে বুঝলাম ঐ গোঙানির মধ্যে ও একটা নাম বলছিলো।’
দেবরাজ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ‘কি নাম?’
মৌমিতা বলে, ‘তোমার নাম, দেবরাজ মুখোপাধ্যায়।’