Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy

3.9  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance Tragedy

সব পেলে নষ্ট জীবন

সব পেলে নষ্ট জীবন

6 mins
1.3K


সব পেলে নষ্ট জীবন


আজ দোল। আকাশে মেঘ রোদের খেলা। আমি আর বৈদেহী আজ ছুটোছুটি করে রং খেললাম ওদের বাড়ির ছাদে। কালচে বেগুনী আর গাঢ় সবুজ রং একসাথে মিশিয়ে তেলে গুলে কাউকে মাখিয়ে দিলে যে এতো বীভৎসরকমের বিশ্রী দেখতে লাগে তা আমার জানাই ছিলো না। বৈদেহীকে একেবারে তো চেনাই যাচ্ছিলো না। ইস্!


তবে আমি বৈদেহীকে নিয়ে খুব আমি মজাও করছিলাম। হাসছিলাম জোরে জোরে, হো হো হো...! বৈদেহী চিলেকোঠার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে জানালার কাঁচের সার্সিতে নিজের মুখটা দেখতে চেষ্টা করছিলো। আর আমি হাসতে হাসতেই তারিয়ে তারিয়ে মজাটা উপভোগ করছিলাম। বৈদেহীর রঙে কালো হয়ে যাওয়া মুখের মধ্যে শুধু সাদা ঝকঝকে মুক্তোর মতো দাঁতগুলোই দৃশ্যমান। বৈদেহী সার্সির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরলো আমার দিকে। ভাবছিলাম, কিছু বলবো কি বলবো না।



এমনসময় হঠাৎ আচমকা আমি এক পুরুষকন্ঠের হা হা হা হা... শব্দের অনাবিল এক হাসির আওয়াজ পেলাম। চট করে শব্দের উৎসের দিকে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি এক সদ্যতরুণ। পাশের বাড়ির ছাদে। আমাকে দেখে অপ্রস্তুতের একশেষ। চট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যেন কিছুই হয়নি, ওর যেন কোনো অস্তিত্বই নেই। ছাদের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গিয়ে রেলিং ধরে নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালো। দোলের দিনে পরিপাটি সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা যুবকটি তখন যেন কী ব্যস্ত রাস্তা দেখতে। আহা রে!



বৈদেহী ততক্ষণে নিজের সালোয়ার কামিজের ওড়নায় মুখ মুছছে, আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে। খানিকটা রং ঘষে ঘষে তুলেও ফেলেছে। একটুও রাগেনি, অথবা ভেতরে ভেতরে রাগলেও বাইরে সামলে নিয়েছে। প্রকাশ করেনি মুখে। পাশের ছাদের দিকে আড়চোখে তাকায় বৈদেহী। সদ্যতরুণের হাসি শুনেছে নির্ঘাত। আর বৈদেহীর ঐরকম রং মাখা বাঁদুরে মার্কা মুখ দেখে তাকে উদ্দেশ্য করেই হাসিটা পাশের ছাদ থেকে ভেসে এসেছে, এটা সে বিলক্ষণ বুঝে ফেলেছে। আমার সাথে আলতো গলায় টুকটাক কথা বলতে বলতেই বৈদেহী আবার তাকালো পাশের ছাদে। 



বৈদেহীর তাকানো দেখে আমি আর নিজের কৌতুহল ধরে রাখতে পারলাম না, "কে রে ওই ফক্কর ছেলেটা? রং খেলা দেখে অমন হাসির কি হলো? অন্য পাড়ার ছেলে বুঝি,?"



হাসিমুখে গালে ওড়না ঘষা থামিয়ে বৈদেহী বলে, "ও হলো বসন্ত... এন বসন্ত। দক্ষিণ ভারতীয় শুধু নামেই, আসলে পাক্কা বাঙালি। কয়েক পুরুষ ধরে এখানেই ওরা।"



আমি বললাম, "ওও, তাই বুঝি? তবে তো তোর চেনা। কিন্তু অমন করে হাসলো কেন? আর তুইও কিছু বললি নাতো?"



বৈদেহী একইরকমভাবে হেসে বলে, "কি বলবো?"

আমি বললাম, "তোর দিকে তাকিয়ে অমন করে ফিচেলের মতো হাসছিলো যে তবে? তোকে কি ভালোবাসে নাকি?"



কয়েক সেকেন্ড বড় বড় চোখের পাতা মেলে সামনের দিকে চেয়ে রইলো বৈদেহী। ওর মুখের লেগে থাকা রঙের প্রলেপের তলায় ধরা পড়লো না ওর মুখের রেখায় নড়নচড়ন... বা কোনো অভিব্যক্তি। তারপর যেন বহুদূরের ওপার থেকে মৃদুস্বরে কেটে বললো বৈদেহী, "না, ও আমায় ভালোবাসে না। তবে আমি বাসি... খুব ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি।" আমি অবাক হয়ে দেখলাম বৈদেহীর দুচোখের কোণ চিকচিক করছে। কী যেন একটা ছিলো বৈদেহীর কথায়। আমি আর বেশী কথা এগোতে পারলাম না। বেলাও হয়েছিলো। ফিরে গেলাম বাড়িতে। 



তারপর বৈদেহীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাতে একটা দূরত্ব তৈরি হলো সামান্য। তবে আমার মনের সবখানিক জুড়েই বৈদেহী, শুধুই বৈদেহী। আমাকে সর্বক্ষণ খুব টানে বৈদেহীর সঙ্গ। তবুও ওর কাছেই যেতে একটা বাধাও পাই নিজের ভেতর থেকে। এর মধ্যেই বিএসসি ফাইনাল। পড়াশোনার চাপে কিছুদিন আর অন্য কোনোদিকে মনই দিতে পারিনি। তাই বলে এমন নয় যে বৈদেহীর চিন্তা একেবারে মনে আসেনি। বারবার মনে পড়েছে ওর কথা, ওর গান, ওর ঝগড়া, ওর চোখের চাউনি... সব। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, এর কোনোটাই তো আমার জন্য নয়। বৈদেহী তো এন বসন্তের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। কে জানে কখনো ও ওর ভালোবাসার প্রত্যুত্তর পাবে কিনা?



এভাবেই পার হলো আরো বেশ কয়েকটি মাস। তারপর আমাদের বিএসসির রেজাল্ট বেরোলো। বৈদেহী কোনোরকমে অনার্সটা ধরে রেখেছে। ও আর পড়বে না। নার্সিং ট্রেনিং নেবে। আমি ইউনিভার্সিটি টপার হলাম যে কী করে তা জানি না। পড়ায় মন তো বসাতেই পারতাম না। যাইহোক রেজাল্ট যখন ভালোই হয়েছে, তখন পড়াশোনা তো এগোতেই হবে। আমি কলকাতায় থেকে এমএসসিটা করবো ঠিক করলাম। জেলা শহর পেছনে পড়ে রইলো বৈদেহীকে নিয়ে। বৈদেহী নার্সিং শেষ করে তখন হাসপাতালে জয়েন করেছে শুনলাম বাড়িতে গিয়ে। আমিও পিএইচডি শুরু করেছি ততদিনে অন্য রাজ্যে থেকে।



এবারে বাড়িতে আসার পরে একদিন একেবারে বৈদেহীর সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলো... স্টেশন বাজারে। বৈদেহী হেসে দাঁড়ালো, "কিশোর, আমি আজই তোদের বাড়িতে যেতাম তোর ফোন নাম্বারটা নিতে। দেখা হয়ে খুব ভালো হলো। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে আর কারুর সাথে তেমন যোগাযোগ তো রাখা হয়নি। শুধু তোর সাথেই রাখতে চেয়েছিলাম যোগাযোগ, অথচ তুই তো দূরে দূরে পড়তে চলে গেলি। আমার জন্য কি আর তোর কোনো সময় ছিলো বল? নামেই শুধু বন্ধুত্ব। বেস্ট ফ্রেন্ড বুঝি এমনি এমনি হয়?"



আমি বলতে চাইলাম, "বৈদেহী, আমি তো আমার সারাটা জীবনই তোকে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই তো নিজেকে এন বসন্তের জন্যই আগলে রেখে দিয়েছিস। আমি কি করবো বল?" কিন্তু মুখে একটা কথাও উচ্চারণ করে কিচ্ছু বলতে পারলাম না। উল্টে হেসে বললাম, "নারে, তা নয় ঠিক। কেরিয়ারটা না গোছাতে পারলে খাবো কি বল? তুই তো আর সারাজীবন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারবি না আমায়? তবে? ওসব ছাড়। তোর কি কথা বলার ছিলো সেটাই বল দেখি, শুনি।"



বৈদেহী চোখ মটকে বললো, "সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ রে। সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে থাকিস, আসবো আমি। এখন আসি রে... হাসপাতালে যাচ্ছি এখন। কথা হবে তবে সন্ধ্যেবেলায়।" বৈদেহী চলে গেলো। ওর চলে যাওয়াটা আমি দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আমার বুকের রক্তটা ছলাৎ করে উঠলো। কি বলতে চায় বৈদেহী? মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো আমার শরীরটা যেন আর আমার নিজের বশে নেই। আমার হৃদপিন্ডটা লাফালাফি করে যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কি বলতে চায় বৈদেহী? সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এসে কি এমন বলবে বৈদেহী? আমার তর সইছে নাই আর... কখন সন্ধ্যে হবে? সারাটা দিনই আমার খুব উদ্বেগে কাটলো।"



সন্ধ্যেবেলায় আমি সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে সেজেগুজে বসে রইলাম। বারবার ঘড়ি দেখলাম আর দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম। কখন আসবে বৈদেহী? ঐতো আসছে মনে হয় বৈদেহী... স্কুটি নিয়ে। হ্যাঁ, সত্যিই বৈদেহী। আমি দোতলার বারান্দা থেকেই ডাকলাম গলা তুলে, "একেবারে ওপরে চলে আয়।" গেট খুলে ভেতরে ঢুকে এলো বৈদেহী। তারপর সিঁড়িতে ধুপধাপ ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পেলাম... বৈদেহী আসছে।



আমি মুখোমুখি দুটো বেতের মোড়া আগে থেকেই বারান্দায় পেতে রেখেছিলাম। বৈদেহী এসে ধপ করে বসে পড়লো একটা মোড়ায়। তারপর হড়বড় করে বলে উঠলো বৈদেহী, "এই শোন, আমার না হাতে সময় খুবই কম। আমার আর এন বসন্তের বিয়ে সামনের সপ্তাহে। তুই কিন্তু আমাদের বিয়ের আগে কিছুতেই ফিরে যেতে পারবি না। তোকেই দাঁড়িয়ে থেকে সব করতে হবে। তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল তো? তুইই তো আমার এক এবং একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড... কাজেই তোর ওপর ভরসা করেই বসে আছি আমি। কোনো মানা, কোনো এক্সকিউজ কিন্তু আমি শুনবো না। বুঝলি? কিরে?" আমিও খুব খুশি খুশি ভাব দেখালাম বৈদেহীকে। আর কথাও দিলাম, "তোর বিয়েতে আমি থাকবো না, তাই কখনো হয়? তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমি থাকছি। তোর বিয়ে পার করেই ফিরবো।" আমি বৈদেহীকে এসব কথা বলছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার বুকের ভেতরটা তখন চিনচিন করে ব্যাথা করছিলো। বৈদেহীর খুব কাজের তাড়া ছিলো। এককাপ চা খাওয়ার সময়ও হলো না, ওর হাজারো কাজের তাড়ায়। তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো বৈদেহী।



বৈদেহীর সাথে এন বসন্তের বিয়ে হয়ে গেছে নির্বিঘ্নে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কাজে তদারকি করে বেড়ালাম সারাদিন ধরে। মাঝে একটা দিন পার হয়ে গেছে। আজ বৈদেহীর ফুলশয্যা। এদিকে আজ একটা কাণ্ড হয়েছে। ওদের ফুলশয্যার খাট সাজাবার লোক আসেনি। এবার কি হবে? বৈদেহী আমাকে ফোন করলো। আমিও ওর ফোন পেয়ে ছুটলাম। মনের মতো করে বৈদেহীর ফুলশয্যার খাটটা সাজালাম। বৈদেহী এবং এন বসন্ত... দুজনেই খুব খুশি। আমি ওদের খাট সাজিয়ে দিয়ে বললাম, "এবার আমি আসিরে। কাল ভোরের ফার্স্ট ট্রেনে আমাকে ফিরে যেতেই হবে... হাওড়া থেকে দুপুরে ট্রেন। গোছগাছ করতে হবে। ওদের দুজনের প্রবল চাপাচাপিতে একটু মিষ্টি খেয়ে আমি বিদায় নিলাম। ফেরার সময় আমার চোখের কোণটা জ্বালা করে উঠলো। অস্ফুটে বললাম, "সুখী হোস বৈদেহী, খুব ভালো থাকিস।"



হাওড়া থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেস ছেড়ে চলেছে আমার গন্তব্যে। চলছে ট্রেন হু হু করে। আমার মনটা চলছে আরো বেশি হু হু করে। বৈদেহী সুখে থাক। আর আমি ওকে সারাজীবন শুভেচ্ছা জানাই। আর আমি? আমি থাকি আমার মতো... আসলে বোধহয় জীবনে কিছু না পাওয়া থাকাতেই বেশী আনন্দ, সব পেলে নষ্ট জীবন।






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance