সাতপাঁকের গেরো
সাতপাঁকের গেরো
সাতপাঁকের গেরো।
মনিভা সাধু
অফিসে কাজ করতে করতেই দুপুর দেড়টা নাগাদ আকাশ কালো হয়ে এলো,খানিক পরেই এলোমেলো ঝড় উঠলো,দিনেদুপুরে অফিসে আলো জ্বলে উঠলো।গোপাল চিন্তায় পড়ে গেলো। আজকেই তার দশম বিবাহবার্ষিকী, সকালে অফিস আসার আগে সুহাসিনী পইপই করে মনে করিয়ে দিয়েছে,"আজকের তারিখটা মনে আছে তো?"
গতানুগতিক জীবনযাত্রার একঘেয়েমিতে ভুলেই গিয়েছিল,ভাগ্যিস আচমকা মনে পড়ে যায়,গোপাল মনেমনে ভাবে,"কোনো পাঁঠা কি বলি হবার দিন ভুলতে পারে?সেদিন যে আমার শহীদদিবস।" মুখে হাসি এনে বলে,"ভুলি কি করে,আজও যে মনে।"
সুহাসিনী লজ্জানত হয়ে বলে,"তুমি কিন্তু এবারে নেকলেস দেবে বলেছো!!"
বিয়ের সময় ছিপছিপে পঞ্চাশ কেজির তরুণী আজ নব্বই কেজির চর্বির স্তুপে পরিণত হয়েছে।তার গলা অর্থাৎ "নেক" এখন আক্ষরিক অর্থেই "নেক-লেস",গোপাল বউয়ের গাল টিপে আদর করে বলে,"তুমি তো আমার নেক-লেসই।"
"সন্ধ্যেয় কিন্তু মা-বাবা আসবে,মনে করে গুছিয়ে সব এনো।আর আজ একবার বিউটিপার্লারে যাবো।"গোপাল ঝোলভাত খেতেখেতে বিষম খায়,আবার বিউটিপার্লার?ওই পিপের মতো চেহারায় আর বিউটি আছে?বিয়ের প্রথম প্রথম ঘুমের ঘোরে বুকে হাত এসে পড়লে শরীরে রিনিঝিনি বাজনা বাজতো,এখন মুগুরের মতো হাতের চাপে দমবন্ধ হয়ে যায়।এখন সামান্য জড়াজড়িতে সুহাসিনীর মধ্যপ্রদেশ দুজনের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়।
সুহাসিনী লিস্টের কাগজ গোপালের হাতে ধরিয়ে দেয়,সেটা না দেখেই শার্টের বুকপকেটে ঢুকিয়ে গোপাল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে,আর দেরি করলে এই ট্রেনটা মিস করবে।আবার আধঘণ্টা লেট,ওদিকে অফিসে বসের তলব।উ:,নিজেকে যেন রেসের ঘোড়া মনে হয়,আর সুহাসিনী যেন জকি!!সুহাসিনীকে জকি ভাবতেই ফিক করে হেসে ফেলে,দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে।
ট্রেনে উঠতেই সমবয়সী অফিসকলিগ,হরেন ডেকে নেয়,জায়গা রাখাই থাকে।রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে সিটে বসে লিস্টের কাগজ বের করে পড়তে পড়তে বলে,"এবারে নির্ঘাত মরে যাবো।"
--- কেন,আবার কি হলো? ব্যাচেলর হরেন জিজ্ঞেস করে।
--এই দ্যাখ।
হরেন পড়ে,"নিরামিষ বিরিয়ানি(পাঁচ প্যাকেট),পনির পসন্দ(পাঁচ প্যাকেট),ইলিশ ভাপা,ভেটকিমাছের পাতুরি,গলদাচিংড়ির মালাইকারি, আলু টিক্কা(চার প্যাকেট), কমলাভোগ(পনের পিস), প্রাণহরা, রাবড়ি ---"এসব কেন?কোন অকেশন?
---ম্যারিনেশন করে রোস্টের দিন, বিবাহবার্ষিকী।শুধু এ-ই নয় এর সাথে সোনার "নেকলেস" আছে।ভাগাড়কান্ডের জেরে মাংসের আইটেম বাদ।
হরেন হো হো করে হেসে ওঠে,"সাধে বিয়ে করিনি,এই বেশ আছি। পাশের বাড়ির বৌদির সাথে বিন্দাস সম্পর্ক পাতিয়ে নিয়ে ভালোমন্দ খাবার ব্যবস্থা করে নিয়েছি।"নেকলেস"কেনা হয়ে গিয়েছে?"
--- মাথাখারাপ?
-- তাহলে কি করবি?
--- জানিনা।
তারপর অফিসে কাজে ডুবে গিয়েছিল,আকাশের অবস্থা দেখে মনে পড়ে গেলো।আসলে দুর্যোগ এলেই সুহাসিনীর কথাই মনে পড়ে। সাতবছরের একমাত্র মেয়ে,টুয়া না থাকলে গোপাল অন্যত্র বদলি নিয়ে পালাতো।বিয়ের পরে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে লোন নিয়ে বাড়ি করা,প্রতিবছর এদিকওদিক বেড়াতে যাওয়া,শহরের নামকরা নার্সিংহোমে মেয়ের জন্ম, অন্নপ্রাশন, নামী ইংলিশমিডিয়াম স্কুলে মেয়ের ভর্তি,ইলেকট্রিকের বিল,ডাক্তারবদ্যি,বাড়ির রান্নার লোক, ঘরমোছা, বাসনমাজার লোকের মাইনে--- কিভাবে যে মাসের মাইনের টাকা বেড়িয়ে যায় বুঝতেই পারেনা। তারমধ্যে শাশুড়ির হাড়জ্বালানো কথাবার্তা, "গোপাল,রান্নাঘরে এবার কিচেন চিমনি লাগিয়ে নাও।""ওমা! এখনো মাইক্রোওয়েভ নাওনি?রাতে খাবার গরম করার জন্য আর গ্যাস জ্বালতে হবেনা, তাছাড়া টুয়াসোনা কেক খেতে কত্তো ভালোবাসে।" "এবারে ডাইনিংয়ে এ সি লাগিয়ে নাও,যা গরম পড়েছে, সুহাসের আবার একদম গরম সহ্য হয়না।" " ড্রয়িংরুমে এবার একটা ওয়াল টিভি নিয়ে নাও,বেশ সিনেমা সিনেমা লাগে।" "বাথরুমে গীজার লাগিয়ে খুব ভালো করেছো, শীতকালে তোমার এখানেই কাটানো যাবে,বয়েস হচ্ছে,জল গরম করে স্নান করতে আর ইচ্ছে করেনা।"
গোপাল মনেমনে বলে,"কেন,নিজের ঘরদোর সারিয়ে নিলেই তো হয়, আপনার বর তো ভালোই পেনশন পায়।"মুখে বলে,"সে আপনি ইচ্ছে করলেই লাগিয়ে নিতে পারেন।"
---তার মানে তোমার এখানে আসতে বারণ করছো।
---ছি ছি,এ কি বলছেন!আপনার মেয়ের বাড়ি তো আপনারই বাড়ি। গোপাল পাঁচন গেলার মতো মুখে কাষ্ঠহাসি হাসে।
অথচ বিয়ের আগে কাছে শ্বশুরবাড়ি বলে কত আহ্লাদ হয়েছিল,এক মেয়ে,মাঝেসাঝেই শাশুড়ির হাতের রান্না খেয়ে ক'দিন কাটিয়ে আসা যাবে ভেবেছিল।বিয়ের পরে পরেই শ্বশুর-শাশুড়িই মাসে দশ-পনেরো দিন তার বাড়িতে এসে থাকতে লাগলো!বিয়ের প্রথম তিনবছর স্বামীস্ত্রী দুজনেই বেড়াতে যেতো,টুয়া হওয়ার পরে সুহাসিনী আবদার ধরে,"মা থাকলে আমি নিশ্চিন্ত হই,একা একা টুয়াকে নিয়ে বাইরে যেতে ভরসা হয়না।"ততদিনে "মধুচন্দ্রিমা"র "মধু"ও ফুরিয়ে গিয়েছে,আর সুহাসিনী তখনই সত্তর কেজি হয়ে "চন্দ্রিমা" হওয়ার সাধনায় নেমেছে। অগত্যা, সেইথেকে শ্বশুর-শাশুড়িও তাদের সঙ্গী।খরচের কথা বলতেই সুহাসিনী, "তোমার মা বাবা থাকলে বলতে পারতে?তোমাকে ওরা নিজের ছেলের মতো ভাবে,আর তুমি?"বলেই আঁচলে দুচোখ মুছেছে। গোবেচারা গোপাল অপ্রস্তুতে পড়ে থতমত খেয়ে যায়,দেওয়ালে ঝোলানো শুকনো মালা পরানো মৃত মা-বাবার ফটোর দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলে, "আপন সন্তানের এমন সর্বনাশ করে চলে যেতে হয়?"।বিয়ের আগে গোলগাল সত্তর কেজির গোপাল এখন ছাপান্নয় এসে দাঁড়িয়েছে।
টিফিনে শুকনো রুটি আর ঢেঁড়সের তরকারি খেতে খেতে ভাবছিল,কি করবে।ক'দিন আগেই মেয়ের স্কুলে নতুন বই,ড্রেস,মাইনে নিয়ে বেশ কিছু টাকা বেড়িয়ে গিয়েছে।পাশের টেবিলের সুরমাদির সাথে হরেন টিফিন ভাগ করে খাচ্ছে আর মাঝেমাঝেই তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
অফিস ছুটির দেড়ঘন্টা আগেই তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো, সামনের রাস্তায় জল জমে গেলো। অফিস ছুটি হলে হরেন বললো, "একটু দাঁড়িয়ে যাই।"
দাঁড়াতে দাঁড়াতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো,বৃষ্টি উত্তরোত্তর বেড়েই চললো।
"এবারে বেড়োতেই হবে,নাহলে মুশকিলে পড়বো।ওদিকে ট্রেন পাবোনা।"গোপাল প্যান্ট গুটিয়ে রাস্তায় নামে।অগত্যা,হরেনও তাকে অনুসরণ করে।কিন্তু খানিক গিয়েই জল হাঁটুর ওপর উঠে যায়।
"হরেন,সামনে ম্যানহোল আছে কিনা বুঝবো কিকরে?"গোপালের কথায় হরেন বলে,"বুঝেই বা কি করবি?খালিহাতে বাড়ি ঢুকলেও তো বৌ বাক্যবাণে তোর সর্বাঙ্গে "হোল" করবে,তারচেয়ে "সীতার পাতালপ্রবেশ" মন্দ কি!"
--- না,আর যাওয়া যাবেনা।এককাজ করি,সামনেই সুরমাদির বাড়ি, আমি সেঁধিয়ে যাচ্ছি,তুই কি যাবি? এভাবে সুইসাইড করতে আমি রাজি নই।হরেন সামনেই একগলির দিকে ঢোকে।
গোপাল কাঁদোকাঁদো মুখে বলে,"আজ না ফিরলে আর কি ওবাড়িতে ঢুকতে পারবো?"
-- বি এ ম্যান।তুই এতো ভিতু কেন? রোজগেরে পুরুষমানুষ হয়ে কোথায় বৌকে তাঁবে রাখবি,তা নয়,বৌয়ের ভয়েই আধমরা।আজকেই নতুন করে বাঁচা শুরু কর,চল আমার সাথে।হরেন গোপালের হাত ধরে টানে। গোপাল হরেনকে বলতে পারেনা,সুহাসিনী রেগে গেলে চড়-থাপ্পড়ও তোলে,একবার তো গোপাল ভির্মি খেয়ে গিয়েছিল,সেই থেকে কথা কাটাকাটি হলে দূরেদূরে থাকে।
--- ফোন এলে?গোপাল কিন্তু কিন্তু করে।
-- আমি ম্যানেজ করবো,তুই তোর ফোন সুইচ অফ করে দে।আমার ফোন নাম্বার তো বৌদির কাছে আছে,তোকে না পেলে নির্ঘাৎ আমাকেই করবে,তখন আমি যা বলার বলবো।
সন্ধ্যে সাতটায় সুরমার বাড়িতে আয়েস করে চা সহযোগে চপ-মুড়ি খাচ্ছে,তখনই হরেনের ফোন বেজে উঠলো,ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে ফোন অন করলো,"হ্যা,বলুন বৌদি।শুভ বিবাহবার্ষিকী।একা অতো মালপত্র নিয়ে এই ঝড়জলের মধ্যে গোপাল বাড়ি পৌঁছে গেলো?"
ওদিক থেকে সুহাসিনীর গলা ভেসে আসে,"তোমার বন্ধু এখনো আসেনি,ও কখন বেড়িয়েছে বলতে পারবে?"
--দুজনে একসাথেই বেড়িয়েছিলাম,কোমরজল দেখে আমি একজনের বাড়িতে আটকে গিয়েছি। কিন্তু গোপালের তো এতোক্ষণে পৌঁছে যাওয়ার কথা।তাহলে কি কোন দুর্ঘটনা হলো?আচ্ছা আমি দেখছি,খবর পেলেই জানাবো।
ফোন বন্ধ করে হরেন গোপালের দিকে চোখ নাচায়,"মাঝেমধ্যে একটু গা-ঢাকা দিতে হয়।বিয়ের আগে তোর কি সুন্দর চকচকে চেহারা ছিল, এখন একদম ডিসপেপসিয়ার রুগীর মতো লাগে।"
রাত ন'টা নাগাদ বৃষ্টি থামলে ভেজা প্যান্ট পড়ে জামা ব্যাগে নিয়ে দুজনে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়োয়।
ট্রেনে ঊঠে জামা মেলে দেয়,স্টেশনে নেমে হরেন বলে,"খেয়েই বাড়ি ঢুকি,তুই বরং এগিয়ে যা।বৌদিকে একটা ফোন করে দি।"
--- হ্যালো,বউদি,গোপালের খোঁজ পেয়েছি,কাঁধের ব্যাগ,জিনিসপত্র সব জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে।ফোনটা প্যান্টের পকেটে ছিল বলে হারায়নি।দু:খে শোকে ট্রেনে মাথা দিতে যাচ্ছিল,মন ভেঙে গিয়েছে।
--কিন্তু এদিকে তো তেমন বৃষ্টি হয়নি।
-- ওইজন্যই তো এদিকে বেশি বেশি হয়েছে।যাকগে এবার রাখছি।
ফোন রেখেই গোপালের কাঁধের ব্যাগ টেনে নিয়ে রাস্তা থেকে একখাবলা ভিজেমাটি গোপালের শার্টপ্যান্টে মাখিয়ে দিলো,খানিক গায়ে-মুখেও মাখিয়ে দিলো,"যা,এবার করুণ মুখে গোয়ালে ফিরে যা।"
রাত এগারোটায় দরজায় বেল টিপতেই ভেতর থেকে শ্বশুরের গলার আওয়াজ এলো,"কে?"
পরক্ষণেই সুহাসিনীর গলা পাওয়া গেলো,"খুলোনা,চারপাশে চোরছ্যাঁচড় ভর্তি।আগে আইহোল।দিয়ে দেখি।"
গতিক সুবিধের নয় বুঝেই গোপাল যথাসম্ভব জোরে বলে ওঠে,"আমি গোপাল।"
দরজা খুলে যায়,"ওমা,তুমি,এতো রাত্তিরে!"শাশুড়ির কথা শুনে গা কিড়মিড় করে,যেন বাড়ির মালিক নয়,চোরই ঢুকেছে!
ড্রইংরুমে ওয়াল টিভির সামনে সুহাসিনী বসে আছে,কিন্তু গলায় ওটা কি?ঝকঝকে নেকলেস!!
গোপাল কিছু না বলে বাথরুমে যায়,ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংরুমের টেবিলে বসতেই সুহাসিনী এগিয়ে আসে,"আমাদের তো খাওয়া হয়ে গিয়েছে, হরেন তোমার খবর দিতে না পারায় এখান থেকেই অর্ডার দিয়ে ইলিশ- বিরিয়ানি, বাটারপনির, রসগোল্লা আর চকোলেট আইসক্রিম আনিয়ে খেয়ে নিয়েছি। ক'টা রসগোল্লা আছে,মুড়ি দিয়ে খেয়ে নাও।" সুহাসিনী নিজের ঘরে যায়।
শাশুড়ি জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,"মেয়ের নেকলেসের শখ ওর বাবাই মিটিয়েছে,প্রথম ইনস্টলমেন্টের টাকা উনিই দিয়েছেন,বাকিগুলো তুমি মিটিয়ে দিও।একমাত্র মেয়েটাকে জলে ফেলে দিয়েছি।"
জলে কে যে পড়েছে গোপাল তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।
টুয়া অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে,শ্বশুর-শাশুড়িও তার ঘরে শুতে চলে গেলো।যাওয়ার আগে সব আলো নিভিয়ে দিলো,শুধু ডাইনিংরুমে হালকা আলো জ্বেলে একবাটি শুকনো মুড়ি আর দুটো রসগোল্লা নিয়ে গোপাল চিবোতে লাগলো।(প্রকাশিত)
