Subhasish Paul

Horror Tragedy

3  

Subhasish Paul

Horror Tragedy

“রাত বারোটার ফোন "

“রাত বারোটার ফোন "

6 mins
579



যখন জ্ঞান ফিরলো, অমিত তখন নার্সিং হোম এর বেড এ শুয়ে । কিছুক্ষন বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে সে। চোখ মেলে একে একে সবাই কে দেখলো। বাবা , মা উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে আছেন । ঠাকুমা বসে আছেন পাশে। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন অমিতের মাথায়। অমিত একটু উঠে বসার চেষ্টা করলো । পিঠে বালিশ দিয়ে ঠেস দিয়ে বসলো একটু। অখণ্ড নীরবতা।


' এখন কেমন লাগছে দাদুভাই?' ঠাকুমা জিজ্ঞেস করলেন তাকে ।

একটু ম্লান হেসে অমিত বললো ' ভালো আছি ঠাম্মি।'

এতক্ষন জমাট মেঘের মতো কান্না চেপে চুপ করে ছিলেন তার মা। আর বাঁধ মানলো না। অঝোর নয়নে দু চোখ দিয়ে ঝরে পড়লো অশ্রুধারা । অমিতের বাবা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।


' ইয়ং ম্যান, হাউ আর ইউ ফিলিং নাউ?' ডাক্তার বাবু এলেন রুম এ। হাসি মুখে ' কেমন বোধ হচ্ছে এখন ? '

'অনেক সুস্থ বোধ করছি' হাসি মুখে জবাব দিলো অমিত।

' তোমায় ছুটি দিয়ে দিচ্ছি। তুমি বাড়ি চলে যাবে। বাড়িতে রেস্ট করো, কেমন?' ডাক্তার বাবু প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে এই কথা গুলি বললেন তাকে।

 

' ডাক্তার বাবু, চিন্তার কিছু কারণ নেই তো ? ' বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

 ' না না নাথিং টু বি ওরিড এবাউট। ইট ইস মোর এবাউট মেন্টাল সেটব্যাক দ্যান ক্লিনিকাল ডিসঅর্ডার। একটু রেস্ট এ থাকতে হবে। হাঁ, কিছুদিন একা থাকতে দেবেন না একেবারেই। কেউ যেন সবসময় সঙ্গে থাকে।' সিস্টার কে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ডাক্তার বাবু বেরিয়ে গেলেন।


বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। ভালো করে স্নান করলো সে। শরীর এ ক্লান্তি জড়িয়ে আছে। খেতে পারলো না ভালো করে। বিছানায় আরাম করে গা এলিয়ে দিলো। হালকা করে ফ্যান চলছে মাথার উপর। চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করলো সে। মা এসে শুয়েছেন পাশে। কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারলো না । চোখ বন্ধ করলেই কালকের বিভীষিকাময় রাত টা ভেসে উঠছে চোখের উপর। কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না সে।


মাধ্যমিক পরীক্ষা আর এক মাস ও বাকি নেই। অমিত বরাবরই মেধাবী ছাত্র । বড়ো হয়ে ডাক্তার হতে চায় সে। পড়াশুনা তে ফাঁকি দেয়নি সে কোনোদিন। কোনোদিন পড়ার কথা বলতে হয়নি তাকে । বাবা মা এর ও অমিতের প্রতি ভরসা আছে খুব।

জানুয়ারির মাঝামাঝি। এবার কলকাতায় ঠান্ডা পড়েছে খুব। একটু রাত বাড়লেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। লোকজন , গাড়িঘোড়া চলাচল কমে যায়। সন্ধ্যের ব্যস্ত সাদার্ন এভিনিউ রাত দশটা বাজলেই একবারে সুনসান । রাতের খাবার খেয়ে অমিত অঙ্ক নিয়ে বসলো। বাবা-মা পাশের রুম এ শুতে চলে গেল। ঠাকুমা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত এগারোটা ।

জিওমেট্রি নিয়ে বসেছে সে। চারিদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে লেকের ভেতর থেকে কোন অজানা পাখির ডাক সেই নিস্তব্ধতা কে খান খান করে দিচ্ছে। দরজা জানালা সব বন্ধ। তাই ক্ষীণ সে ডাক রুমের মধ্যে এসে পড়ছে। পড়াশুনাতে মন দিলো অমিত।


হটাৎ করে টেলিফোন টা বেজে উঠলো। একবার বেজেই বন্ধ হয়ে গেল। অমিত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত পৌনে বারোটা । কান খাড়া করে থাকলো কিছুক্ষন । না, আর বাজেনি ফোনটা । হয়তো কেউ ভুল করে করে ফেলেছিলো। আবার মন দিলো সে অংকে। দশ মিনিট পর আবার বেজে উঠলো ফোন টা। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে বেজেই চলেছে। অমিত অবাক হলো। এত রাতে আবার কে ফোন করছে। তাড়াতাড়ি উঠেগিয়ে ধরলো ফোনটা। বাবা-মা ও উঠে এসেছে পাশের ঘর থেকে।

'হ্যাল্লো অমিত? আমি অভীক বলছি' উত্যেজনাতে অভীকের গলা টা কেঁপে উঠছে ।

' হাঁ অমিত বলছি, এত রাতে কেন ফোন করছিস?'

' তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়, আমার বাবা-মার গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে।' একটা চাপা বেদনা, একটা অসহায়তা ঝরে পড়ছে অভীকের গলায়।

'কোথায় এক্সিডেন্ট হয়েছে?' জানতে ছিলো অমিত।             

'বন্ডেল গেটে, ট্রেন র সাথে ধাক্কা লেগেছে' বলেই ফোন টা ছেড়ে দিলো অভীক।

অভীক অমিতের সব থেকে প্রিয় বন্ধু। সেই কোন ছূটোবেলা থেকে একসাথে পড়াশুনা করে। দুজন দুজনের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত।

কি করবে বুঝতে পারছেনা অমিত। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রিসীভর টাও রাখতে ভুলে গ্যাছে। 

' কার কি হয়েছে? ' বাবা এগিয়ে এই জিজ্ঞেস করলো ।

' অভীকের ফোন ছিল। ওর বা-মার গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়ে গ্যাছে । আমায় যেতে বলছে । কি করবো বুঝতে পারছিনা ।' অমিত বললো 

'যেতে তো হবেই' অভয় দিলো বাবা ' চল তৈরী হয়ে নে, আমরা গাড়ি নিয়ে যাবো এখুনি' বাবা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। ডোরবেল টা বেজে উঠলো তখনি। অমিত অবাক হয়ে গেল। কে হতে পারে এতো রাত এ 

' অমিত দরজা খোল, আমি অভীক।' অমিত তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিলো।

' কেন যাস নি এখন ও ? কখন ফোন করেছিলাম।' অভীক হাপাচ্ছে। একরাশ ক্ষোভ , অভিমান ঝরে পড়ছে তার চোখে মুখে। অদ্ভূত শুন্যতা তার চোখে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এই শীতের রাত ও। অমিত ভাবছি এতো তাড়াতাড়ি অভীক এলো কিভাবে ।

' চল আমরা বেরিয়ে পড়ি, দেরি করা ঠিক হবে না' অমিতের বাবা তাড়া দিলো। নিচে নেমে গাড়ি স্টার্ট করলো । বোল্ডেল গেটে পৌঁছতে সময় লাগলো দশ মিনিট। গাড়িটাকে একপাশে পার্ক করে সবাই নেমে পড়লো। অভীক একপ্রকার টানতে টানতে অমিত কে নিয়ে গেল গাড়িটার দিকে। ট্রেনের ধাক্কায় কার টা একেবারে দুমড়ে মুজড়ে গেছে। এত রাতে ও দু চার জন মানুষের ভিড় গাড়িটাকে ঘিরে । কিন্তু কেউ সাহস করছেনা গাড়িটাকে ছুঁতে। ওরা গাড়ির কাছে গেল। অসহনীয় । দেখা যায়না এই দৃশ্য । আলো-আধারিতে ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা কিছুই। কোনোমতে একটা দরজা খুলে ফেললো অভীক। রক্তে মাখামাখি কিছু দেহ । চেনা যাচ্ছেনা কাউকেই ঠিক করে।

'আমি পায়ের দিকটা ধরছি, তুই মাথার দিকটা ধর, নিয়ে যাবো ওই পাশে।' বলেই অভীক পায়ের দিক এ চলে গেল। অমিত মাথাটা ধরলো । বাবা সাহায্য করছেন অভীক কে । ওরা দ্রুত রক্তাক্ত শরীরটাকে রেল লাইনের পাশে নিয়ে যেতে চাইছে। জীবিত না মৃত তাও বুঝতে পারছেনা। একটা ঘোরের মধ্যে ছুটে চলেছে ওরা । ঠিক সেই সময় পাশের লাইন দিয়ে একটা ট্রেন আসছে হু হু করে। হেডলাইট টা এসে পড়ছে ওদের উপর। এই প্রথম দেহ টাকে স্পষ্ট  করে দেখার সুযোগ

পেলো অমিত। ভয়ে ভয়ে দেখলো একবার বয়ে নিয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে। দেখেই গায়ের রক্ত সব শীতল হয়ে গেল। যেন পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মাথাটা ঘুরে গেল অমিতের, দেখলো সে এবং অভীক যাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা সয়ং অভীকের মৃতদেহ। অমিত দেখলো অভীক এক অদ্ভুত ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অমিতের দিকে। কি ভীষণ ক্ষোভ , আগ্রাসন ,লোলুপতা সেই দৃষ্টিতে। দেহটা পড়ে গেল হাত থেকে। অমিত ও প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। ওর বাবা এসে ধরে ফেললেন ওকে । তারপর আর কিছু মনে নেই অমিতের। জ্ঞান ফেরে সেই নার্সিং হোম এ।


ঘুমোতে পারেনি অমিত। উঠে বসলো বিছানায়। ' কি হয়েছে বাবা?' উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করলো মা।

' ভুলতে পারছি না, কিছুতেই ভুলতে পারছেনা।' ফুঁপিয়ে উঠলো অমিত ' মেনে নিতে পারছিনা অভীকের চলে যাওয়াটা, কালকের রাতের ঘটনাটা, চোখ বন্ধ করলেই সব চোখের সামনে ভেসে উঠছে ' দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকলো অমিত।

বাবা , ঠাকুমাকে ডাকলেন ওর মা। তাড়াতাড়ি সবাই এলেন অমিতের রুম এ। সবাই ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন , সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। অমিত ঠাকুমার অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। ঠাকুমা বুকে জড়িয়ে ধরে অমিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন । তারপর ধীরে ধীরে বললেন 

'শোনো দাদুভাই, তোমায় একটা কথা বলি। কাল তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে। ভগবান তোমায় নবজন্ম দিয়েছেন। না হলে আজ তোমায় আমরা ফিরে পেতাম না ।' ঠাকুমা একটু চুপ করলেন । একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তারপর আবার ঠাকুমা অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বলে চললেন ' জানো দাদুভাই, মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই বড়ো অদ্ভুত। সব উপরওয়ালার লিখন। কোনোটাই আমাদের হাতে নেই। অভীকের জন্য তোমার কষ্ট হওয়াটা খুব স্বভাবিক। কিন্তু ওটা ওর কপালের লিখন। মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা যখন এক দেহ ছেড়ে চলে যায়, সে তখনি কোনো একজন প্রিয় মানুষ কে তার দোসর হিসেবে নিয়ে যায়। তোমার বন্ধু অভীক ও তোমায় সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তোমায় পরমায়ু ছিল, তাই তুমি বেঁচে গিয়েছো। ভগবান তোমায় বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তুমি যদি ঠিক সময়ে অভীকের দেহটা ফেলে না দিতে, তুমিও ওই ট্রেন এ কাটা পড়তে।' ঠাকুমা চুপ করলেন ।

সারা বাড়িটা একটা নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। অমিতের মা ফুপিয়ে উঠলেন । বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে । লেকের সে পাখিটা আবার ডেকে উঠলো একবার।অমিত ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরলো। শান্তির সন্ধানে।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror