Subhasish Paul

Tragedy Fantasy Others

3  

Subhasish Paul

Tragedy Fantasy Others

"অতিরিক্ত"

"অতিরিক্ত"

3 mins
359



আর দাঁড়াতে পারিনি ওখানে । এক প্রকার পালিয়ে এলাম। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়য়ের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত চোখে আর সইতে পারলাম না। পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেলো। অন্তরে অন্তরে রক্তক্ষরণ। ওনার শেষের সে কথাগুলো চাবুকের মতো বিবেকের উপর এসে পড়ছিল। " আমি যে কথা বলতে পারিনা ঠিক করে, তাইতো তিন তিনজন ছেলের মা হয়েও , আজ আমায় ভিক্ষা করে খেতে হয়।"


প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় অফিস ফেরত এসে নামি 'মিরারোড' স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে। জনঅরণ্যে ভিড় সামলাতে সামলাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি ফ্লাইওভার এ। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরটা কোনোমতে বয়ে নিয়ে আসি। তারপর স্কাই ওয়াক এ হেঁটে সোজা অটোস্ট্যান্ড এ। অটো ধরে বাড়ি ফেরা। এই আমার রোজ নামচা। মিরারোড স্টেশনে র ফ্লাইওভার, প্লাটফর্মে এ অজস্র ভিখারি। ' বাবু কিছু দিয়ে যান ' , ' আল্লা আপনার ভালো করবেন,' শুনতে শুনতে চলে আসি প্রতিদিন। কখনো কাউকে কিছু দেই, আবার কোনোদিন কিছু না। 


এদের মাঝে একজন ছিলেন একটু ব্যতিক্রমী। বয়স্ক মহিলা, সাদা কাপড় পরিহিতা। মাথায় হালকা করে ঘোমটা টানা। গায়ের রং বেশ ফর্সা। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা। বয়েস আন্দাজ ৬৫/৭০। বয়েসের ভাৱে মুখের চামড়া একটু কুঁচকে গেলেও বেশ একটা আভিজাত্য আছে চেহারায়। দেখলে সম্ভ্রম হয়। ভাবলেশহীন নির্লিপ্ত চোখ। দুই হাতে আঁচল খানি সামনের দিকে খানিকটা পাতা। ১ এবং ২ নম্বর ফ্লাটফর্মের ঠিক উপরে ফ্লাইওভার এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। আধবোজা নির্লিপ্ত চোখ মাটির দিকে। কোনোদিন কাউকে কিছু চাইতেন না। কোনোদিন ওঁনার গলার আওয়াজ শুনিনি। এমনকি স্পষ্ট করে কারো মুখের দিকে চাইতেন ও না। অন্য সকলের থেকে সতন্ত্র। দেখলেই কেমন একটা মায়া হয়। কেউ কিছু দিলে শুধু একবার চোখ তুলে তাকান।


বেশ মনে আছে, প্রথমদিন ৫ টাকা দিয়েছিলাম। তারপর কোনোদিন ১০ , কোনোদিন কুড়ি , কোনোদিন না গুনেই যত খুচরো থাকতো পকেটে সব। একদিন আমি পঞ্চাশ টাকা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম অফিসের রাস্তায়। ফেরার পথে ওনাকে দিয়েছিলাম। সেই প্রথম আমার মুখের দিকে স্পষ্ট করে তাকালেন। এতো টাকা সাধারণত পাইনা একসাথে। কিছুদিন এভাবে চলছিল। কেমন একটা অভ্যেস হয়ে গেছিলো। প্রতিদিন ফেরার পথে কিছু দেয়া। উনি ও আমাকে চিনে রাখতেন। জানিনা আমার অপেক্ষা করতেন কিনা। কিন্তু মুখ দেখে মনে হতো খুশি হতেন, কোনোদিন কোন কথা হয়নি আমাদের।


তারপর কিছুদিন ওনাকে আর দেখিনি ওখানে। প্রথমদিন ভাবলাম হয়তো বা আজ কোনো কারণে আসেননি। তারপর বেশ কিছুদিন আর দেখিন। মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি হলো । উনি কি অসুস্থ ? অনেক বয়েস হয়েছিল। বেঁচে যাচ্ছেন তো উনি ? বুকের ভেতরটা কেমন শুন্য মনে হতো যখন ওই জায়গাটা দিয়ে রোজ পার হতাম।


তারপর সময়ের স্রোতে আমি ও আর তেমন করে মনে রাখিনি। প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। সেই প্রতিদিন স্কাই ওয়াক এ করে অটোস্ট্যান্ড , বাড়ি। এমনি করে প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। হটাৎ করে একদিন আমি স্কাই ওয়াক এ না গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম ৪ নম্বর প্লাটফর্মে। সিঁড়ি দিয়ে নামছি , দেখলাম সিঁড়ির ঠিক নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন উনি। এক ভঙ্গিমাতে। মনের মাঝে একটা খুশির স্রোত বয়ে গেলো। আরো একটু নিচে নামতেই চোখ পড়লো চোখে। বুঝলাম , উনিও চিনতে পেরেছেন আমাকে। পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করলাম। অনেকদিন পর দেখা , কত দেয়া যায় ভাবছি। দাঁড়ালাম মুখোমুখি। আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো ' কোথায় ছিলেন এতদিন ? আপনি ওপরে ফ্লাইওভার এ থাকেন না আর ?'


একটু যেন কিছু ভাবলেন বলবেন কি বলবেন না দ্বিধান্বিত। তারপর মুখ খুললেন । এই প্রথম ওঁনার কথা শুনলাম। শুন্য দৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন ' মাঝে খুব শরীর খারাপ হয়ে গেছিলো। তাছাড়া আমাকে র উপরে দাঁড়াতে দেয়না ওরা। 


একটু অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম , 'কারা দাঁড়াতে দেয় না ?, কেন দাঁড়াতে দেয়না ?'

একটু চুপ করে রইলেন। দৃষ্টি মাটির পানে। আমি তাকিয়ে রয়েছি ওঁনার মুখের দিকে। তারপর খুব নিচুস্বরে বললেন ' আমি যে চাহিদামতো ভিক্ষার ভাগ দিতে পারিনা ওদের। আমি তো কোনদিন ঠিক করে কথা বলতে পারিনি, নিজের অধিকারটুকুও স্নেহ , মায়ায় বিসর্জন দিয়েছি। তাই তো তিন তিনজন ছেলের মা হয়ে ও আজ আমায় ভিক্ষা করে খেতে হয়।'

এক ঝলক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রইলেন। আমার বলার মতো আর কোনো ভাষা ছিলোনা। আমি ঘামতে শুরু করেছি। উনি যতটুকু বললেন , না বলা কথা রয়ে গেল অনেক বেশি। বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার। একটা ১০০ টাকার নোট অঞ্চলে ফেলে কোনোমতে পালিয়ে এলাম একপ্রকার।


অটো ধরিনি আর। বুকের ভেতর একরাশ রক্তক্ষরণ নিয়ে পায়ে পায়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম আমি। অজশ্র প্রশ্ন মনের মাঝে তোলপাড়। কাল বাদে পরশু আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ত্রিরঙ্গা পতাকা উঠবে চারিদিকে। মঞ্চে মঞ্চে কত কত কথার ফুলঝুরি ছুটবে। কিন্তু কবে সত্যিকারের স্বাধীনতা পাবে আমাদের মায়েরা, কবে আমরা সন্মান করতে পারবো আমাদের আগের প্রজন্মকে! কবে আমরা মুক্তি পাবো এই অমানবিক জঙ্গল রাজ্ থেকে ! একটা চাপা অপরাধবোধ চেপে রইলো মনের মাঝে। আমার বাড়ির দরজায় কলিং বেল টিপলম্। ভীষণ ক্লান্তিতে সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমিও কি দায়ী নই এর জন্য ? আমার কি কোনো দায় নেই ?



..........................


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy