Unveiling the Enchanting Journey of a 14-Year-Old & Discover Life's Secrets Through 'My Slice of Life'. Grab it NOW!!
Unveiling the Enchanting Journey of a 14-Year-Old & Discover Life's Secrets Through 'My Slice of Life'. Grab it NOW!!

Keya Chatterjee

Inspirational

4.5  

Keya Chatterjee

Inspirational

রাস্তা

রাস্তা

11 mins
974


― “চা? আর ইউ সিরিয়াস সোম? মানে ক্যাফে তো?”

― “না দাদা চা। চায়ের দোকান।”

― কি ফালতু বলছিস সোম? তুই একটা বি.কম গ্রাজুয়েট। তুই কিনা শেষে বিক্রি করবি চা! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

― আমি সিরিয়াস দাদা। আমার মতো অনেক বি. কম গ্রাজুয়েট চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ দাঁতে দাঁত চেপে সরকারি চাকরির জন্য লড়ছে। যারা পারছে না তারা প্রাইভেট সেক্টরে গিয়ে ঘাম-রক্ত নিংড়ে যৎসামান্য কিছু উপার্জন করে আনছে। 

― তাহলে ব্যবসা কর। আমি টাকা দিচ্ছি।

― এটাও তো একটা ব্যবসা দাদা।

― মা, মা।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন অশীতিপর বৃদ্ধা। তার চেহারায় দারিদ্রের ভাব স্পষ্ট না হলেও চিন্তার ছাপ প্রকট। বড়ছেলদ আর ছোটছেলের কথা তিনি পাশের ঘরে বসেই শুনেছেন। বড়ছেলে দেবেশ উচ্চশিক্ষিত ও সরকারি উচ্চপদে আসীন। ছোটছেলে সোমনাথ আবার একটু অবাধ্য কিন্তু লেখাপড়ায় রেজাল্টে দুর্দান্ত হয়েও চাকরি পাচ্ছে না প্রায় তিন বছর হলো। সহেলী দেবী দরজার ফ্রেমে এসে ছবির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। দেবেশ গর্জে উঠে বলল, “এসব খামখেয়ালিপনার জন্য আমি এক পয়সা নষ্ট করবো না, মা। ওকে বলে দিও।” দেবেশ ঘর ছেড়ে চলে গেলে সোমনাথ আলতো হেসে তাকালো মায়ের দিকে। মায়ের চোখে অসহায়তা ধ্যানমগ্ন। এর থেকে কষ্টের আর কিই বা হতে পারে? সোম মাথা নেড়ে বলল, “কোনো কাজই ছোট নয় মা। চিন্তা করো টাকার জোগাড় হয়ে যাবে।” সহেলী দেবী ততোধিক কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “কিন্তু এসব খামখেয়ালিপনার কি কোনো মানে হয় সোম? তুই তো এমন না বুঝে কাজ করিস না।” সোম উঠে দাঁড়িয়ে তেমনই শান্ত স্বরে বলল, “কে বলেছে মা, খামখেয়ালিপনা? সব দিক দেখেই তোমার ছেলে মাঠে নামছে। আসি।” সোম বেরিয়ে গেল। সহেলী দেবী বসে পড়লেন বৈঠকখানার চৌকিতে। কবে যে এই সংগ্রামের শেষ হবে তা ঈশ্বরই জানেন। ছেলেটা যে যুদ্ধে নামছে তা আদৌ সফল হবে কি না তাও জানা নেই। তবু মায়ের মন বারবার সমাজের দিকে ফিরে চায়।


    একটা মেট্রো স্টেশনের সামনে এসে দাঁড়ালো সোম। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একবার কথা বলবে। তাদের এরিয়াতেই তো দোকানটা হবে। কিছু সরঞ্জাম কিনতে হবে, একটা গুমটিও দেখতে হবে কমের মধ্যে, সাজাতে হবে। ব্যস্ত সময়ে হাজার লোকের ভিড়ে যেন মাথা ঘোরালেই চোখে পড়ে। এতকিছুর জন্য টাকা চাই। অনেক না হলেও বেশ কিছু। দাদা দেবে না বলেছে। এতদিন টিউশন থেকে বাঁচানো টাকায় কিনতে হবে। সত্যি তো একজন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরের ভাই চায়ের দোকান দেবে, কেউই তো মানতে পারেনা। কিন্তু সোম মনে প্রাণে ঠিক করে নিয়েছে সে এটাই করবে। যেভাবে ভেবেছে ঠিক সেভাবেই। অনেকের দরজায় তো ঘোরা হলো, অনেক সময়ও নষ্ট হলো। এবার সে তার মনের কথাই শুনবে। কিন্তু তারপর? হ্যাঁ তারপরটাই খুব কঠিন। ভীষণ কঠিন। হল ছাড়লে হবে না। সমাজের কথায় কান দিয়ে ভেঙে পড়লে চলবে না। 


    [ তৃষার বাড়ির পাশ থেকে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা ঢিল এসে পড়তো সোমের গায়ে। প্রত্যেকবার অব্যর্থ ভাবে মেয়েটা ঠিক পিঠের মাঝে ঢিলটা ছুঁড়ত। যাতে সোমের ব্যথা না লাগে। সোম ফিরে তাকাতো। ছোট একটা হাসি বিনিময় হতো পরস্পরের মধ্যে। ব্যাস এটুকুই সারাদিনের দেখা। মাঝে মধ্যে যখন টুকির সঙ্গে মানে খুড়তুতো বোনের সঙ্গে দেখা করতে আসতো তখন চোখে চোখে কথা হতো। এই দ্রুত জীবনে যে এতটা নিঃশব্দ প্রেমের সঞ্চার হতে পারে তা ভাবা একটু কষ্টকর হলেও, ওদের সম্পর্কটা ছিল এমনই। ওদের চোখে তবু স্বপ্ন ছিল, ঘর বাঁধার, ভবিষ্যৎ গড়ার। সোমের গ্র্যাজুয়েশনের পর তিন চার বছর কেটে গেলেও চাকরি না পাওয়া ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিতে থাকে অবসাদের মায়াজালে। হঠাৎ রেগে যাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান এমনকি ড্রাগস নেওয়াও শুরু করলো। তৃষা তখন বি.এস.সি পাস করে এম.এস.সি তে ভর্তি হয়ে গেছে। সোমের অধঃপতন নিজের চোখে দেখছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। এর থেকে বেশি কষ্টকর কি আর হতে পারে! 

   

     এক সন্ধ্যেবেলা আচমকা টান পড়লো সোমের হাতে। তাকিয়ে দেখল তৃষা। অন্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশি পরিপাটি। শাড়ি পড়েছে। দুই ভ্রুর মাঝে ছোট্ট কালো টিপ। কথা সড়লো না সোমের মুখে। তৃষাই প্রথম মুখ খুলল, “কেন সর্বনাশ করছো নিজের সোমদা?” সোম উদাসীন ভাবে বলল, “আমার আর কিছু হবে না তৃষা। আমার সব স্বপ্ন, সব প্লানিং এক্কেবারে ফিনিশ। বাই দ্য বাই, তোমায় কিন্তু বেশ লাগছে আজ।” সোম প্রশংসাসূচক হাসি হাসে। তৃষা তেমনই গম্ভীরভাবে বলে, “জানো কেন সেজেছি আজ? আমার সম্বন্ধ দেখতে এসেছিল। আজ পাকা কথা হলো। আমি অনেকদিন আটকে রেখেছিলাম সোমদা। কিন্তু আর কতদিন? কোন গ্রাউন্ডে লড়াই করতাম বলতো?” সোম একবার আকাশের দিকে তাকালো, হয়তো চোখের জল আটকাতে, অথবা হয়তো ঈশ্বরের কাছে শুষ্ক চোখে একফোঁটা জলের প্রার্থনায়। “তুমি আর নেশা করো না সোমদা প্লিজ। যত টাকা তুমি এই নেশায় ওড়াচ্ছ ততো টাকায় তুমি একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেবে। তুমি একটা শিক্ষিত ছেলে, ভেবে দেখো প্লিজ।” সোমনাথ তেমনই চুপ করে রইল। পরিস্থিতি সবসময় মুখে উত্তর জুগিয়ে দেয়না। সব পরিস্থিতিতে উত্তর দেওয়ায় যায়না। তৃষা যাওয়ার আগে আবার ফিরে তাকালো, বলল, “কথাটা ভেবে দেখো। আমার মাথার দিব্যি রইল কিন্তু।”]


                 ২

ছেড়ে দাও বললেই ছাড়া যায়? ভাবো বললেই ভাবা যায়? বুঝতে পারছো না তৃষা কতো বাধার সম্মুখীন সোম? দেখতে পারছো না ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? একটা চাকরি, একটা সুস্থ জীবন পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলছে সোম। ইতিমধ্যে একটা টিউশন বাড়ি থেকে একটা এলার্ম ক্লক চুরি করেছে। এসব নেশাড়ুদের ধাতই এমন। মান-সম্মান, ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু খুঁজতে থাকে টাকা জোগাড় করার নতুন উপায়। কোথায়, কি করছে কোনো হুঁশ থাকেনা। যখন নেশা করে না তখন অন্য মানুষ, আর নেশা চড়লেই অন্য মানুষ। তৃষা বেশ কয়েকবার বুঝিয়েও পারলো না সোমকে ফেরাতে। এক সন্ধ্যায় সোম সহ আরো চারজনকে এরেস্ট করলো পুলিশ। ওদের নিয়ে বেশ কয়েক জায়গায় রেডও করলো। সৌভাগ্যবশত সোমের বিরুদ্ধে ড্রাগ পাচারের কোনো মামলা আনতে পারলো না ওরা, যথাযথ প্রমাণের অভাবে। কয়েক সপ্তাহ পরেই সোম ছাড়া পেলো। ত্রস্ত-বিধ্বস্ত একটি মানুষ। যে প্রায় সব হারানোর খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এক পা এগোলেই অতল গভীরে তলিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফিরে আসার পথ নেই। সোম বাড়ি ফিরল। কিন্তু এ বাড়ি, বাড়ির মানুষ যেন তার কতো অপরিচিত, কতো দূরের। ধীরে ধীরে নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো সোম। বাড়িতে মন বসছে না, কাজে ধৈর্য থাকছে না, ড্রাগ কেনার পয়সা নেই হাতে, অথচ জিনিষটা একবার শরীরে না ঢুকলে শরীর খারাপ করছে, বমি ভাব, মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। সোম বুঝতে পারলো এই চক্র থেকে বেরোতে হবে নিজেকেই। অনেক মানুষ এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে, নিজের মনোবল আর জেদের জন্য, তাহলে সে কেন নয়। সোম নিজেই ভর্তি হলো একটি নেশা মুক্তি কেন্দ্রে। এদের সারাদিনে অলস মস্তিস্কের অবসর নেই। সকাল থেকে রাত অবধি প্রত্যেকটি মুহূর্ত রুটিনে বাধা। সোম ধীরে ধীরে চিকিৎসায় সারা দিল। বহু মানুষের যে ব্যাধি দু-তিন বছরেও পুরোপুরি কমে না, সেই ব্যাধি সোম সারিয়ে ফেলল দুই মাসের মাথায়।


     বাড়ি ফিরলো সেই স্বাভাবিক সোমনাথ। যার চোখ সবসময়ই স্বপ্নালু ছিল। কিন্তু এবারের স্বপ্নটা যেন অন্যরকম। নেশা মুক্তি কেন্দ্রে বিনয় মানে সোমের দাদার প্রচুর খরচ হওয়ায় সে ভাইয়ের এই নতুন ক্ষেপামিতে সায় না দিয়ে বেরিয়ে গেল। সোম হাঁটতে হাঁটতে এলো তৃষার বাড়ির সামনে। আজ সেই ঢিল ছোঁড়া মেয়েটা নেই। জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেনা শ্যামলা একটা মেয়ে যার চাপা হাসিতে লুকিয়ে থাকতো প্রেমে পড়ার প্রশ্রয়। মেয়েটির মাসখানেক হলো বিয়ে হয়ে গেছে। সোমনাথের বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা দলা পাকালো। মনে মনে বলল, “ভালো থেকো। আমার মতো বাউন্ডুলে, অপদার্থ তোমায় ধরে রাখতে পারতো না।” সোম জানে সেদিন পুলিশে খবর দিয়েছিল তৃষা। সত্যিই তো আর কতদিন সহ্য করা যেত মেয়েটার পক্ষে। কতো ভাবেই না চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সোম তখন উন্মাদ, উন্মত্ত। কারুর কোনো কথা কানে ঢুকতো না। তৃষার বাড়ি পিছনে ফেলে সোম পা বাড়ালো বাড়ির পথে। কাল থেকে নতুন যুদ্ধ শুরু।


              ৩

স্টেশনের গেটের কাছেই একফালি জায়গায় স্টলটি বসিয়েছে সোম। অনেকগুলি সুদৃশ্য ভাঁড় দিয়ে সাজানো স্টলটির একদিকে ঝোলানো একটি মেনুকার্ড। নানা ধরণের চা ও কফির নামের পাশে তার দাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো, দু-একজন পথচারী এসে চা খেয়ে গেলেও তারা স্টলের অভিনবত্ব বুঝতে পারলো না। যদিও প্রথমদিনের নিরিখে খুব আশা করেনি সোম। আজ শনিবার, অফিস যাত্রীর সংখ্যা একটু হলেও কম। পরেরদিনও তাই। কিন্তু বদল ঘটলো সোমবার। একদল কলেজ পড়ুয়া এসে জড়ো হলো দোকানের সামনে। মেনুকার্ড দেখে একে একে অর্ডার দিলো চকোলেট চা, জেমস চা, মালাই চা, কেশর চা। প্রথম চুমুকেই তাদের চমক লেগে গেল। “বাহ, এতো দারুন বানিয়েছেন দাদা।” বলল একজন। সোম সলজ্জ হাসি হেসে ধন্যবাদ জানালো। বেশ কয়েকজন ছবি তুলে নিয়ে গেলো সোম সহ স্টলের। সোমের মনে সাহস এলো। হয়তো ভুল পথে পা বাড়ায়নি সে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সাফল্য আসবে। 

 রাতে বাড়ি ফিরে ফেসবুক খুলতেই কিছু ছবি ভেসে উঠলো স্ক্রিনে। দুপুরে সেই কলেজ পড়ুয়াদের তোলা ছবি। পর পর নিজেকে ট্যাগ করলো সোম। ধীরে ধীরে জমতে লাগলো লাইক ও কমেন্টের ভিড়। ”এগিয়ে যাও”, “খুব ভালো” ইত্যাদি। বহুদিন পর নিশ্চিন্তের ঘুম এসে জমলো সোমের চোখে। কতদিন, কতদিন ঘুমায়নি সে। কতো বিনিদ্র রাত কেটেছে দুশ্চিন্তায়, দুর্ভাবনায়, কষ্টে, অপমানের স্মৃতি নিয়ে। “ফিরে আসা যায় সোম, ফিরে এসো, ভেবে দেখো।” তৃষার কথাগুলি স্বপ্নে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। আজ ঘুম ভাঙার নয়। এই ঘুম নতুন সকাল দেখার।


   “ছোড়দা আসবো?” টুয়ার ডাকে ঘুম ভাঙলো সোমের। অনেকদিন পর টুয়ার সাথে দেখা হলো। বেশ কয়েক মাস পর। ছোড়দা নেশা করছে জানার পর আর কাছে ঘেঁষেনি টুয়া। হয়তো কাকু-কাকিমার নিষেধ ছিল। হয়তো নিজেই ঘেন্নায় সরে গেছিল। সোমনাথ উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ রে আয়। বল কিছু বলবি?” টুয়া সেই আগের মতোই উচ্ছাস নিয়ে বিছানায় এসে বসলো। বলল, “তোর মোবাইলটা দে তো।” সোম অবাক হয়ে জানতে চাইল কেন। টুয়া বিনা বাক্যব্যয়ে ছিনিয়ে নিল ফোনটা। তারপর ফেসবুক খুলে একটা পেজ বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করল, “তোর দোকানের নাম কি দিলি?” সোম এবার একটু ভাবলো। নাম? নাম তো ঠিক করা হয়নি। দাদার এমন ভ্যাবলা মুখ দেখে টুয়া হাসি চেপে বলল, “বোঝা গেছে। বোঝা গেছে। দাঁড়া আমিই নাম দিচ্ছি।” তারপর টাইপ করলো, “আড্ডাখানা”। নামটা পছন্দ হলো সোমের। সত্যিই তো, কতো কতো বছর ধরে কলকাতার বুকে একমাত্র নির্ভেজাল আড্ডা শুধু চায়ের দোকানেই হয়। টুয়া পা বাড়ালো। ও এখন ইউনিভার্সিটিতে যাবে। সোমের ডাকে থমকালো, “কিছু বলবি রে? ও একটা কথা আমার একটা বন্ধু খুব ভালো ফটোগ্রাফি করে। ও এসে কটা ছবি তুলে দেবে। ওগুলো পেজে আপলোড করিস কিন্তু। মোবাইলের পাতি ছবিতে চলবে না।” সোমকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, “কি রে বল?”

 “পুরো আইডিয়াটা কার টুয়া?” সোমের প্রশ্নে একটু থমকালো তারপর কেটে কেটে বলল, “আইডিয়া, নাম সবকিছু, তুই যার কথা ভাবছিস তার । আসি।” টুয়া চলে গেল। সোমের বুকে ধীরে ধীরে ফিরে এলো সেই চিনচিনে ব্যথা। তৃষা। সামনে না থেকেও পাশে আছে। কতদিন জানা নেই। ঝাপসা চোখ মুছে উঠে বসলো সে। বেরোতে হবে। অনেক কিছু করতে হবে।


            ৪

 পেজের ব্যাপারটা বেশ ক্লিক করে গেল। কিছুদিনের ভিতরেই হাজার খানেক লাইক। দোকানে ভিড়ও জমছে ধীরে ধীরে। পাড়ার ভোম্বলকে একদিন সঙ্গে নিতে হয়েছিল। ওকে বরাবরের মতো রেখে দেবে ভাবলো সোম।

            

   “আপনার দোকান নিয়ে নাকি স্টোরি করা যাবে? একটু বলুন তো কি স্টোরি আপনার?” সিগারেট শেষ করে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বললেন একজন ভদ্রলোক। বয়স ওই ত্রিশের মধ্যেই, পিঠে একটা কালো ব্যাগ, তার ভারে লোকটা একটু পিছন দিকে হেলে গেছে। চোখে হাল ফ্যাশনের চশমা, চেহারা বেশ ঝকঝকে। সোমকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “আরে মশাই, সাংবাদিক। এই দেখুন কার্ড। আপনার ফোকান কিন্তু বেশ নাম করেছে। আমার বৌও আপনার পেজে লাইক ঠুকেছে। বলছে চা খেতে আসবে। তাই আগেভাগে আমি এলাম দেখতে। তা বলুন। টাকা-পয়সা নেবো না। একদম ১০০% সততা।” এক নাগাড়ে বলে লোকটা একটু দম নিলো। সোম হেসে এগিয়ে দিলো এক ভাঁড় মালাই চা।

   তিনদিন পর টুয়া সকালের কাগজ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো সোমের বিছানার উপর। লোকটা কথা রেখেছে। একটা নামী খবরের কাগজের মাঝামাঝি পেজে বেশ বড় করেই ছেপেছে দোকান সহ সোমের ছবি। হেডলাইন “আলোয় ফেরা।” মানিব্যাগ হাতড়ে ভদ্রলোকের কার্ডটা বের করলো সে । প্রিয়াংশু সেন। একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য ভদ্রলোকের। ফোনটা একবার রিং হয়ে কেটে। দ্বিতীয়বার ফোনটা তুলল একজন মহিলা, যার কণ্ঠস্বর শুনে বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো সোমের। নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো, “প্রিয়াংশু বাবু আছেন? আমি সোমনাথ লাহিড়ী বলছি।” ওপাশের মানুষটাও যেন কিছুক্ষন স্তব্ধ থাকলো তারপর ছোট্ট একটা “হুম” বলে এগিয়ে দিল ফোন প্রিয়াংশুর হাতে। ফোন হাতে পেয়েই স্বভাবসিদ্ধ উচ্চকিত কণ্ঠে প্রিয়াংশু বলে উঠলো, “কি ব্রাদার! বলেছিলাম তো, ১০০% সৎ সাংবাদিকতা, নো স্তাবকতা।” সোম একগাল হেসে কথা শুরু করলো। এরকম মানুষের সাথে একবার দেখা হলেই সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। জড়তা আসেনা। 


         ৫

সকাল সকাল বাজারে বেরিয়েই খবরটা কানে এলো সোমের। মৈত্র কাকু হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন, “কি সোমনাথ, কেমন চলছে ব্যবসা?” এইসব লোককে একদম সহ্য হয়না সোমের। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া যেচে কথা বলার লোকই নয়। তবু সৌজন্য মূলক হাসি হেসে বলে, “এই চলছে কাকু। আপনারা ভালো আছেন তো?” মৈত্র বাবু ঘাড় নেড়ে জানান ভালো আছেন। সোম যেতে উদ্যত হলে আবার ডেকে বলেন, “তা খবরের কাগজে তো বেশ নাম টাম উঠছে দেখছি। তুমি চা-ই বিক্রি করো তো বাবা?” সোম অন্য কিছুর গন্ধ পেলো প্রশ্নে। জিজ্ঞেস করলো, “কেন বলুন তো? কি পড়েছেন কাগজে?” মৈত্র বাবু এগিয়ে দিলেন তার হাতের কাগজে। তার এক কোণে একটি কলামে “আড্ডাখানা”র নাম নিয়ে লেখা, এই কয়েকদিন এতো রমরমায় সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। ড্রাগসের নেশাড়ু চায়ের নামে কি বিক্রি করছেন? 

 বাজ পড়লো সোমের মাথায়। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে পৌঁছলো ওই পত্রিকার দপ্তরে। অনেক কৈফিয়ত ও ঝগড়া ঝাটির পর যখন এডিটরের ঘরে পা রাখলো সোম তখন এডিটরের সামনের চেয়ারে বসে প্রিয়াংশু। আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে নতমস্তকে। এডিটর যারপরনাই বিরক্ত তার ওপর। সোমকে দেখে প্রিয়াংশু উঠে দাঁড়িয়ে তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “তোমার জন্যই তো ওয়েট করছিলাম। একদম কড়কে দিয়েছি মালটাকে। আমার স্টোরির ওপর কলকাঠি করা অ্যঁ।” দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে বিদ্বেষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে আবার এডিটরের প্রতি বলল, “এই যে বিশ্বাসদা এই সেই ছেলে। দুমাসে ড্রাগস এর নেশা থেকে মুক্তি পেয়েছে। এইসব inspirational লেখা তো পাবলিককে খাওয়াতে পারেন। দেশে চাকরি বাকরির অবস্থা তো জানেন। বেকার ছেলের পেটে লাথি মারতে মন চায়?” এডিটর তার সাংবাদিককে কড়া ভাষায় বেরিয়ে যেতে বলে উঠে দাঁড়ালেন। সোমের কাছে ক্ষমা চেয়ে পরের দিন শুধরে নেবার কথা দিলেন। প্রিয়াংশু এডিটরের দিকে তাকিয়ে একটা মিচকে হাসি হেসে সোমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

 “থ্যাংক ইউ প্রিয়াংশুদা।” অফিস থেকে বেরিয়ে সোম জড়িয়ে ধরলো প্রিয়াংশুকে। ছটফটে লোকটা এরকম একটা মুহূর্তের জন্য তৈরি ছিল না। সোমের পিঠে আলতো চাপড় মেরে বলল, “এই বাঙালির দোষ। কথায় কথায় দাদা, দিদি। ইমোশন। যদিও ভালোই লাগে। কিন্তু ব্রাদার সন্ধ্যে বেলা যে প্রশ্নের জন জোয়ার সামলাতে হবে। গেট রেডি ব্রাদার।”

 সন্ধ্যে বেলা হলোও ঠিক তাই। রোজের মতো ভিড় জমেছে দোকানে। কিন্তু ওদের চোখে হাজার প্রশ্ন। সোমের বুক কাঁপলো। ওরা তো শুধু ওর কাস্টমার নয়, ওরা ওর মেরুদন্ড। সোম হাসি মুখে ওদের চায়ের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কোনো প্রশ্ন না করলেও আন্তরিকতার অভাব বোধ করছে সোম। হঠাৎ টুয়ার গলা পেল ও। টুয়া লাইভে কিছু বলছে। কাস্টমারদের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে আসছে ওদের বিশ্বাস। যতই হোক নতুন, যতই হোক এক ড্রাগ সারভাইভরের ব্যবসা, সোমের শৈল্পিক ক্ষমতায়, আচরণে, আন্তরিকতায় ওরা তৃপ্ত। 

তৃষা। আবার তৃষাকে পাশে পাওয়ার অনুভূতি বোধটা ফিরে এসেছে। কাছে না থেকেও কিভাবে যেন পাশে থাকা যায়।

“জিতে গেলে তো হে!” প্রিয়াংশুর কণ্ঠস্বরে হাসি খেলে গেল সোমের ঠোঁটে। কিন্তু পিছন ফিরেই সেই হাসি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। প্রিয়াংশুর পাশে দাঁড়িয়ে তৃষা। যা ভেবেছিল তাই। সেদিনের ফোনের কণ্ঠস্বর তৃষার ছিল। প্রিয়াংশুর স্ত্রীর। 

“দাও দাও তোমার ফ্যানকে এককাপ চা দাও।” প্রিয়াংশু জমিয়ে বসলো একটা টুলে। সোমের হাত থেকে ভাঁড় নিয়ে ধন্যবাদ জানালো। পাশে একদল কলেজ পড়ুয়া গিটার হাতে গান ধরেছে, ভালোবাসা বাকী আছে তোমারও আমার কাছে। প্রিয়াংশু অলক্ষে তৃষার কাছে সরে এসে বলল, “ছেলেটা তো ভালোই ছিল গো। বাড়ির চাপে এই উদগা... এই মানে.. এরকম একটা অদ্ভুত লোককে কেন বিয়ে করলে কেন বলতো?” তৃষার সপ্রশ্ন চোখদুটি দেখে হেসে ফেলল সে, “আরে তোমার বর সাংবাদিক, কবর থেকে খবর তোলে। এতো সামান্য খবর।” পিছনে তখনও গান বেজে চলেছে। তৃষা মুচকি হেসে বলল, “ওই ছেলেটা তো একদমই কথা শুনতো না, এই লোকটা অদ্ভুত কিন্তু বেশ obedient।” প্রিয়াংশু লাজুক হেসে হঠাৎ গিটার টেনে গাইতে শুরু করলো প্রেমে পড়া বারণ। 

 সোম দূর থেকে দেখলো ওর সঙ্গীদের। ওর আলোয় ফেরার হাতগুলিকে। বহুদিন পর মনে হলো জীবনটা ভারী সুন্দর। জীবনের রাস্তা একটু জটিল কিন্তু সফরটা খুব দামী।


Rate this content
Log in

More bengali story from Keya Chatterjee

Similar bengali story from Inspirational