রামধুরা, যা ছিল আমার অধুরা
রামধুরা, যা ছিল আমার অধুরা
আমাদের এবারের ভ্রমণ পথ ছিল প্রথম দু'দিন রামধুরা, পরে দু'দিন পেশক। সকালে এনজেপি-তে ট্রেন থেকে নেমে চলে এলাম রামধুরায় ভুটিয়া হোমস্টে তে। আগে থেকেই বলে রাখায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরেই অপেক্ষা করছিল দু' দুটো সুমো! আমাদের চার বন্ধুর পরিবার, যাদের সঙ্গে ছিলো তিন তিনটে ছোট্ট পরীর একটা দল।
রাস্তায় মাটিগাড়ায় একটু থেমে হাল্কা টিফিন করে নিলাম - নদী আর পাহাড়ের মাঝে রাস্তার ধারে, রেস্টুরেন্টটা বেশ সুন্দর, পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন। খাবারের মানও ভালোই লেগেছিলো - অবশ্য সেটা ক্ষিধে পেয়েছিলো বলে নাকি রান্নার গুণ সেটা এখন আর বলতে পারবো না।
যাই হোক, প্রায় ঘন্টা চারেক তিস্তার ধার ধরে ওপর দিকে বেয়ে চললাম সবুজ বনের বুক জুড়ে এঁকে বেঁকে চলা পিচ-রাস্তা ধরে। দু'পাশের সবুজ বনানী আর নব্য বর্ষার আলতো ছোঁয়ায় কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পদার্পনের জন্য উন্মুখ সুন্দরী তিস্তার বক্রিম সৌন্দর্য উপভোগ্য ছিলো সমস্ত যাত্রা পথে।
ভুটিয়া হোম স্টে তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছিলো। আমরা পেলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশের অভিমুখে চারটে ঘর! গীজারের কৃত্রিম উষ্ণ জলে চটপট স্নান সেরেই সকলে দৌড়ালাম ডাইনিং হলে, আর সেখানে পেলাম গরম গরম ভাত, ডাল, সবজি আর ওমলেট। শেষ পাতের আচারটুকুর কথা একটু আলাদা করে বলি, কারণ অভ্যস্ত স্বাদের বাইরে আচার খাবার ইচ্ছে না থাকলে, আগে চেখে দেখে নেওয়াই ভালো - আমারই যেমন ভুল করে লংকার আচার খেয়ে গলা জ্বলে... যাক গে সেকথা মনে না করাই ভালো।
ভুটিয়া গেস্ট হাউস সম্পর্কে আগে কে কি বলেছেন জানিনা, তবে আমার তো বেশ লেগেছে - শুধু লোড শেডিংয়ের কারণে বেশ ভুগতে হয়েছে পরের দিন, এই যা। আর একটা মজার, খানিকটা দুঃখের বিষয় হলো - আমাদের থাকার সময় দু' দিন আকাশ মুখ ভার করে থাকলো, মাত্র কয়েকবার ব্যতিরেকে বেশিরভাগ সময় তো সামনের সবুজ গালিচার মতো ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া অরণ্যের উদ্দাম চঞ্চলতা দেখার বা উপভোগের সুযোগই পেলাম না, উল্টে দরজা খোলা পেয়ে চুপি চুপি মেঘ ঢুকে ঘরের বিছানাপত্র ভিজিয়ে দিয়ে গেলো!!
পাশেই আর্মির রাজপুত রেজিমেন্ট, সকালে ঘুম ভাঙলো ওদের শ্যুটিং প্র্যাকটিশের গুলির ছড়ড় ছড়ড় আওয়াজে! ফটো তোলা নিষিদ্ধ না হলে সে দৃশ্যও মনে রাখার মতো এবং রেকর্ড করে ধরে রাখার মতোও। বেশ কিছু ক্ষণ সেই দৃশ্য উপভোগ করলাম সকলে দাঁড়িয়ে। বাইরের দেওয়ালে আটকানো থার্মোমিটারে দেখি তাপমাত্রা ষোলো ডিগ্রী! মোবাইলে দেখলাম - নর্ম্যাল তাপমাত্রা ষোলো কিন্তু "ফিলিং লাইক নাইন ডিগ্রী!" বাবারে!
এখানে সমস্ত গাড়ির ড্রাইভারই একটু উঁচু দর হাঁকতে অভ্যস্ত, আর তার ওপর যদি হোম স্টে থেকে ডাকে তবে তো আর কথাই নেই! যাক গে, আমার বন্ধু বিপ্লব আবার এসব বিষয়ে বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী, ওর প্ল্যান হলো- রানিং গাড়ি ধরে বেরিয়ে পড়ো সবাই মিলে, খরচও কম, সময়েরও সাশ্রয়। যাই হোক, প্রথম দিন আমাদের গাড়ি হোম স্টে থেকেই ঠিক করে দিয়েছিলো - সুবাস, গাড়ি চালায় ভালো, দরটাও দরাদরির পর একটু স্বাভাবিক করলো!
প্রথমে গেলাম বিদং নদীর বুকে, ছোট্ট পাহাড়ি নদী, জলের ক্ষীণস্রোত তিড়তিড় করে বইছে, অনায়াসে পাড়াপাড় করছে শিশু থেকে ছোট মাঝারি মাপের গাড়িগুলোও! দুপাশ জুড়ে ঘন সবুজ বন পাহাড়ের ঢাল ধরে উঠে গেছে ওপরে, নৈসর্গিক শোভা সত্যিই মনমুগ্ধকর। পাশেই রয়েছে প্রাচীন, দীর্ঘদিন অব্যবহারে শীর্ণ এক দুর্বল ঝুলন্ত কাঠের সেতুও। একটু সাবধানেই চড়া উচিত সেতুটিতে, কারণ বেশ কিছু জায়গায় কাঠের পাটাতন ভেঙে পড়েও গেছে! তবে ঐ যে নেসর্গিক সৌন্দর্যের আকর্ষণ টেনে নিয়ে যাবেই এই ভাঙা সেতুতে, আর সেখান থেকে চোখ জুড়ানো সবুজে সবুজ দেখে মনটাও সবুজ হয়ে উঠবেই! সেতুর গোড়ায় একটা হোমস্টে কাম রেস্টুরেন্ট নাকি চায়ের স্টলও আছে, যেখানে চা খেতে খেতেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় (এখানে বাঁশের খোপে মজানো লোকাল লিকার ড্রাইভারদের খুব প্রিয়!)।
ওখান থেকে গেলাম ডেলো পাহাড়ের পার্কে, কিন্তু তুমুল বৃষ্টির কারণে ঘন্টা দুয়েক থেকেও কিছুই দেখার সুযোগ না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলাম। দুপুরের মেনুতে গরম ভাত, ডাল, বাঁধাকপি আর ডিমের ঝোল। লাঞ্চের পর, একটু বসে, গেলাম জলসা বাংলো - এখান থেকে অনেক দূরে নিচে বয়ে চলা যুবতী তিস্তাকেও কৃশা মনে হয়, আর ঘন সবুজ উঁচু নিচু পাহাড়ের বুক চিঁড়ে বেয়ে চলা তার বঙ্কিম গতিধারাও অতীব দৃষ্টিনন্দন, শুধু তার পানে চেয়ে চেয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায় এক একটা দিন!
কিন্তু আমাদের তো হাতে সময় কম, তাই আপাতত সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অমোঘ আকর্ষণ ভুলে পাড়ি দিলাম ইচ্ছেগাঁওয়ের দিকে। মূল সড়ক থেকে ইচ্ছেগাঁও যাবার রাস্তা ভয়ঙ্কর খারাপ, ডেলো পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখা হয়ে গেলে এখানে সত্যিই আর নতুন কিছু আকর্ষণীয় আমার চোখে পড়েনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য তো গোটা পাহাড় জুড়েই এটা মেনে নিয়েও বলছি, এবং কেউ কেউ নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে সহমত হবেন না তাও মেনে নিচ্ছি।
রাতে বনফায়ার করে হৈ হৈ করে কাটালেও, বার্বিকিউয়ের লোভ ছাড়তেই হলো সরীসৃপদের কারণে। রোজ রাতেই এখানে ছিলো মুরগীর মাংস, রুটী বা ভাত। আমাদের অনুরোধে মোমো, এবং ওনারা নিজেরাই দিয়েছিলেন চিকেন ফ্রাই। তবে পরদিন ফেরার সময় একটা অদেখা লোকাল পদ খাওয়ালেন - কি যেন নাম, দূরবীন মোমো! হা হা, তার স্বাদও বেশ অন্যরকম। ভুটিয়া হোম স্টে তে লোকের আনাগোনা লেগেই রয়েছে। তবে, ওঁদের আতিথেয়তা বেশ ভালোই।
এরপরের গন্তব্যস্থল - পেশকের ল্যামিংডো ভিলা, টী এস্টেটের বাংলো, উচ্চতায় যা রামধুরা থেকে বেশ কিছুটা কম, তাই মেঘের সঙ্গে গা ঘেসাঘেসিটা একটু কম। ভিলার সৌন্দর্য অসাধারণ, তাঁদের ব্যবহারও সুন্দর - সকলকে স্বাগতম জানালেন গলায় সাদা উত্তরীয় পড়িয়ে! ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা প্রাক্তন সরকারী কর্মচারী, তাঁদের কন্যাও স্কুল শিক্ষিকা, তিনিই বাবা মাকে সাহায্য করেন এই হোম স্টেটিকে চালাতে।
ঐ দর্শনীয় আবাসন চোখ জুড়ালেও আমাদের বেশ কয়েকজনেরই পেট জুড়ায়নি! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে চা বাগান, নিচে গ্রামের ভিতরে কমলালেবুর বাগান, টিলার প্রান্তে দাঁড়িয়ে বহু নিচে প্রবহমান তিস্তার ক্ষীণকায় রূপ আর সর্পিল পিচ রাস্তার দেখা মেলে। এখানে রাস্তার ঢাল খুবই বেশি, আমরা কিছুটা নামার পর থেমে গিয়ে ওঠার সময় বেশ বেগ পেয়েছিলাম। এনাদের বাগানের চাও বেশ সুস্বাদু, শুধু খাওয়ানই নি, চাহিদামত আসার আগে প্রত্যেককে দিয়েওছেন - অবশ্যই নির্ধারিত দামেই! বন্ধুরা মিলে সপরিবারে আড্ডা দিয়ে জমিয়ে সময় কাটানোর জন্য জায়গাটা অতুলনীয়।
এবার ফেরার পালা, সন্ধ্যায় ওনাদেরই ব্যবস্থা করে দেওয়া গাড়িতে চড়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছালাম রাত দশটা নাগাদ, রাতটুকু পাশের হোটেলে কাটিয়ে ভোর বেলা ট্রেন ধরে পৌঁছালাম কলকাতা - মা গো, ষোলো ডিগ্রী থেকে সরাসরি ছত্রিশে? শরীর খারাপ করে গেল!

