The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

Siddhartha Singha

Tragedy Classics Crime

2  

Siddhartha Singha

Tragedy Classics Crime

পুনর্জন্ম

পুনর্জন্ম

16 mins
514



সিঙ্ঘানিয়া পরিবারে আনন্দের আর সীমা নেই। তাঁদের একমাত্র মেয়ে আবার তাঁদের কাছে ফিরে এসেছে। কে বলে পুনর্জন্ম বলে কিছু হয় না?

প্রায় আট বছর আগের ঘটনা। প্রিয়াঙ্কার বয়স তখন খুব বেশি হলে সাত কি আট। হঠাৎ বাড়ির মধ্যে থেকে উধাও। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হল। থানা পুলিশ করা হল। সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের মেয়ে বলে কথা। সমস্ত মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল। নড়েচড়ে বসল পুলিশ প্রশাসন। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি বৈঠক ডেকে উপর মহল থেকে সতর্ক করে দেওয়া হল আকাশ, রেল, জল, এমনকী সড়ক পথের সমস্ত পাহারা-চৌকিকেও।


কিন্তু না। তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। প্রতিটি মুহূর্ত তখন সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের কাছে যেন এক-একটা যুগ। বিকেল গড়াতেই অস্থির হয়ে উঠলেন বাড়ির লোকজনেরা। কোনও উপায় না দেখে শেষমেশ বাড়ির কর্তা সংবাদ মাধ্যমের সামনে ঘোষণা করে দিলেন--- যে তাঁর মেয়ের সন্ধান এনে দিতে পারবে, তাকে নগদ দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে 


সিঙ্ঘানিয়াদের বিশাল প্রতিপত্তি। চার পুরুষের ব্যবসা। শুধু কলকাতা, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুতেই নয়, তাঁদের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। ফুড প্রসেসিং থেকে নার্সিংহোম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে চা বাগান, মোটর সাইকেল থেকে সিমেন্ট কারখানা। কী নেই তাঁদের?তেমনই বিশাল বাড়ি। ছবির মতো বিশাল লন। লনের মধ্যে বসার জন্য বড় বড় রঙিন ছাতার নীচে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকাজ করা মেহগিনি কাঠের চোখ ধাঁধানো এক-একটি-টেবিল। সেই টেবিল ঘিরে সে রকমই চারটে, ছ'টা চেয়ার। মর্নিংওয়ার্ক করে এখানেই প্রাতরাশ সারেন বাড়ির কর্তা। কখনও সখনও বিকেলেও বসেন। অফিস বা কারখানার বিশেষ কেউ এলে, এখানে বসেই সেরে নেন ছোটখাটো মিটিং। এমনিও, সময় পেলেই মাঝে মাঝে এসে বসেন। কারণ, এই তল্লাটে এত গাছগাছালিওয়ালা বাড়ি আর দ্বিতীয়টি নেই। থাকবেই বা কী করে!


তিন পুরুষ আগে যখন এই বাড়ি তৈরি হয়, তখন এই জায়গাটা ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে একটু দূরেই। যাঁরা একটু নিরিবিলিতে থাকতে চাইতেন, তাঁরাই এ সব জায়গায় বাড়ি বানাতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর যত বড় হয়েছে, লোপাট হয়ে গেছে নিরিবিলি। উধাও হয়ে গেছে গাছপালা। লোকজনের ভিড় আর গাড়ির ধোঁয়া গ্রাস করেছে আশপাশের অঞ্চল। দেখতে দেখতে জমজমাট থেকে ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে তাঁদের এলাকাটিও।


আগে, বহু আগে যাঁরা বাড়ি করেছিলেন, তাঁদের বংশধরেরা প্রায় সকলেই একে একে প্রোমোটারদের খপ্পরে পড়েছেন। বাংলো টাইপের ছিমছাম বাড়িগুলোর জায়গায় মাথা তুলেছে আকাশ-ছোঁয়া এক-একটা অট্টালিকা। কেউ কেউ নিজে থেকেই বিক্রি করে চলে গেছেন শহরতলিতে। কিছু টাকা দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়ে, বাকি টাকাটা ফিক্সড করে দিয়েছেন ব্যাঙ্কে। তার সুদেই তাঁদের সংসার চলে।


কিন্তু সিঙ্ঘানিয়াদের ব্যাপারটা আলাদা। যত দিন গেছে তাঁদের ব্যবসাপত্র, প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতা ততই বেড়েছে। আর তার জেরেই এত কিছুর মধ্যেও তাঁরা ঠিক আগলে রাখতে পেরেছেন তাঁদের পূর্বপুরুষের করে যাওয়া এই বিশাল বাড়ি। আর কেউ যাতে এক বিঘত, দু'বিঘত করে ঠেলেঠুলে তাঁদের সীমানার ভেতরে থাবা বসাতে না পারে, সে জন্য এই কিছু দিন আগেই সারভেন্ট কোয়ার্টার-সহ পুরো বাড়িটাই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। বাইরে থেকে হুট করে কেউ ঢুকলে মনে হয়, এ কোথায় এলাম রে বাবা! এটা বাড়ি, না বাগানবাড়ি! এই গাছপালার জন্যই বুঝি এত পাখি আনাগোনা করে এখানে। গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে।


গান নয়, কোনও যন্ত্রসংগীত নয়, এই বাড়ির কর্তার সব চেয়ে প্রিয় হল--- পাখিদের এই কলকাকলিই। আর এটা শোনার জন্যই, যখনই সময় পান, তিনি চলে আসেন এখানে। কান পেতে তন্ময় হয়ে শোনেন সেই মধুর ধ্বনি।

এটা জানতে পেরে কে যেন তাঁকে একদিন বলেছিলেন, এতই যখন পাখির কূজন শুনতে ভালবাসেন, এত জায়গা আপনার, বিশাল বড় বড় খাঁচা বানিয়ে তার মধ্যে ইচ্ছেমতো নানান জাতের পাখি এনে পুষলেই তো পারেন। সেটা শুনে বাড়ির কর্তা তাঁকে বলেছিলেন, খাঁচার মধ্যে বন্দি পাখির ডাক আর প্রকৃতির মধ্যে মনের আনন্দে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ানো পাখির ডাক কি এক?


লোকটা অবাক হয়ে বলেছিলেন, কেন? আলাদা নাকি?

উনি বলেছিলেন, অবশ্যই আলাদা। সেটা বোঝার জন্য শুধু কানই নয়, একটা মনও দরকার।

এমনই কূজন-প্রেমিক তিনি। এটা ছাড়াও আর একটা বিষয়ে তার দুর্বলতা রয়েছে, সেটা হল ব্যাডমিন্টন। তাই এই লনেরই এক পাশে বানিয়েছেন ব্যাডমিন্টন কোর্ট। অন্য দিকে সুইমিং পুল। সুইমিং পুলের ও ধার দিয়ে সার সার ঝাউগাছ। সন্ধেবেলায় বাগানের আলোগুলো জ্বললে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে যায়, বোঝাই যায় না। এ ছাড়াও তাঁর আর একটা হবি হল--- গাড়ি। নতুন কোনও মডেল বেরোলেই হল, তাঁর সেটা চাই-ই চাই। ফলে, বাড়িতে যত না লোক, তার চেয়ে বেশি গাড়ি। এবং কাজের লোক।

সেই সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়তেই ছুটে আসতে লাগলেন আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে তাঁদের কোম্পানির তাবড়-তাবড় সব পদাধিকারীরা। আশপাশের রাস্তা ভরে যেতে লাগল নানান রঙের গাড়িতে। তার মধ্যে কত গাড়িতে যে লালবাতি লাগানো কে জানে!

সবার মুখে তখন একটাই কথা, টাকার জন্য কেউ ওকে অপহরণ করেনি তো! ইদানীং খুব শুরু হয়েছে এটা। এখন এ রাজ্যে ব্যবসা করতে হলে শুধু সরকারকে ট্যাক্স দিলেই হবে না, রাজনৈতিক নেতাদের হাত যাদের মাথার ওপরে আছে, তাদের দৌরাত্ম্যও সহ্য করতে হবে। একটু গাঁইগুঁই করলেই শুরু হবে হুমকি, ভয় দেখানো। তাতেও কাজ না হলে বাইকে করে এসে গুলি করে চলে যাবে। এতে ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা পাওয়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু না দিলে তাদের সঙ্গেও যে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে, এ রকম একটা আতঙ্ক অনায়াসেই ছড়িয়ে দেওয়া যায় অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে। ফলে চাওয়ামাত্রই সবাই সুড়সুড় করে টাকা বার করে দেন, সেটা ওরা জানে। আর এটাও জানে, ওরা যাই করুক না কেন, থানা পুলিশ ওদের কিচ্ছু করবে না।


তবু, তার পরেও যদি কেউ বেঁকে বসেন, তখন হুমকি দেওয়া হয় তার ছেলে বা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার। কিংবা খতম করে দেওয়ার।

কিন্তু এ সব তো হয় উঠতি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। তাঁদের সঙ্গে এ রকম হবে কেন? আর যদিও বা হয়, কত টাকা চায় ওরা? যাই হোক না কেন, মেয়েকে ফেরত পাওয়ার জন্য তাঁরা সব দিতে রাজি। দরকার হলে অপহরণকারীরা যা চাইবে, পুলিশকে অন্ধকারে রেখেই তাঁরা তা তুলে দিয়ে আসবেন ওদের হাতে।

কিন্তু কত চায় ওরা? সেটা তো আর মোবাইলে ফোন করে জানাবে না। যে বা যারা এটা করেছে, তাদের নম্বর উঠে যাবে। আর যারা করেছে তারা তো খোঁজখবর নিয়েই করেছে। ফলে তারাও জানে, এদের হাত কত দূর... তাই তারা কত টাকা চায়, সেটা জানার জন্য সবাই যখন ল্যান্ডফোনের কাছে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন, এক্ষুনি ফোন এল বলে, প্রতিটা মুহূর্ত উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছেন, ঠিক তখনই কে যেন দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল, প্রিয়াঙ্কার নিথর দেহ ভেসে উঠেছে বাড়ির সুইমিং পুলে।


গোটা পরিবার স্তব্ধ হয়ে গেল। রঙিন মাছ রাখার অ্যাকুরিয়ামের মতো প্রায় আস্ত একটা চৌবাচ্চার মাপে বিশাল একটা পাত্র অর্ডার দিয়ে বানিয়ে, দেড়- দু'বছর বয়স থেকেই বাড়িতে দক্ষ প্রশিক্ষক আনিয়ে যে মেয়েকে নিয়মিত সাঁতার শেখানো হয়েছে, যে মাঝে মাঝেই এই সুইমিং পুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়, সে কিনা ডুবে গেল সেই সুইমিং পুলের মাত্র তিন ফুট জলে! এটা হতে পারে! না, কখনও সম্ভব! সন্দেহ হল সবার।

দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হল মর্গে। পোস্টমর্টেমে জানা গেল, তাকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। কিন্তু তার গলায় আঙুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

কে মারল তাকে! পরিবারের সবার চোখে-মুখে তখন একটাই প্রশ্ন। কিন্তু কার দিকে আঙুল তুলবেন তাঁরা! বাড়িতে দশ-বারো জন কাজের লোক। তারাও শোকে বিহ্বল। সব চেয়ে বেশি ভেঙে পড়ল সেই আয়া। জন্মানোর পর থেকেই যে তাকে কোলে-পিঠে করে বড় করে তুলেছে। ও তার সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিল যে, প্রিয়াঙ্কা একটু বড় হওয়ার পরে তাকে যখন ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা উঠল, সেই আয়া এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, নিজে থেকেই সে বলেছিল, আমাকে ওর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। আমাকে যেটা মাসে মাসে দেন, না হয় সেটা দেবেন না। তবু ওর কাছ থেকে আমাকে চলে যেতে বলবেন না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।

সে যেমন প্রিয়াঙ্কাকে ছেড়ে যেতে চায়নি, প্রিয়াঙ্কাও তাকে ছাড়তে চায়নি। তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হবে শুনে রীতিমত কান্না জুড়ে দিয়েছিল। ফলে মেয়ের জন্যই সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের কর্তা শেষ পর্যন্ত তাকে আর ছাড়াননি। রেখে দিয়েছিলেন। সেই আয়া দু'দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে তৃতীয় দিন কাঁদতে কাঁদতে জানিয়ে দিল, প্রিয়াঙ্কাই যখন নেই, তখন আমি আর থেকে কী করব?

প্রিয়াঙ্কার একমাত্র দাদা আয়ুষ তখন সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের ছেলেরা উচ্চমাধ্যমিকের পর সাধারণত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেয়। কিন্তু হঠাৎ করে অমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, বাড়ির লোকেরা তাঁদের সবেধন নীলমণি একমাত্র ছেলেকে আর বাইরে পাঠাতে চাননি। পাঠানওনি।

মাঝখান থেকে পেরিয়ে গেছে আট-আটটা বছর। সিঙ্ঘানিয়া পরিবারও সামলে উঠেছে মেয়ের শোক। আয়ুষও পড়াশোনা শেষ করে শুধু বাবার ব্যবসাতেই যোগ দেয়নি, বলতে গেলে পুরো ব্যবসাটাই রীতিমত দেখভাল করছে। এবং বাবার ব্যবসার পাশাপাশি নিজেও খুলেছে বেশ কয়েকটি অন্য ধারার নতুন ব্যবসা। তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে যেটা, সেটা হল--- 'সত্যসন্ধানী' নামে তার বড় সাধের প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা।

না, অন্যান্য ছোটখাটো সংস্থার মতো বিয়ের আগে পাত্রীপক্ষের ফরমাশ মতো তারা পাত্রপক্ষের খোঁজটোজ এনে দেয় না। বিশেষ কারও আবেদনে সাড়া দিয়ে, কারও পিছু পিছু ঘুরে তার গতিবিধির খবরাখবর সরবরাহ করে না। বউ কার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে, সে সব নিয়েও ওরা মাথা ঘামায় না।


ওদের সব কিছুই বড় বড়। মারাত্মক কোনও গলদ নজরে আসার পরে, বড় কোনও কোম্পানির কর্ণধার যখন থানা-পুলিশ করার আগে, চুপিচুপি একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হয়ে নিতে চান, সত্যিই গলদ হয়েছে, না কি তাঁরই ভুল, তখন তিনি ওদের শরণাপন্ন হন। ওরাও ঠিক বার করে দেয় সেই কেলেঙ্কারির নেপথ্যে আসলে কী। প্রথম শ্রেণির খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেলের হয়ে ঠিক খুঁজে বার করে দেয়, সরকারি বড় কোনও ঘাপলার পিছনে কোন নেতা, মন্ত্রী বা আইএস, আইপিএসরা জড়িত। বিশাল অঙ্কের আর্থিক তছরুপের আড়ালে আসলে কাদের হাত রয়েছে। এই রকম বড় বড় কাজ ছাড়া ওরা হাতই দেয় না।

এই সব নানান কাজে জড়িয়ে পড়ায় আয়ুষ প্রায় ভুলতেই বসেছিল তার বোনের কথা। ঠিক এমন সময় এই খবর। মুখে বুলি ফোটার পর থেকেই নাকি একটি বাচ্চা মেয়ে অদ্ভুত-অদ্ভুত সব কথা বলত। তখন কেউ সে ভাবে গুরুত্ব দেয়নি। এখন তার বছর সাতেক বয়স। আশপাশের লোকেরা বলছে, সে নাকি জাতিস্মর। পূর্বজন্মের কথা সব বলতে পারে। সে বলছে, সে নাকি সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের সেই মেয়ে, যাকে তার আয়া গলা টিপে খুন করেছিল।


আয়ুষ পূর্বজন্মে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই খবর শুনে সে আর ঠিক থাকতে পারল না। তার বাবা-মাও সেই মেয়েকে দেখার জন্য এতটাই উতলা হয়ে উঠলেন যে, সব কাজ ফেলে খোঁজ করে করে তাকে যেতে হল ঢাকুরিয়া স্টেশন লাগোয়া, রেল লাইনের ধারে একটি ছোট্ট ঝুপড়িতে। যে-মেয়ে আগের জন্মে অমন একটা পরিবারে জন্মেছিল, সে-মেয়ে এ জন্মে কী করে এ রকম একটা হতদরিদ্র ঘরে জন্মায়! ও কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিল না। যখন সামনাসামনি দেখল, তার প্রথমেই মনে হল, না, এ মেয়ে কিছুতেই তার বোন হতে পারে না। তার বোনের সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই। না-চেহারায়, না-কথাবার্তায়, না-আচরণে। তবু তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য সে বলল, তুমি আমাকে চেনো?

মেয়েটি বলল, চিনি মানে? হাড়ে হাড়ে চিনি। তুই আমার হেলিকপ্টারের রিমোর্ট লুকিয়ে রেখেছিলি। কোথায় রেখেছিস রে?

আয়ুষ হতভম্ব হয়ে গেল। ওই মর্মান্তিক ঘটনার ক'দিন আগেই ওর বাবা ওর বোনের জন্য একটা হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছিলেন। ওটা রিমোর্টে চলত। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও, ওর পড়ার সময় প্রিয়াঙ্কা ওটা ঘরের মধ্যে ওড়াচ্ছিল দেখে, বোনের হাত থেকে রিমোর্টটা নিয়ে ও লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সে কথা এ জানল কী করে!

ফের প্রশ্ন করল ও, বলো তো আমি কী জমাতাম?

--- স্ট্যাম্প। এই, তোর কাছে যে মালয়েশিয়ার তিনটে স্ট্যাম্প ছিল, তুই বলেছিলি লায়লার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করে একটা রবীন্দ্রনাথ নিবি, নিয়েছিলি?

আয়ুষ একেবারে থ' হয়ে গেল। হ্যাঁ, তার কাছে একই স্ট্যাম্প দুটো হয়ে গেলে, আর কালবিলম্ব না করে, সে তড়িঘড়ি তার থেকে একটা দিয়ে, তার কাছে যে স্ট্যাম্প নেই, সেটা নিয়ে নিত ওদের স্ট্যাম্প ক্লাবের কারও না-কারও কাছ থেকে। আর মালয়েশিয়ার একই স্ট্যাম্প তিনটি হয়ে যাওয়ায়, সে তার বোনকে বলেছিল--- এই জানিস তো, এই স্ট্যাম্পটা না... লায়লার কাছে নেই। ও একদিন বলছিল এক্সচেঞ্জ করবে। ভাবছি, এর থেকে একটা দিয়ে, ওর কাছে রবীন্দ্রনাথের যে দুটো স্ট্যাম্প আছে, তার থেকে একটা নিয়ে নেব। কিন্তু এ কথা তো সে আর তার বোন ছাড়া অন্য কারও জানার কথা নয়! তবে কি...

আবার কী একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল আয়ুষ, তার আগেই মেয়েটি বলল, সুচিদি কেমন আছে রে?

এ বার আর হতবাক নয়, আয়ুষ একেবারে বোল্ড আউট হয়ে গেল। মিডল উইকেট ছিটকে গেল। কারণ, সূচির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা একমাত্র তার বোনই জানত। তার বোনই তার লেখা প্রথম হাতচিঠি পৌঁছে দিয়েছিল সূচির কাছে। তা হলে কি এ-ই তার সে-ই বোন!

আর কোনও সংশয় রইল না। আয়ুষ যখন জানতে পারল, তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টি, এমনকী তাদের বাড়ির কাজের কোনও লোকের সঙ্গেও এই মেয়েটির কোনও রকম যোগাযোগ নেই--- যা আছে, তা শুধু পূর্বজন্মের সূত্র ধরেই, তখন সামান্য কুয়াশাটুকুও তার মন থেকে সরে গেল।

আয়ুষের বাবা-মা উঠেপড়ে লাগলেন তাঁদের হারানো মেয়েকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসার জন্য। প্রথম প্রথম আপত্তি করলেও সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের দেওয়া বিপুল টাকা এবং নানা রকম লোভনীয় প্রতিশ্রুতির কাছে শেষ পর্যন্ত নত হলেন মেয়েটির বাবা-মা। ফলে এ জন্মে অন্য ঘরে জন্মালেও, ও যাঁদের মেয়ে, তাঁদের কাছেই ফিরে এল। গোটা বাড়ি আলো দিয়ে সাজানো হল। অসময়েই মহা ধুমধাম করে করা হল জয় মাতাদির পুজো। সাত দিন ধরে চলল মহোৎসব। দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করা হল বস্ত্র। পথবাসীদের হাতে হাতে তুলে দেওয়া হল কম্বল। সব মিলিয়ে আয়ুষদের পরিবার ভেসে যেতে লাগল আনন্দের জোয়ারে।

কোনও মাসে একবার, কোনও মাসে দু'বার, আবার কোনও মাসে তিন বার আয়ুষ ওর বোনকে নিয়ে যেত ঢাকুরিয়া স্টেশন লাগোয়া, রেল লাইনের ধারের ওই ছোট্ট ঝুপড়িতে। ওর মা-বাবার কাছে। না, ওর মা-বাবার এ বাড়িতে ঢোকার কোনও অনুমতি ছিল না। কারণ সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের ধারণা ছিল, যে যেখানে যে ভাবে বড় হয়েছে, তাকে সেখান থেকে একদম আলাদা করে তুলে এনে যদি নতুন কোনও জায়গায় রাখা যায়, তা হলে সেখানে থাকতে থাকতে সেও একদিন নতুন জায়গার আদব-কায়দা শিখে পুরোপুরি সেই জায়গার মতো হয়ে ওঠে।

কিন্তু তার শিকড়বাকড় সুদ্ধ তাকে নিয়ে এলে, সেই শিকড়বাকড়ই তাকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে যে, ইচ্ছে থাকলেও তার থেকে সে আর বাইরে বেরোতে পারে না। তাই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা।

কিন্তু মা-বাবা বলে কথা! তাঁরাই বা সন্তানকে না দেখে থাকেন কী করে! তা ছাড়া, মুখে কিছু না বললেও, যাঁদের সঙ্গে ও এত দিন কাটিয়েছে, সেই বাবা-মাকে দেখার জন্য তার মনপ্রাণও তো ছটফট করতে পারে! গুমরে গুমরে কাঁদতে পারে! না, তাকে আমরা আমাদের কাছে রাখতে চাই বলে, তাকে কষ্ট দেওয়ার কোনও অধিকার আমাদের নেই। পরিবারের কর্তা এ কথা বলতেই, সবাই মিলে ঠিক করেছিলেন, তা হলে আয়ুষ তার বোনকে মাঝে মাঝেই তার এ জন্মের বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। দেখা করিয়ে আনবে।

সেই মতো একদিন প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সেই ঝুপড়ি থেকে এক মহিলাকে বেরোতে দেখে আয়ুষ একেবারে চমকে ওঠে। হ্যাঁ, চেহারায় অনেক বদল ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু চিনতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। এই মহিলাটি আর কেউ নন, তার বোনের নৃশংস হত্যাকারী, সেই আয়া।

এ এখানে কী করতে এসেছে! ও-জন্মে মেরে আশ মেটেনি, তাই এ-জন্মেও কি সে তার বোনকে শেষ করতে চায়? কী তার উদ্দেশ্য? খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আয়ুষ তার গোয়েন্দা সংস্থা 'সত্যসন্ধানী' থেকে বাছাই করা বেশ কয়েক জন দক্ষ কর্মচারীকে নিয়ে পুরোদস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যদি তেমন কোনও তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা যায়, তা হলে মাঝখান থেকে আট-আটটা বছর পার হয়ে গেলেও, সেই অপকর্মের জন্য ও এই আয়ার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে। করবেই।

আঁটঘাট বেঁধে, সব খবরাখবর জোগাড় করে, যাদবপুর থানা থেকে তার এক পুলিশ অফিসার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সে একদিন হানা দিল ওই মহিলাটির ডেরায়। পুলিশ আর আয়ুষকে দেখে সে যেন ভূত দেখল। ভয়ে একদম জড়সড় হয়ে গেল। না, একটা চড়চাপড়ও মারতে হল না। দু'-চারটে ধমক দিয়ে জেরা করতেই সে গড়গড় করে বলে গেল--- ওই বাড়িতে কাজ করতে করতেই আমার সঙ্গে রজনীশের আলাপ হয়। ও ছিল ওই বাড়ির গাড়ির চালক। বাড়ির বললে ভুল হবে। ও ছিল প্রিয়াঙ্কার গাড়ির চালক। প্রিয়াঙ্কাকে স্কুলে নিয়ে যেত। নিয়ে আসত। আর আমি যেহেতু প্রিয়াঙ্কার দেখাশোনা করতাম, তাই ওকে ঠিক মতো স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসেছে কি না, মনে করে ওয়াটার বোতলটা ও নিয়েছে কি না, কিংবা ফিরে এসে কী খাবে, কিছু বলেছে কি না, এ সব ওর কাছেই জিজ্ঞেস করতাম। ফলে সেই সূত্র ধরেই ওই আলাপটা কয়েক দিনের মধ্যেই নিবিড় একটা সম্পর্কে পরিণত হয়। আমরা তখন একে অপরকে না দেখে দু'দণ্ডও থাকতে পারতাম না। দু'জনে একটু একসঙ্গে থাকার জন্য পাগল হয়ে উঠতাম। সুযোগ পেলেই বাড়ির মধ্যেই কোনও ফাঁকা জায়গায় চলে যেতাম। সবার চোখ এড়িয়ে একসঙ্গে নিভৃতে কাটাতাম। আমাদের সব চেয়ে প্রিয় আর নিরাপদ জায়গা ছিল সুইমিং পুলের পিছনে, ঝাউগাছগুলোর ঝোপের আড়াল। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা দু'জনে কাছাকাছি হলেই যেন আগুনে ঘি পড়ত। না, আদর তো নয়ই, চুমুটুমুও নয়। এমনকী জড়াজড়ি করেও সময় নষ্ট করার ছেলে ছিল না ও। প্রথমেই আমার শরীর-সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। হাবুডুবু খাওয়া শুরু করত। সাঁতার কাটত।

সে দিন দু'জন মালিই ছুটি নিয়েছিল। তাই আমরা সেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। সকাল থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম, কখন সুযোগ পাব... বেলা দশটা-এগারোটা নাগাদ সবার নজর এড়িয়ে অবশেষে ওখানে গিয়ে আমরা যখন ভালবাসায় মেতে উঠেছি, এতটাই মেতে উঠেছি যে, কোনও দিকে তাকাবার ফুরসতই নেই। ভুলে গেছি, অন্যান্য দিনের মতো মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখে নেওয়া, এ দিকে কেউ আসছে কি না। ঠিক তখনই, সুইমিং পুলে নামার জন্য আসতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা বোধহয় কোনও কালো ফড়িং দেখেছিল। আর সেটা ধরার জন্যই পিছু পিছু ধাওয়া করে ও বুঝি ও দিকে চলে এসেছিল। এবং কী করে যেন আমাদের দেখেও ফেলেছিল। বয়সে ছোট হলেও ও বুঝতে পারত সব। আমাদের দেখেই ও বলল, তোমরা এখানে কী করছ? আমি পাপাকে সব বলে দেব।

ওর গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা লাফ দিয়ে উঠে পড়েছিলাম। আমি শাড়িটাড়ি পরেই ছিলাম। তাই আমিই প্রথমে ওর কাছে ছুটে গিয়ে এটা-ওটা বলে কথা ঘোরাবার চেষ্টা করলাম। তাতেও কাজ না হওয়ায়, ও যাতে ওর বাবাকে না বলে, সে জন্য অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগলাম। কিন্তু ও শুনল না। ওর সেই একই কথা, আমি পাপাকে সব বলে দেব।

ও যদি সত্যিই ওর বাবাকে বলে দেয়, তা হলে তো একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। চাকরি তো যাবেই, তার ওপরে আরও যে কী কী হবে, তা একমাত্র ভগবানই জানেন। তা হলে এ বার কী হবে! আমরা যখন এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, রাজনীশ বলল, নাঃ, আর কোনও উপায় নেই। বলেই, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, আচমকা ও প্রিয়াঙ্কার গলা টিপে ধরল। ও রকম কোনও ঘটনা যে ঘটতে পারে, আমি তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। যখন সংবিৎ ফিরল, আমি ওর হাত ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওর গায়ের জোরের সঙ্গে কি আমি পারি!

--- কিন্তু পোস্টমর্টেমে তো আঙুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি... 

আয়ুষের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই পুলিশ অফিসারটির দিকে তাকিয়ে আয়া বলল, পাবে কী করে? ওই বাড়ির লোকেরা খাবার সার্ভ করার সময় যেমন মাথায় টুপি পরে নেয়, রান্নার সময় রাঁধুনিরা অ্যাপ্রন পরে রান্না করে, ঠিক তেমনই ড্রাইভাররাও সব সময় টিপটপ থাকে। মাথায় হ্যাট, পায়ে শ্যু, হাতে গ্লাভস।

--- আপনি যে বললেন...

--- হ্যাঁ, আমরা ঝাউগাছের আড়ালেই ছিলাম। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার গলা শুনেই আমি কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ও আমাদের ওই অবস্থায় দেখে ফেলেনি তো! কী করব, কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। রজনীশের কিন্তু ও সব কিছু হয়নি। ও ধীরেসুস্থে জামা-প্যান্ট, টুপিফুপি পরে নিয়েছিল। ওর হাতে গ্লাভস পরা ছিল বলেই প্রিয়াঙ্কার গলায় আঙুলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

আয়ুষ বলল, যদি আপনার কথাই বিশ্বাস করতে হয়, তা হলে তো প্রিয়াঙ্কাকে মেরেছে রজনীশ। তা, আপনি সে কথা কাউকে বলেননি কেন?

--- কী করে বলব? আমি যে ওকে ভালবাসতাম।

--- প্রিয়াঙ্কাকেও তো আপনি ভালবাসতেন। কী? বাসতেন না? আপনি তো ছোট থেকে ওকে বড় করেছেন...

--- হ্যাঁ, বাসতাম। ভীষণ ভালবাসতাম। সে জন্যই তো রজনীশকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। ওকে ছেড়ে বিহারে চলে গিয়েছিলাম। ও বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তুমি যেও না, প্লিজ। তুমি চলে গেলে আমি আর বাঁচব না। দেখবে, হয় বিষ খাব, নয়তো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ব। কিন্তু ও যে সত্যি সত্যিই এ রকম একটা কাণ্ড ঘটাবে, আমি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছিল?

--- ও ট্রেনের তলায় গলা দিয়েছিল। তাই ওর মৃত্যুর খবর পেয়ে, যাদবপুরের দিক থেকে ঢাকুরিয়া স্টেশনে ঢোকার আগেই, বাঁ হাতে, রেল লাইনের যেখানটায় ও আত্মহত্যা করেছিল, তারই সামনের এই ঝুপড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে আমি থাকতে শুরু করি...

--- অদ্ভুত কাকতালীয় তো! আপনি যেখানে থাকতে শুরু করলেন, সেখানেই প্রিয়াঙ্কা জন্মাল!

--- ও প্রিয়াঙ্কা নয়।

চমকে উঠল আয়ুষ, তা হলে?

--- ও আমার মেয়ে।

আয়ুষ অবাক, আপনার মেয়ে!

--- হ্যাঁ, ও আমার আর রজনীশের মেয়ে।

আয়ুষ বলল, সে কী করে হয়! আমি তো ওর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমাকে এমন এমন সব কথা বলেছিল, যা আমি আর আমার বোন ছাড়া অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

--- এটা আপনার ভুল ধারণা। যেখানে যখন যা হত, প্রিয়াঙ্কা এসে আমাকে সব বলত। আর সেগুলিই খুব ছোটবেলা থেকে আমি আমার মেয়ের মাথায় এমন ভাবে গেঁথে দিয়েছিলাম, ওই বাড়ির ছবি এমন নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছিলাম যে, ও নিজেকে প্রিয়াঙ্কা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারত না। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয়নি, একজন অবিবাহিতা মেয়ের বাচ্চাকে এ সমাজ কিছুতেই ভাল চোখে দেখবে না। আমাকে যেমন নানান লোকে নানান কথা বলত, ওর জন্ম-রহস্য নিয়েও সারা জীবন ওর দিকে আঙুল তুলবে। তাই, কী করব যখন ভাবছি, ঠিক তখনই পাশের ঘরের ওরা আমাকে বলল, বাচ্চাটা আমাদের দিয়ে দাও। আমরা মানুষ করব। ওরা ছিল নিঃসন্তান। ফলে সঙ্গে সঙ্গে আমি রাজি হয়ে গেলাম। আর সেই থেকেই ও ওদের বাবা-মা বলে ডাকতে শুরু করল। ও এখনও জানে না আমি ওর কে...

পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আপনি এটা করলেন কেন? নিজের মেয়েকে ও বাড়িতে ঢুকিয়ে সম্পত্তি হাতানোর জন্য? নাকি হতদরিদ্র ঘরে জন্মালেও আপনার মেয়ে যাতে রাজার হালে থাকতে পারে, সে জন্য?

চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না আয়া। সে বলল, এ সব কী বলছেন আপনারা? আসলে আমাদের জন্যই তো বড়মা'র কোল খালি হয়েছিল, সেই মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন ভেবে তাঁর দুঃখ যদি কিছুটা লাঘব হয়, সে জন্যই এ সব করেছি।

--- সে নয় আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু ওর আয়া মানে তো আপনি। আপনি ওকে গলা টিপে খুন করেছেন, এটা ওকে কে বলল?

--- আমি।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আয়ুষ। ভ্রু কুঁচকে তাকাল পুলিশ অফিসারটি।--- কেন?

--- কারণ, ওর মৃত্যুর পরে যে দু'দিন আমি ও বাড়িতে ছিলাম, তখনই পুলিশের নানান প্রশ্ন এবং ও বাড়ির বিভিন্ন লোকজনের কথাবার্তা, আমার আড়ালে ওদের ফিসফাস, তির্যক চাহনি দেখে বুঝেছিলাম, হাতেনাতে কোনও প্রমাণ না পেলেও, কেন জানি না, ওরা আমাকে সন্দেহ করছে। তাই এত দিন পরে সেই সন্দেহটাকেই ওর মুখ দিয়ে বলিয়ে আমি রাস্তা পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, একমাত্র এটা বললেই ও-বাড়ির লোকেরা সহজে বিশ্বাস করবে যে, ও-ই ও বাড়ির মেয়ে।

আয়ুষের দিকে তাকাল পুলিশ অফিসার।--- তা হলে আমরা এ বার থানার দিকে যাই, না কি?

আয়ুষ বলল, থাক। বোনের শোক বাবা-মা একবার সহ্য করেছেন। তাকে ফিরে পেয়েছেন ভেবে এখন তাঁরা খুব আনন্দে আছেন। আজ এটা শুনলে তাঁরা নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পড়বেন। আমি চাই না, তাঁরা আর একবার মেয়েকে হারান। তার চেয়ে বরং এই-ই ভাল, যেমন চলছে, চলুক। আর ওই মেয়েটিও যখন মনে করে ও সিঙ্ঘানিয়া পরিবারেরই একজন, তখন অসুবিধা কোথায়? বলতে বলতে আয়ার দিকে ফিরে তাকাল আয়ুষ। বলল, আপনার সব অপরাধ আমি মাপ করে দিতে পারি, শুধু একটা শর্তে। আপনি ওকে কখনও ওর আসল পরিচয়টা জানাবেন না, কেমন?

মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না আয়ার। ছলছল চোখে কেবল মাথা কাত করল, আর তাতেই সে বুঝিয়ে দিল, ঠিক আছে।



Rate this content
Log in

More bengali story from Siddhartha Singha

Similar bengali story from Tragedy