পথ প্রদর্শন
পথ প্রদর্শন
আমার জীবনটা একটা সাপ -লুডোর খেলা। তফাৎ একটা: আমার জীবনের সাপ -লুডো ১০০তে থেমে যায় না। ১০০ পৌঁছে দেখি ১০১ থেকে ২০০র নতুন ছখ। তাই সিঁড়ির শেষ নেই। সিঁড়িগুলো এক একটা অনুপ্রেরণা -সংখ্যাটা বড্ড বেশী। আমার খেলায় ছোট সিঁড়ি আর বড়ো সিঁড়ি দুটোই সমান মূল্যের। তাই তাদের মধ্যে থেকে বাছতে পারিনি। বাকি রইলো কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছি কিনা ;সেটাও একটু আবছা। তাই স্মৃতির পাতা খুঁজে দুটো নাম পেয়েছি যাদের লেখা আর কাজ আমাকে মনে রেখেছে। এরা দুজনে এক্কেবারে আলাদা ,অথচ আমার মনে এদের অভিন্ন স্থান।
আলবার্ট এক্কা :
আদিবাসী ,জন্ম ঝাড়খণ্ডের প্রত্তন্ত গ্রামে। ধর্মে ক্যাথলিক খ্রীষ্টান। কিন্তু ধৰ্ম একে সংকুচিত করে নি। সব ধর্মের অনুষ্ঠানে যোগ দেয় মনের টানে।
প্রায় ৪০ বছর আগে আমার নতুন চিন্তা হলো কি করে আধুনিক কৃষি বিজ্ঞান নিরক্ষর আদিবাসী চাষীদের কাছে পৌঁছনো যাবে। ক্লাসে লেকচার আর ল্যাবরেটরিতে দেখানো ,যা আমরা ইস্কুলে -কলেজে করে থাকি তাতে কাজ হবে না। এতে জ্ঞান কিছুটা বাড়বে নিশ্চই ,কিন্তু আত্মবিশ্বাস বাড়বে না। আত্মবিশ্বাস না বাড়লে জ্ঞানকে জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারবে না.; তাহলে কৃষিবিকাশ হবে না।
নতুন পদ্ধতিতে শেখানোর রাস্তা বার করবার চেষ্টা করছিলাম। সেই সময়ে জানলাম গান্ধীজি নই তালিম শিক্ষা প্রণালী চালু করতে চেয়েছিলেন যাতে ভারতের সব মানুষ শিখতে পারে আর শেখাটাকে জীবনের কাজের মধ্যে এনে কাজটিকে আরো ভালোভাবে করতে পারে। গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন যে নতুন জ্ঞানকে আধার করে কেউ যদি একটা সিঁড়ি উঠতে পারে তাহলে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সে তখন আরো নতুন কিছু শিখে আর একটা ধাপ চড়তে চাইবে। এটাই মানব বিকাশ। আমি এর কিছুদিন আগে আমার নতুন Theory of Development লিখেছি ,যাকে সাধারণতঃ Theory of Three Cs বলা হয়। এই তিনটে C হচ্ছে Competence ,Confidence আর Comprehension যা গান্ধীজির ন ই তালিমের মতনই।
আমার দরকার শিক্ষক -ছাত্র নয় , ওস্তাদ -সাগরেদ বা গুরু -শিষ্য। গুরু শিষ্যের হাত ধরে জ্ঞানকে কাজে লাগাতে উৎসাহ দেবেন আর সঙ্গে থেকে দেখবেন কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। কাজের দুর্বলতাগুলো কাজের মধ্যে দিয়ে দূর করবেন। আমার দরকার ছিল কৃষি পন্ডিতের। সেই সূত্রে এলবার্টকে পেলাম। বি এ পাশ ,সবাইকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নিজে চাষ করে আর অন্য চাষীদের যতটুকু পারে ততটুকু করে ,ভালো বীজ ,ঠিক সময়ে ভালো সার এই সব।
আলবার্ট জানালো ওর কৃষি বিজ্ঞানের কিছু জানেনা। আমিও জানতাম। তাই ওকে তৈরী করা দরকার। বিভিন্ন কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র,বিশ্ববিদ্যালয় কেউই আমার প্ল্যান মতো ট্রেনিং যে রাজি হলো না। শেষে খোঁজ পেলাম এক জাপানী বৈজ্ঞানিকের ,এলাহাবাদে এক কৃষি কেন্দ্রের অধ্যাপক। তার কাছে সবটা বললাম ,সানন্দে রাজি হলেন।
এক বছরের ট্রেনিং ,শুধু পাঁচ বিষয়ে :কুয়োর জলে শীতের সবজি ,একটা ডাল ,একটা তেলের গাছ ,গাঁধা ফুল আর ধান। যেভাবে কৃষি পণ্ডিত কাজ করবে সেইভাবে ট্রেনিং চলবে। পাঁচ জনের সঙ্গে আলবার্ট রইলো এলাহাবাদে।
কৃষি পণ্ডিত প্রকল্পের রূপরেখা এইরকম : এক পণ্ডিত আর সঙ্গে ১৫জন কৃষি চেলা ;সপ্তাহে একদিন একটা কাজ বোঝানো হবে তার বৈজ্ঞানিক তথ্য সমেত ;পরের পাঁচ দিন সবাই মিলে প্রতিদিন তিনজনের জমিতে সেই কাজটুকু করবে ;একটা দিন ,হাটের দিন ছুটি। তার মানে প্রতি চেলা ১৫ বার practice করবে। পুরো বছরে একটা কৃষি Cycle শেষ হবে। তখন কৃষি পন্ডিত অন্য একটা জায়গায় যাবে আর নতুন ১৫ চেলা নিয়ে কাজ শুরু করবে।
তিন বছর বাদে দেখা গেলো প্রায় ১০,০০০ কুয়োতে সবজির চাষ শুরু হয়েছে ,মটরশুটি ,টমেটো আর ফ্রেঞ্চ বিন বড়ো বড়ো বাজারে যাচ্ছে। কিছু বছর পরে রাঁচী জিলা ভারতের সবচেয়ে বেশী মটরশুঁটি উৎপাদন করতে পেরেছিলো।
আমি আলবার্ট কে আমার কাছে রাখলাম ,যাতে ওকে দিয়ে দেশের অন্য আদিবাসী এলাকায় কৃষি বিজ্ঞান বিস্তার করা যায়। আমার সিলেকশন ভুল ছিল না। আলবার্ট কৃষির সঙ্গে পশুপালন ,বিশেষতঃ শুওর পালন নিজেই শিখে নিলো। একটা মজার ঘটনা বলি :আমি ছোটো একটা দল নিয়ে গেছি শিলংয়ে। Construction ,LED Reading Lamp ,Food Processing , ফুল ঝাড়ু তৈরী আর শুয়োর পালনের নতুন বিজ্ঞান জানাতে। পাঁচ দিনের প্রোগ্রাম ,তারপর দুদিন আমরা ঘুরে বেড়াবো। আয়োজকদের অনুরোধ আর একটা দিন আলবার্ট স্যার যদি থেকে যান ;অগত্যা রাজি হতেই হলো। এলবার্টকে জানানো দরকার ,কিন্তু কোথায় সে ? খবর পেলাম দশ জনকে নিয়ে সে গেছে পাহাড়ে -জঙ্গলে। একটু যে রাগ হয়নি বলবো না। ফিরলো বেশ দেরীতে।
পরদিন আমাদের কাজ নেই। এলবার্টকে নিয়ে গেছে একটা বড় হলে। একটু দেরীতে গেলাম দেখতে হচ্ছেটা কী ? সে এক দৃশ্য। হল ভর্তি লোক ,এসেছে দূর দূর থেকে। হলের একটা দেয়াল টানা ব্ল্যাক বোর্ড , তাতে ঝুলছে নানা গাছের ডাল ,প্রত্যেকের নীচে গাছের লোকাল নাম লেখা। আলবার্ট স্যার একটা লম্বা টেবিলে শোয়া , আর হাঁপাতে হাঁপাতে নিশ্বাস নিচ্ছে। সবাই চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলছে ,কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই সকলের চোখে -মুখে নতুন পাবার আনন্দ। তারপরই আলবার্ট চট করে উঠে দাঁড়ালো ,সবাই চুপ। আলবার্ট কোনো কথা না বলে একটা ডালের থেকে একটা একটা করে ১৫টা পাতা তুললো ,সবাই দেখলো ১৫তা পাতা ;একজন এসে পাতাগুলো চেপে চেপে রস বার করলো ;আলবার্ট আবার টেবিলে শোয়া ;রস আর পাতা জোর করে মুখ খুলিয়ে দেওয়া হলো। আলবার্ট লাফ দিয়ে উঠে পাতা -রস মুখ থেকে বার করলো। শ্রোতাদের হাততালি আর আনন্দ - বুঝলাম এতক্ষন আলবার্ট অসুস্থ শুওরের role play করছিলো যাতে সবাই symptom গুলো বুঝতে পারে ;তারপর কি পাতা ,কতটুকু,কিভাবে দিতে হবে সেটাও বোঝানো হলো অভিনয় করে। ছাত্ররা হিন্দি বোঝে না ,আলবার্ট খাসি ভাষা জানেনা। তাই আগের দিন কাছাকাছি জঙ্গল থেকে গাছ জোগাড় করেছে , একজনকে দিয়ে প্রতিটি গাছের লোকাল নাম লিখিয়েছে। আর আজ acting করে শিখিয়েছে রোগের symptom আর medication .আমি সবসময়ে বলতাম বিজ্ঞান জানা ভাষায় আটকায় না ,আজ তার living example আলবার্ট দেখালো।
সেই আলবার্ট।
এক দিন ডেকে পাঠালাম নতুন একটা আইডিয়া কি করে করবো পরামর্শ করতে আর এও জানালাম নতুন প্রজেক্টে তার স্থান আর মইনের কথা.
আলবার্ট শুনলো ,পরামর্শ দিলো ,তারপর খুব শান্ত গলায় বললো যে ও কাজটা ছেড়ে দিতে চায়।
এবার আমার অবাক হবার পালা। বোঝালাম ওর দুই মেয়ে ,কদিন হলো কলেজে ঢুকেছে ,খরচ আছে। নতুন কাজে সুবিধে হবে। কিন্তু ওর শান্ত মুখ দেখে বুঝলাম ওর মন স্থির হয়ে আছে ,চোখে একটা নতুন স্বপ্ন ,যাতে আমি নেই।
তাও বোকার মতো প্রশ্ন করলাম আমার কাছ থেকে কোনো কষ্ট পেয়েছে কিনা। আমার দিক থেকে কিছু করলে এত বড়ো সিদ্ধান্ত বদলাবে কিনা।
মনে করবার চেষ্টা করছি ওর উত্তর যেমন ভাবে আলবার্ট বলেছিলো। এতদিন বাদে কিছু বাদ যাবে।কিছু আমার ভাষা এসে যাবে ,কিন্তু আমি যত্ন করে আলবার্টের মনের ভাব অক্ষত রাখছি।
" গত ক বছর ধরে আমি আমার গ্রামকে ভালো করবার চেষ্টা করেছি। আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই যে আমার গ্রাম অনেক এগিয়ে আছে আশ পাশের অন্য গ্রামের থেকে। আমার যত জমি আছে আর যেরকম সেচের ব্যবস্থা করেছি তাতে আমার সংসার ভালোভাবে চলে যাবে। আমার মেয়েদের লেখাপড়ায় কোনো আঁচড় পড়বে না। এতদিন আমি আপনার কাছ থেকে শুধু নিয়েছি ;কাজ শিখেছি ,কাজ করেছি ,আমার কাজের বিস্তার করেছি ,অনেক বিজ্ঞান সভায় গেছি। যা আমার স্বপ্নেরও বাইরে ছিল সেগুলোকে হাতের মধ্যে পেয়েছি। কিন্তু আপনাকে কিছু দি নি। এবার আমি কিছু দিতে চাই। ''
আমি তাড়াতাড়ি থামাবার চেষ্টা করলাম যে আমার কিচ্ছু চাইবার নেই। তোমার কাজ আমার কাছে বড় উপহার। আমাকে থামিয়ে আলবার্ট জানালো তার মনের মধ্যে স্বপ্ন।
"আপনার কাছ থেকে দুটো অদ্ভুত জিনিষ পেয়েছি। আপনি বলেন সব মানুষের মধ্যে অনেক শক্তি আছে ,কিন্তু তার প্রকাশ নেই , কারণ সে প্রকাশ করতে ভয় পায় - বিজ্ঞান আর টেকনলজি সেই ভয়টাকে কমাতে সাহায্য করে। আপনি আর একটা কথা বলেন : মানুষ আজ যেটা সত্য বলে বিশ্বাস করে সেটাই তার জ্ঞান ; এই বিশ্বাসগুলোর মধ্যে কিছু অংশ থাকে যেগুলো সব জায়গায় করে দেখানো যায় সেই সত্য গুলো বিজ্ঞান; আর এই বিজ্ঞানের সত্যগুলোর মধ্যে কিছু সত্য সমাজের ব্যবহারে লাগে,সেটাই টেকনোলজি ; তাই টেকনলজি সত্যেরই এক রূপ যাকে দেখা যায় ,ধরা যায় ,যা নিয়ে খেলা যায়। এই সত্যের ওপর সব মানুষের সমান অধিকার। কিছু মানুষ শুধু নিজের কথা ভেবে এই সত্যকে অনেকের কাছে যেতে দেয় না। আর তাই আপনি সারা জীবন Technology Barrier ভাঙ্গবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আমি আপনার এই দুটো কথা আমার আদিবাসী সমাজে ছড়াতে চাই। আপনি জানেন আদিবাসী গ্রামগুলো ছোট ছোট টোলাতে ভাঙা। আমি চেষ্টা করবো প্রতি টোলায় একটা করে জ্ঞানকক্ষ খুলতে। এগুলো এক একটা Technology Club ; সেই টোলার সবাই যে যতটুকু জানে অন্যদের জানাবে ,সবাই মিলে বিচার করবে তারপর নিজেদের নির্ণয় নিজেরাই নেবে। একবার যদি কোনো একটা কাজে উপকার পায় তখনই বুঝবে নিজেদের ভেতরে কত শক্তি লুকিয়ে আছে ,আরও বুঝবে যে ব্যবহারিক বিজ্ঞান চর্চা করেই সত্যকে চোখে দেখা যায় ,সেই সত্যকে হাতে ধরা যায় ,তাকে নানা সাজে সাজানো যায়। "
আমি এলবার্টকে আটকাইনি। বলেছিলাম দরকার পড়লে ডাকতে। আলবার্ট ও কথা দিয়েছিলো আমি ডাকলে সে আসবেই।
আমি লুকিয়ে নজর রাখি। গত মাস অব্দি ২৯৯টা জ্ঞান কক্ষ চলছে। আলবার্টের এক মেয়ে ঝাড়খণ্ড বিধান সভার অনুবাদক ,তিনটি আদিবাসী ভাষার বক্তৃতা হিন্দিতে অনুবাদ করে ;অন্যজন এক ছোট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।
এপিজে আব্দুল কালাম :
জন্ম তামিল নাদুর এক প্রত্যন্ত গ্রামে , সমুদ্রে মাছ ধরার জেলে পরিবারে। ধর্মে মুসলমান ,কিন্তু উপনিষদে মহাজ্ঞানী আর সমান ভাবে গভীর জ্ঞান খ্রীষ্টান ,বৌদ্ধ্, জৈন ,পারসিক ধর্মের। নিজ গুনে দেশের শীর্ষে স্থান।
আমার সঙ্গে প্রথম দেখা প্রধান মন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা সমিতিতে। নতুন কমিটি ,চেয়ারম্যান নামকরা বৈজ্ঞনিক সি এন রাও- প্রথম অভিভাষণে বললেন প্রত্যেকে দেশের বিজ্ঞান নিয়ে নিজের ভাব জানাতে। আমার ভাব সহজ :"ভারত বৈজ্ঞানিক দেশ হবে"। সবাইকার বিচারে এই ভাবনা সবচেয়ে উপযুক্ত। একটা কাগজের টুকরোতে কালাম সাহেব পাঠালেন তার অভিনন্দন ,"খুব ভালো লাগলো ".
এই শুরু থেকে অনেক কাজে কাছ থেকে পেয়েছি। প্ল্যানিং কমিশন এ অনেক Steering Committee ; কালাম সাহেব প্রায় সাবেতে আমাকে রেখেছেন।স্নেহ করে পরিচয় করিয়ে দিতেন ," Conscious Keeper of the Committee " বলে।
দিল্লীতে গেলে আমার একটা কাজ ছিল সন্ধ্যেটা ওঁর অফিসে যাওয়া। আমাকে গাড়ীতে করে নিয়ে যাওয়া হতো। কালাম সাহেব মিতাহারী রাত্রের খাবার দুটো ইডলি ,আমারও তাই ;প্রথম বারের পরেই জানালাম আমার ছাড়তে ইডলি চাই। Nuclear আর Rocket ছাড়া ত্রিভুবনের সব বিষয় নিয়ে কথা হতো। দেশের কথা মানুষের কথা ,ধর্মের কথা ,নতুন আবিষ্কার কোনো কিছুই বাদ ছিলনা। আমরা দুজনেই কেমন যেন কৈশোরের ছাত্রাবস্থায় ফিরে যেতাম ,সব কিছুতে নতুন রঙ।
একদিন কালাম সাহেব জানতে চাইলেন retire করে তাঁর কি কাজ হবে। একা মানুষ ,কিভাবে দিন কাটবে ? আমার উত্তর ছিল ,'জানিনা ,তবে অফিস আর ল্যাবের বাইরে বেড়োলে অনেক পথ দেখা যায়। " খুব হেসেছিলেন আমার কথায়। বেশ জোর দিয়ে জানালেন তাঁর ছোটবেলার লড়াই ,মাটি থেকে ওঠার ইতিহাস। শুনলাম সব ,তবু বললাম আমার মত। "আপনি এখন আর মাটিতে নন। আপনি জানেন না মাটির আজকের চেহারা আর গন্ধ ,যা আপনার ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে পারে না। "
পরের বার যখন দেখা হলো জানতে চাইলেন মাটির সঙ্গে ওঁর পরিচয় করিয়ে দেবার কোনো প্ল্যান আমি করতে পারি কিনা। আমার কোনো দ্বিধা ছিলোনা। "আমি আপনাকে তিনটে জায়গা দেখতে চাই : একটা শহরে ,একটা বর্ধিষ্ণু গ্রামে ,আর একটা জঙ্গলের মধ্যে ".মুখখানা দেখে বুঝলাম আমার prompt উত্তরে অনেক কষ্টে হাসি চাপছেন।
পরদিন planning meeting এ দেখা।
বাসুজি কোঁথায় নিয়ে যাবে গত রাতে প্ল্যান করেছো ?
প্রথমে রাঁচিতে আমার কাছে। তারপর তিলোনিয়া ,Bunker Roy ;আর তারপর B R Hills ,ডাক্তার সুদর্শনের কাছে।
একটা কাগজে লিখে দিতে বললেন।
দিন পনেরো বাদে একটা চিঠি এলো : Travel Schedule : দিন তারিখ সময় দেওয়া।
প্রথম আমি। থাকতে হবে High Security দিয়ে। আমি জানালাম আমাদের ইনস্টিটিউশনের থেকে বেশী সিকিউরিটি কোত্থাও নেই। আমার ১০০ জন গ্রাম থেকে আসা trainee ঘিরে থাকবে। প্রথমে কেউ রাজি নয় ;আমিও একগুঁয়ে। শেষে মানলো ;পরে শুনেছি ডঃ কালাম নিজে আমাকে support করেছিলেন।
ওই তিন দিন ভোলবার নয়। সকল ছটা : ওঠো ন্যাড়া পাহাড়ে -দেখো পাথরে গাছ করা যায়। তারপর পুকুরে ,দেশের সব খানে মাছের ডিম্ করা যায় ,তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং Civil .Electrical ,Mechanical সব গ্রামের ছেলেরা শিখছে। বিকেলে ছাত্র -ছাত্রিদের সঙ্গে আলোচনা। রাঁচির স্কুলের ক্লাস নাইন টেনের ফার্স্ট আর সেকেন্ড যারা তাদের। সে কী তর্ক ; কেন আমরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার হবোনা ,কেন আমরা আবিষ্কার করতে পারিনা ,আরও কত কী।
পরের দিন কাছের একটা গ্রামে। মাটিতে বসা ডঃ কালাম। ঘিরে আদিবাসী মহিলারা। আমি নেই ধারে কাছে। একদল সাদরিতে কথা বলছে আর একজন হাতপা নেড়ে ইংরিজি ,ভাঙ্গা হিন্দি ,কখনো তামিল। কি হলো জানিনা। ঘন্টা দুই বাদে আমাকে তলব। তারপর বকুনি।
তুমি মেয়েদের বিজ্ঞান শেখাও না। এদের এত Thyroid এর সমস্যা ,মাসের সময়ে নোংরা থাকায় এত Cervical যন্ত্রনা। কিচ্ছু দেখোনি ? আমি ফিরে গিয়ে মেডিকেল টীম পাঠাবো ,Total হেলথ^ Check হবে। তারপর ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিন জায়গা দেখার পর রাত্রে ইডলি খেতে খেতে ডঃ কালামের আপন মনে কথা ,এত কাজ !
আমি সাহস করে বললাম ,আপনাকে একটাই কাজ করতে হবে; ; আমাদের তরুণেরা অস্থির হচ্ছে , ওরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাচ্ছে। আপনিই পারেন ওপরে যাবার সাহস ফিরিয়ে আনতে। আপনিই তো রাঁচিতে স্কুলের বাচ্ছাদের বলেছিলেন ,আমরা যে কোনো সময়ে আবার নিউক্লিয়ার টেস্ট করতে পারি। কিন্তু দেশের আসল শক্তি তো তোমাদের হাতে। তোমরা মনে আর শরীরে শক্ত হলেই দেশ উঠবে, এটম বোমার দরকার পারবেনা না.। আপনি কি জানেন আপনার এইটুকু কথা সব স্কুলের মুখে মুখে ছড়াচ্ছে। Retire করে সব শক্তি দিয়ে তরুণদের প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দিন। গ্রামের মানুষের অনেক শক্তি ;তাদের ছেলে মেয়ে ভালো হলে ওদের হাসি মুখে থাকবে। গ্রামের মানুষ এখনও আশাবাদী। ওদের দারিদ্র্য নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না,ওদের কাজ আর জীবন একসাথে চলে। বাইরের চোখে দেখা দারিদ্র্য গ্রামের মানুষের ভেতরের নয়। আপনাকে দেশকে বিজ্ঞানের রাস্তায় চলা শিখাতে হবে ,বহু যুগের অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্তি আনতেই হবে।
পরের ইতিহাস সবাইকার জানা। রাঁচিতে যখন রাজ্যের অতিথি হয়ে আসলেন, সেদিন হাজার ছয়েক স্কুলের ছাত্র ছাত্রী এয়ারপোর্ট এ এসেছিলো একটু কথা শোনবার জন্যে। আর ডঃ কালাম তাঁর বই Ignited Minds যে রাঁচির কথা লিখে গেছেন। তাঁর শেষে জানিয়েছেন যে তাঁর রাঁচিতে আসা এক দৈব শক্তির প্রকাশ ( It was ordained ).
জীবনে আমাকে এত সম্মান কেউ দেয় নি।